দক্ষিণ এশিয়ার পানি ব্যবস্থাপনা, পানি-কূটনীতি ও আসন্ন পানিযুদ্ধ
লিখেছেন লিখেছেন সামি২৩ ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:১২:৪৩ দুপুর
(ডিসক্লেমারঃ এই লেখা সাংবাদিক,লেখক, এবং গবেষক আলতাফ পারভেজ ফেইসবুক নোট থেকে লেখকের অনুমতিক্রমে ব্লগে পোষ্ট দেওয়া হল। )
পাকিস্তান ও ভারতের যুদ্ধ-উম্মাদনা সর্বশেষ পানির দিকে ধাবিত হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার অবধারিত এক নিয়তি এবং বাংলাদেশও এই যুদ্ধ পরিসরের বাইরে নয়। দক্ষিণ এশিয়ার আসন্ন এই পানিযুদ্ধের পটভূমিটি বোঝার লক্ষ্যেই এই পর্যালোচনা।
'দক্ষিণ এশিয়া' বলতে বর্তমান আলোচনায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তানকে নিয়ে গঠিত এলাকাকে বোঝানো হচ্ছে। বিশ্বের জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ এ অঞ্চলে বাস করে। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার অনেকগুলো দক্ষিণ এশিয়াতেই অবস্থিত।
কেবল ঘনবসতি হিসেবেই নয়, বিশ্বে দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ পরিচিতি তার দারিদ্র্যের কারণেও। বিশ্বের দরিদ্র জনগণের একচতুর্থাংশেরও বাস এ অঞ্চলেই। জাতিসংঘের হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার ৫৫ শতাংশ বাসিন্দাই দরিদ্র। আলোচ্য আটটি দেশের মধ্যে জিডিপিতে সবচেয়ে এগিয়ে শ্রীলঙ্কা, সবচেয়ে পিছিয়ে আফগানিস্তান। পুরো অঞ্চলের মধ্যে অনেক সাংস্কৃতিক ঐক্য থাকলেও দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য বিশ্বের অন্য যেকোন অঞ্চলের চেয়ে কম-- দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এটা ২০ শতাংশ।দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য কম হওয়ার প্রধান রাজনৈতিক কারণ-- দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস খুবই দুর্বল। স্বাভাবিকভাবেই এর ছাপ পড়েছে পানির মতো জরুরি প্রসঙ্গেও। পানিও ক্রমে এখানে বিবাদের এক বিষয় হয়ে উঠছে। কারণ তার চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ দেশের পানিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদী মানসিকতাও রূঢ় রূপ নিচ্ছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক অঞ্চলে পানিতে ধীরে ধীরে মানুষের অভিগম্যতা কমে আসছে। মোদি জি’র সর্বশেষ হুমকি ( 'rakt aur paani ek saath nahin beh sakta')-এর পর পানিযুদ্ধ নিশ্চিতভাবেই আরো তীব্র হবে।
জীবনের জন্য পানি জরুরি। দক্ষিণ এশিয়ায় এটা বিশেষভাবে জরুরি। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠেরই পেশা কৃষি কাজ, মাছ ধরা ইত্যাদি। পানির সঙ্গে এখানে তাই জড়িয়ে আছে দেশগুলোর অস্তিত্বের প্রশ্ন। যে কারণে ইতোমধ্যে যে পানি এখানে ‘নিরাপত্তা ইস্যু’ হয়ে উঠছে তাও বিস্ময়কর নয়।বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া হলো বিশ্বের সেসব অঞ্চলের একটি যেখানে পানির দুষ্প্রাপ্যতা ঘটছে দ্রুতলয়ে। অথচ নিকট অতীতেও এ অঞ্চলে পানির প্রাচুর্য ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় পানির প্রধান উৎস তিনটি:
ক. হিমালয় ও সংলগ্ন এলাকা থেকে বয়ে আসা নদীর পানি; বরফ গলা পানি। প্রায় ২০টি আন্তর্জাতিক নদী বয়ে চলেছে দক্ষিণ এশিয়া দিয়ে।
খ. বৃষ্টিপাতের পানি।
গ. ভূ-গর্ভস্থ পানি।
উপরোক্ত তিনটি উৎস নিয়েই কমবেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। যেমন দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলোতে এমুহূর্তে পানি প্রাপ্তির পরিমাণ কমবেশি ৩ হাজার মিলিয়ন একর ফুট। এর বিরাট অংশই প্রবাহিত ভারতের উপর দিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তার আয়তনই সবচেয়ে বড় ৩১ লাখ ৬৬ হাজার ৪১৪ বর্গ কিলোমিটার। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে নদীর এই প্রবাহ কমে যেতে পারে। সেই বিপদের ছাপও সিংহ ভাগই পড়বে ভারতেই।পানির দ্বিতীয় উৎস হিসেবে বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়াকে সৌভাগ্যবানই বলতে হবে। বছর জুড়ে এ অঞ্চলে গড়ে ১১৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় বাংলাদেশে। কিন্তু বৃষ্টিপাতের এই পানি ধরে রাখার পর্যাপ্ত কোনো অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। যদিও দক্ষিণ এশিয়াতে বিভিন্ন দেশে পানি সংরক্ষণাগার তৈরির হিড়িক পড়েছে-- কিন্তু এ অঞ্চলে মাথাপিছু পানি সংরক্ষণ সামর্থ্য এখনো খুব কম। গড়ে ১৭৬ কিউবিক মিটার। ফলে নির্ভরতা থেকে যাচ্ছে নদীর পানির প্রাকৃতিক প্রবাহের ওপর। কিন্তু সেখানে পানি প্রাপ্তি কমে যাওয়ায় শেষ বিচারে চাহিদার জোগান দিতে হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। কৃষিতে 'সবুজ বিপ্লব’ এই চাহিদা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অত্যধিক জনসংখ্যার খাবারের জোগান দিতে কয়েক দশক আগেই দক্ষিণ এশিয়া সবুজ বিপ্লবের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। পানির সরবরাহ কমে তা এখন বিরাট ফাঁদে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় পানির গুণগত মানও কমছে। রাসায়নিক ও কীটনাশক মিশ্রিত গাহস্থ্য ময়লা, শিল্পবর্জ্য নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পানিকে কলুষিত করছে। নদীগুলোর মধ্যে গঙ্গাতেই দূষণ সবচেয়ে বেশি। কেবল ভারতেই ১১টি প্রদেশ জুড়ে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ ময়লা-আবর্জনা ফেলছে এই নদীতে। বিভিন্ন ধর্মীয় উপলক্ষে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রায় সাত কোটি মানুষ গোসল করতে আসে এই নদীর বিভিন্ন ঐতিহাসিক বাঁকে-- যাদের খাবারের এবং শরীরের উচ্ছিষ্ট তাৎক্ষণিকভাবে নদীতে পড়ে। বিশ্বের দূষিত নদীর তালিকায় গঙ্গার স্থান এখন ষষ্ঠ। গঙ্গার এই অবস্থার এক বড় শিকার ভাটির বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ কখনো এ প্রসঙ্গটি ভারতের কাছে উত্থাপন করেছে বলে জানা যায় না। গঙ্গার প্রবাহে নির্গত দূষিত বর্জ্যরে ১২ শতাংশই শিল্প বর্জ্য। এর দু’ধারে টেক্সটাইল, সিমেন্ট, কাগজ, স্টীল, গ্লাস ইত্যাদি শিল্পের ক্রম আধিক্য নদীটির দূষণ বাড়িয়ে চলেছে। আসন্ন দিনগুলো গঙ্গার দূষিত পানি অববাহিকাজুড়ে অনেক চেনা ও অচেনা রোগের যে প্রাদুর্ভাব ঘটাবে তা প্রায় নিশ্চিত। পাশাপাশি, হরিদ্দার ড্যাম কিংবা ফারাক্কা ব্যারাজের মতো মানবসৃষ্ট কাঠামো গঙ্গার প্রবাহের কী ক্ষতি করেছে তা দক্ষিণ এশিয়ায় বহুল আলোচিত। তবে আরও বড় উদ্বেগের বিষয়-- গঙ্গা ও এর শাখা নদীগুলোতে এখনো শত শত ড্যাম তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে সক্রিয় আছে ভারতীয় আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদরা। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির জয় তাতে বিশেষ গতি দিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় পানির চাহিদা যেভাবে বাড়ছে
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় লোকসংখ্যা রয়েছে প্রায় ১৭০ কোটি। এ শতাব্দিতে বিশ্বে জনসংখ্যা যা বাড়বে তার ৩০ শতাংশই জন্ম নেবে দক্ষিণ এশিয়ায়। ২০৫০ সাল নাগাদ এ অঞ্চলে লোকসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২৩০ কোটি। আর জনসংখ্যার আধিক্য মানেই পানির বাড়তি চাহিদা। অপরদিকে পানির সংকট মানেই সংঘাত ও উত্তেজনা। আসন্ন দিনগুলোতে তাই দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাত ও উত্তেজনার অন্যতম ইস্যু হবে পানি।দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ জায়গা মালদ্বীপ ও বাংলাদেশ। এই দুই দেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে এক হাজারের বেশি মানুষ বাস করে (বাংলাদেশে ১০৯৯ এবং মালদ্বীপে ১৩৩০)। অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় জনগোষ্ঠীও এই দুই দেশে সর্বোচ্চ-- যথাক্রমে ৪৯ ও ৪৮ শতাংশ। ফলে তাদের পানির চাহিদাও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু জনপ্রতি বাৎসরিক পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য অনেকের চেয়ে পিছিয়ে।বিশ্বে জনপ্রতি গড়ে পানিসম্পদ আছে ৬ হাজার ২৩৬ কিউবিক মিটার। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় জনপ্রতি পানিসম্পদ ১ হাজার ১৯৯ কিউবিক মিটার। স্বাভাবিকভাবেই জনসংখ্যা যত বাড়বে মাথাপিছু পানি প্রাপ্তির সম্ভাবনা তত কমবে এখানে। বর্তমানে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় এক পঞ্চমাংশের বাস দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশে। কিন্তু বিশ্ব মানচিত্রের মাত্র ৩.৩ অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে পানির উৎসের খোঁজে নতুন বসতি নির্মাণের সুযোগও দক্ষিণ এশিয়াবাসীর সীমিত।বাড়তি জনসংখ্যার সাথে পানি প্রাপ্তি কমে যাওয়ার সম্ভাবনাটা একটা দুষ্টচক্রের মতো। কারণ বাড়তি জনসংখ্যা মানেই বাড়তি খাদ্যশস্য উৎপাদনের চাপ-- আর তার জন্য প্রয়োজন বাড়তি পানি। জনসংখ্যা বাড়লে খানা পর্যায়েও বেশি পানি প্রয়োজন। বাড়তি মানুষদের ভোগ চাহিদা মেটাতে যে বাড়তি শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে সেখানেও দরকার হবে বাড়তি পানি। আবার এই মানুষদের জন্য সভ্যতার চাকা ঘোরাতেও প্রয়োজন বাড়তি বিদ্যুত। সে জন্যও চাপ পড়বে পানিসম্পদে।
পানি নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সংকটের প্রধান এক ক্ষেত্র হলো এর কৃষি নির্ভরতা এবং পানিনির্ভর কৃষি। এখানে আবাদে ধান অগ্রাধিকার পায়। দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবহৃত পানির ৯১ শতাংশ ভোক্তা কৃষি খাত। ফলে পানি এখানে সরাসরি খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এমনকি অনেক এলাকায় পানি থাকা না থাকার ওপর সেখানকার দারিদ্র্য পরিস্থিতির ওঠানামা নির্ভর করে। চাষযোগ্য জমির ৪৬ ভাগ এখানে সেচের আওতাভুক্ত। পাকিস্তানে এটা প্রায় ৯৪ শতাংশ। দেশটি প্রধানত একটি নদীর অববাহিকাভিত্তিক। আর বাংলাদেশে সেচের আওতাভুক্ত জমির ৮৬ শতাংশেই ধান আবাদ হয়। কিন্তু কৃষিতে পানির উৎপাদনশীলতা বিশ্বের অন্য যে কোন অঞ্চলের চেয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক কম। সেচপ্রযুক্তির নিম্নমান পানির অপচয় ও কম উৎপাদনশীলতার বড় এক কারণ। শিল্পে পানি ব্যবহার দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো অনেক কমÑ পুরো ভোগের মাত্র ২ শতাংশ। তবে দ্রুত এটা বাড়ছে। এক্ষেত্রে ভারতের ক্ষুধাই অত্যধিক। দক্ষিণ এশিয়ায় শিল্পে পানি চাহিদার ৮৫ শতাংশ জোগাতে হচ্ছে ভারতের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য।দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক দেশে পানির তৃতীয় প্রধান ভোক্তা বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। এ অঞ্চলে জ্বালানি ব্যবহারের হার বছরে ছয় শতাংশ হারে বাড়ছে-- যদিও চাহিদা বেশি। পানি বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো হলো বিদ্যুতের সবচেয়ে সস্তা উৎস। ফলে সে-দিকে ঝুঁকছে অনেক দেশ এবং পানির প্রবাহ হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত, বিশেষত ভাটির অববাহিকা তাতে বিপদগ্রস্ত।
আবহাওয়ার পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ায় পানির বিবাদ বাড়িয়ে তুলতে পারে
দক্ষিণ এশিয়ার পানি বিষয়ক ভাবনায় আবহাওয়ার পরিবর্তন বিরাট এক কালোমেঘ হয়ে আছে। এ অঞ্চলের পানির দুই প্রধান উৎস-- তথা নদীর প্রবাহ এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাত আবহাওয়ার পরিবর্তন দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে ও হবে। প্রধান তিন নদী-- সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ অংশত হিমালয়ের বরফ গলা পানি। মুশকিল হলো আবহাওয়াগত পরিবর্তনের কারণে পানির প্রবাহ বাড়লেও বিপদ, কমলেও বিপদ। কারণ অতিরিক্ত পানি বা স্বল্প পানি দুটোই কৃষিকে প্রভাবিত করবে-- যা দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের প্রধান আশ্রয়। আবহাওয়ার পরিবর্তন খরা, বন্যা ও লবনাক্ততা রূপে স্বাস্থ্যখাতে বিপর্যয় ঘটাতে পারে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ে তা হলে উপকূলীয় মানুষদের অনেককে বর্তমান বসতি ছাড়তে হতে পারে। এরূপ মানুষের শতকরা হার মালদ্বীপের পরই বাংলাদেশে বেশি। মালদ্বীপে পুরো জনগোষ্ঠীই এক্ষেত্রে ঝুঁকিতে আছে। বাংলাদেশে এ হার প্রায় ৪৬ ভাগ। যদিও শিল্পায়ন সীমিত হওয়ার কারণে গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন দক্ষিণ এশিয়ায় সামান্যই। কিন্তু নগরায়ন ও জ্বালানি এবং পরিবহন ইত্যাদির চাহিদা যেভাবে বাড়ছে তাতে গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন দ্রুতলয়ে বাড়বে এ অঞ্চলে। ১৯৯০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত যে বৃদ্ধির হার দেখা গেছে বছরে ৩.৪ শতাংশ।দক্ষিণ এশিয়ায় পানি ব্যবস্থাপনা উন্নত করা জরুরি
দক্ষিণ এশিয়ায় পানির মূল্য এর পানির অপচয় ও কম উৎপাদনশীলতাকে কিছুটা হলেও উৎসাহিত করে। কোনো কোনো দেশে সেচের পানি সস্তা রাখার একটা ফল হয়েছে এই, সেচ প্রকল্পগুলো লাভজনক হয়নি। সেগুলোর পুনর্নিমাণ, সংস্কার কম। সংস্কার ও আধুনিকায়ন হয়নি বলে চাষাবাদ পর্যায়ে পানির অপচয়ও বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় পানি সংকটের ক্ষুদ্র হলেও অন্তত একটি কারণ পানির অদক্ষ, অপচয়মূলক ব্যবহার।বিশ্বের এই অঞ্চলের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো পানিকে সচরাচর খোদার দান হিসেবেই দেখা হয়। ফলে পানিকে কম দামেই পেতে অভ্যস্ত সবাই। আবার ভূমির ব্যক্তিগত মালিকানাকে একই সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির মালিকানা হিসেবেও ধরে নেয়া হয়। উপরন্তু এরূপ পানি উত্তোলনে ভর্তুকিও দেয়া হয়! দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবদেশে কৃষির জন্য সেচে কমবেশি বিদ্যুত-ভর্তুকি রয়েছে। কৃষিভিত্তিক সমাজে রাজনীতির এক ব্যয়বহুল রক্ষাকবচ এটা। পাকিস্তানে সেচের ক্ষেত্রে ২০১০ সালে বিদ্যুত সাবসিডি ছিল ১২ বিলিয়ন রুপি। এইরূপ ভর্তুকির ইতিবাচক ফলের পাশাপাশি নেতিবাচক ফল হলো ভূগর্ভে দূষণ, পানির স্তর নেমে যাওয়া ও লবণাক্ততার বিস্তৃতি। এ অঞ্চলের কৃষকদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় এরূপ ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে দেয়া যৌক্তিক হবে কি না সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবে ভুর্তকি কৃষকদের জন্য সুখবর হলেও লবণাক্ততা তাদের জন্য ধেয়ে আসছে অভিশাপ হিসেবে।সম্প্রতি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বরিশাল মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে , ওই বিভাগের ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৩০ হেক্টর কৃষি জমির মধ্যে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮৭০ হেক্টরই অতি লবণাক্ত। এসব জমিতে লবণের পরিমাণ সময় বিশেষে ১৬ থেকে ২৮ দশমিক ৫ ডেসিসিমেন (প্রতি মিটার পানিতে লবণের পরিমাণ)। ধান চাষে লবণের সহনশীলতা মাত্র ৪ দশমিক ১ থেকে ৮ ডেসিসিমেন। সব্জি চাষে মাত্র ২ থেকে ৪ ডেসিসিমেন। এই ইন্সটিটিউটের গবেষকরা দেখেছেন, নদী যেখানে পানি শূন্য সেখানেই এইরূপ লবণাক্ততার প্রকোপ বেশি। কারণ আবাদের জন্য সেখানে ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে হচ্ছে চাষীদের। উল্লেখ্য, অতীতে বরিশাল বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি নদী বিধৌত জেলা হিসেবে চিহ্নিত ছিল।
বিশ্বে অঞ্চলগতভাবে দক্ষিণ এশিয়াতেই ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বেশি এবং তা নিয়ন্ত্রণে কোনো আইন বা কর্তৃপক্ষ নেই-- যদিও এ অঞ্চলের দেশগুলোতে পানি সম্পদকেন্দ্রীক মন্ত্রণালয় রয়েছে। কোনো কোনো দেশে পানি বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়েরও বিস্তর এখতিয়ার রয়েছে। যেমন, বাংলাদেশ। তবে এরূপ দ্বৈততায় পানিকেন্দ্রিক শাসন কাঠামো কোনো সুনির্দিষ্ট রূপ পায়নি।এ অঞ্চলে পানি ব্যবস্থাপনার আরেকটি দুর্বল দিক হলো পানি সংরক্ষণের অবকাঠামো কম থাকা। যেমন পাকিস্তানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বন্যার সময় দেশটিতে ৩৫ মিলিয়ন একর ফুট পানি আরব সাগরে চলে যায়। বাংলাদেশেও বর্ষায় দেখা যায়, দেশটির গড়ে ৪০ ভাগ অঞ্চল বন্যা উপদ্রুত। অথচ অন্য মৌসুমে একই এলাকায় থাকে পানির তীব্র সংকট।পানি সংরক্ষণ উদ্যোগগুলোর সঙ্গে বিদ্যুত উৎপাদনের ধারণাকেও যুক্ত করা যায়। ভূটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবদেশে বিদ্যুত ঘাটতি রয়েছে। ভূটান হাইড্রোইলেকট্রিসিটিকে তার আয়ের প্রধান এক খাত বানিয়ে নিয়েছে। তবে পানি সংরক্ষণাগার বা ড্যামধর্মী অবকাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এক বিবেচনা থাকা উচিত পরিবেশ প্রশ্ন। উপরন্তু, এসব প্রকল্পে অনেক ক্ষেত্রেই প্রচুর মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। ফলে তাদের যথাযথ পুনর্বাসনের প্রশ্ন এসে পড়ে এবং এভাবে পানি প্রশ্নের সাথে জড়িয়ে পড়ে রাজনীতিও।উগ্র জাতীয়তাবাদ ও দুষ্প্রাপ্যতা পানিবিবাদ অবধারিত করে তুলছেদক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পানি সংকটের কিছু একক বৈশিষ্ট্য থাকলেও বিভিন্ন দেশের আবার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ তার পানিপ্রবাহের ৯০ শতাংশের জন্যই চীন-ভারতের ওপর নির্ভরশীল। উদ্বেগের দিক হলো, কৃষি-শিল্প ইত্যাদিকে ঘিরে ভারত ও চীনে পানির ক্ষুধা বৃদ্ধি মানেই বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তির সম্ভাবনা কমে যাওয়া। ভারতে ১৯৫০ সালেও জনপ্রতি পানির প্রাপ্যতা ছিল ৫ হাজার কিউবিক মিটার। ২০০৫ সালে যা এসে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮০০ কিউবিক মিটারে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ নাগাদ এটা এক হাজার কিউবিক মিটারে নেমে আসবে। খবর হিসেবে এটা কেবল ভারত নয়-- বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগের। কারণ ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহে বাংলাদেশ ভাটির দেশ হওয়ায় দরকষাকষির সুযোগ তার অল্প। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশীদের মাঝে এটা এক বোবা ক্ষোভের জন্ম দিয়ে যাবে। ২০১৪ সালের এপ্রিলে দেশটির রংপুর বিভাগে তিস্তার পানি প্রত্যাশী মানুষের আন্দোলনে জন-অংশগ্রহণের ব্যাপকতা সেটাই জানিয়ে দিল আবারও।
ভারতের নদী প্রবাহের প্রধান তিনটি ধারার (সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপত্র) দু’টিতেই বাংলাদেশের সরাসরি স্বার্থ জড়িত রয়েছে। দু’দেশের মধ্যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। তার মধ্যে, বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের পানির প্রাপ্যতার ৮৫ শতাংশ নির্ভরতাই গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রকে ঘিরে। অন্যদিকে ভারতে বিশ্ব জনসংখ্যার ছয় ভাগের এক ভাগের বাস হলেও-- বিশ্ব পানি সম্পদে তার হিস্যা ২৫ ভাগের এক ভাগ। ক্রমে এই ব্যবধান বাড়ছে, আর দেশটি তার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী প্রবাহের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করাকে কর্তব্য জ্ঞান করছে।ভারতের এরূপ মনোভাব কেবল বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের সঙ্গেও তার বৈরিতা বাড়াচ্ছে। সিন্ধু, ঝিলাম, চেনাভ, রাভি, বিয়াস, সুৎলজ ইত্যাদি অন্তত ছয়টি নদীতে এই দুদেশের যৌথ হিস্যা রয়েছে। ১৯৬০ সালের সিন্ধু নদীচুক্তি দেশ দুটির মধ্যে উপরোক্ত নদীগুলোর পানি বৈরিতা নিরসনের একটি দিকনির্দেশনা হিসেবে নির্ধারিত হলেও তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সমঝোতায় আসতে পারছে তারা কমই। চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাভে পানি ব্যবহারে অগ্রাধিকার পায়Ñ ভারত পায় অপর তিনটিতে। তবে পরস্পরের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের বিস্তর অভিযোগ উঠছে হরহামেশা। অনেকক্ষেত্রে এরূপ বিবাদ ১৯৪৭-এর ভারত ভাগেরও অংশীদার। রাজনীতি স্থলভাগ ও মানুষকে ভাগ করে দিলেও পানিপ্রবাহকে ভাগ করে দিতে পারেনি। বিশেষত র্যাডক্লিফ লাইন পাঞ্জাব বিভক্ত করা মাত্রই সিন্ধু অববাহিকার নদীমালায় দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত শুরু হয়। অনুরূপ বিবাদ রয়েছে নেপাল-ভারত পানি সম্পর্কের ক্ষেত্রেও।তবে সমঝোতার দৃষ্টান্তও এক্ষেত্রে পুরানো। ১৯২০-এ সারদা ব্যারাজ চুক্তির মধ্য দিয়ে নেপাল-ভারত পানি-সমঝোতার শুরু। এরপর ১৯৫০-এ কোশি চুক্তি, ১৯৫৯ সালে গন্ধক চুক্তি, ১৯৯৬ সালে হয়েছে মহাকালী চুক্তি। এসব চুক্তি হওয়ার পরও পানি বিষয়ে এই দুই দেশের জনসমাজে পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস কম। বিশেষত নেপালের নাগরিক সমাজ মনে করে চুক্তিগুলোতে (অন্তত মহাকালী চুক্তিতে) তাদের দেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। এইরূপ মনোভাবের যথেষ্ট সত্যতাও বিদ্যমান। এ জন্য ১৯৮৩ সালে ভারত যখন নেপাল সীমান্তে এককভাবে তানকপুর ব্যারাজ তৈরি শুরু করে তখন নেপাল জুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। অন্যদিকে পানি থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের বিস্তর সুযোগ থাকার পরও নেপাল এখনো ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানি করে। পানি-কূটনীতির ক্ষেত্রে নেপালের নীতিনির্ধারকদের প্রতি জন-আস্থাহীনতার এটাও একটা কারণ।
ভারতের সঙ্গে পানি বিষয়ে দরকষাকষিতে নেপাল ও বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যটি প্রায় একই রকম-- উভয় দেশে জাতীয় বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক ঐক্য না থাকায় বৃহৎ প্রতিবেশির সঙ্গে তারা ন্যায্যহিস্যা নিয়ে শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারে না। উভয় দেশেই বড় কয়েকটি রাজনৈতিক দল ভারতের কাছে তাদের পানির ন্যায্য হিস্যা চাইতে কুণ্ঠিত।বিবাদ রয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মাঝেও। নদীর প্রবাহ নিয়ে আফগানিস্তানের কূটনৈতিক অবস্থান বোধ হয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিচিত্র। এর পঞ্চ নদীতে অংশীদার রয়েছে তাজাকিস্তান, সিন্ধুর শাখা নদী ‘কাবুল’-এর অংশীদার হিসেবে আছে ভারত ও পাকিস্তান; হেলমান্দ-এর পানি ভাগ হয় ইরানের সঙ্গে; আবার হারি-রুদ নদীর অংশীদার তুর্কেমিনেস্তান ও ইরান।কেবল দেশে-দেশে বিবাদই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের প্রদেশে প্রদেশেও পানি নিয়ে বিবাদ চলছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সিন্ধু ও খাইবার পাখতুনোয়ার বিরোধিতার কারণে ১৯৫৩ সালে শুরু করেও কলাবাগ ড্যাম নির্মাণ সম্পন্ন করতে পারেনি দেশটি। অথচ সেচ ও বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য প্রকল্পটি দরকার ছিল পাকিস্তানের। ভৌগলিকভাবে উঁচু-নিচু ও উজান-ভাটির সমস্যা থেকে এসব বিবাদের উৎপত্তি। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অববাহিকার সবার স্বার্থকে সুবিবেচনা না করাই এসব বিবাদকে উত্তেজক রূপ দিচ্ছে।গত শতাব্দির শেষ ৫০ বছরে দেখা গেছে, বিশ্বের আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি নিয়ে অন্তত ১৫৭টি চুক্তি হয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার হিস্যা একেবারেই কম। আশা করা যায়, জাতিসংঘের পানি সনদটি প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রগুলোর অনুসমর্থন পাওয়ার মধ্যদিয়ে কার্যকর হয়ে যাওয়ায় দক্ষিণ এশিয়াতে পানি বিবাদ মিমাংসায় তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে তার জন্য প্রয়োজন এ অঞ্চলের রাজনীতিবিদদের উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান পাল্টানো-- আপাতত যার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিশেষত ভারতে আরএসএস ও বিজেপি’র উত্থান এবং পাকিস্তান ও ভারতের মাঝে সর্বশেষ যুদ্ধ-উম্মাদনার পর।
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১১৫৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন