আমরা কি খেতে যাচ্ছি?

লিখেছেন লিখেছেন মোতাহারুল ইসলাম ০৬ আগস্ট, ২০১৩, ০৫:৫৩:০৭ বিকাল

দুই দশকেরও বেশী আগে, যখন স্কুলে পড়তাম, তখন আমরা বিজ্ঞান আশির্বাদ না অভিশাপ এই নিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগীতায় অবতীর্ণ হতাম। প্রতিযোগীতায় জয় লাভের স্বার্থে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি যাই থাকুক না কেন, কেউ আমাদের দৈনন্দিন জীবন এবং আধুনিক সভ্যতায় বিজ্ঞানের অবদান কে অস্বীকার করতে পারবেনা। অবশ্য এর যে নেতিবাচক দিক যে নেই তা কিন্তু নয়। এই যেমন বিজ্ঞানের কল্যানে আমরা ফরমালিন যুক্ত খাবার খাচ্ছি, নানা রকম ভেজাল পণ্য ব্যাবহার করছি, প্রযুক্তির উৎকর্ষে মটর গাড়ীর জন্ম হয়েছে বিধায় আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকি, বিজ্ঞান এর অবদান বিদ্যুৎ এর জন্যই আমাদের লোডশেডিং এর জ্বালা সহ্য করতে হয়।

এই বিজ্ঞানের জন্যই বিজ্ঞান কল্পকাহিনী রচিত হয়েছে, কিছু মানুষের অর্থ এবং খ্যাতির বন্দোবস্ত হয়েছে। কয়েক বছর আগে এরকমই এক কল্পকাহিনীতে পড়েছিলাম ভবিষ্যতে সকল খাবার তৈরী হবে গবেষনাগারে। না, এখনকার মত কোনও হাইব্রীড শস্য নয়, খাবারের জন্মই হবে মেশিনে বা ক্ষুদ্র রসায়ণাগারে। তখন রান্নাঘর প্রতিস্থাপিত হবে রসায়নাগার দ্বারা। খাবারের স্বাদ, গন্ধ কিন্তু থাকবে রান্না করা খাবারের মতনই। এ প্রযুক্তি তখন বিশেষ ভাবে প্রয়োজন হবে মহাশুন্যে বসবাসকারী জনগোষ্ঠির জন্য, কারন তারাতো তখন ইচ্ছা করলেই গাছে উঠে পেয়ারা খেতে পারবেনা। পৃথিবীতে আসতে পাসপোর্ট, ভিসা, টিকেট, ছুটি নানা ঝক্কি পোহাতে হবে, আর যদি সন্ত্রাস বাদের কারণে কালো তালিকা ভুক্ত হয় তাহলেতো পৃথিবী দেখার আশা ছাড়তে হবে।

বিজ্ঞানের কল্যাণে এ ধরনের খাবার তৈরীর প্রক্রিয়া বোধ হয় এখনি শুরু হয়ে গেছে। চীন দেশে মাঝে মাঝেই জাহাজ নিয়ে যেতে হয়, প্রসঙ্গ ক্রমে বলে রাখি আমি একজন নাবিক। বছর দুয়েক আগে এমনি এক ভয়েজে সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম চীনারা কৃত্রিম ভাবে মুরগীর ডিম তৈরী করা শিখেছে, দেখতে অবিকল ডিমের মত এমনকি ভেতরে হলুদ কুসুম ও রয়েছে। শোনার পর কিছুটা দুশ্চিন্তায় পরলাম, কারন চীনারা খাদ্যে ভেজাল দিতে বাংলাদেশীদের মতই সিদ্ধ হস্ত আর সেখানে জাহাজীদের খাদ্য হিসাবে প্রচুর পরিমান ডিম সহ অন্যান্য খাদ্য কিনতে হয় এবং অবধারিত ভাবে অনেক সময় প্রতারিত হতে হয়। আমাদের তখন ডিম কেনা হয়ে গেছে এবং আমরা তা নিয়মিত খাচ্ছি। ঘটনা ক্রমে তখন একজন সাপ্লায়ারের সাথে সাক্ষাৎ হয়, উনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন, তবে চীনাদের মধ্যে এখনো এ ধরনের ডিম জনপ্রিয় হয়নি আর উনি আশ্বস্ত করেন জাহাজে সাপ্লাই কৃত ডিম কৃত্রিম নয়। আমাদের তার কথা বিশ্বাস করা ছাড়া কোনো উপায় নেই, অবশ্য ডিমের স্বাদে গন্ধে কোনো রূপ ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়নি। জানিনা হয়ত এই কৃত্রিম ডিম একদিন আসল ডিমের জায়গা দখল করে নেবে ।

আজ একটি নতুন খবরের প্রতি দৃষ্টি পড়েছে আর তা হল স্টেম সেল দিয়ে গরুর গোশ্ত তৈরী করা এবং সেই গোশ্ত দিয়ে বার্গার তৈরী করার ঘটনা। খবর টি নিম্নরূপঃ

"গবাদিপশুর স্টেমসেল থেকে তৈরি মাংস দিয়ে বার্গার তৈরি করবেন বিজ্ঞানীরা। সোমবার লন্ডনের একটি রেস্টুরেন্টে

এই বার্গার তৈরি হবে। আর সেটা চেখে দেখবেন দুই স্বেচ্ছাসেবক খাদক। ডাচ বিজ্ঞানী মার্ক পোস্টের গত কয়েক বছরের গবেষণার ফল এই মাংস। পোস্টের আশা, তার উদ্ভাবিত মাংস বিশ্বের খাদ্যচাহিদা মেটানো ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা করবে।

কয়েকটি তথ্য দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার ২০০৬ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, কৃষিকাজে প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তন, বায়ুদূষণ, ডিফরেস্টেশন ও বায়ো-ডাইভারসিটি কমানোর ক্ষেত্রে ‘বড় ভূমিকা’ রাখছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বে যত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়, তার ১৮ শতাংশের জন্য নাকি দায়ী মাংসশিল্প এবং এই মাত্রা আরও বাড়তে পারে; কারণ দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ চীন ও ভারতে মাংস খাওয়ার পরিমাণ বাড়ছে।

জাতিসংঘের ওই সংস্থার মতে, ২০৩০ সালে মাংস উত্পাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৩৭৬ মিলিয়ন টনে। ১৯৯৭-৯৯ সালে যেটা ছিল ২১৮ মিলিয়ন টন। বেশি বেশি মাংস উত্পাদন মানেই হলো বেশি বেশি পরিবেশ দূষণ। সুতরাং যদি কৃত্রিম মাংস উত্পাদন করে মাংসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে তো সেটা ভালোই হবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

ডাচ বিজ্ঞানী পোস্ট আশা করছেন, আগামী ২০ বছরের মধ্যে বাণিজ্যিক উপায়ে কৃত্রিম মাংসের উত্পাদন শুরু করা যাবে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কৃত্রিম মাংস কি আসল মাংসের স্বাদ এনে দিতে পারবে? সূত্র : ডিডব্লিউ"

গত কয়েক বছর ধরে স্টেম সেল রিসার্চ নিয়ে বিতর্ক চলছে। আমেরিকা এই রিসার্চের ওপর অর্থায়ন কমিয়ে দিয়েছে বা বন্ধ করে দিয়েছে। এই গবেষনা মূলত চিকিৎসা শাস্ত্র কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছে এর শাখা বিস্তৃত হচ্ছে অবশ্য প্রশাখার খবর এখনও পাইনি। আর এই শাখাটিই হচ্ছে খাবার তৈরী, আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে বার্গার তৈরী। এর সুফল কুফল এর জন্য এখন ও অপেক্ষা করতে হবে। তবে একটা প্রশ্ন মুসলমানদের তরফ থেকে নিশ্চয় ই উত্থাপিত হবে, আর তাহলো এ ধরণের খাবার কি হালাল? প্রশ্নের উত্তর হয়ত ইসলামিক স্কলার রা ভবিষ্যতে দেবেন। সেটার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

তবে বিজ্ঞানের কল্যাণে বর্তমানের একটি প্রশ্ন "আমরা কি খাচ্ছি?" ছাপিয়ে হয়ত ভবিষ্যতে আরো একটা প্রশ্নের উদ্ভব হবে, আর তা হলো, "আমরা কি খেতে যাচ্ছি?"

বিষয়: বিবিধ

১৪২৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File