স্বপ্ন, স্বপ্নের সত্যতা এবং অর্থবোধক ব্যাখ্যা

লিখেছেন লিখেছেন মোতাহারুল ইসলাম ০৬ আগস্ট, ২০১৩, ১২:০৮:৪৮ রাত



আমি রাত্রির কেউ নই , কিংবা নই তার পুজারী

বরং আমি দিনের শাবক, তাই দিনের সংবাদবাহী

যারা এটা মনে করে, সে তো পরেছে সাধুদের ফাঁদে

আর সেটাতো চন্দ্রমুখী স্বর্গীয় বাগানের প্রতিফলন।

-ইমাম রাব্বানী (মুজাদ্দিদে আলফেসানি)

যখন আপনি আপনার চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকেন, তখন আপনার দৃষ্টি শক্তি, শ্রবন শক্তি এবং বাক শক্তি রহিত হয়ে যায়। আপনার হাত-পা চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে, তখন আপনি কি করে কয়েক মিনিট এমনকি কয়েক সেকেন্ড এর মধ্যে দুরবর্তি অঞ্চলে ভ্রমন করেন, মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং এমন আরও অনেক কিছু করেন? আপনি যখন ঘুম থেকে জাগ্রত হন, তখন সেই নিশি অভিযান আপনাকে গভীর ভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে। আর পৃথিবীতে বোধ করি এমন কোনও মানুষ নেই যে স্বপ্ন দেখেনা। যদিও ফ্রয়েড এবং তাদের অনুসারীদের মতে স্বপ্ন হচ্ছে মানুষের অবচেতন মনের চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা কিংবা অতীত জীবনের কোনও ঘটনার প্রতিবিম্ব, তথাপিও যে স্বপ্ন আপনাকে ভবিষ্যতের কোনও ঘটনার পুর্বাভাষ প্রদান করে যা আপনি কখনও চিন্তাও করেননি কিংবা যে ব্যাপারে আপনার বিন্দু মাত্র জ্ঞান নেই তাকে আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করবেন? আমরা কেমন করে স্বপ্ন দেখি? কেন এবং কেমন করে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখা স্বপ্ন মনে রাখি? এই সব এবং এ রকম ধাঁধাঁর মত জটিল অনেক প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান এখনও আমাদের দিতে পারেনি।

কখনও কখনও, যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি, আমাদের অবচেতন মনের ভাবনা, বাসনা, অনুভুতি এবং অতীত অভিজ্ঞতা অচেতন ভাবেই স্বপ্নে ধরা দেয়। আমরা হয়তো রুগ্ন বা ক্ষুধার্ত থাকি অথবা সমাধান করতে ব্যর্থ এমন কোনও সমস্যার ভেতর মগ্ন থাকি। আমাদের কল্পনা তখন নিজেকে ক্রুদ্ধ মেজাজী হিসাবে উপস্থাপন করে, অথবা মন কিছু কাল পুর্বে ঘটে যাওয়া উত্তেজনাকর কোনও ঘটনাকে সম্পুর্ণ নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে। এ ধরনের মানসিক অবস্থা থেকে যে সকল স্বপ্ন উৎসরিত হয় তা বিক্ষিপ্ত থাকে। এর হয়ত কিছু অর্থ থাকে তবে তা ব্যাখ্যা প্রদানের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়না। উদাহরণ স্বরূপ আমরা যদি ঘুমের আগে কোনও লবনাক্ত জিনিস খাই, তখন স্বপ্ন দেখতে পারি যে কোনও লবনাক্ত জলাশয়ের পাশে শুয়ে আছি। আমরা যদি রাগান্বিত অবস্থায় ঘুমুতে যায়, স্বপ্ন দেখতে পারি যে কারও সাথে মারামারি অথবা বিবাদ করছি।

[ আল্লাহ যাকে এই পর্যায়ের জ্ঞান দান করেছেন, তারা এ ধরনের অনেক স্বপ্নেরও ব্যখ্যা প্রদাণ করতে সক্ষম, যেমন, আল্লামা ইবনে সিরিন- অনুবাদক]

ঘুম এবং স্বপ্নের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সত্য লুক্বায়িত থাকে

ঘুম এবং স্বপ্নের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সত্য লুক্বায়িত থাকে, যথা হযরত ইউসুফ (আলাইহিয়াসসাল্লাম) এর স্বপ্ন যা কিনা পবিত্র কুরানে সুরা ইউসুফ এ বর্ণিত হয়েছে। অনেক আয়াত [যেমন, “ আমরা রাত্রিকে তোমাদের বিশ্রামের জন্য নির্ধারণ করেছি। (সুরা নাবা- ৭৮, আয়াত-৯)] থেকে বোঝা যায় যে, ঘুম এবং স্বপ্নের মধ্যে গুপ্ত সত্য লুক্বায়িত থাকে।

সত্যনিষ্ঠ বিজ্ঞজনেরা পবিত্র কুরানের সাহায্যে স্বপ্নের অর্থ বর্ণনা করা অথবা স্বপ্নের উপর নির্ভর করাকে অনুমোদন করেন না।

সত্যনিষ্ঠ বিজ্ঞজনেরা পবিত্র কুরানের সাহায্যে স্বপ্নের অর্থ বর্ণনা করা অথবা স্বপ্নের উপর নির্ভর করাকে অনুমোদন করেন না। যেহেতু পবিত্র কুরান অবিশ্বাসীদের প্রতি ঘন ঘন কঠোর আঘাত করে, কোনও ব্যাক্তি যদি পবিত্র কুরান থেকে উপদেশ গ্রহণের নিমিত্তে তা অধ্যয়ন করে, তখন অবিশ্বাসীদের প্রতি ভীতি প্রদর্শন মূলক আয়াত গুলো তার নৈরাশ্যের কারন হতে পারে। তেমনিভাবে যেহেতু স্বপ্ন অধিকাংশ সময় বাস্তবের বিপরীত হয়, ভালো এবং প্রতিশ্রুতি মূলক স্বপ্নও মানুষের মাঝে হতাশা বা নৈরাশ্যের জন্ম দিতে পারে। এমন অনেক স্বপ্ন আছে যা আপাতদৃষ্টিতে খারাপ এবং ভীতিকর, কিন্তু বাস্তব জীবনে তা ভালো এবং সুসংবাদ দান কারী । যেহেতু প্রত্যেকে স্বপ্নের সত্য ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম নয়, তাই স্বপ্ন মানুষের মধ্যে অস্বস্তি কিংবা পীড়ার কারণ হতে পারে। আর এ কারনেই সত্য নিষ্ঠ বিজ্ঞজনের কথা বলেছি আমি (লেখক) প্রবন্ধের শুরুতে, ইমাম রাব্বানি (মুজাদ্দিদে আলফেসানি) থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি, “আমি রাত্রির কেউ নই , কিংবা নই তার পুজারী”

সত্য স্বপ্ন নবুয়তের ছিচল্লিশ দিকের একটি দিক

রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহুয়ালাইহিয়াসসাল্লাম এর একটি সহীহ হাদীস অনুসারে সত্য স্বপ্ন নবুয়তের ছিচল্লিশ দিকের একটি দিক [ যেহেতু আল্লাহর রসুল সাল্লালাহুয়ালাইহিয়াসসাল্লাম তার তেইশ বছর নবুয়তের প্রথম ছয় মাসে সত্য স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাই সত্য স্বপ্ন এক ধরনের ওহী ] এর অর্থ সত্য স্বপ্ন কিছু সত্য ধারণ করে এবং তা নবুয়তের দায়িত্ববলীর সাথে কোনও ভাবে সম্পর্কযুক্ত। সংক্ষেপে এটুকুই এখানে উল্লেখ করলাম কারণ এটা একটা দীর্ঘ, গভীর এবং গুরুত্বপুর্ণ বিষয় যা এই নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনার সু্যোগ নেই।

স্বপ্ন তিন প্রকার

স্বপ্ন তিন প্রকার। দুই ধরনের স্বপ্ন হল বিক্ষিপ্ত বা বিশৃঙ্খল স্রেণীর [পবিত্র কুরান অনুসারে] । হয় কল্পনা শক্তি মানুষের অশান্ত মানসিক অবস্থাকে স্বপ্নে রূপান্তরিত করে, নতুবা নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া উত্তেজনাকর কোনও ঘটনা নতুন আঙ্গিকে ভিন্ন রূপে স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। এ সমস্ত স্বপ্ন সাধারণত এলোমেলো হয়। যেমন সুরা ইউসুফ এ বর্ণিত হয়েছে।

বাদশাহ বললঃ আমি স্বপ্নে দেখলাম, সাতটি মোটাতাজা গাভী-এদেরকে সাতটি শীর্ণ গাভী খেয়ে যাচ্ছে এবং সাতটি সবুজ শীষ ও অন্যগুলো শুষ্ক। হে পরিষদবর্গ! তোমরা আমাকে আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা বল, যদি তোমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পারদর্শী হয়ে থাক। [ সুরা ইউসুফঃ আয়াত ৪৩ ]

তারা বললঃ এটা কল্পনাপ্রসূত স্বপ্ন। এরূপ স্বপ্নের ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। [ সুরা ইউসুফঃ আয়াত ৪৪ ]

বললঃ তোমরা সাত বছর উত্তম রূপে চাষাবাদ করবে। অতঃপর যা কাটবে, তার মধ্যে যে সামান্য পরিমাণ তোমরা খাবে তা ছাড়া অবশিষ্ট শস্য শীষ সমেত রেখে দেবে। [ সুরা ইউসুফঃ আয়াত ৪৭ ]

এবং এরপরে আসবে দূর্ভিক্ষের সাত বছর; তোমরা এ দিনের জন্যে যা রেখেছিলে, তা খেয়ে যাবে, কিন্তু অল্প পরিমাণ ব্যতীত, যা তোমরা তুলে রাখবে। [ সুরা ইউসুফঃ আয়াত ৪৮ ]

এর পরেই আসবে একবছর-এতে মানুষের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং এতে তারা রস নিঙড়াবে। [ সুরা ইউসুফঃ আয়াত ৪৯ ]

সত্য স্বপ্ন

এক প্রকার স্বপ্ন আছে যেখানে অবচেতন মনের কোনও ভূমিকা নেই। এ সমস্ত স্বপ্ন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বহন করেঃ হয় সেগুলো হয় আল্লাহর পক্ষ হতে সুসংবাদ বাহী, না হয় সেখানে আমাদের পাপের কারনে কোনও সতর্ক বার্তা থাকে। এ সমস্ত স্বপ্ন যাকে আমার সত্য স্বপ্ন বলি, তা হয় খুব পরিস্কার যা বিস্মৃত হওয়ার মত নয়।

কোনও কোনও সত্য স্বপ্নে ভবিষ্যতের কোনও সংবাদ থাকে। এ ধরনের স্বপ্নের প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া জানতে নিম্নের বর্ণনার দিকে দৃষ্টিপাত করুনঃ

আমরা যদি কোনো একটি লিখনির কথা চিন্তা করি, এর নির্যাস বা সারমর্ম লিখনি টি কাগজে দৃশ্যমান হওয়ার আগেই বিদ্যমাণ থাকে। তেমনি ভাবে কোনো কিছু পৃথিবীতে অস্তিত্ব লাভের পূর্বেই সে বিষয়টি বিশেষ অবস্থায় আল্লাহর জ্ঞানে অস্তিত্বশীল থাকে। ইসলামী দার্শনিক গণ এই বিশেষ অস্তিত্বশীলতা কে বলেন মূলরূপ [Archetype]। যখন আল্লাহ কোনো কিছুকে তাঁর প্রজ্ঞা, ক্ষমতা এবং গুণাবলীর মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রেরণের ইচ্ছা করেন তখন তাকে বাস্তব আকৃতি দেন। মূলরূপ জগত [যেখানে আল্লাহর জ্ঞানের প্রাথমিক অভিব্যাক্তি থাকে] এবং এই বাস্তব জগতের মাঝে আর একটি জগত থাকে তাকে সাংকেতিক বা রূপক জগত বলে। এই জগতে কোনো কিছু তার আদর্শিক অবস্থা বা সাংকেতিক রূপে বিরাজ করে। সেই জগতে সময় এবং পরিমাপের ধারণা এই বাস্তব পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে সম্পুর্ণ ভিন্ন। যে মানুষ টি স্বপ্ন দেখে, তার সাথে স্থান-কাল-পাত্র, সংস্কৃতি, এমনকি ব্যক্তিগত ও জাতীয় গুণাবলী ভেদে এই সঙ্কেতের পরিচয় ঘটে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে।

যখন আমরা ঘুমায় তখন আমাদের আত্মা ঊর্ধ্ব জগতে [রূপক জগতে] ধাবিত হয়, কিন্তু দেহের সাথে এর সম্পর্ক কোনো রূপে ছিন্ন হয়না। দেহের সাথে আত্মার সম্পর্ক কোনও এক রকম অদৃশ্য রজ্জুর সাহায্যে বজায় থাকে। আত্মা তখন এ রূপক জগতে এক ভিন্ন মাত্রার অস্তিত্ব লাভ করে, যেখানে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত সমন্বিত রূপে বিরাজ করে। ফলশ্রুতিতে আত্মা কোনো অতীত ঘটনা অবলোকন করে অথবা কোনও ভবিষ্যত ঘটনার সাথে পরিচিতি লাভ করে। যেহেতু ঐ জগতে সব কিছু রূপক অথবা সাঙ্কেতিক রূপে বিরাজ করে, আত্মা যে সকল সংকেত লাভ করে তার বাস্তব সম্মত ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়।

উদাহরণ স্বরূপ, রূপক জগতের পরিস্কার পানি বাস্তব জগতের জ্ঞান বোঝাতে পারে। আপনি যদি আপনার নিজের কোনো বস্তুকে আবর্জনা হিসেবে দেখেন, তা বাস্তব জগতে হালাল উপায়ে অর্থ উপার্জন হিসাবে ব্যাখ্যা লাভ করতে পারে। আর আবর্জনা যদি অপরের হয়, তা হয়ত হারাম উপায়ে অর্থ উপার্জন নির্দেশ করতে পারে। যেমন সুরা ইউসুফ এ বর্ণিত মোটা গাভী দ্বারা এক বছরের উদবৃত্ত ফসল বোঝায়, যেখানে শীর্ণকায় গাভী দ্বারা দুর্ভিক্ষের বছর বোঝানো হয়েছে। পবিত্র কুরানে, রসুল সাল্লাল্লাহুয়ালাইহিয়াসসাল্লাম এর হাদিসে এবং কখনো জ্ঞানী মানুষের কথার মাঝে এরূপ উপমা, রুপকালঙ্কার এবং ধাঁধাঁর অর্থ পাওয়া যায়, যা স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদাণে সুত্র হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। কিছু সত্য স্বপ্ন এতটাই স্বচ্ছ যে, এর কোনো ব্যাখ্যা দরকার হয়না।

যেহেতু এই দুই জগতে সময়ের পরিমাপ সম্পুর্ন ভিন্ন, এবং যেহেতু মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে,আত্মা তখন দেহের বাঁধনে থাকেনা বিধায় অনেক বেশী কর্মঠ হয়, অনেক বড় সাধকেরা আছেন যারা নিজের আত্মাকে মুক্ত করে, অত্যন্ত অল্প সময়ে অনেক দূরবর্তি অঞ্চলে অত্যন্ত অল্প সময়ে ভ্রমন করতে পারেন, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

কিছু সত্য স্বপ্ন

আব্রাহাম লিঙ্কন এর আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার আগের রাতের স্বপ্নটি বিখ্যাত। তার স্বপ্নে তিনি দেখেন হোয়াইট হাউসের কর্মচারীরা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে এবং একে অপরকে বলাবলি করছে যে, জনাব লিঙ্কন কে হত্যা করা হয়েছে। উত্তেজিত অবস্থায় তার ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং তিনি অস্বস্তিকর একটি দিন কাটালেন। তাকে নিষেধ করা সত্বেও সন্ধ্যায় এক থিয়েটার এ যান এবং সেখানেই আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান।

নরম্যান্ডিতে অবতরণ এর পুর্বে আইজেনহাওয়ার এর স্বপ্ন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের গতি পথ বদলে দেয়। অবতরণের কয়েক দিন আগে তিনি স্বপ্ন দেখেন যে এক বড় ঝড়ের কবলে পরে তার অবতরণ তরী উল্টে যায়। এ স্বপ্নের কারণে তিনি অবতরণের তারিখ পরিবর্তন করেন। ইতিহাস সাক্ষী যে তার স্বপ্ন স্বঠিক ছিল। এনি অস্ত্রভস্কি নামে একজন রাশিয়ান লেখকের মা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পাঁচ বছর আগে জার্মানী ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘটিত অনেক খন্ড যুদ্ধের স্বপ্ন দেখেন। তার এই স্বপ্ন তখন অনেক সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বহু আবিস্কার স্বপ্নে পাওয়া গেছে । এলিয়াস হাউয়ে যখন সেলাই মেশিন দিয়ে সুতো সেলাই এর চেষ্টা করছিলেন, তখন স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি এক উপজাতির হাতে বন্দি এবং তারা চাচ্ছিল তাকে একটি সেলাই মেশিন দিয়ে সুতো সেলাই এর ব্যাবস্থা করে দিতে হবে, সে হঠাৎ দেখেন, যে সৈন্যটির হাতে উনি বন্দী, তার বর্শার ফলার মাথায় একটি ছিদ্র। জাগ্রত হওয়ার পর উনি ছোট একটি ফলা তৈরী করেন যার মাথায় ছিদ্র ছিল। নিলস বোর যখন পরমাণুর গঠন নিয়ে গবেষণা করছিলেন তখন স্বপ্ন দেখেন যে, গ্রহ গুলো সুতো দিয়ে সুর্যের সাথে সংযুক্ত আছে এবং সুর্যের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করছে। জাগ্রত হওয়ার পর তিনি নিশ্চিত হন যে, তিনি স্বপ্নে যা দেখেছেন, পরমাণুর গঠণের সাথে তার সাদৃশ্য আছে।

এছাড়া অনেক সত্য স্বপ্ন আছে, যা ভবিষ্যতের ঘটনাবলী সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে অথবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত আবিস্কারের কোনো কারণ হয়েছে। সত্য স্বপ্নের প্রকৃতি বোঝার জন্য এই গুটিকয়েক উদাহরণই যথেষ্ট। এটা আত্মার ভিন্ন মাত্রার সাঙ্কেতিক জগতে ভ্রমণ এবং সেখানে সঙ্কেত সমুহের সাথে পরিচিত হওয়ারই ফল।

পরিশেষে এটা বলা যায় যে, স্বপ্ন হলো পরাবাস্তব জগত এর অস্তিত্ব তথা দিব্য জ্ঞান এবং অদৃষ্টের শক্ত প্রমাণ। সর্বশক্তিমাণ আল্লাহ যদি পূর্বনির্ধারিত ঘটনা সমূহ “সর্বোচ্চ সংরক্ষিত পুস্তকে” [লউহে মাহফুজ] লিপিবদ্ধ না রাখতেন তাহলে কি করে আমরা ভবিষ্যতের ঘটনাবলী সম্পর্কে অবগত হতে পারি? স্বপ্ন আরও প্রমাণ করে যে। এই জগত সমূহে সময়ের পরিমাপও অনেক ভিন্ন।

[ এই পরাবাস্তব /রূপক জগত সমুহের ব্যাপারে ‘শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি রহিমাহুল্লাহ’ তার ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ পুস্তকে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাছাড়া ভিন্ন স্থানে সময়ের ভিন্ন পরিমাপও বিজ্ঞানের আপেক্ষিক তত্ত্ব দ্বারা প্রমাণিত- অনুবাদক]

সত্য স্বপ্ন হল মানুষের সম্প্রসারিত সুক্ষ সহজাত অনুভুতির ফল

সত্য স্বপ্ন হল মানুষের সম্প্রসারিত সুক্ষ সহজাত অনুভুতির ফল। প্রতিটি মানুষের ভেতরেই এই সুক্ষ সহজাত অনুভুতির উপস্থিতি কিছুটা হলেও থাকে; এটা এমনকি জন্তুদের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। আমি এটাও আবিস্কার করেছি যে, মানুষ এবং জন্তুর বহিস্থ এবং অন্তস্থ ইন্দ্রীয়জাত অনুভুতির বাইরেও আরও দুই প্রকার অনুভুতি রয়েছে যাকে আমরা প্রেরণাদায়ী বল আর প্রলুব্ধকারী বল বা উদ্দীপনা বলতে পারি। যদিও পথভ্রষ্ট এবং দূষিত চিন্তার ব্যাক্তিগণ আহম্মকের মত এই অবোধ্য অনুভুতিকে বলে প্রবৃত্তি। বরং এ কে বলা যেতে পারে স্বভাব জাত প্রেরণা যার মাধ্যমে মানুষ এবং জন্তু তার তকদীর এর দিকে ধাবিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ, তকদীর সঙ্ক্রান্ত নির্দেশনার কারনেই একটি বিড়াল যখন অন্ধ হয়, তখন বনজ ঔষধ খুঁজে বের করে চোখের নিরাময় এর নিমিত্তে এবং এই ঔষধ চোখে লাগিয়ে তার অন্ধত্ব দূর করে।

তেমনি ভাবে শকুনের মত মাংসাশি পাখী, যা এই ধরাতে বর্জ পরিস্কার করে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত বলা হয়। কারণ সৃষ্টি গত ভাবেই তা বুনো জন্তুর দেহাবশেষ দূর করার কাজে নিয়োজিত থাকে। এই শকুন দশ মাইল দূর থেকেও তার খাদ্যের সংবাদ পায় আর প্রেরণা দায়ী বল-ই তাকে তার তকদির এর দিকে যেতে নির্দেশনা দেয় অথবা অন্যভাবে বলা যায় স্বর্গীয় ভাবে অনুপ্রানিত হয়েই তা মৃত জন্তুর অস্তিত্ব খুঁজে পায়।

আর এভাবেই মাত্র কয়েক দিন বয়সী মৌমাছি অনেক দূরে উড়ে যেতে পারে এবং পথ না হারিয়ে মৌচাকে ফিরেও আসতে পারে। এটা অনেক সময় ঘটে যে, আপনি কোনো এক ব্যাক্তির কথা বলছেন আর তখনি লোকটা আপনার সামনে অপ্রত্যাশিত ভাবে আবির্ভুত হয়। এই ধরনের ঘটনা এতটাই সাধারণ যে, তুর্কি ভাষায় একটা প্রবাদ আছে “তুমি যখন নেকড়ের কথা উচ্চারণ কর, তখন নেকেড়েকে আঘাত করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে” আপনি মূলত নেকড়ে বা মানুষ আসার ব্যাপারে কিছুই জানেন না বা আপনার এমন সংবাদ জানার কোনো উপায় ও নেই। বরং আপনি এ ব্যাপারে অবচেতন ভাবে সুক্ষ অনুভুতি [ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়] দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন এবং অনিচ্ছায় সে ব্যাক্তিটির কথা বলেছেন। পরহেজগার ব্যাক্তিদের মাঝে এই ধরনের অনুভুতির উপস্থিতি বেশী পরিমানে দেখা যায়, বিশেষ ভাবে সাধক দের মধ্যে যা আশ্চর্যের কারণ হয় অনেক সময়।

যেহেতু সাধারন মানুষের মধ্যেও কিছু পরিমান হলেও সাধকের গুনাবলী দেখা যায়, তারা স্বপ্নে অদেখা জগতের বা ভবিষ্যতের কোনও ঘটনার সাথে পরিচিত হয়। যেহেতু সত্য স্বপ্নের প্রেক্ষাপটে ঘুম হল এক প্রকার সাধনা, সেহেতু এটা একটা বিনোদনের সময়ও বটে যখন তাকে মহাণ স্বর্গীয় চলচ্চিত্র দেখানো হয়।

ভালো চরিত্রের লোক ভাল কথা চিন্তা করে আর তাই সে স্বপ্নে ভাল জিনিস দেখতে পায়। অপর পক্ষে খারাপ চরিত্রের লোক স্বপ্নে কুৎসিত জিনিস দেখে।

সত্য স্বপ্নের প্রেক্ষাপটে আবার ঘুম হোলো একটি খোলা জানালাও যার মাধ্যমে দেহ বিশিষ্ট জগতে বসে অদেখা জগত দেখা যায়। পরন্তু এটা হোলো স্থানকালে সীমাবদ্ধ মরনশীল মানুষের জন্য মুক্ত হয়ে বিচরণের ক্ষেত্র। আরও বলা যায় এটা একটা স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ যেখানে সময় শুধু বর্তমান কিন্তু তার ভেতর অতীত ও ভবিষ্যত একিভূত হয়ে অবস্থান করে। উপুর্যপুরি ঘুম হোলো দৈনন্দিন জীবনের জাঁতাকলে পিষ্ট জীবিতদের জন্য স্বস্তিরও একটা সময়। ঘুমের এই দিকটির জন্যই পবিত্র কুরান আমাদের শিক্ষা দেয় “ আমি নিদ্রাকে তোমাদের জন্য বিশ্রাম স্বরূপ নিযুক্ত করেছি”

সত্য স্বপ্ন মানুষের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ প্রদর্শন এবং অদৃষ্টের নির্দেশক

প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং নিশ্চিত প্রমানের মাধ্যমে সত্য স্বপ্ন দ্বারা আমি অনেক আগেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, তকদীর সবকিছুকে বেষ্টন করে রাখে। ঐ সকল স্বপ্ন আমার জীবনে এমন অর্থবহ হয়ে এসেছে যে আমি বুঝতে পেরেছি, কাল আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে, এমনকি খুব গুরুত্বহীন ঘটনা, কার্যাবলী এবং কথোপকথন পুর্ব থেকে নির্ধারিত হয়ে আছে। নিশি স্বপ্নে এ জিনিস গুলোকে আমি এমন ভাবে দেখেছি, যেন আমি নিজের দৃষ্টি দিয়ে তা পড়েছি। এটা আমার কাছে একবার কিংবা শত বার ঘটেছে এমন নয়, বরং তা ঘটেছে সম্ভবত সহস্র বার, যে মানুষ গুলোকে আমি স্বপ্নে দেখেছি বা যে ব্যাপারে আমি কথা বলেছি, পরেরদিন তা সামান্য ব্যাখ্যার পর সত্য হিসাবে ধরা দিয়েছে। এর অর্থ, এই মহাবিশ্বে কোনও কিছুই কাকতালীয় বা দুর্ঘটনা মূলক নয়, কিংবা তা উদ্দেশ্য বিহীনও নয়, বরং সবকিছু , এমন কি সাধারণ কোনো ঘটনা পর্যন্ত পূর্ব নির্ধারিত এবং অদৃষ্টের বিধান যা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত।

[এখানে উল্লেখিত প্রকারের বাহিরেও আরও এক প্রকার স্বপ্ন আছে যাকে দুঃস্বপ্ন বলা হয়, এই প্রকার স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে দেখানো হয়, এই প্রকার স্বপ্নে সাধারনত মানুষ কে ভীতি প্রদর্শণ করা হয়। নিম্নক্ত হাদীসে তা বর্ণিত হয়েছেঃ

আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহুয়ালাইহিয়াসসাল্লাম বলেন, “ভাল স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে আর খারাপ স্বপ্ন আসে শয়তানের পক্ষ থেকে; তাই কেউ যদি খারাপ স্বপ্ন দেখে ভয় পায়, তার উচিত বাঁ দিকে থু থু ফেলা এবং এর অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থণা করা, এরূপ করলে তার কোনো ক্ষতি হবেনা।“]

{সহীহ বুখারী} - অনুবাদক

মূলঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

অনুবাদ ও সম্পাদনাঃ মোতাহারুল ইসলাম

বিষয়: বিবিধ

৪১৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File