“বাংলাদেশ-ভারত” একটি জটিল সম্পর্কের নাম।
লিখেছেন লিখেছেন মুসাফির দিল ২১ মে, ২০১৪, ০৩:৪৩:২৬ রাত
বাংলাদেশে বর্তমানে ২টি বড় রাজনৈতিক দল বিদ্যমান একটি আওয়ামীলীগ এবং অপরটি বিএনপি। একটি দল উলঙ্গ ভাবে ভারত পন্থী আর অপরটি কোন পন্থী বলা মুশকিল। যদিও আওয়ামী পন্থীদের অভিযোগ তারা পাকিস্থান পন্থী। কিন্তু পাকিস্থান পন্থী হয়ে কোন কূল কিনারা করতে তারা পারবেন না। পাকিস্থানের অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির চাইতে অনেক নিম্ন পর্যায়ে। তাই তাদের কাছ থেকে কোন কিছু আশা করা বোকার স্বর্গে বাস করা সমান। তাহলে তারা কোন পন্থী তা বলাটা একটু দরহ-ই বটে। বিএনপির কার্য নির্বাহী পরিষদ চলে নানা মুনির নানা মতের মত করে। একে জগাখিচুড়িও বলা যায়। কেউ ভারত পন্থী কেউ আমেরিকা, কেউ কমিউনিষ্ট রাশিয়া, কেউ পূর্বে আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত থেকে এই দলে এসেছে। বর্তমান প্রধান মন্ত্রীর সংসদে দেয়া বক্তব্যের সাথে তাল মিলিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় “এর ছাল ওর বাকল দিয়ে যে দল গঠিত তা আবার বড় বড় কথা বলে কি করে?”
গত ১৬ মে ভারতের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষনা করা হল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজেপি-এনডিএ জোট সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে উগ্র-হিন্দুবাদী সংগঠন বিজেপির নেতা নরেন্দ্র মোদী প্রধান মন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করবেন। মোদীর নির্বাচন পূর্ব বিভিন্ন সংলাপ সাধারনের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এর কারণ তার চরম মুসলিম বিদ্বেসী মনোভাব। তার বিতর্কিত সংলাপের মধ্যে ছিল ভারতের বাংলাদেশীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ঘোষনা, পাকিস্থানের মানচিত্র মুছে ফেলা এবং আরো কয়েকটি। এর প্রত্যুত্তরে মমতা ব্যানার্জির “তুই কোন হরিদাস?” কথাটি পশ্চিম বঙ্গ এলাকায় রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তারপরও মোদী আগামীতে শপথ গ্রহণ করে জনবহুল ভারতের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করবেন এবং সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করবেন এটাই আমাদের আশা।
ভারতের নির্বাচনে মোদীর বিজয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি একটু সরগরম বলা যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল গুলো কে কার আগে মোদীকে অভিনন্দিত করবে তা নিয়ে ব্যাস্ত। আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি দুটি দলই অভিনন্দন জানিয়েছে সাথে জামায়াতে ইসলামও আছে। কিছু লোক জামায়াতের অভিনন্দন জানানো সহ্য করতে পারছেন না। তাদের কথা জামায়াত কেন অভিনন্দন জানাবে? যদিও গত উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত অত্যন্ত মজবুত দল এবং তৃতীয় অবস্থানে আছে বলে জামায়াত দাবী করে। বাংলাদেশে তৃতীয় অবস্থানে থাকা দল মোদীকে অভিনন্দন জানাতে পারে এতে দোষের কিছু আছে বলে মনে করি না। মোদীর বিজয়ের সাথে সাথে বাংলাদেশে একটি লক্ষ্যনীয় ব্যাপার ঘটে গেছে।
বিষয়টি হল মোদীর বিজয়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল গুলো ক্ষমতায় যাওয়া বা হারাবার একটা দোলাচলে ভূগছে। যার ফলে এক দল অন্যদল এর প্রতি বিভিন্ন বিষোধগার এর মাধ্যমে হেয় করার পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। এক দল ভাবছেন আমরা ক্ষমতায় চলে এসেছি আর অন্য দল গোপনে গোপনে লীঁয়াজো করায় ব্যাস্ত। আমি বিষয়টিকে রাজনৈতিক দল গুলোর এক ধরনের বালখিল্য আচরণ বলেই আখ্যায়িত করব। মোদীর জয়ের সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম গুলোতেও কিছু ব্যাবহারকারী বর্তমান সরকারের দিন শেষ বলে একধরনের আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করেছেন। প্রধান মন্ত্রীর উদ্দ্যেশ্যে তার ক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে মর্মে নানা ধরনের পোষ্ট ছড়িয়ে দিয়েছেন। আমি বলব এ ধরনের চিন্তা ভাবনা মূলতঃ রাজনৈতিক প্রজ্ঞাহীনতারই পরিচায়ক। আর তারা ভারতের রাজনীতি ও পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ।
ভারতের পররাষ্ট্র নীতি চলে ভারতের সাউথ ব্লকের সিদ্ধান্তের উপর। অনেকে ভারতের এই সাউথ ব্লক কি তা জানেন না। দিল্লীতে অবস্থিত সেক্রেটারিয়েট ভবন দুই ভাগে বিভক্ত আর এই দুই ভাগের মধ্যে আছে প্রশস্ত রাস্তা। রাস্তার দক্ষিন পাশের ভবন গুলোকে সাউথ ব্লক আর উত্তর পাশের ব্লকের ভবন গুলোকে নর্থ ব্লক বলে আখ্যায়িত করা হয়। সাউথ ব্লকে অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ তিনটি মন্ত্রনালয়ের অফিস বিদ্যমান। এগুলো হচ্ছে প্রধান মন্ত্রীর অফিস, প্রতিরক্ষা বিভাগ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অফিস। আর উত্তর অর্থাৎ নর্থ ব্লকে আছে স্বরাষ্ট্র এবং অর্থ মন্ত্রনালয়ের অফিস। ভারতের পররাষ্ট্র নীতি নিয়ন্ত্রন করে মূলতঃ সাউথ ব্লক। ভারতের রাজনীতিবিদদের পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারে নির্বাহী ক্ষমতা থাকলেও মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা সাউথ ব্লকের সিদ্ধান্তের বাইরে যায় না। বাংলাদেশের ব্যাপারে বিগত কংগ্রেসের আমলে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় রাখার ব্যাপারে সাউথ ব্লক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য রাজনীতিবিদ এবং “র” সংস্থাকেও একটি লাইনে আনতে পেরেছে। কারণ এতে ভারতের নিজস্ব স্বার্থ জড়িত ছিল। আমাদেরকে এ কথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে মেনে নিতে হবে যে ভারতের যত উগ্রবাদী রাজনীতিবিদই হোক না কেন ভারতের স্বার্থে বিন্দু মাত্র আঘাত আসুক তা তারা মেনে নেবে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় কে থাকলে ভারতের জন্য বেশি সুবিধা হবে ত-ই তারা বিবেচনা করবে। আওয়ামীলীগ বা বিএনপি বলে কোন কথা নয়। বর্তমান সময়ে আওয়ামীলীগ ভারতকে যে সুযোগ সুবিধা দিয়েছে বিএনপি যদি এর চেয়ে বেশি দেবার প্রতিশ্রুতি দেয় তবেই তারা ক্ষমতায় যাবার ব্যাপারে নিশ্চয়তা পেতে পারে। নচেৎ নয়।
ভারত বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা অর্জন থেকে শুরু করে আজ অবধি নিজের স্বার্থের জন্য সব কিছু করে গেছে। অনলাইনের সুবাধে বাংলার খুটিনাটি ইতিহাস আজ সাধারণ মানুষের নখদর্পনে। মেজর জলিলের বই থেকে আমরা জানতে পারি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের প্রতিবাদ করায় তাকে জেলে যেতে হয়েছে। ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের সময়ও ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে গিয়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ভূমিকার কারণে অবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হয়। কথিত আছে শেখ মুজিবের হত্যার পিছনে ভারতীয় “র” সংস্থার হাত ছিল। হুমায়ুন আহমেদের দেয়াল উপন্যাস থেকে আমরা জানতে পারি যে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে তা তৎকালীন ভারতীয় “র” সংস্থা জানত। এরপর জিয়া হত্যার পুরো পরিকল্পনাই নাকি ভারতীয় “র” সংস্থার ছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রেসিডেন্ট এরশাদ বরাবরই ভারতীয় এজেন্ট হিসাবে পরিচিত আর বর্তমান আওয়ামীলীগের কথা বাদই দিলাম। তাদের মন্ত্রী এমপি বুদ্ধিজীবিরা বাংলাদেশের কেউ নন তারা সব সময় ভারতের তুষ্টি নিয়েই ব্যাস্ত। বিএনপির কথা আগেই বলেছি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পূর্বে ফারাক্কা বাঁধ নির্মান করে পরিক্ষামূলক চালু করে আজো তা বন্ধ করেনি। যার ফলে বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গ আজ মরুভূমি হতে বসেছে। বাংলার প্রমত্তা পদ্মা আর সেই পদ্মা নেই। রূপালী ইলিশ যেন আজ সোনার হরিণ। টিপাইমুখ বাঁধ বাস্তবায়ন হলে দেশের কৃষি শেষ হবার প্রহর গুনতে হবে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষতি কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর পর রয়েছে বানিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-২০১০ অর্থ বছরের হিসাব অনুযায়ী ভারতের সাথে বাংলাদেশের বানিজ্য ঘাটতি প্রায় ৩শ কোটি ডলার। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে ভারত থেকে ৩২১ কোটি ৪৬ লাখ ডলার আমদানির বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৩০ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। বাংলাদেশে মোট আমদানী করা পণ্যের প্রায় ১৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তারপরও আমাদের নেতারা বলে উঠে “দাদা হরিবোল”।
বানিজ্য ঘাটতির পর আসা যাক রেমিট্যান্স এর মাধ্যমে পাঠানো অর্থের কথা। বাংলাদেশে যেখানে শতকরা ৪৭ জন শিক্ষিত বেকার সেখানে অন্ততঃ ৫লক্ষ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা প্রতি বছর ৩শ৭১ কোটি মার্কিন ডলার তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংক ২০১৩ এর বার্ষিক রেমিট্যান্স এর প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করে। বাংলাদেশ ভারতের পঞ্চম রেমিট্যান্স সরবরাহকারী দেশ। প্রকৃত হিসাব এর চেয়েও বেশি। এছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে কি পরিমান টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে তার কোন হিসাব কারো কাছে নেই। তবে এক তথ্য মতে ২০১৩ সালে হুন্ডির মাধ্যম গোদাগাড়ী সিমান্ত দিয়ে অন্তত ৫শ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। সে হিসাবে ধারণা করা হয় বাংলাদেশ থেকে অবৈধ ভাবে পাচার হওয়া টাকার পরিমান ২ হাজার কোটির ও উপরে। এক তথ্য মতে বাংলাদেশে ভারতের ৬ লক্ষ ৩০ হাজার এজেন্ট আছে। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে চলছে।
এত কিছুর পরও আরও অন্ততঃ ১০০ গুন লেখা বাকী থেকে যায়। গত ৯ মে রাত ৮ টা ৩৮ মিনিটে মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর দেয়া ফেসবুক ষ্ট্যাটাস টা তুলে ধরছি।
“দাদাবাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিলো, ট্রানজিট দে, দেখিস একদিন তিস্তা দিয়ে দিবো। জঙ্গী হটা, বানিজ্য ঘাটতি কমিয়ে দিবো। দাদা সব নিয়ে নিয়েছে। দেয়নি কিছু, আমাদেরও দেখা হয়নি কিছুই, ৪৩ বছর কেটে গেল। বাজার গেছে, আকাশ গেছে, পত্রিকার পাতাগুলো গেছে, চিন্তা গেছে, সিনেমা হলটা বাকী ছিলো, এবার সেটাও যাচ্ছে। যে দেশের মন্ত্রীর একমাত্র এজেন্ডা মনে হয় ভারতের ছবি আমদানি (তাও আবার ভারতের সবচেয়ে অখাদ্য ছবিগুলো ), যে দেশের মন্ত্রী মনে করে বাংলাদেশের সিনেমার উন্নতির একমাত্র উপায় ভারতের ছবি আনা এবং আমাদের ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক ভারতীয় কোনো সংস্থাকে দেয়া, সে দেশের ভবিষ্যত চরম উজ্জ্বল। এইরকম চিন্তাশীল মানুষ যদি দেশ চালায়, সে দেশের ভবিষ্যত উজ্জ্বল না হয়ে পারে না। আশা করি অন্যান্য দেশও (যাদের সিনেমার অবস্থা খারাপ) আমাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে চলচ্চিত্র বিপ্লব সাধন করবে।
বিঃ দ্রঃ পাশে বসা ছোটো ভাই বললো ‘দুই দেশের ছবি না বিনিময় হওয়ার কথা। আমি তাকে পুনরায় নাদের আলী"র কবিতা পড়তে বললাম খুশী হয়ে ছোট্ট ভাই আমাকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জঙ্গী দমনের গুরুত্ব বিষয়ে একটা বক্তৃতার রিপোর্ট ধরিয়ে দিয়ে বললো, দেশ চালাতে এইরকম প্রতিভাই আসলে দরকার!
আমি বললাম এইরকম একটা মন্ত্রী তুই ফুসলিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে দিয়ে দে। আমরা বেঁচে যাই!
তাই বলছি যে সব রাজনৈতিক দল আজ মোদির বিজয়ে বগল দাবাচ্ছেন তারা একটু সাবধান হোন ভারতের কেউই আমাদের বন্ধু নয়। আর যারা বিমর্ষ তারাও একটু এ দেশের কথা ভাবুন। মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর টকশো এর আরেকটি কথা দিয়ে শেষ করব।
“একদল বলছে ওরা ভারত পন্থী অন্যদল বলছে ওরা পাকিস্থান পন্থী। তাহলে বাংলাদেশ পন্থী কে?” আমারও তাই প্রশ্ন আসলেই বাংলাদেশ পন্থীকে? আমরা কি একটু দেশের কথা ভাবতে পারি না? আর কতদিন এভাবে চলবে?
আমাদের নেতাদের বলব ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কটা একটু যাচাই করুন আর ভাবুন যা করছি তা কি ঠিক করছি?
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১৪৮৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন