বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন: কিছু অসঙ্গতি, কিছু প্রশ্ন
লিখেছেন লিখেছেন সাম্প্রদায়িক ১৫ জুলাই, ২০১৩, ১০:১৫:১৮ রাত
বাংলাদেশের স্থায়ী শাসনতন্ত্র তৈরীর উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি “বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ” জারি করেন। এই আদেশের দুইটি মূল দিক ছিল। প্রথমত, ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের অধীনে বিভিন্ন তারিখে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হবে। দ্বিতীয়ত, এই পরিষদ বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা করবে। এই আদেশের বলে তৈরী পরিষদের উপরে দায়িত্ব বর্তায় শুধুমাত্র বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র তৈরীর, আইন তৈরীর নয়।
এটি মোটামুটি সর্বজন স্বীকৃত যে, বাংলাদেশের সংবিধান প্রনয়নে নিয়োজিত গণপরিষদ সদস্য সংখ্যা ৪০৩ জন। কিন্ত জাতীয় পরিষদে আসন ছিল ১৬৯ টি এবং প্রদেশিক পরিষদে ৩০০ টি। অর্থাৎ গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিল ৪৬৯ জন।
এখানে বিভ্রান্তি কিংবা প্রশ্নগুলো কি কি? সাধারন দৃষ্টিতে আমি কয়েকটি বড় অসঙ্গতির উত্তর খুজছি। এক. ১৯৪৭ সালে ভারত শাসন আইনের পর থেকেই গণপরিষদের নিকট সাধারনত দুটি ক্ষমতা দেয়া থাকার কথা। যার একটি স্ব স্ব দেশের জন্য নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ এবং অন্যটি হল শাসনতন্ত্র তৈরীর পূর্ব পর্যন্ত গণপরিষদ আইনসভার কাজ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের গণপরিষদকে কেন আইনসভার দায়িত্ব দেয়া হলো না? কেন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট তার হাতে রাখলেন? তাহলে কি রাষ্ট্রের তৎকালীন কর্তাব্যক্তিদের গণপরিষদের সদস্যদের উপর পূর্ণ আস্থা ছিল না? নাকি এর মধ্য দিয়ে বাকশালের ভ্রুণ তৈরীর কাজটি করে রেখেছেনা?
দুই. ‘লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক’ অনুযায়ী গণপরিষদের সদস্যরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি এবং পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি অঙ্গিকারবদ্ধ হয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। কেননা এই নির্বাচনগুলো হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীনে তাদের প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য হওয়ার জন্য। তাহলে নৈতিকভাবে কি এরা বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব নিতে পারে? আর এই সংবিধান কি বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত? কেননা এই প্রশ্ন অধিকার ও নৈতিকতার।
তিন. প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের মোট নির্বাচিত সদস্য ছিল ৪৬৯ জন। তাহলে সংবিধান প্রণয়নে কেন ৪০৩ জন? বাকি ৬৬ জন কোথায়? এর মধ্যে মারা যায় ১২ জন, পাকিস্তানী নাগরিক হয়ে যায় ০২ জন, দালাল আইনে আটক হয় ৫ জন, বৈদেশিক সার্ভিসে যোগদান করে ০১ জন। এরপরেও বাকি থাকে ৪৬ জন। এই ৪৬ জনকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। কেননা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এরা পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিল। এই ৪৬ জন কারা? তারা এখন কোথায় আছে?
চার. যেহেতু এই ৪৬ জনকে আওয়ামী লীগ দল থেকে বহিস্কার করেছে, অতএব এরা আওয়ামী লীগের দলগতভাবে স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী। অন্যদিকে গণপরিষদ আদেশ অনুযায়ী এরা সংবিধান প্রণয়নে অংশিদার থাকার কথা। যেহেতু এদেরকে সংবিধান প্রণয়ন থেকে বিরত রাখা হয়েছিল, সেহেতু এরা রাষ্ট্র স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী। এদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সরকারের প্রকাশ করা উচিত। নাকি এদের সম্পর্কে আমরা অজ্ঞই থেকে যাব?
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ইত:মধ্যে অনেকগুলো রায় দিয়েছে। কয়েকটি মামলা বিচারাধীন। অথচ এই ৪৬ জন রাষ্ট্র স্বীকৃত অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য ট্রাইবুনালের বেশী সময়ের প্রয়োজন থাকার কথা না। প্রত্যাশা করছি সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে। আমরা কলঙ্কমুক্ত হব। কিন্তু এত অসঙ্গতি নিয়ে যে দেশের সংবিধান তৈরী হয়, সে দেশে অসঙ্গতিমুক্ত সবকিছু হবে! আমি সন্দিহান। তারপরেও প্রত্যাশা করছি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।
বিষয়: বিবিধ
২৯১১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন