নিজের অজান্তে গড়িয়ে পড়া অশ্রুতে কোনো অর্থ খুঁজতে চাইলেই কেবল পড়তে পারেন।
লিখেছেন লিখেছেন ডব্লিওজামান ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০২:১১:৩০ রাত
একজন প্রত্যক্ষদর্শীর জবানীতে
পিলখানায় ৫৭ সেনা অফিসার হত্যাঃ
---------------------------------------------------
ডেটলাইনঃ ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০০৯ ।।
২০০৯ এর ২৫ই ফেব্রুয়ারীতে বিডিআর এর ঘটনায় আমি হারিয়েছি আমার আপন চাচাত ভাই (লেঃ কর্নেল), ২জন ক্লোজ ফ্রেন্ড (মেজর), ২ জন প্রিয় প্রতিবেশীকে (১জন লেঃ কর্নেল, ১ জন মেজর,)। এদের কারোই আমি বিস্তারিত পরিচয় দিতে এখন আর ইচ্ছুক নই ।
২৫ তারিখ সকাল ৮:৪৫ মিনিটে সেনাবাহিনীর এক ফ্রেন্ড আমাকে প্রথম ফোন করে ঘটনা জানায়। সংক্ষেপে ঘটনা বলে জিজ্ঞাসা করে ***** স্যার (আমার চাচাতো ভাই) কোথায়? জানালাম, উনিতো ভোরেই পিলখানার উদ্দশ্যে বেরিয়ে গেছে। তিনি আর কিছু না বলে শুধু বললেন ----
তুই এখুনি পিলখানায় চলে আয়। আমার চাচাত ভাই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছিলেন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এবং আমাদের বাসায় উঠেছিলেন। ওইদিন সকালে শুধু এক কাপ চা খেয়েই বেরিয়ে যান উনার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে। দরবার হলের অনুষ্ঠানের বিশেষ এক দায়িত্ব ছিলো তার উপর। তাড়াহুড়ো করে সকালের নাস্তাটাও করেনি।
ভাইকে আমি ফোন করছি তো করছি, রিং বেজেই চলেছে…………… বাসার কাউকে তখনও কিছু বলিনি। আমি তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বেরুচ্ছি, এমন সময় আরেক ফ্রেন্ড ফোন করে জানায় পিলখানার দরবার হলে ৫০ জনের মত সিনিয়র অফিসার শুট ডাউন। শুনে আমার সারা শরীর হিম শীতল হয়ে গেল। তাকে জানালাম, আমি পিলখানার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি।
নিউ মার্কেটের সামনে পৌঁছে এক র্যাবের গাড়ির দিকে তাকাতেই দেখি আমার মহল্লার এক র্যাব অফিসার । তিনি সিনিয়র মেজর, (উনারও এক আত্মীয় মারা গিয়েছেন ঐ ঘটনায়)। তাকে দেখেই ট্যাক্সি থেকে নেমে ইশারা দিতেই তিনি দৌড়ে আসেন । তাকে জানালাম ভাইয়ের মোবাইলের এতক্ষণ রিং বাজছিলো কিন্তু এখন ফোন অফ। সে নির্বিকারভাবে আমাকে জানালো ****** স্যার (আমার চাচাতো ভাই) এর আশা ছেড়ে দেন। এরপর এই প্রথম তার কাছেই জানতে পারি আমাদের পরিচিত কারা কারা ভিতরে আছে।
এরই মধ্যে আমার আরও কয়েকজন আর্মি ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা হয়। ততোক্ষণে ঘটনা কি ঘটেছে বুঝতে আর আমার বাকি রইলো না।
এরই মধ্যে কিভাবে যেন আমার পরিচিত কয়েকজন জেনে যায় আমি পিলখানায় আছি। একটার পর একটা ফোন আসা শুরু হলো । যাদেরকে বলা প্রয়োজন মনে করেছি তাদেরকে সত্য কথা বলছি। কিন্তু কাউকে কাউকে এড়িয়েও গিয়েছি। ঐ সময় আমিও কেমন যেন অনুভুতিহীন হয়ে পড়েছিলাম। আমি জানি, তাদের কাছের লোকটি নেই কিন্তু নির্বিকার ভাবে তাদের স্ত্রী, সন্তান, ভাই বোনদের বলে যাচ্ছি উনি ভালো আছেন/আছে, একটু আগে আমার সাথে কথা হয়েছে………… এমন মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছিলাম অবলিলায় ।
এদিকে টিভিতে লাইভে আপনারা যেভাবে সাংবাদিকদের মিথ্যাচার দেখছিলেন, আমিও ঠিক একই ভাবে মিথ্যে বলে যাচ্ছিলাম আমার পরিচিত জনদের। কিছুক্ষণের ভিতর আমার মোবাইলে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আশা শুরু করলো। কল করে বলে “অমুক আপনার ফ্রেন্ড হয় না ? আমি তার , চাচা, মামা, খালাতো বোন, মামাতো বোন…………… আমার হাসবেন্ডের নাম লেঃ কর্নেল ****** আমার ছেলে/ভাই/ভাতিজা মেজর *****, ক্যাপ্টেন ***** আমিতো ওকে ফোনে পাচ্ছি না……… আপনিতো পিলখানায় আছেন………… একটু দেখবেন ও কোথায় আছে, কেমন আছে? একটু খোঁজ নিয়ে জানাবেন, প্লিজ।“
আর আমি শূয়োরের বাচ্চা, ইতর, হিজড়া নামক মানুষটি সবাইকে সমানে মিথ্যে বলে যাচ্ছিলাম। আমি এমন ভীরু, কাপুরুষ হয়ে গিয়েছিলাম যে কাউকে বলতে পারিনি যে আপনার স্বামী, ভাই, ছেলে আর জীবিত নেই। যেকোন ভাবেই হোক আমি প্রতি মিনিটে নিহতদের আপডেট নামের তালিকা দেখছিলাম। পিলখানার ভিতর থেকে কেউ একজন প্রতিনিয়ত নিহতদের নাম প্রকাশ করে যাচ্ছিল সরকারের একটি বিশেষ সংস্থার কাছে। আমার সামনেই নামগুলো নোট করে নিচ্ছিলো সেই সংস্থার একজন। পিলখানার এই গেট থেকে ঐ গেটে দৌঁড়ুদৌঁড়ির মধ্যে দুই টিভি সাংবাদিকের খপ্পরে পড়ি। আমি তাদের একটি প্রশ্নেরও উত্তর না দিয়ে মাইক্রোফোন সরিয়ে দিয়ে আমার পথে যেতে থাকি। টিভিতে লাইভে ঐ দৃশ্য আমার পরিচিতজন কয়েকজন আমার চেহারার অভিব্যাক্তি দেখে বুঝে ফেলেন ভেতরের অবস্থা কি ! বিশেষ করে আমার স্ত্রী নিশ্চিত বুঝে ফেলে আমার ভাই আর নেই ।
পিলখানায় উদ্ধার কাজ শুরু হওয়ার মুহূর্তে যে কয়জন পিলখানার ভেতরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো আমি তাদেরই একজন। যেকোন উপায়ই হোক আমি ভেতরে ঢুকেছিলাম। তার অনেক আগেই জেনে গিয়েছিলাম বা বুঝেছিলাম আমরা কাদেরকে হারিয়েছি। আমি ঢুকেছিলাম শুধু আমার হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের লাশ খুঁজতে। লাশ খুঁজতে খুঁজতে পাগলপ্রায় অবস্থা আমার। এর মধ্যে খবর পাই কিছু লাশ মিটফোর্ডে মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ছুটে যাই সেখানে। মর্গে গিয়ে দেখি সরকারী বাহিনীর বিশেষ কিছু লোকজন ছাড়া অন্যদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ । এক পরিচিত অফিসারের সহায়তায় আমি মর্গে ঢুকি। জীবনের প্রথম মর্গে ঢুকা আমার । লাশগুলো কিছু উপড় হয়ে আছে, কিছু কাত হয়ে আছে। ৬-৭টা লাশ উলটিয়ে দেখতে গিয়ে প্রথম পাই আমার প্রতিবেশী সিনিয়র ভাইয়ের (লেঃ কর্নেল)। তার চেহারা দেখে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে। সাথে সাথে মর্গে থেকে বেরিয়ে আসি ।
পিলখানায় ও হাসপাতালে দৌঁড়ুদৌঁড়িতে অনেক নিহতের আত্মীয়-স্বজনের কাছে চেনামুখ হয়ে যাই । তখন এক হতভাগা নিহতের আত্মীয় এসে একটা ছবি দিয়ে বলে লাশটা আইডিন্টিফাই করার অনুরোধ করে।আরো কয়েকজন ছবি, নাম ও র্যাংক লিখে চিরকুট দেয়। আবার ঢুকে ভাইয়ের লাশ খোঁজা শুরু করি । একপর্যায়ে পেয়েও যাই। ভাইয়ের লাশ পেয়েও আমি কিভাবে যেন নির্বিকার ছিলাম। অনুভুতিহীন হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর পকেট থেকে কয়েকটা ছবি ও নাম দেখে কিছু লাশ আইডিন্টিফাই করার চেষ্টা করলাম। বেশিরভাগ লাশের নেমপ্লেট ছিল না। হঠাৎ মাথায় এলো মোবাইল দিয়ে কিছু ছবি তুলে বাইরে আত্মীয় স্বজনদের দেখালে হয়তো চিনতে পারবে । আমিতো ছবির সাথে লাশের কোন মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বেশ কিছু ছবি তুললাম সরকারী বিশেষ সংস্থার লোকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। আবার বাহির হয়ে দু'জনকে ছবিগুলো দেখাচ্ছিলাম । পাশ থেকে এক মহিলাও ছবিগুলো দেখছিলো যা' আমি খেয়াল করিনি। হঠাৎ ধুপ করে আওয়াজ শুনে পাশে ফিরে দেখি এক মহিলা মাটিতে পড়ে আছে । তার সাথের লোকটি জানালো আমার ঐ ছবিগুলোর মধ্যে ঐ মহিলার স্বামীর ছবি ছিলো।
২৬শে ফেব্রুয়ারি মাঝ রাতে বাসায় ফিরি। এই দুই দিন খেয়েছিলাম ২টা কলা আর ২ পিস ব্রেড। এরপর মাসখানেক আর তেমন কিছুই খেতে পারিনি ।
ফেব্রুয়ারির ২৫ ও ২৬ তারিখে অনেকের বাসায় আমি দাওয়াত পাই মৃত্যু বার্ষিকীর মিলাদ মাহফিলে। গত ৮ বৎসরেও যাইনি, আগামীতেও যাবো না। যে সব অফিসারদের স্ত্রী কন্যা, পুত্রদের ২৫ তারিখ সন্ধ্যায়ও বলেছিলাম উনি জীবিত আছেন তারা জানে তাদের প্রিয় মানুষটির মৃত্যু হয়েছে ২৬ তারিখে। আমার মিথ্যা কথার উপর ভিত্তি করে তারা ২৬ তারিখ মৃত্যু বার্ষিকী পালন করে। সেইসব পরিবারের মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার আজও হয়নি। আমার নিজের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেই বিভীষিকাময় ‘ঘটনা’ এবং ‘ঘটনার পিছনের ঘটনা’ হয়তো একদিন কেউ না কেউ প্রকাশ করবে।
সেদিন একটা কথা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম যে ঘরের মালিক যদি নিজের ঘর জ্বালিয়ে দিতে চায় তাইলে প্রতিবেশী সেই আগুন নেভাতে পারে না। সেদিন র্যাব-১ এর দুই পিকআপে ১৬ জন ছিলো। তাদের কমান্ডিং অফিসার বারবার তার মহাপচালিকের কাছে অনুমতি চাইছিলো একশানে যাওয়ার। কিন্তু হায় অনুমতি মিলেনি। ঐ অফিসারকে দেখেছি দাঁত কিড়মিড় করে বার বার তার মহাপরিচালকের কাছে বলছে ----
“স্যার, পারমিট মি ... ... পারমিট মি।” যদি অনুমতি মিলতো তাহলে এত অফিসারের প্রাণহানি হত না। অধিকাংশ গুলিবিদ্ধ অফিসারকে উদ্ধার করে বাঁচানো সম্ভব ছিলো। অনেক অফিসার গুলিবিদ্ধ হয়েও রাত পর্যন্ত জীবিত ছিলো। জীবিত অবস্থায়ই তাদের মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিলো। র্যাবের নিজস্ব সোর্সে আগেই খবর পেয়েছিলো এবং প্রস্তুতি নিয়েই পিলখানা গেটে অবস্থান নিয়েছিলো সকাল সাড়ে আটটায়। গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসএমজি’র গুলির আওয়াজ শুনেছে। র্যাবের ঐ দু'টো টিমই যথেস্ট ছিলো ভিনদেশী ১২ জন হায়েনাকে প্রতিহত করার জন্যে । এতো এতো ট্যাঙ্ক, কামান আর হেলিকাপ্টারের কোন দরকার ছিলো না। সেদিন র্যাব-১ যদি এ্যাকশানে যেতে পারতো সারা দুনিয়ার সামনে পিলখানার ঘটনার ভিন্ন কিছু উন্মোচিত হতো ।
আপনারা বিভিন্ন মিডিয়ায় যে সব ঘটনা, পৈচাশিক ঘটনার কথা শুনেছেন বা বর্ণনা পড়ছেন তা' আমার দেখার সাথে মিলে না। ছবিগুলো দেখে কি আপনারা বলতে পারেন, যাদেরকে মারা হয়েছে তারা পাগল পশু ছিলো নাকি যারা এভাবে মেরেছে তারা পাগল, পশু ছিলো ???
নীচের প্রথম ছবিটি ডিজি শাকিলের। যাকে জীবিত অবস্থায় মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিলো । যার কারনে তার চোখ দু'টি বের হয়ে আসছিলো (সি.এম.এইচ.-এর এক ডাক্তারের অভিমত) গুলি খাওয়ার পর অনেকে জীবিত ছিলো যারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মাটি চাপা দেওয়ার পর। শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেলে মানুষের চোখ বেরিয়ে আসে।
(ছবিটা দেখুন; পৈচাশিকতা এবং নৃশংসতার মাত্রা কোন পর্যায়ের হতে পারে ।)
২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯।।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পিলখানায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা । বাংলাদেশ রাইফেলস এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ সহ ৫৭ জন বিভিন্ন পদবির চৌকশ সেনা অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় । হত্যাকারীরা মহাপরিচালক শাকিলের বাসস্থানে তাঁর স্ত্রীর উপর নারকীয় পৈশাচিক নির্যাতনের পর তাঁকেও হত্যা করে। কতিপয় দেশদ্রোহীর সহায়তায় পিলখানার দরবার হল থেকে সেনা অফিসারদের বাসস্থান পর্যন্ত অকাতরে গুলি চালিয়ে হত্যা, স্ত্রী সন্তানদের উপর পৈশাচিক নির্যাতন, হত্যার পর লাশ ড্রেনে ফেলে দেয়া, মাটি চাপা দেয়া এবং পুড়ে ফেলার মত ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এই জাতির প্রতিটি সন্তান সেদিন এই আকস্মিক অভাবনীয় হত্যাযজ্ঞের শোকে দুঃখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে ।
নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। সে ঘটনায় মারা যায় তৎকালীন পুলিশের আইজি নূর মোহাম্মদের সদ্য বিবাহিত একমাত্র মেয়ের জামাতা (ক্যাপ্টেন)। বিপদের সময় মানুষ কতটা অসহায় হয়ে যায়, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে । তিন বাহিনীর প্রধানের সামনে আইজিপি নূর মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রীর পা ধরে আকুতি জানিয়েছিলো তার একমাত্র মেয়ের জামাই ও মেয়েকে উদ্ধারের জন্যে। প্রধানমন্ত্রী তাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “তোমার পদবীর সাথে এমন ইমোশান মানায় না। তোমার মেয়ে ও জামাইর কিছুই হবে না।“ তার মেয়ে নির্যাতিত হয়ে জীবিত বের হতে পেরেছিলো বটে তবে মেয়ের জামাতা নৃশংসভাবে মৃত্যু বরন করেছিলো।
সেদিনের সেই শোকাহত পরিবাররের মানুষ গুলোর হৃদয়ে এখনও রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। এ' ঘটনার পর আজও বিবেকবান সকলের মনে প্রশ্ন , বিশেষ করে দেশ প্রেমিক চিন্তাবিদ ও সামরিক বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন ----
এই হত্যাযজ্ঞ কি মিউটিনি নাকি আভ্যন্তরীণ এবং বহিঃ ষড়যন্ত্রেরই কোন অংশ! ঘটনার প্রেক্ষাপট, স্থান, ঘটনার গভীরতা, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন, ঘটনা পরবর্তী সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম এবং মিডিয়ার প্রভাব অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই লেখায় আমি শুধু সেই সময়ের নিজের দেখা ঘটনার একটা ক্ষুদ্র অংশ প্রকাশ করলাম। ঘটনা সামনে থেকে দেখে নিজের কিছু প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজছি ।
এই প্রসঙ্গে বলা দরকার ----
প্রিয় পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই রৌমারীর ঘটনা মনে আছে ।
২০০১ সালের ১৮ই এপ্রিল রাতে বাংলাদেশের বেশ কিছু ভুখন্ড দখলের উদ্দেশ্যে রাতের আঁধারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রৌমারীর বড়াইবাড়ি গ্রামে প্রবেশ করেছিলো দশ প্লাটুন বিএসএফ। তৎকালীন বিডিআর-এর মহাপরিচালক আ ল ম ফজলুর তৎক্ষনাৎ আদেশ দিলেন কাউন্টার অ্যাটাকে যেতে। সেই রাতে মাত্র বিডিআর-এর দুই প্লাটুন সৈন্য গ্রামবাসীদের সাথে নিয়ে বিএসএফ উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দু'দিন যুদ্ধ চলে । ফলাফল !
আপনারা পত্রিকায় দেখেছেন বিএসএফ -এর ২২জন, কোন পত্রিকায় ৪০ কোন পত্রিকায় ৭০জন কিংবা ৮০ জন এমন কি কোন কোন কোন মিডিয়ায় ১৩২ জন নিহত হওয়ার খবর বেরিয়েছে । বিএসএফ নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ভারত সরকারও যেমন বোধগম্য কারনে গোপন করেছে তেমনি বাংলাদেশ সরকারও প্রকাশ করেনি । ওই ঘটনার পরের দিন অফিসিয়াল কাজে বুড়িমারী গিয়েছিলাম। কাজ সেরে দুপুরের পরে স্থানীয় এক ছেলেকে সাথে নিয়ে রৌমারী বিডিআর ক্যাম্পে যাই। সেনাবাহিনীর যে দু'জন অফিসারের নেতৃত্বে কাউন্টার অ্যাটাক হয়েছিলো তাদের মুখে ঐ রাতের কথা ঘটনার বর্ণনা শুনি। তাদের কথার সারসংক্ষেপ হলো এই বিজয়ের মূল ক্রেডিট বড়াইবাড়ী গ্রামবাসীর। গ্রামবাসীরা বিডিআর - এর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিএসএফ কচুকাটা করে। বড়াইবাড়ির বিডিআর -এর সাথে সেই রাতে যুক্ত হয়েছিলো জামালপুর থেকে কর্নেল শায়রুজ্জামানের নেতৃত্বে অতিরিক্ত ফোর্স। ঐ দুই অফিসার এবং গ্রামবাসীদের ভাষ্য অনুযায়ী তিন ট্রাক বিএসএফ -এর মৃতদেহ বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে খুঁজে খুঁজে সরিয়ে নেয়ভারতীয় বাহিনী । আর বাংলাদেশ সীমান্তের বেশ ভেতরে বিএসএফ-এর ১৬ টি মৃতদেহ পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে সামরিক নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয় । সব মিলে বিএসএফ-এর মোট লাশের সংখ্যাটি আশা করি আপনারা অনুমান করতে পারছেন।
রাতের আঁধারে অপরিচিত টেরিটোরিতে ঢুকে বিএসএফ বিডিআর-এর অতর্কিত অ্যামবুশে পড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিলো। সেইসাথে গ্রামবাসীর দা' কুড়ালের আক্রমনের শিকার হয়েছিলো। দু'দিনের যুদ্ধে বাংলাদেশের বেশকিছু গ্রামবাসী ও কয়েকজন বিডিআর আহত হয়েছিলো। কিছু ঘর বাড়ি ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছিলো । এই ঘটনায় দুইজন দেশপ্রেমিক বিডিআর আর দুইজন গ্রামবাসী শহীদ হয়েছিলো সেদিন। এর মাত্র কয়েকদিন আগে বিএসএফ-এর সাথে সিলেটের পদুয়া সীমান্তের যুদ্ধে ১৫ বিএসএফ নিহত হয় । এই দু'টি যুদ্ধের জের ধরেই তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক আ ল ম ফজলুর রহমান পরবর্তিতে চাকুরী হারিয়েছিলেন। এর পরপরই ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী যশবন্তু সিং তাদের পার্লামেন্টে হুংকার ছেড়ে বলেন ----
এর বদলা নেয়া হবে । বাংলাদেশের বিডিআর হেড কোয়ার্টার বম্বিং করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে ।
আজও মনের ভেতর আরো কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। যার উত্তরগুলো এখনো আমাদের অজানা। এই ঘটনার পুনঃতদন্ত হলে এইসব প্রশ্নগুলো সামনে আসবেঃ
১। আমার মত একজন সাধারন নাগরিক যখন সকাল ৯টার এর মধ্যে জেনে যায় ৩৭ জন অফিসার মারা গেছে সেখানে সকাল ১১টায় প্রধান মন্ত্রী কি করে সাংবাদিকদের বলেন, পিলখানার অভ্যন্তরে হতাহতের কোন খবর জানেন না !
২। পিলখানায় মুল হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় মাত্র ১২ জন। যারা ৯:১৫ মিনিটের মধ্যে পোশাক পরিবর্তন করে বের দেয়াল টপকিয়ে হাজারীবাগ এলাকা দিয়ে বের হয়ে যায়। তাদেরকে ২টি এ্যাম্বুলেন্সে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেয়া হয়। দু'টো পুলিশের গাড়ি এস্কট করে তাদের বিমান বন্দরের ভিআাইপি গেট দিয়ে ঢুকানো হয়। কার নির্দেশে সেই দিন বিমানে ফ্লাইট ৩০ মিনিট দেরি করেছিল ? কারা ওইদিন বিমান বন্দরের নিরাপত্তায় ছিলো ?
৩। সকাল ৭টায় রংপুর থেকে এক ডিজিএফাই-এর এক মেজর পিলখানায় তার বন্ধুকে ফোন করে বলেছিল -----
“বাঁচতে চাইলে পিলখানা থেকে এখনই বের হয়ে যা।” পিলখানার অফিসারটি তাৎক্ষনাৎ বের হতে না পারলেও ঘটনার পরে জীবিত অবস্থায় বের হয়েছিলো । এই কথা বলছি এই কারনে যে ডিজিএফাই -এর একটা অংশ কি তা'হলে এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলো ???
৪। ঘটনার পরের দু'মাসের ভেতর কতজন অফিসার ক্যান্টমেন্টের অভ্যন্তরে অপঘাতে বা দুর্ঘটনায় মারা যায় ? একজন মারা যায় হেলিকাপ্টার এক্সিডেন্টে। এদের অধিকাংশই সারভাইবাল বা পিলখানা থেকে জীবিত ফেরত এসেছিলো। CMH -এ চিকিৎসারত অবস্থায় কয়জন অফিসারের স্মৃতিভ্রম হয়েছে ??? সেনাকুঞ্জে সেসব অফিসার প্রধানমন্ত্রীর সাথে উদ্ধত আচরন করেছিলো তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছিলো !
৫। সারা দেশ থেকে আগত কয়েক হাজার বিডিআর জওয়ানকে আটক করার পর ৬০ জনের মত জওয়ান হার্ট অ্যাটাকে বা গলায় গামছা পেঁচিয়ে মারা যায় !!! এরা কি ঘটনার পিছনের আসল ঘটনা জানতো ???
৬। কর্মরত ডিবি, র্যাব, পুলিশ বা ডিজিএফআই -কে ইনভল্ব না করে কি কারনে আবসরে যাওয়া ডিবির আবুল কাহার আকন্দকে ডেকে এনে এর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো ??? এই ফরমায়েশি তদন্তকারী কি হত্যার আলামতগুলো হেফাজত করেছেন নাকি চিরতরে শেষ করে দিয়েছেন?? সিসি টিভির ফুটেজগুলো কি সংরক্ষণে রেখেছেন নাকি আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছেন !!!
.
--------------------------
(লেখাটি সংগৃহীত )
বিষয়: বিবিধ
১৫৭৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন