নাজাতই গন্তব্য

লিখেছেন লিখেছেন ডব্লিওজামান ২৫ অক্টোবর, ২০১৩, ০৩:২০:০০ দুপুর



বারে বারে আজাদি পায় একেকটি জাতি। কিন্তু নাজাত পায় কি? আমরা ১৯৪৭ এ আজাদি পেলাম। ১৯৭১ এও পেলাম। নাজাত পেলাম না। বরং দুই বারই আজাদি আনলেঅলাদের জুলুমের শিকার হয়েছে গণমানুষ। ৪৭ এর মুক্তিযোদ্ধাদের চরিত্র সম্পর্কে সত্যনিষ্ঠ বয়ান লিখেছেন ভাই মরহুম শেখ মুজিবর রহমান। শেখ হাসিনার উদ্যোগে বের হওয়া 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে এর বিবরণ আছে।

শেখ মুজিব আর বেচে নাই বলে ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা লেখা হয় নাই। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'কে সমাপ্ত করতে পারলে নিশ্চয় তিনি লেখতেন। তবে তিনি বলে গেছেন, এরা চাটার দল। মানে কম্বল চোর। যারা শেখেরটাও পর্যন্ত চুরি করেছিল।

তাও সেই সময় কিছু লোক ছিল যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছে। কিন্তু এই বারের মুক্তিযুদ্ধঅলারা তো বাটপার। স্রেফ ১৯৭১ এর ৯টা মাস ইনডিয়ায় আশ্রিত ছিলো। এতেই যেন তাদের মধ্যে ৯ মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঞ্চার হলো। যেই চেতনাকে ৪২ বছরে লালন-পালন করে এখন বটবৃক্ষে পরিণত করেছেন। বটের ডালেপাতায় ঝুলেঝুলে চেতনাঅলারা কিচিরমিচির করে। তারা এদেশের মানুষকে গুলি করতে বলে, তাদের ধর্মকে গুড়িয়ে দিতে বলে এবং নিজেরা দালানকোঠার আরামের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিতে চায়।

সত্যি কথা কি যে আজাদি, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ নাজাত দিতে পারে না তার চেতনা হলো গণবিরোধী চেতনা। ওই চেতনাকে প্রতিরোধ করা কর্তব্য। চোর ডাকাতকে যতখানি প্রতিরোধ করতে হয় তার কয়েকশ' গুন বেশি প্রতিরোধ করতে হয়। কারণ এতে আছে আবেগ ও মিথ্যার বেসাতি।

২.

এই কথাগুলান লেখতেছি আজকের দিনটাকে খেয়াল রেখে। দেখতেছি লক্ষ্য কোটি জনতার কাছে এই শুক্কুরবারকে আজাদির দিন মনে হচ্ছে। তাদের উচ্চারণ ও ভঙি আমাকে ভাবতে বাধ্য করে গত পাঁচটা বছর আওয়ামী লীগ মানুষকে কী নিপীড়নই না করেছে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দিন মানে ১৬ ডিসেম্বর যেমন মানুষ উল্লাস করেছে, তেমন একটা উল্লাসধ্বনিকে সারা দেশে উচ্চারিত হতে শুনছি যেন।

যে ছেলেটা নামাজ পড়ে, যে মেয়েটা বোরকা গায় দেয়, যেই বুড়ো লোকটা মাওলানা সাঈদীর বিদেশ থেকে শ্রমিক পোলার পাঠানো মোবাইল ফোনে সাঈদীর ওয়াজ শুনে সেই সব লোকেরা আজ উল্লাস করতেছে।

আজাদি পেয়েছে বলে মনে করছে সেই সব লোক। যারা ভাবে ক্ষমতার গুটি বদলে যাবে। তারা ক্ষমতার শরিক হবে। তাদের উপর অনাচার-জুলুম বন্ধ হবে। তারপর তারা আবার ক্যারিয়ারিস্ট হয়ে যাবে।

নাজাতের উল্লাসে উন্মত্ত হবে বিএনপি-যুবদল-ছাত্রদলের লোক। তারা পাঁচ বছরের জন্য দেশটার বরাদ্দ পাবে। চেটেচুষেই খেয়ে ফেলবে যেন দেশটা। আহা কতো মানুষ যে তরতর করে গাছের ডালে উঠার স্বপ্নে বিভোর।

৩.

আমি এটা স্বীকার করি যে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কোনো উল্লাস নাই। তাদের স্বজনদের ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

আমি যদি বলি যে জামায়াত-শিবির-হেফাজতের শহীদদের স্বজনরা উল্লাস করছে তবে মিথ্যা বলা হবে। তারা এই শুক্রবারের সকালটাতে স্মরণ করছে স্বজনদের। যাদের লাশ তারা নিজ হাতে কবর দিয়েছ, এরপর নিজেরাও পালিয়ে বেড়িয়েছে।

আহা, চিন্তা করা যায় বাপ-মা ছাড়া গ্রামের সেই এতিম শিশুটার কথা। যে হয়তো কোনো এক এতিমখানার লিল্লা বোর্ডিংএ থাকতো। নজরানা শেষ করে সবে মাত্র হেফজ শুরু করেছে। যে রাস্তায় হাটতো আর মাথাটা নিচের দিকে দিয়া সাতসবক ইয়াদ করতো। তার কণ্ঠের কেরাত শুনে অনেক বুড়ো লোক চোখের পানি ফেলে দিতো।

আমরা কি জানি যেই ছোট্ট ছেলেটার গলাটাকে ঢাকার পিচঢালা রাস্তার সাথে বড়ো বড়ো বুট জুতা দিয়ে যখন চেপে ধরা হয়েছিলো, তখনও যে শিশুটা কেরাত পড়েছিলো কি না।

আমরা জানিনা সেই মুয়াজ্জিনটার কী খবর যে পবিত্র কুরআন মুখাস্ত করার পরেও এদেশের একজন গার্মেন্টস কর্মীর বেতনের সমান বেতনের একটা চাকরি পায়নি। তিন বেলা খেতো, আর পাঁচ বেলা আজান দিতো। রোজার ঈদে গ্রামের মায়ের জন্য যাকাতের কাপড়, আর কোরবানির ঈদে কিছু গোশতের টুকরা নিয়া যাইতো।

এমন একটা ছেলে, নবীজীর (সা.) সম্মান রক্ষায় ঢাকায় এসেছিল। ওর লাশটা কোথায়? ওর কেন জানাযা হলো না। ওর শরীরে কেন ঢাকাবাসীরা একটা পরিষ্কার কাফনের কাপড়ও পড়াতে পারলো না। কেন ৩০ টাকা গজের পলিস্টার কাপড়ের পাঞ্জাবী আর পাজামা গায়ে জড়িয়েই তার দাফন হলো?

আমরা কী বলবো? আমরা তো হাড্ডিগুড্ডির খবর জানিনা। আমরা তো বলতে পারি না যারা কুরআন-হাদীস পড়ে তাদের কঙ্কাল কিভাবে ময়লার ডিপোতে পাওয়া যায়। তাদের আমরা হত্যা করতে পারি, তাই বলে কি তালবে এলেমদের লাশের বেইজ্জত করতে পারি আমরা?

৪.

আমি বলবো জালেমের পতন দেখে উল্লাস করার নাম আজাদি হতে পারে, তবে এতেই নাজাত মেলে না। নমরুদ-ফেরাউনসহ সব জালেমই প্রকৃত প্রস্তাবে দুর্বল। তাদের পতন অনিবার্য। এতে নাজাত পাওয়ার কিছুই নাই।

এটা অনেকেই বুঝতে চান না। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবর রহমানকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করাকেই অনেকেই নাজাত মনে করেছিলেন। সেদিন তারাও উল্লাস করেছিলেন। তারা এখনো মানতে চান না যে মুজিব হত্যা বেঠিক ছিলো।

ব্যক্তিকে হত্যা করলে বা ব্যক্তি ক্ষমতা থেকে চলে গেলে যে মুক্তি ঘটে তা নাজাত নয়। তাহলো ওই ব্যক্তির জুলুমের অবসান জনিত রেহাই। জালেম থেকে মুক্তি চাওয়ার কিছু নাই। কারণ জালেমের পতন একটা বায়োলজিক্যাল নিয়তি ও সামাজিক বাস্তবতা। আমরা জুলুমতন্ত্র থেকে মুক্তি চাই।

এটা চাইতে হলে জালেমকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়না। গুরুত্ব দিতে হয় জুলুমতন্ত্রকে।

এই জুলুমতন্ত্র জিনিশটা কি? খেয়াল করে দেখবেন শেখ হাসিনা বিদায় নেবে। তার দলের ক্যাডাররাও। কিন্তু যেই পুলিশ গুলি চালাইছে, তারা থেকে যাবে। যেই শিক্ষকেরা ছাত্রলীগের হাতে গোপণে তালিকা দিয়া বলছে এরে কোপাও ওরে কোপাও তারাও থেকে যাবে।

এভাবেই থেকে যাবে সমাজের রন্ধে রন্ধে পুষ্ট হওয়া জুলুমতন্ত্রের নাটবল্টুরা। খোদ জুলুমতন্ত্রটাই থেকে যায় বলে এদের দরকারি মনে করে বাদ দেয়া হয়না। ক্ষমা করা হয়। এই ক্ষমা পেয়ে ওরা রেহাই পায়, রসদ পায়, অপেক্ষা করে আবার আঘাতের জন্য। ফের আঘাত হয়, আজাদিই টুটে যায়।

৫.

আমি মনে করি বিএনপি-জামায়াত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে আজাদি কায়েম করতে যাচ্ছে তাকে সর্বাত্মক সমর্থন দিতে হবে। সবাইকে আন্দোলনে নামতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ক্রেডিটটা যেনো আওয়ামী লীগের মতোই শুধু বিএনপি-জামায়াতই নিতে পারে। এটার মালিকানা যেন সবাই নিতে পারি এই রকমভাবে মাঠে নামুন।

তারপর মুক্তিযুদ্ধ শেষে আজাদি পাওয়ার পরে আওয়াজ বুলন্দ করুন। নাজাত পাওয়ার লড়াইকে সম্ভবপর করে তুলুন। যেন বিএনপি-জামায়াতের আমলে আমরা সামাজিক ও নাগরিক লড়াইটা বিনা বাধায় করতে পারি। যেন ওই সময়ে জুলুমতন্ত্রের নাটবল্টুরা আমাদের ডিস্টার্ব না করে।

আমরা যদি আপাতত নাগরিকের জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার জিনিশটাই কায়েম করতে পারি তবে তা হবে অনেক বড় কাজ। এখানে নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার জরুরি। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা দরকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দরকার। নিরাপত্তা দরকর। এসব হলে এদেশে ব্যাপক আকারে ইসলামী আন্দোলন করাটা সহজ হবে।

মনে রাখতে হবে এখানকার সেক্যুলারদের সাথে লড়াই করার কোনো ব্যাপার নাই। এই পরজীবীরা বিরক্তিকর। আসল লড়াইটা পুঁজিতন্ত্রের সাথে, সাম্রাজ্যবাদের সাথে, সম্প্রসারণবাদের সাথে। কাজেই এসবকে যতদ্রুত রাজনৈতিকভাবে অবিরক্তিকর পর্যায়ে নামিয়ে যায় ততোই ভালো।

সমাজকে সত্যি সত্যি প্রগতিশীল করে তোলা গেলে সেক্যুলার প্রতিক্রিয়াশীলদের পতন ঘটবে। ওরা না জেনেই তো এখন দেশের উপরিকাঠামোতে গিয়ে রাজত্ব করছে। যখন সমাজকে বিকশিত হতে দেওয়া হবে তখন এরা আপনাআপনি অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে।

৬.

আমরা এমন নাজাত চাই, যখন খুনীরা সব অনুশোচনা করতে করতে এসে পা ধরবে আর বলবে হে ভাইয়েরা, হে বোনেরা আমাদেরকে কিসাস করে করে তোমরা দোযখ থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ দাও।

সেই দিন আমরা হয়তো দিয়ত, কাফফারা নিয়ে তাদের ক্ষমা করে বুকে টেনে নেবো। বা কিসাসের দাবি পূরণ করেও অনেকে সন্তুষ্ট থাকবেন যে আখেরাতের মুক্তি তো মিললো।

নাজাত হলো অপরাধীর মধ্যে অনুশোচনা ও অপরাধের কাফফারা দেওয়ার অনুভূতি জাগ্রত হওয়া, মজলুমদের হৃদয়ে এহসানে জন্ম নেয়া। সেই গন্তব্যে আমরা পৌছবো ইনশাআল্লাহ।

বিষয়: বিবিধ

১০৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File