জাতির পিতা মূল্যায়নে ঈদুল আযহা/কোরবানির ঈদ

লিখেছেন লিখেছেন ডব্লিওজামান ১৩ অক্টোবর, ২০১৩, ০৪:৪৯:৫২ রাত

ওয়াহিদুজ্জামান :

ছোট বেলা থেকেই মুসলমানদের জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)’র মনে অশান্তি মানুষের উদ্ভট আচরণ দেখে । তাঁর বাবা আজরও তাই করে, মানে নিজ হাতে গড়া মূর্তির পূজা! কিন্তু ছোট্ট ইব্রাহীম (আঃ)’র বিবেক তা সায় দেয়না। তিনি নিজ জ্ঞানে স্রষ্টা খোঁজছেন । রাতে এক নক্ষত্র দেখে ভাবেন এটা বড়, এই হবে আমার স্রষ্টা। কিন্তু তা এক সময় ম্লান হয়ে গেলে তিনি ভাবেন-- না ; যা ম্লান হয়ে যায় তা স্রষ্টা হতে পারেনা। এভাবে চাঁদ, সূর্য ও এক সময় অস্তমিত হয়ে গেলে তিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও প্রকৃতি থেকে হতাশ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন, « যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন তবে অবশ্যই আমি বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। এরপর তাঁর সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা যে সব বিষয়কে শরীক কর, আমি ঐসব থেকে মুক্ত । আমি একমুখী হয়ে স্বীয় আনন ঐ সত্তার দিকে করেছি, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিক নই।« (সূরা আল আনআম ৭৪ থেকে ৭৯ আয়াতের সারমর্ম ) …………………… অবশেষে তাঁর কাঙ্ক্ষিত স্রষ্টাকে খোঁজে পান ।

এরপর নামেন সমাজকে বুঝানো ও সংশোধনের চেষ্টায়। তাদেরকে কিছুতেই বুঝে আনতে না পেরে অবশেষে একদিন অন্যদের সঙ্গে শহরের বাইরে মেলায় না গিয়ে তিনি সবচেয়ে বড় মূর্তিটি বাদে সবগুলো ভেঙ্গে বড়টার কাঁদে কুড়াল ঝুলিয়ে রাখেন। সমাজপতিরা এ কাণ্ডের জন্য হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে দায়ী করেন। তাঁর কাছে এলে তিনি বলেন, ঐ বড় মূর্তিটাই এ কাজ করেছে । ওঁকে জিজ্ঞেস করেন। ( ধর্মের উপর আঘাত করা তার উদ্দেশ্য ছিলনা । ইসলাম কখনো অপর ধর্মে আঘাত অনুমোদন করেনা । অবস্থার প্রেক্ষিতে সেই ছোট্ট বয়সে যুক্তিতে তাদেরকে বুঝাতেই তিনি এ রকমটি করেছিলেন। ) তারা বলে, ওই তো হাঁটতে,বলতে এবং কোনও কাজ করতে পারেনা ! তখন তিনি বলেন, তাহলে কেন তাদের প্রভু মনে করে পূজা করেন । এ সব ঘটনা ও নানান যুক্তিতে পরাস্ত হয়ে এক পর্যায়ে সমাজপতিরা তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী এক বিরাট অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হয়। আগুনের লেলিহান শিখার কারণে কাছ থেকে নিক্ষেপ করতে না পেরে অবশেষে চড়ক গাছের মাধ্যমে তাকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলা হয়। দীর্ঘ সময় জ্বলার পর দেখা গেল হযরত ইব্রাহীম (আঃ)’র একটি লোমকুপও জ্বলেনি ……………………… !!!

‘হযরত ইব্রাহীম (আ) এর জন্য নমরূদ বিশাল অগ্নিকান্ড তৈরি করেছে খবর পেয়ে টিকটিকি ছুটছে আগুন নেভাতে। পথিমধ্যে একজন তাকে জিজ্ঞেস করলো ও টিকটিকি কই যাও? টিকটিকি বললো নমরুদ ইব্রাহীমের জন্য আগুন জ্বালিয়েছে আমি যাচ্ছি সেটা নেভাতে। পথিক টিকটিকিকে ভৎর্সনা করে বললো, ‘তোমার মত এত ছোট টিকটিকি কিভাবে এত বড় আগুন নেভাবে?’ টিকটিকি বললো, আগুন নেভাতে পারবো না সেটা আমিও জানি কিন্তু আমার আল্লাহ তো জানবে ইব্রাহীমের বিপদে আমি ছুটে গিয়েছি, সত্যের পক্ষ নিয়েছি এটাই আমার বড় পাওয়া!’

এসব ঘটনার পর আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে নিজ শহর ছেড়ে তাকে প্যালেস্টাইনে বসতি গড়তে হল। যৌবনে বিবি সারাহকে বিয়ে করেন। বিয়ের বেশ কয়েক বছরেও তাদের বাচ্চা না হওয়ায় স্বামীকে রাজি করিয়ে হাজেরা নামে একজনকে বিয়ে করান । এই হাজেরার গর্ভে ইসমাইল (আঃ) নামে এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন । তখন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বয়স ৮০ বছর । এর কিছুদিন পর আল্লাহর নির্দেশ এল পরম আদরের শিশু ইসমাইলসহ হাজেরাকে নির্বাসন দিতে। এ নির্দেশ পেয়ে প্রাণের স্ত্রী-পুত্রকে জনমানবহীন ধু-ধু বালু আর উপরে আকাশ ছাড়া চারিদিকে আর কিছুই দেখা যায় না, এমন জায়গায় নির্বাসন দিয়ে এলেন …………… !!!

নির্বাসনে হাজেরার সঙ্গে আনা খাবার এবং পানীয় শেষ হয়ে এলো । এমনকি তাঁর বুকের দুধও শুকিয়ে এসেছে। পুত্রকে বাঁচাতে পানির খোঁজে বের হন। একবার সাফা পাহাড়ের দিকে আবার মারওয়া পাহাড়ের দিকে দৌড়ান । কোথাও পানি না পেয়ে ফিরে আসেন ইসমাইলের কাছে। এসে দেখেন ইসমাইলের পায়ের করাঘাতে শুষ্ক মরুভূমির বালু ভেদ করে পানির ফোয়ারা ছুটছে ! এ পানি ধরে রাখার জন্য চারিদিকে বাঁধ দিলেন। এটাই জমজম ! একে ঘিরে যে বসতি গড়ে উঠে তা আজকের এই মক্কা। এখানে হাজেরা ও ইসমাইলের ৭ বছর কেটে যায়। পুত্র মাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করে ………………… …………… ……… !!!

এরপর এক সময় আল্লাহর হুকুমে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাদেরকে ফেরত নিতে আসেন। এসে এই জায়গা চিনতে পারেন না । অবশেষে হাজেরাকে দেখতে পান ! সে এক মধুর মিলন ............. ............ ........ !

পুত্র স্নেহে অধিক কাতর হযরত ইব্রাহীম (আঃ) । এর মাঝে একদিন স্বপ্নে দেখেন আল্লাহ্ তাঁর কাছে কোরবানি চেয়েছেন । পরের দিন ১শ’ উট কোরবানি দেন। আবার একই স্বপ্ন দেখেন। পরের দিন আরও ১শ’ উট কোরবানি দেন। এরপর দিন দেখেন তোমার প্রিয়বস্তু কোরবানি দাও । তখন ভাবলেন, এই বুড়ো বয়সের পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) ই আমার সবচেয়ে প্রিয় । তাহলে তাকেই কোরবানি চেয়েছে । এই ভাবনাকে সত্যে রূপ দেয়ার মনস্থির করলেন। হাজেরাকে বললেন, ইসমাইলকে নিয়ে আমি জিয়াফতে যাব, ওঁকে সাজিয়ে দাও। যাওয়ার সময় হাজেরা বললেন, ওঁকে সব সময় সঙ্গে রাখবেন এবং তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আগেই দড়ি ও ছুরি লুকিয়ে নিয়েছেন । এ চিত্র দেখে ইবলিশ স্থির থাকতে পারেনি। সে সাধু সেজে হাজেরাকে ইব্রাহীমের ইচ্ছার কথা বলে। বিশ্বাস করাতে না পেরে বলে- আল্লাহর হুকুমে তা করতে যাচ্ছে। তখন হাজেরা বলে, তাহলে তো আমার সৌভাগ্য ! এরপর ইসমাইল (আঃ)’র কাছে এসেও বিশ্বাস করাতে না পেরে তাকেও আল্লাহর নির্দেশের কথা বলে। তখন ইসমাইল (আঃ) বলেন, এতো ছেলের মধ্যে যদি আল্লাহ্ আমাকে পছন্দ করে থাকে তাহলে তো আমার সৌভাগ্য ! ইসমাইল (আঃ) বুঝতে পারে এটা শয়তান, তখন তাকে ৭টি পাথর ছুঁড়ে মারে । ( যা হাজীদের করতে হয়) ……………………

মিনায় উপস্থিত হয়ে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ছেলেকে স্বপ্ন ও তাঁর ইচ্ছার কথা বলেন। ছেলে উত্তর দেন, আমি ধৈর্যশীল থাকবো এবং সৌভাগ্যবান । ছেলের উত্তর শুনে ইব্রাহীম (আঃ) উথলে উঠেন কিন্তু আবেগ দমন করে শক্ত হন………………………। এরপর ছেলে বলল-- আব্বা আমার হাত, পা বেঁধে নিবেন যেন রক্ত আপনার গায়ে ছিটে না যায় । আর উপুড় করে নিবেন যেন আমাকে দেখে আপনি দুর্বল হয়ে না পড়েন । আর আমার রক্তমাখা জামা আমার মাকে দিবেন, যেন তিনি সান্তনা পান। ছোট্ট শিশুর বুদ্ধিমত্তা, শ্রদ্ধাবোধ ও আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস দেখে ইব্রাহীম (আঃ)’র বুক ভরে গেল । কান্না সংবরণ করে পুত্রের ইচ্ছামত হাত, পা বেঁধে উপুড় করে ছুরি চালালেন । কিন্তু কাটেনা । রাগ করে ছুরি ফেলে দিলে পাথর দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। ……………………………………… ,ইসমাইল (আঃ) কোরবানির অপেক্ষায় নিশ্চল, নিশ্চুপ শুয়ে আছে । এ দৃশ্য দেখছে মিনার বিশাল শূন্য প্রান্তর, ধু-ধু মরুভূমি, তপ্ত হাওয়া …………………………… ইব্রাহীম (আঃ) ছুরি কুঁড়িয়ে এনে আবার চালালেন। কিন্তু চলেনা । ইসমাইল (আঃ) বলেন, আব্বা আমায় দেখে মনে হয় আপনার অন্তর কাঁদছে, তাই ছুরি চালাতে পারছেন না । আপনার চোখ বেঁধে নিন। ছেলের কথা মত চোখ বেঁধে নিয়ে ছুরি চালালে তখন ছুরি চললো । ইব্রাহীম (আঃ) এতে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ্ । চোখ খুলে দেখে তাঁর সামনে দুম্বা পড়ে আছে । আর ইসমাইল (আঃ) দাঁড়িয়ে আছে জিব্রাইলের সঙ্গে । তখন জিব্রাইল (আঃ) বললেন, আল্লাহর চূড়ান্ত পরীক্ষায় আপনি উত্তীর্ণ হয়েছেন। আল্লাহ্ তা’আলা পুত্রের বদলে দুম্বা পাঠিয়েছেন ………………………………।

এরপর পিতা পুত্র ক্বাবাঘর নির্মাণ করে তারা দোয়া করলেন, « হে প্রতিপালক আপনি আমাদেরকে এবং আমাদের বংশের একটি দলকে ‘মুসলিম’ (ইসলামের অনুগত) বানিয়ে দিন। আমাদের মধ্য থেকে আপনি এমন একজন রাসুল প্রেরণ করুন, যিনি মানুষদেরকে আপনার বাণী শুনাবে, জ্ঞান দান করবে এবং তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করবে ।

তাদের সেই স্মৃতিকে স্মরণ করা হয় হজ্জ ও কোরবানির মাধ্যমে।

শিক্ষা :

ছোট্ট পরিসরে শিক্ষার বিশেষ যে দিকটি উল্লেখ করবো তা হল :-

 কারো কাছ থেকে বা কোন উপায়ে তৌহিদের দাওয়াত না পেয়ে থাকলে কিভাবে সৃষ্টিকর্তা/প্রভুকে খোঁজে বের করতে হয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ । কারণ এ পৃথিবীর সব এবং আপনি আমি এমনিতেই সৃষ্টি হয়নি …………. কেউ একজন কারিগর অবশ্যই আছে ।

 সর্বাবস্থায় সবচেয়ে প্রিয়বস্তু সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে কোরবানী ও সকল ধরনের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকা ।

 পরাকাষ্ঠার শতভাগ পেশ করাতেই তিনি খলিলুল্লাহ ও মুসলিম জাতির পিতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন।

 পশু কোরবানির মাধ্যমে ঈদুল আযহা’র যে মৌলিক শিক্ষা নিহিত তা শুধুমাত্র জাগতিক অর্থে কিছু অর্থের কোরবানি নয় ; সেক্ষেত্রে রয়েছে হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতাসহ সকল প্রকার অনৈতিক লোভ-লালসার কোরবানি এবং সর্বোপরি হযরত ইব্রাহীম (আঃ)’র স্মৃতির অনুরণন।

 জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়,

« পাওনি শান্তি, আনন্দ প্রেম জানি আমি তাহা জানি

তোমার অর্থ ঢাকিয়া রেখেছে তোমার চোখের পানি

এ টাকা তোমার রবে না বন্ধু জানি,

এ লোভ তোমারে নরকে লইবে টানি,

চাহিব ভিক্ষা তোমার সর্ব লোভ ও অহংকার …….. … .

আজ আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন

ওরে হত্যা নয় আজ সত্য গ্রহ শক্তির উদ্বোধন «

 ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ বলেন,

যতদিন না কায়েম হবে, খোদার ধরায় তাঁরই দ্বীন

কোথায় আবার ঈদের খুশী, সেই অনুষ্ঠান অর্থহীন।

প্রিয় পাঠক, পশুর উপর দিয়ে যাওয়া আমাদের এ কোরবানিও কি তার কাঙ্ক্ষিত মানের আদায় হয় ? আমাদের এ টাকার উৎস, কোরবানির নিয়মাবলী, মাংসের বণ্টন, চামড়ার ব্যবহার, এ উৎসবকে ঘিরে নানা অসাধু ব্যবসা……………………………………… আপনি, আপনার বিবেককে জিজ্ঞেস করুন ; মিলিয়ে দেখুন আপনার হজ্জ, কোরবানি এবং ইসলামের চাওয়া ! এরপর এই মুহূর্ত হতে চেষ্টা করি ও করুন খাঁটি মুসলমান হওয়ার ।



বিষয়: বিবিধ

২৩২২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383904
০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ দুপুর ০৩:৫৬
হতভাগা লিখেছেন : আপনার পোস্ট সবাই পড়ে । কিন্তু কমেন্ট করার মত সাহস পায় না ।
১১ আগস্ট ২০১৯ সকাল ০৫:২৪
318406
ডব্লিওজামান লিখেছেন : তাহলে বলবো, তারা আমার সংশোধন ও ভালো চায় না।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File