সশস্ত্র প্রতিরোধে বাঙালি নারী (বৈদিকযুগ থেকে উনিশ শতক )
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ০২:৫২:২৪ দুপুর
সশস্ত্র প্রতিরোধে বাঙালি নারী (বৈদিকযুগ থেকে উনিশ শতক )
যুদ্ধক্ষেত্রে (War field) বাঙালি নারীর ভূমিকা বিরল। সঙ্গত কারণেই যোদ্ধানারীর তালিকাও ছোট। তবে সশস্ত্র প্রতিরোধ ও প্রতিবাদে বাঙালি নারীর অভিজ্ঞতা বৈচিত্র্যময়। যুগে যুগে তারা যেমন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, অত্যাচারী শাসক-প্রশাসকের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে কিংবা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অস্ত্রধারণ করেছে, তেমন অভ্যন্তরীণ শত্রু, নারীসম্ভ্রম হরণকারী একক পুরুষ বা অঞ্চল বিশেষের পুরুষশক্তির বিরুদ্ধেও অস্ত্রহাতে রুখে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তা রক্ষায় গ্রামীণ নারীদের দেশী অস্ত্রের ব্যবহার প্রাচীনকালের। কিন্তু ইতিহাস ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে একীভূত করে বিচার করলে দেখা যায়, বাঙালি নারীচরিত্র আদৌ যুদ্ধংদেহী নয় বরং তুলনামূলকভাবে বিনম্র-সংবেদনশীল। পুরুষের সহায়তা ছাড়া এরা সাধরণত আক্রমণাত্মক পরিস্থিতির মোকাবিলা করে না। এ ব্যাপারে গ্রামীণ নারী তথা নিম্নবিত্তের নারীরা শোষণের বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত জঙ্গি মনোভাবাপন্ন।
রণাঙ্গনে সশস্ত্র বা যোদ্ধা নারীর কিঞ্চিৎ সাক্ষাৎ মেলে হিন্দুধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ-এ। এতে বলা হয়েছে, মৃদগলনী' (আক্ষরিক অর্থে যে নারী মুগুর ব্যবহার করতো) যুদ্ধে জয়লাভ করে। আর এক যুদ্ধের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যুদ্ধে একটি পা কাটা যায় বীরাঙ্গনা বিশপলার, হাত কাটা যায় বীর রমণী বর্ধিমতীর। শশিয়শী নামেও একজন বীরাঙ্গনা ছিলেন। পতঞ্জলী অস্ত্রধারিণী শক্তিকী’র উল্লেখ করেছেন খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে। কিন্তু এদের মধ্যে কেউ বাঙালি ছিলেন কি না তার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তবে মোগল আমলে বাঙলায় একজন যোদ্ধারীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
দক্ষিণ রাঢ়, ভুরশুট ও নিকটবর্তী পরগণাগুলি নিয়ে যে রাজ্য ছিল সেই রাজ্যের রাজবংশ ধ্বংস হয়ে যায় অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে। বাঙলার অন্যতম কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় এই রাজবংশেরই সন্তান। এই বংশের রানি ভবশংকরী উড়িষ্যার পাঠানদের সঙ্গে যুদ্ধ করে রাজ্য রক্ষা করেছিলেন। মোগল সম্রাট আকবর এজন্য তাঁকে উপাধি দিয়েছিলেন রায়বাঘিনী’। তিনি আরও বলেছেন, ভুরশুট এক কালে বাঙলার নবদ্বীপ ছিল বললে অত্যুক্তি হয় না। এ অর্থে অনুমান করা যায় যে, রায়বাঘিনী বাঙালি বা বাঙালি বংশোদ্ভুত মহিলা ছিলেন( বিধুভূষণ ভট্টাচার্যের বঙ্গ বীরাঙ্গনা রায়বাঘিনী' (১৯১৯) গ্রন্থের ভূমিকায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী )।
এরকম অনেক বীরনারীর পরিচয় পাওয়া যায় বাঙলার লোকজ উপাখ্যানে। একটি উপাখ্যান থেকে জানা যায়, কেল্লা তাজপুরের শাসক ওমর খাঁর মেয়ে এবং ফিরোজ খাঁর স্ত্রী সখিনা শৌর্য-বীর্যে সমকালে অতুলনীয়া ছিলেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যান। হতোদ্যম সৈন্যরা তাঁর বিক্রম দেখে তাৎক্ষণিকভাবে সংগঠিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মোগল বাহিনীর ওপর। যুদ্ধে সখিনা জয়লাভ করে পরিণত হন জীবন্ত কিংবদন্তিতে। এই উপাখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতা তথা ইতিহাসের সংশ্লিষ্টতা নেই এ কথা বলা যায় না। কারণ বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয় লৌকিক উপাখ্যান। সখিনার বীরত্বগাথা তারই একটি।
ইংরেজ শাসনামলের প্রথক দিকে বাঙলায় দু’পর্যায়ে সংঘটিত হয়েছিল চুয়াড় বিদ্রোহ। নারী সংগ্রামীদের অংশগ্রহণ স্পষ্ট ও প্রবল ছিল উভয় বিদ্রোহেই। এক পর্যায়ে নারীদ্রোহীদের তৎপরতায় প্রায় উদভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। কার্যত দুই দশকের জন্য ইংরেজ শাসনকে অচল করে দিয়েছিল চুয়াড় বিদ্রোহের বীর সেনানীরা মেদিনীপুরের নগর চন্দ্রঘোনা থেকে শুরু করে বাকুড়া, ধলভূম, ঘাটশীলা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায়। বিদ্রোহে সবচেয়ে তাৎপর্যময় ভূমিকা ছিল গ্রামের গরিব ঘরের মেয়েদের। তারা রাতের আঁধারে গুপ্তচরের কাজ করতেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কখনও যেতেন শত্রু শিবিরে এবং ইংরেজ বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত করতেন পাহাড়-জঙ্গলে অবস্থানরত সতীর্থদের। এ সময় ইংরেজ সেনাদের হাতে ধরা পরতেন অনেকেই এবং তাৎক্ষণিকভাবেই তাদের উপর শুরু হতো দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন। চুয়াড় বিদ্রোহের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইংরেজ সৈন্যরা ধৃত নারীদ্রোহীদের কাছ থেকে কখনও কোনো ব্যাপারে স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেনি, পায়নি বিদ্রোহীদের গোপন আস্তানার একটি সংবাদও । ইংরেজ বাহিনীর এই ব্যর্থতার কথা প্রকাশ পেয়েছিল তৎকালীন (১৭৭৪) বাকুড়া জেলার ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের লেখা একটি চিঠিতে।
দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গোবর্ধন সর্দার। তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষক তথা সংগ্রামী সহযোগী ছিলেন কর্ণগড়ের রানি শিরোমণি। এক পর্যায়ে বিদ্রোহীদের নেতৃত্বের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন শিরোমণি স্বয়ং। ১৭৯৯ সালে তিনি গ্রেফতার হন ইংরেজ সৈন্যদের হাতে, তাঁকে পাঠানো হয় মেদিনীপুর জেলে। রাণি শিরোমণি মারা যান ১৮২২ সালে।
নীল বিদ্রোহ বাঙালি কৃষক সমাজের সম্মিলিত সংগ্রামের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। এই বিদ্রোহের প্রথম পর্যায়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিতুমীর ওরফে সৈয়দ নিসার আলী। তিনি নারকেলবাড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজিত ও নিহত হন। অতঃপর বিদ্রোহকে অব্যাহত রাখার জন্য সক্রিয় নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন তিতুমীরের মা আয়েশা বেগম। একইসঙ্গে তিনি মেয়েদের আরবি ফারসিতে শিক্ষিত করে তোলার কাজেও আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
বস্তুত নীলবিদ্রোহ ছিল ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে গ্রামীণ কৃষক সমাজের বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের তুঙ্গ সময় মূলত এক বছরকাল স্থায়ী ছিল (১৮৫৯-৬০ খ্রি.)। এ সময় নীলকররা বাঙলার কৃষকদের নীল চাষে বাধা
করতো। প্রচলিত ফসলাদির পরিবর্তে নীল চাষ করে সারা বছর খাদ্যাভাবে কষ্টভোগ করতে কৃষকরা। স্বভাবতই নীল চাষ করে সেই ঘাটতি ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় কৃষকরা নীল চাষ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নীলকর তথা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ্ধ গণজাগরণ। এ প্রসঙ্গে সুপ্রকাশ রায়ের মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর ভাষায় :
নীলবিদ্রোহ ছিল গ্রামীণ বিপ্লবের প্রথম পদক্ষেপ। সামন্ত তথা ঔপনিবেশবাদ উচ্ছেদের প্রয়াসে এটা ছিল এক জাতীয় রাজনৈতিক
সংগ্রাম(সুপ্রকাশ রায়, বিদ্রোহী ভারত, কোলকাতা )।
নীলবিদ্রোহের বিস্তারভূমি ছিল গোটা বঙ্গদেশ। প্রধানত নদীয়া, ২৪ পরগণী, যশোর, খুলনা, পাবনা ও দিনাজপুর জেলা। এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন অসংখ্য নীল চাষী পরিবারের মেয়েরা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রষ্টব্য ভূমিকা রেখেছিলেন পিয়ারী সুন্দরী। তিনি ছিলেন কুষ্টিয়ার মিরপুর থানা এলাকার মহিলা জমিদার । নীলকরদের বিরুদ্ধে তিনি কৃষকদের সংগঠিত করেছিলেন এবং অবতীর্ণ হয়েছিলেন সম্মুখযুদ্ধে । নিজের জমিদারির স্বার্থে হলেও তাঁর এই সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল কৃষকদের জন্য, কৃষকদের নিয়ে। ১৮৬০ সালে তার বাহিনী যুদ্ধ করে নীলকর টমাস আইভান কেলির বাহিনীর সঙ্গে। কৃষক যোদ্ধাদের সম্মিলিত হামলায় পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন আইভান কেনি ও পাবনার ম্যাজিস্ট্রেট হ্যামডেন। কিন্তু নীলকরদের পক্ষ অবলম্বনকারী দারোগা মাহমুদ বখশ পলায়নের পথে কৃষকদের হাতে মারা যান। এরপরে আপাতত পরাভূত নীলকর কেনি পিয়ারী সুন্দরীর কাছে এই মর্মে সংবাদ পাঠান যে, নীলবিদ্রোহ প্রত্যাহার করলে তার বিরুদ্ধে দায়েককৃত মামলা প্রত্যাহার করা হবে। পিয়ারী সুন্দরী এই প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করে দেন। পরিণামে নিলামে ওঠে তার জমিদারি, তিনি স্বর্বশান্ত হন।
নীলবিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী অঞ্চলে গ্রামীণ নারীসমাজ গড়ে তুলেছিল প্রতিরোধের ব্যুহ, বহু প্রতিরোধ বাহিনী। তাদের মানসিক প্রেরণা ছিল পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, ঔপনিবেশিক গোলামির ক্রমবর্ধিত মর্মাহ আর হাতিয়ার বলতে ছিল দেশি অস্ত্রপাতি এবং অভিনব উপকরণ যেমন: দা, বটি, তীর-ধনুক, লাঠিসোটা, বেলফল, কাসা-পিতল ও পোড়ামাটির বাসন, মরিচের গুঁড়ো ইত্যাদি।
নীলবিদ্রোহের পাশাপাশি বাঙলায় ফরায়েজী আন্দোলনের সূচনা করেন ফরিদপুরের মীর মোহাম্মদ দুদু মিয়া। এই আন্দোনের অন্যতম অগ্রনায়ক ছিলেন এনায়েত খাঁ ও বেলায়েত খা। তাঁদের সঙ্গে সগ্রামে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের পরিবারের সকল নারী সদস্য। তাঁরাও শত্রুর সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলা করার জন্য মজুত রাখতেন দেশীয় হাতিয়ার ও উপকরণ। ১৮৩৪ সালে দুদু মিয়া মারা গেলে আন্দোলনরত নারীসমাজের সংগঠিত করার দায়িত্ব নেন হাজি শরীয়তউল্লাহর বিধবা স্ত্রী। আন্দোলনকারীদের আশ্রয়দান, সংঘর্ষে আহতদের সেবাশুশ্রুষা সর্বোপরি অস্ত্রপাতি সংগ্রহের কর্মকাণ্ড পরিচালনায়ও তিনি রেখেছিলেন দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা। এই অসম সাহসী মহিলার নেতৃত্বে সে সময় অসংখ্য মহিলা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তাঁদের এই লৌহদৃঢ় অবস্থান ভাঙতে বেসামাল হয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ সরকারের স্থানীয় প্রশাসন। ফরায়েজী আন্দোলনে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছিলেন অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী। দণ্ডপ্রাপ্তদের অনেকের মা এ সময় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। জবানবন্দিতে তারা ইংরেজ সরকারের করুণা বা অনুকম্পা প্রত্যাখ্যান করে পুত্রের ন্যায় সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়ে গৌরব প্রকাশ করেছিলেন।
উনিশ শতকের ষাটের দশকে বাঙলায় সূচিত হয়েছিল ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। প্রধানত ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় কর সংগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিলেন ফকির ও সন্নাসীরা। কিংবদন্তি আছে, এই সংগ্রামের অন্যতম প্রধান নেত্রী ছিলেন দেবী চৌধুরানী। জনৈক ভবানী পাঠক ছিলেন তাঁর প্রশিক্ষক।
ড. দীনেশচন্দ্র সেনের বর্ণনা অনুসারে, ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছিলেন পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী জেলার চৌধুরী পরিবার ও তাদের অনুগামীরা। ইংরেজদের সঙ্গে এক
সংঘর্ষে এই পরিবারের জনৈক বেগম অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর বীরত্বগাথা বর্ণিত হয়েছে ‘চৌধুরীর লড়াই’ শীর্ষক পল্লীগীতিকায়।
বিশ শতকের চল্লিশের দশকে (১৯৪৬) ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন ছিল সামন্ত ভূস্বামী-জমিদারের বিরুদ্ধে দরিদ্র-শ্রমিকের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। প্রকৃত প্রস্তাবে এই আন্দোলনের নিয়ন্ত্রক-পরিচালক সবই ছিল কৃষক-শ্রমিক নারীসমাজ। আরও পরিষ্কার করে বললে, ব্রিটিশ পুলিশ ও ভূস্বামীদের লাঠিয়াল বাহিনীর সঙ্গে যারা সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন তাদের পরিচয় ভাগচাষীদের স্ত্রী-কন্যা ও মহিলা খেতমজুর। নারীদ্রোহীদের মনোবল তথা শোষণবিরোধী প্রতিবাদী ভূমিকা সে সময় দ্বিধাগ্রস্ত পুরুষদেরই বরং সংগ্রামে শরিক হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছিল।
প্রচলিত ইতিহাসে তুলনামূলকভাবে অনুজ্জ্বল থাকলেও তেভাগা আন্দোলন ছিল বাঙলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষিবিপ্লব এবং সবচেয়ে স্ফুর্ত নারী আন্দোলন।
পিটার কাস্টার্স লিখেছেন :
‘তেভাগার সময় জেগে উঠেছিলেন চরম নির্যাতীত রমণীরা, যারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত ছিলেন একই সাথে সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশিকতা উভয় বিরােধী গ্রামীণ বিদ্রোহের অত্যন্ত সাহসী ও সুযোগ্য নেতৃত্বের আসনে। শ্ৰেণীগত নেতৃত্বের নিরিখে মহিলা-প্রতিরোধের ইতিহাসে এই তেভাগা হলো সর্বোচ্চ শিখরে( পিটার কাস্টার্স, তেভাগা অভ্যুত্থানে নারী, অনুবাদ-কৃষ্ণা নিয়োগী, গণসাহিত্য একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯২)।
তেভাগা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, যুদ্ধংদেহী গ্রামীণ নারী পুরুষপ্রধান সমাজের আবহে থেকেও নিজেরাই যূথবদ্ধ হতে পেরেছিলেন। এ লক্ষ্যে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন নারীবাহিনী। ইতিহাসের কোনো পর্বেই বাঙলার নারী এরকম বাহিনী গঠন করে শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার স্পর্ধা দেখায়নি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও নারীসমাজের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট গরিয়ান। তখনও নারীসমাজ জঙ্গি মিছিল করেছে, পুলিশ-সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করেছে, কারাভোগ করেছে, শহীদ হয়েছে কিন্তু পুরুষনেতৃত্বের প্রভাব ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো বাহিনী গড়ে তুলতে পারেনি। এমন কি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও গঠিত হয়নি তেমন কোনো নারীবাহিনী। এদিক থেকে তেভাগা আন্দোলনে সংগঠিত নারীবাহিনী বাঙালি নারীর সংগ্রামী ইতিবৃত্তে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। যদিও ইতিহাসবিদরা তুলনামূলক বিচারের প্রশ্নে বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছেন কিংবা গুরুত্ব দিয়েছেন ভিন্নভাবে। অনেকে খুব সহজ উত্তর দিয়ে দায় সেরেছেন। বলেছেন, এটা ছিল সময়ের দাবি। এ প্রসঙ্গে চটজলদি বলা যায়, ইতিহাসে এই নারীবাহিনী
অনুজ্জ্বল হয়ে আছে একটি মোটাদাগের কারণে। তা হলো, এই বাহিনীর সংগ্রামী নারীরা কেউ অভিজাত’ ছিলেন না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত নারী যোদ্ধাদের প্রধান তিন-চারজন ছাড়া হদিস পাওয়া যায়নি স্বাধীনতালাভের আড়াই দশক পরেও। এর অন্তর্গত কারণও তেভাগা আন্দোলনের বীর-নারীদের মতোই। ইতিহাসবিদদের শ্রেণীগত বৈষম্যের জন্যই নারীবাহিনীর মতো দ্রোহী সংগঠনের চালচিত্র বিশ শতক পর্যন্ত অধিকাংশ বাঙালির স্মৃতিতেই ছিল না। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নানা পর্যায়ে বারবার ঘুরে ফিরে এসছেন যে সকল সংগ্রামী নারীর নাম সেখানেও প্রায় অপাংক্তেয় থেকে গেছেন তেভাগার বিমলা মাজি, পালিয়া বামমানী থেকে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সশস্ত্র যোদ্ধা তারামন বিবি, কাকন বিবিরা (এদের মূল্যায়ন করা হয় স্বাধীনতার ২৬ বছর পর)।
আবার ফিরে যাওয়া যাক তেভাগা প্রসঙ্গে। তেভাগা আন্দোলনের বিস্তারভূমি ছিল উত্তরে জলপাইগুড়ি থেকে দক্ষিণে কাকদ্বীপ পর্যন্ত। এই সংগ্রামের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল ১৯৩৭ সালের মার্চে কৃষক সভা' প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর । তখন থেকেই কৃষকরা সংগঠিত হতে শুরু করেছিলেন এবং শনাক্ত করতে আরম্ভ করেছিলেন শোষণের বহুমাত্রিক দিক।
১৯৪০ সালে ক্লাউড কমিশন’ কৃষকদের স্বার্থে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিলে তা কার্যকর করার জন্য বিভিন্ন স্থানে কৃষকদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে। কৃষক সভার কাউন্সিল সভায় তেভাগার দাবিতে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ১৯৪৬ সালে ।
দাবিগুলো ছিল এরকম: কৃষক উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুভাগ পাবে; জমিতে দখলিস্বত্ব পাবে ভাগচাষী, প্রতি একমণ ধানে পাঁচ সেরের বেশি সুদ নেওয়া চলবে না; ধান উঠবে ভাগচাষীদের গোলায়; সেখান থেকে মাড়াই শেষে তিনভাগের একভাগ নেবে জোতদার ।
প্রথমে তেভাগা আন্দোলন তীব্ররূপ ধারণ করে দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁওয়ে। শুরুতে কৃষকরা নেতৃত্ব দিলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে কৃষক-নারীরা হাতেকলমে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। অতঃপর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রংপুর, নীলফামারী, যশোর, নড়াইল, ময়মনসিংহ, জলপাইগুড়ি, চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলি, হাওড়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে । দেশি হাতিয়ার সজ্জিত নারীরা জঙ্গি মিছিল, থানা ও কাছারি ঘেরাও বা আক্রমণ, লাঠিয়াল ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এভাবে গ্রামীণ নারীসমাজ থেকে বেরিয়ে আসে স্বতন্ত্র বিক্রম ও স্বতন্ত্র রণকুশলী নারীনেতৃত্ব। সম্ভবত তেভাগা আন্দোলনেই যুথবদ্ধ নারীবিদ্রোহী লড়াই করতে করতে শহীদ হন। অসংখ্য শহীদের মতো আকস্মিকভাবে, অজানিতভাবে এবং পরিস্থিতির চাপে তারা শহীদ হননি। মারব অথবা মরব; এই সংকল্পে অটুট নারীযোদ্ধারা মারা গেছেন যুদ্ধংদেহী অবস্থায়।
তেভাগা আন্দোলনের অসংখ্য বীর-নারীর মধ্যে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। যারা শুধু নেপথ্যে প্রেরণা দেননি, ময়দানে লড়াই করেছেন। এঁদেরই একজন ছিলেন দিরী সিং। দেশজ হাতিয়ার নিয়ে তিনি রাইফেলধারী পুলিশ বাহিনীর মোকাবেলা করেছিলেন একাধিকবার। তাঁর সংগ্রাম বিস্তারিত ছিল দিনাজপুরের পশ্চিম ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে। এ অঞ্চলের ঠুনটুনিয়ায় ভূস্বামীদের নির্বিরোধ স্বেচ্ছাচারিতা ভাগচাষীদের পরিণত করেছিল প্রায় উদ্বাস্তু শ্রেণীতে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ভূস্বামীদের বাধার মুখে ঠুনঠুনিয়ার দলবদ্ধ ভাগচাষীরা কেটে নেয় তাদের উৎপাদিত ধান। তার পরদিন (১৯৪৬ সালের নভেম্বর) পুলিশ ৩২ জন ভাগচাষীরে গ্রেফতার করে ধান চুরির অজুহাতে । এ সময় জমির ধান পাহারা দিচ্ছিল দিল্লরীর নেতৃত্বে একদল মহিলা। পরে অন্যরা এগিয়ে আসে। অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশ রণে ভঙ্গ দেয়। এই ঘটনার পর ভাগচাষীদের মারমুখী আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। পুলিশী প্রতিরোধ ব্যর্থ হয় সবক্ষেত্রে। অবশেষে সেখানে পাঠানো হয় রাইফেলধারী বাহিনী। এই বাহিনীকে বাধা দিতে প্রথম লাঠি হাতে এগিয়ে যান অসীম সাহসী দিলরী এবং তাঁকে অনুসরণ করে ক্ষিপ্ত গ্রামবাসী। শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হয় সরকারি সাজোয়া বাহিনী। রাজবংশী পরিবারের তরুণী বিধবা দিল্লরীর বীরত্বের কাহিনী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। প্রচণ্ড উৎসাহের সৃষ্টি হয় বিক্ষুদ্ধ কৃষক নারী-পুরুষের মধ্যে।
এসময় দিনাজপুর জেলার বালিয়াডাঙ্গি গ্রাম আন্দোলনের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। এই গ্রামের দুই নারীযোদ্ধার নাম রোহিনী ও জয়মনি। এক পর্যায়ে গ্রামবাসী ধান কাটতে গেলে রাইফেলধারী পুলিশ বাহিনী তাদের বাধা দেয়। এসময় রোহিনী ও জয়মণি নারীবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পুলিশের ওপর । লাঠিধারী নারীরা পুলিশের হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে আছড়ে ভেঙে ফেলেন।
পুলিশের হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছিলেন পালিয়া বামমানী। দিনাজপুরের নিকট এলাকা রামপুরে তখন স্বেচ্ছাসেবক কৃষকরা একাট্টা হয়ে আন্দোলন করছিলেন। আন্দোলনের তুঙ্গ পর্যায়ে একদিন তার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাদের উৎপাদিত ধান কাটতে শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে বাধা দেয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। পুলিশ কৃষকদের গ্রেফতার করার প্রস্তুতি নেওয়া মাত্র ঝাঁটা আর ছেনি হাতে ছুটে আসে গ্রামের কৃষক মহিলারা। তাদের অগ্রভাগে ছিলেন বীরনারী পালিয়া বামোনী। তিনি পুলিশের হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙে ফেলেন। অতঃপর শুরু হয় ধস্তাধস্তি, হাতাহাতি। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় গ্রামের সকল পুরুষ। অবশেষে পুলিশ ভেগে যায়। এই খণ্ডযুদ্ধে জঙ্গি মেয়েদের লাঠির আঘাতে দাঁত খোয়া যায় চার জন পুলিশের।
তেভাগা আন্দোলনে জমিদার বা ভূস্বামীদের কাছারি আক্রমণ করা ছিল রণকৌশলের একটি প্রধান দিক। দিনাজপুরের পাঁচগড় কাছারি আক্রমণ, মেদিনীপুর জেলার নন্দীরাম গ্রামের কাছারি ঘেরাও, রাণীশংকৈলের সংঘর্ষ তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী দৃষ্টান্ত। নন্দীরাম গ্রামের কাছারি ঘেরাওয়ে অংশ নিয়েছিলেন পাঁচ হাজারের মতো বিদ্রোহী কৃষক। এর মধ্যে দুহাজারই ছিলেন মহিলা। তারাই ছিলেন ঘেরাওয়ের পুরোভাগে। মহিলাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল ঝাঁটা। এক পর্যায়ে ঝাটাধারী মহিলাদের হাতে প্রহৃত হয় কাছারির সকল পাহারাদার। অবশেষে কাছারি মালিকের সহােদররা ও অন্যান্য কর্তাব্যক্তিরা গলায় কাপড় জড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে দলবলসহ। এই ঘটনার পরে রাণীশংকৈলে পুলিশ বাহিনী এসে কৃষক আধিয়ারকে গ্রেফতার করে ট্রাকে তুললে গৃহবধূ ভাণ্ডানী বর্মন স্বেচ্ছাসেবী মহিলাদের নিয়ে ট্রাক ঘিরে ফেলেন। এসময় ইন্সপেক্টর অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করলে ভাণ্ডানী তার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেন এবং তাকে গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলেন। বন্দি ইন্সপেক্টরকে রাখা হয় একটি ঘরে, ভাণ্ডানি তাকে পাহারা দিতে থাকেন। অতঃপর তেভাগা সংগঠক ও কমিউনিস্ট নেতা গুরুদাস তালুকদারের নির্দেশে ইন্সপেক্টরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরের দিন গ্রামে ব্যাপক পুলিশী আক্রমণ চলে এবং গ্রেফতার হন অনেকে। এই ঘটনার পরেও ভাণ্ডানী ভাগচাষী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং পেয়েছিলেন প্রবাদ নারীর মর্যাদা।
তেভাগা আন্দোলনের আর এক প্রবল তরঙ্গের নাম বিমলা মাজি। তাঁর বিয়ে হয়েছিল এক ডাকাত পরিবারে ১৩/১৪ বছর বয়সে। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি জড়িয়ে পড়েন কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে। এ সময় মহিলাদের সংগঠিত করার উদ্দেশে বিমলা মাজিদের এলাকার বিভিন্ন গ্রামে সফর করেন তৎকালীন নারী রাজনীতিক মণিকুন্তলা সেন। বিমলা মাজি তাঁর সংস্পর্শে আসেন এবং তেভাগা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তক্রমে কর্মকাণ্ড শুরু করেন। এক পর্যায়ে পুলিশ ক্যাডারদের সঙ্গে তিনি নন্দীগ্রামে যান সেখানকার মেয়েদের সংগঠিত করার জন্য। তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয় ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে গ্রামের সকল নারী। তারা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত ছিলেন আগে থেকেই। অতঃপর লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে, ঝাঁটা এবং মরিচের গুড়ো সম্বল করে দলবদ্ধ নারীরা ভূস্বামীদের কাছারি ঘেরাওয়ে অংশ নেন। নন্দীগ্রামের কাছারি ঘেরাওয়ের দিন জঙ্গি নারীরা কাছারির সকল পাইক-বরকন্দাজদের মুখে কালি মেখে দেয়। এরপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো দু’হাজার নারীর মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেককে আঁটাপেটা করা হয়। পরিণামে গ্রামের উৎপাদিত সকল ধান আসে চাষীদের ঘরে।
ক্রমাগত দ্রোহী তৎপরতার অভিযোগে পুলিশ বিমলার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ারা জারি করে। উল্লেখ্য, এসময় স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতা-নেত্রীদের সকলেই বন্দি ছিলেন। এমতাবস্থায় এই এলকায় আন্দোলন অব্যাহত রাখার দায়িত্ব ছিল বিমলার ওপর। কাছারি ঘেরাও ও পুলিশ ঠেকাও আন্দোলনের এক পর্যায়ে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। সেখানে এই বীরনারীকে রাখা হয়েছিল একটি খাচায় পুরে। বিচারে বিমলা মাজির আড়াই বছরের কারাদণ্ড হয়। ভারত স্বাধীনতা পেলে তিনি মুক্তি পান। তেভাগার লড়াকু কর্মীদের তালিকায় রক্তের অক্ষরে লেখা যশােদা রানী, কৌশল্যা, সুরমা সিং-এর নাম। এরা তিনজনই শহীদ হন পুলিশের গুলিতে ১৯৪৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে। এ সময় একাধারে তেভাগা আন্দোলনের সবচেয়ে শোকাবহ আত্মত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল দিনাজপুরের খাপুর গ্রামে। ২০ ফেব্রুয়ারি তিনটি লরিতে এক পুলিশ বাহিনী এই গ্রামে হামলা চালায়। উদ্দেশ্য, আত্মগোপন করে থাকা কৃষক নেতাদের গ্রেফতার করা। জঙ্গি নারীবাহিনী যথারীতি তাদের সতর্ক করে দেয় শাখ ও কাসার ঘণ্টা, বাসনকোসন বাজিয়ে। পুলিশ গ্রামে ঢোকার পরই স্বেচ্ছাসেবীরা পুলিশের প্রত্যাবর্তনের পথে ব্যারিকেড রচনা করে গর্ত খুঁড়ে এবং গাছ কেটে। পাঁচ জন নেতাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পথে আটকে পড়ে পুলিশের লরি। চারদিকে ঘিরে ফেলে হাজার হাজার নারী-পুরুষ। তাদের দাবি, নেতাদের ছেড়ে দিতে হবে। এসময় এগিয়ে আসেন আত্মগোপনকারী কৃষকনেতা নীলমাধব সরকারের স্ত্রী দুই সন্তানের জননী যশোদা রানী। তাঁর অনুগামী হয় ঝাঁটা ও বারুণ হাতে নারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। এক পর্যায়ে সাহসী কৃষক চিরাইসাই শেখ শাবল দিয়ে গাড়ির টায়ার কেটে দিরে পুলিশ গুলি চালায় ।,গুলিতে নিহত হন দুই কৃষকনেত্রী যশোদা সরকার, কৌশল্যা এবং চিরাইসাই শেখসহ ২২ জন। পরে গুলিবিদ্ধ ৮ জন মারা যান বালুরঘাট সদর হাসপাতালে।
খাপুরে রক্তের দাগ শুকোনোর আগেই পুলিশ আন্দোলনের কর্মী ডোমা সিংকে গ্রেফতার করার জন্য হামলা চালায় চুমানিয়া গ্রামে। এবারও মেয়েরা সতর্ক সংকেত দিতে ভুল করে না। ডোমা সিংকে যাতে পুলিশ গ্রেফতার করতে না পারে সেজন্য শত শত কৃষক নারী-পুরুষ তার বাড়ির সামনে জড়ো হয় এবং পুলিশকে ফিরে যেতে বলে। পুলিশ গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় লাঠি হাতে পুলিশের দিকে দৌড়ে যান লড়াকু সুকুরচাদ সিং, পেছনে স্ত্রী সুরমা সিং। পুলিশ গুলি চালায় এবং ঘটনাস্থলেই শহীদ হন এই বীরদম্পতি।
তেভাগা আন্দোলনকে দমন করার জন্য পুলিশী অত্যাচার যখন চরম আকার ধারণ করেছে তখন লড়াইয়ের সামনের কাতারে এগিয়ে আসেন পুণ্যেশ্বরী দেবী। জলপাইগুড়ির দেবীগঞ্জ থানার রাজবংশী সম্প্রদায়ের বিধবা। সংগ্রামী ভূমিকার জন্য তাঁকে জলপাইগুড়ির মানুষ বুড়িমা বলে ডাকতো। বুড়িমা এলাকার কৃষকদের সংগঠিত করে খেতের ধান কাটায় নেতৃত্ব দিতে থাকেন। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুন্দরদীঘিতে পুলিশ আক্রমণ চালায়। এ অবস্থায় জঙ্গি নারীরা ধান কেটে আনতে সমর্থ হন। এই ধানকাটা অভিযানে নেতৃত্ব দেন বুড়িমা। এপ্রিল মাসে চখাইপোশর গ্রামে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন একজন কৃষক রমণী। বুড়িমার আন্দোলনও তীব্র হয়ে উঠতে থাকে। তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেন মাকড়ি, উজানী, বিদ্যা প্রমুখ।
শিখা নন্দী ও তিলকতারিণী দেবী সগ্রাম করেন পঞ্চগড় এলাকায়। বহুবার তারা পুলিশী হামলার মুখোমুখি হয়েছেন, অমান্য করেছেন ১৪৪ ধারা । এই দুই জঙ্গি রমণী ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। তাঁরা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্য ছিলেন। এক্ষেত্রে কল্যাণী দাশগুপ্তের নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ সালে জলপাইগুড়ির কোনো কোনো অঞ্চলে তেভাগা কায়েম হয়েছিল বলে জানা যায়। এসময় আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন দুই কৃষক সহোদরা পোকো ওরাওঁনি ও মহারাণী ওরাওঁনি। এছাড়া ছিলেন গৃহবধূ নৈহারী, ছোটেস প্রমুখ। জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সে তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম জঙ্গি কর্মী ছিলেন চন্দিয়া। তারা দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন এলাকায় ধান বণ্টনের সময় উপস্থিত থাকতেন। ১৯৪৭ সালের ১ মার্চ তেভাগা করার সময় পুলিশের গুলিতে পোকো অথবা মহারাণী মারা যান অন্য চারজনের সঙ্গে। ৪ এপ্রিল একই কারণে ৯ জনের সঙ্গে মারা যান একজন মহিলা কর্মী। এ ঘটনা ঘটে জোতদার গয়ানাথের গোলায় তেভাগা করার সময় জলপাইগুড়ির বিভিন্ন অঞ্চলে নারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কখনও পুলিশকে হটিয়ে দেয় পাথর ছুঁড়ে, কখনও গাড়ি আটকে দেয় ব্যারিকেড রচনা করে, কখনও জোর করে ছিনিয়ে নেয় পুলিশের রাইফেল। রাইফেল ছিনিয়ে নেওয়ার একটি ঘটনা ঘটেছিল ঝিকিরাডাঙ্গায়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষকালে জঙ্গি নারী-পুরুষ পুলিশের কয়েকটি রাইফেল ছিনিয়ে নেওয়ার পরে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের পরামর্শে সেগুলি নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়।
অহল্যা, উত্তমী, সরোজিনী ও বাতাসী - এই জঙ্গি চতুষ্টয় তেভাগা আন্দোলনের চারটি রক্তে লেখা নাম। এঁরা শহীদ হয়েছিলেন পুলিশ ও গুর্খা সৈন্যদের সমন্বিত আক্রমণে এবং চার জনই ছিলেন সুন্দরবন অঞ্চলের চন্দনসিঁড়ি গ্রামের। তেভাগা আন্দোলন দমন এবং নেতাদের গ্রেফতারের জন্য এ গ্রামে হামলা হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ৬ নভেম্বর। হামলাকালে পুলিশ ও সৈন্যরা মেয়েদের শ্লীলতাহানির উদ্যোগ নেয়। তখন অন্তঃসত্ত্বা অহল্যা, উত্তমী, সরোজিনী, বাতাসীসহ ষোল-সতের জন মেয়ে নিয়ে রুখে দাঁড়ান। দা, বটি, আঁটা, তীর ধনুক দিয়ে তাঁরা ৩৬ জন রাইফেরধারীর সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। এসময় আলোচ্য চার বীর রমণী শহীদ হলে উন্মত্ত গুর্খা সৈন্যরা গুলিবিদ্ধ অহল্যার তলপেটে সঙ্গীন দিয়ে চিরে ফেলে।
বীরনারী অহল্যার স্মরণে কবি-গায়ক বিনয় রায় লিখেছিলেন একটি মর্মবিদারি গান:
‘অহল্যা মা তোমার সন্তান জন্ম নিল না।
ঘরে ঘরে সেই সন্তানের প্রসবযন্ত্রণা...।'
প্রতিরোধ বাহিনী সংগঠিত করে তেভাগা আন্দোলনকে যারা কৃষি বিপ্লবের পথে এগিয়ে দেওয়ার সচেতন প্রয়াস পেয়েছিলেন তাদের অন্যতম সরলাদি। এই নমশূদ্র কৃষক রমণী তেভাগার দুর্ধর্ষ নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজেকে। তার লড়াইয়ের ঘাঁটি ছিল যশোর জেলার নড়াইলের বাকরি গ্রামে।
তেভাগা আন্দোলনের সময় এরই অংশ হিসেবে গড়ে ওঠে আরও কয়েকটি এলাকাভিত্তিক আন্দোলন। যেমন সিলেটের মৌলভীবাজার মহকুমার ভানুবিল এলাকায় জমিদারিপ্রথার বিরুদ্ধে ভানুবিল আন্দোলন, দিনাজপুর অঞ্চলে হাট থেকে বেআইনীভাবে হাটতোলা বা জোর করে টাকা আদায়ের ভোলাবাটি আন্দোলন, ময়মনসিংহে কমিউনিস্ট নেতা মনি সিংহের নেতৃত্বে হাজং আদিবাসীদের আন্দোলন, সিলেটে জমিদারদের পেটভাতি ভূমিদাসদের পক্ষে নানকার আন্দোলন। নানকার অর্থাৎ রুটি। শুধু খাওয়া এবং সামান্য জমির বিনিময়ে যারা দিনমান জমিদারদের কাজ করতেন তারা নানকার নামে পরিচিত ছিলেন। এসব আন্দোলনের প্রত্যেকটিতে বিক্ষুদ্ধ নারীদের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। ক্ষেত্রবিশেষে তাঁরা নেতৃত্বও দিয়েছিলেন, অনেকে মুখোমুখি সংঘর্ষে হয়েছিলেন শহীদ।
এর মধ্যে তোলাবাটি আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী কণ্ঠমণি বর্মণীর নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯৩৮ সালে দিকে হাটে মেয়েরা বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করতে গেলে তাদের কাছ থেকে তোলাসহ রশিদ লেখাই খরচ আদায় করা হতো। তোলা ও লেখাই বন্ধ করে দিলে জোতদারদের সংগঠন ‘ক্ষত্রিয় মহাসভা' মেয়েদের হাটে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই নির্দেশকে জঙ্গি মেয়েরা সরাসরি অমান্য করে, যার অগ্রভাগে ছিলেন নির্ভিক কৃষক রমণী কণ্ঠমণি বৰ্মনী।
হাজং বিদ্রোহ বা টংক বিদ্রোহের ইতিহাসখ্যাত লড়াকু নারী নেত্রী ছিলেন রাসমনি।
১৯৩৭-৩৮ সালে মনি সিংহের আহ্বানে ময়মনসিংহের সুসং দুর্গাপুর এলাকার প্রঅয তিনশ’ আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্য রাজনীতিক হাজৎ রমণী রাসমনি দ্রোহের আগুন আরও ছড়িয়ে দেন। ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনী হাজং অঞ্চল আক্রমণ করে ১৯৪৬ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন রাসমনি। এরপর ১৯৪৭ সালের ৩১ জানুয়ারি আবার আক্রান্ত হয় হাজং গ্রাম। সৈন্যবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েদের ওপর। এসময় লাঞ্ছিত হন কৃষক রমণী সরস্বতী। তার চিৎকারে ৩৫ জন হাজং চাষীসহ সৈন্যদের প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেন রাসমনি ও সুরেন্দ্র হাজং। ২৫ জন অস্ত্রসজ্জিত সেনার সঙ্গে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে লড়াই চলে দুঘণ্টা রাসমণি দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন দু’জনকে। এক পর্যায়ে তার দেহভেদ করে দশটি বুলেট, তিনি শহীদ হন। পরবর্তীকালে দেড়শ’ হাজং বীরসহ শহীদ হন লড়াকু রমণী রেবতী, নীলমনি, পদ্মমনি, শঙ্খমনি প্রমুখ।
সূচনাতেই বলা হয়েছে, তেভাগা আন্দোলনের প্রধান কৃতিত্ব হচ্ছে শত্রুপক্ষকে মোকাবেলা করার জন্য সংগঠিত নারীবাহিনী। তেভাগা আন্দোলনের তুঙ্গ পর্যায়ে ব্রিটিশশাসন, অত্যাচারী ভূস্বামী এবং ক্ষেত্রবিশেষে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীবাহিনী গড়ে ওঠার পিছনে ছিল বাঙালি কৃষক নারীর আত্মশক্তির জাগরণ, স্বতঃস্ফূর্ততা এবং সংগ্রামী সৃজনশীলতা। পরিস্থিতির প্রয়ােজনে এই বাহিনী গড়ে উঠেছিল সাধারণ নারীর স্পর্ধাকে পুঁজি করে। কাজেই স্বভাবতই এর পুরোভাগে ছিল গ্রামীণ নারীসমাজ। সর্বহারা, অর্ধ সর্বহারা, খেতমজুর, ভাগচাষী এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের হিন্দু, মুসলিম, আদিবাসী রমণীদের জঙ্গি সম্মিলনেই গড়ে উঠেছিল নারীবাহিনী। এতে পুরুষদের ভূমিকা ছিল তুলনামূলকভাবে গৌণ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তো বটেই, এমনকি তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাও আশানুরূপ ছিল না। এর নেপথ্যেও পিতৃতান্ত্রিক ভিন্ন নামে । যেমন ঝাটা বাহিনী, নারীরক্ষী বাহিনী, গায়েন বাহিনী ইত্যাদি। পরবর্তীকালে অনেকেই নারীবাহিনীকে আধা মিলিশিয়া’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তেভাগা আন্দোলনের সময় নারীবাহিনীর মূল কাজ ছিল চাষের খেত, ফসল ও গ্রামকে জমিদারদের হাত থেকে রক্ষা করা।
নারীবাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র ছিল বটি, দা, লাঠি, আঁটা, গাছের ডাল, ইট, ঢেলা, পাথর, বেল ও শক্ত ফল, তীর-ধনুক, ছেনি, কোদাল, শাবল, শরকি, কাস্তে। অর্থাৎ গৃহস্থালির বিভিন্ন সামগ্রী ও কৃষিকাজের উপকরণ ছাড়াও চোর তাড়ানোর হাতিয়ার এবং শিকারের অস্ত্রপাতিও ছিল তাদের যুদ্ধাস্ত্র। মরিচের গুড়া ব্যবহার করা হতো প্রতিপক্ষের চোখেমুখে ছিটিয়ে দেওয়ার জন্য।
অভিযান, প্রতিরোধ এবং আত্মগোপনকালে দলীয় সদস্যদের আহ্বান, সতর্কীকরণ করতে নারীবাহিনী ব্যবহার করতো শঙ্খ, সিঙ্গা, কাসা-পিতলের বাসন কোসন, ঘন্টা ইত্যাদি। অনেক সময় মেয়েরা উলুধ্বনি দিয়েও সংকেত দিতেন। সাধারণত হিন্দু এলাকায় শঙ্খধ্বনি এবং মুসলিম এলাকায় ঘন্টাধ্বনি করা হতো। জানা যায়, শখ যোগাড় করতে না পেরে জলপাইগুড়ি, দেবীগঞ্জ এলাকার মেয়েরা উলুধ্বনি করতেন। এ ব্যাপারে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। তিনি তাই ব্যবহার করতেন যার পক্ষে যা সুবিধাজনক। তবে সাধারণ মানুষের যূথবদ্ধ সংগ্রামে নারী বাহিনীর উদ্ভাবিত সকল রণকৌশলই ছিল কার্যকর, অভিনবও বটে।
ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, নারীবাহিনীর অঞ্চলভেদে ভিন্ন নাম ছিল। এর মধ্যে বঁটাবাহিনী অন্যতম। তেভাগা আন্দোলনের প্রথম কাতারের নেত্রী সরলাদি, যার কিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া হয়েছে পূর্ব পরিচ্ছেদের শেষাংশে, তিনি যশোরের নড়াইলে প্রায় তিনশ জঙ্গি মেয়ে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি ঝটাবাহিনী।
বদরুদ্দিন ওমরের ভাষায় :
সমগ্র বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন(বদরুদ্দিন ওমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে। বাংলাদেশের কৃষক, ঢাকা)
সরলাদির আঁটাবাহিনীর সামনে নাস্তানাবুদ পুলিশ পরপর দুই বার ক্ষমা চেয়ে হটে গিয়েছিল। তার বিক্রমগাথা যশোর তথা সারা বাঙলার কৃষকদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল বিপুল উদ্দীপনা। যেখানে প্রতিরোধ সেখানেই ঝটাবাহিনী। এর সদস্যরা পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন বন্দিদের, জঙ্গি মিছিল করে নিয়ন্ত্রণে এনেছেন জমিদারের কাছারি, কেটে নিছেন নিজেদের উৎপাদিত ধান, আক্রমণকারী পুলিশকে প্রহার করেছেন, ভেঙেছেন তাদের হাতের বন্দুক।
তেভাগা আন্দোলনের চরম পর্যায়ে বিদ্রোহী অঞ্চলের প্রতি গ্রামে গঠিত হয়েছিল নারীবাহিনী। গোটা আন্দোলনে যতো জন জঙ্গি কৃষক-রমণী শহীদ হন (প্রায় ৩০ জন) তাঁদের সকলেই আন্দোলনের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। তবে বেশিরভাগই ছিলেন নারীবাহিনীর সক্রিয় সদস্য। তেভাগার শহীদ নারীদের মধ্যে যাদের নাম পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হচ্ছেন : পূর্ব বাঙলার দিনজাপুরের তিন জন - খাপুরের যশোদা রাণী সরকার, কৌশল্যা কামরানী, ঠুমানিয়ার সুরমা সিং। ময়মনসিংহের টংক বিদ্রোহের পাঁচ জন – সুসং দুর্গাপুরের রাসমনি, শঙ্খমনি, রেবতী, নীলমনি, পদ্মমনি। পশ্চিম বাঙলার জলপাইগুড়ি ডুয়ার্সের পোকে ওরাওঁনী অথবা মহারাণী ওরাওঁনী। চব্বিশ পরগনার তিন জন, কাকদ্বীপের চন্দনপিড়ির অহল্যা দাসী, বাতাসী, সরোজিনী। হুগলির বারাে জনের মধ্যে ছিলেন ডুবরি ভেড়ী গ্রামের পুষ্পবালা মাঝি, পাঁচুবালা ভৌমিক, দাসীবালা মাল, কলিবালা পাখিরা, চণ্ডিবালা পাখিরা, মুক্তকেশী মাঝি, রামকৃষ্ণের মা। হাওড়ার পনেরো জনের মধ্যে শাঁকরাইলের মাশিলা গ্রামের মনোরমা রায়, লক্ষ্মীময়ী, হিরন্ময়ী রায়, ঘেটুরামের স্ত্রী, বাঁশরীর মা, পাঁচুর মা, হাটাল গ্রামের যশােদাময়ী সাঁতরা, পারুবালা সাঁতরা, সত্যবালা দাসী, অষ্টবালা পণ্ডিত, ননীবালা পাত্র, বালিতা পাত্র, সিঁধুবালা দলুই, ভাটময়ী দাসী। বাকি শহীদদের নাম পরিচয় জানা যায়নি।
উল্লেখ্য, কিশোরগঞ্জের পর্দানশীল মুসলিম কৃষক মেয়েরাও নারীবাহিনীর পক্ষ থেকে তেভাগা লড়াইয়ের অংশ নিয়েছিলেন। বলা হয়েছে আগেই, তেভাগা আন্দোলনে নারী নেতৃত্ব উঠে এসেছিল গ্রামীণ দরিদ্র নারীসমাজ থেকে। এরা ছিলেন বাঙলার কৃষিসমাজের সবচেয়ে শোষিত নিপীড়িত অংশ । ঔপনিবেশিক-সামন্ত-পিতৃতান্ত্রিক আবহে তাদের দুর্দশার সীমা পরিসীমা ছিল না। এই ত্রিমুখী শােষণকে তারা মোকাবেলা করেছিলেন আত্মশক্তি দিয়ে।
ব্রিটিশ শাসন তথা ভূস্বামীদের পাশাপাশি তেভাগার সংগঠিত নারীবাহিনী নারীর সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নারীবাহিনী অলিখিত আইন জারি করে বন্ধ করেছিল নারীর প্রতি পুরুষদের প্রাত্যহিক অত্যাচার। তাদের প্রচেষ্টা সাময়িক কালের জন্য হলেও গ্রামাঞ্চলে স্ত্রীপ্রহার বা বউপেটানাে বন্ধ হয়েছিল। সামন্তপ্রভু এবং তাদের অনুচরেরা গ্রামে গ্রামে নারীদের ওপর বিশেষত বালবিধবাদের ওপর যে যৌননিগ্রহ শুরু করেছিল তার বিরুদ্ধে নারীবাহিনী কার্যকর প্রতিরােধব্যুহ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
নারীবাহিনী গঠনের ফলে স্বভাবতই কমে গিয়েছিল পর্দাপ্রথার কড়াকড়ি। সাধারণ নারীরা পর্দার চিরায়ত ঘের ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন লড়াইয়ের প্রকাশ্য ময়দানে। রক্ষণশীলরা তখন তাদের উপহাস করতো ‘পুরুষালি মেয়ে বলে। কেউ কেউ ফতোয়া জারি করেছিল যে, মেয়েরা বিভিন্ন সভায় যোগদানকালে ঘোমটা টানবে, মুসলমান মেয়েরা বোরকা পরবে। তারা আরও বলেছিল, সব মেয়েদের সভায় উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। সভার সিদ্ধান্ত তাদের জানিয়ে দিলেই চলবে। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক প্রবক্তাদের এই নির্দেশ সেদিন অগ্রাহ্য করেছিল সংগ্রামরত নারীবাহিনী। এসব ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে বলা যায়, তেভাগার নারীবিদ্রোহ পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণার শিকড় তুলে ফেলতে না পারলেও তার প্রাচীন প্রাচীরে প্রবল আঘাত হেনেছিল। কাজেই তৃণমূল পর্যায়ে সমাজ-পরিবর্তনের ইতিহাসেও তেভাগার নারীবিদ্রোহের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ব্রিটিশ শাসনামলে তেভাগা আন্দোলন ছাড়া স্বতন্ত্র নারীবাহিনী গঠনের আর কোনো দুষ্টান্ত পাওয়া যায় না। তবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নানাভাবে নারীরা সংগঠিত হয়েছে, গঠন করেছে বহু সংস্থা-সংগঠন। স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা সুভাষচন্দ্র বসু ব্রিটিশবাহিনীর মােকাবেলা করার জন্য যে আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গড়ে তুলেছিলেন তাতে নারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ছিল। তারা সামরিক কায়দায় ট্রেনিং গ্রহণ করে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রশিক্ষণ নিতেন। এছাড়া গঠিত হয়েছিল ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈয়ের নামে ঝাঁসি মহিলা বিগ্রেড'।
পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষ রণাঙ্গণে অংশ নেওয়ার জন্য একটি নারীবাহিনী সংগঠিত করেছিলেন সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল। এর অধিকাংশ সদস্য ছিল ছাত্রী। কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য এটি আলাদাভাবে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নারী দ্রষ্টব্য)।
বিষয়: বিবিধ
১৮১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন