স্পেনের কান্না •

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১১:৫৭:২৯ রাত

স্পেনের কান্না •

গ্রানাডার সবচেয়ে বড় মসজিদ --- গ্রানাডা জামে মসজি। মসজিদে ঢুকলে এখন আর দেখা মেলে না মুসলিম চিহ্ন।যা খ্রিষ্টানরা গীর্জায় পরিণত করেছে।এককালের সবচেয়ে বড় মসজিদটির এ করুণ পরিণতি দেখে অন্তরে বড় আঘাত লাগবে যে কোন মুসলিমের।যে মসজিদে তাওহিদ প্রেমিকেরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্বীয় প্রভুর পদতলে বিনয়াবনত হয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়ত। যেখান থেকে আজানের ধ্বনিপ্রতিধ্বনির সুরঝংকারে কেঁপে উঠত ইথার পাথার। আলোকিত করে তুলত আদিগন্ত সবকিছু। সেখানে আজ কুফর শিরকের তামসী ছায়ারা জেঁকে বসে আছে সব জুড়ে।

‘আজও তোমার মাটির পরে সিজদা আমার লুকায়িত,

ভোরের হাওয়ায় আজান তোমার হয় না যে আর উচ্চারিত।

মুসলমানদের কাছ থেকে স্পেনের কর্তৃত্ব যে খ্রিষ্টানরা ছিনিয়ে নিয়েছিল তারা ছিল খুব কট্টরপন্থী, সংকীর্ণমনা ও গোঁড়া। তারা ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে স্পেনের মসজিদগুলোকে গীর্জায় পরিণত করার ফরমান জারি করে। এ ফরমান জারির সাথে সাথে স্পেনের সব মসজিদ গীর্জায় রূপান্তরিত করা হয়। সে স্বেচ্ছাচারী ফরমানের নাগপাশ থেকে এ মসজিদটিও রক্ষা পায়নি। এমনকি খ্রিষ্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও রাণি ইসাবেলার সমাধিও এ মসজিদেই বানানো হয়েছে। এটাই ওদের মুসলিম বিদ্বেষ ও গোঁড়ামির প্রমাণ বহন করে। ওদের এ গোঁড়ামির যাতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে স্পেনে কোনো মসজিদই টিকে থাকতে পারেনি।

এভাবে মসজিদকে গীর্জায় পরিণত করার খ্রিষ্টানি আক্রমণের সাফাই গাইতে গিয়ে পাশ্চাত্যের কোনো কোনো ঐতিহাসিক ও লেখক বলে থাকেন যে,

“এটা আসলে ছিল খ্রিষ্টানদের পাল্টা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা।মুসলমানরাও তাদের অনেক বিজিত অঞ্চলে গীর্জাকে মসজিদে রূপান্তা করেছিল। তাই এর প্রত্যুত্তরে খ্রিষ্টানরা স্পেনের মসজিদগুলোকে গীর্জায় পরিণত করেছে।

কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, খ্রিষ্টানদের পক্ষ হতে এর উত্তর সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। সত্য ঘটনার সাথে এ উত্তরের সুদূর কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা, মুসলমানদের পক্ষ হতে গীর্জাকে মসজিদ বানানোর ঘটনা ইতিহাসে অনেক কমই পাওয়া যায়।

কিন্তু স্পেন জয়ের পর খ্রিষ্টানরা সেখানে যে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে, নির্বিশেষে সকল মসজি গীর্জায় পরিণত করেছে এর কোনো উদাহরণ মুসলমানদের বিজিত অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ইসলামি শরিয়তের বিধান হলো : মুসলমানরা যদি কোনো এলাকা যুদ্ধ জয় করে তাহলে সে এলাকার ভূমি, স্থাপনা ও ইমারাতসমূহের উপর মুসলমানদের পূর্ণ অধিকার থাকে। এ অধিকারের ভিত্তিতেই যদি মুসলমা চায় তাহলে অমুসলমানদের কোন ইবাদতগাহকে প্রয়োজন বশত দখল নিতে অথবা মসজিদে পরিণত করতে পারে। এ অধিকার থাকা সত্তেও মুসলিম বিজেতারা এর প্রয়োগ খুব কমই করেছেন। কোনো কোনো বিশেষ প্রয়োজনের খাতিরে এরূপ করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ইবাদতগাহ আপন অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে সকল এলাকা সহজে জয় করা হয়েছে বিশেষ করে যেখানে অমুসলিমদের সাথে তা ইবাদতগাহ সংরক্ষণ করার চুক্তি হয়েছে সে সমস্ত এলাকার অমুসলিম ইবাদতগাহগুলোকে বলপ্রয়োগ করে খতম করে দেওয়ার অথবা মসজিদ পরিণত করার একটি ঘটনাও ইতিহাসের পাতায় অন্তত নেই।

পক্ষান্তরে খ্রিষ্টানরা গ্রানাডাকে যুদ্ধ করে নয়; বরং লিখিত চুক্তিনামার ভিত্তি সন্ধি করে জয় করেছিল। যে সময় রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও রানি ইসাবেলা তখনকার শেষ মুসলিম শাষক আব্দুল্লাহর কাছ থেকে আল-হামরা কবজা করে তখন তারা ৬ দফাসম্বলিত একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছিল। সে চুক্তিপত্রে নিচের বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল,

১. ধনী-গরিব নির্বিশেষে কোনো মুসলমানের জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না। তারা যেখানে খুশি সেখানে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারবে।

২. মুসলমানদের ধর্মীয় ব্যাপারে খ্রিষ্টানরা অনধিকার চর্চা করতে পারবে না এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।

৩. মসজিদ ও ওয়াকফ-সম্পত্তি যথারীতি বহাল থাকবে।

৪. কোনো খ্রিষ্টান মসজিদে প্রবেশ করতে পারবে না।

৫. মুসলমানদের ব্যাপারে ইসলামি শরিয়তের বিধি-বিধান অনুসরণ করা হবে।

৬. যেসব খ্রিষ্টান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে তাদের পুনরায় খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা যাবে না। যদি কোনো মুসলমান খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করতে চায় তাহলে একজন মুসলমান ও একজন খ্রিষ্টান বিচারক তার অবস্থা অনুসন্ধান করবেন যে, এ ব্যাপারে তাকে বাধ্য করা হচ্ছে কিনা?

উক্ত শর্তসমূহ মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করার পর তা শুধু কাগজ পত্রেই রয়ে গিয়েছিল। প্রাণহীন একটি কাগজের টুকরার মর্যাদাও সে চুক্তিপত্রকে দেওয়া হয়নি। চুক্তিপত্রের এমন কোনো শর্ত ছিল না যা নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্যে ভঙ্গ করা হয়নি।

ফার্ডিন্যান্ড, ইসাবেলা ও তাদের সমকালিন খ্রিষ্টান পাদরিদের মনে ধর্মীয় গোঁড়ামির বীজ খুব দৃঢ়ভাবেই বন্ধমূল হয়ে গিয়েছিল।

করুণা ও আক্ষেপ হয় তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ ঐতিহাসিকদের ওপর যারা সত্য ও ন্যায়-নীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত এ মানবতা-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডেও যৌক্তিকতা অথবা নীতির প্রতিফলন খোঁজার প্রচেষ্টা চালায়।

বিষয়: বিবিধ

৮৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File