কর্তাভজা ধর্মের ইতিবৃত্ত

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১১ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৬:৪২ দুপুর

কর্তাভজা ধর্মের ইতিবৃত্ত

(প্রথম পাঠ --কর্তাভজা ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ )

বাংলাদেশের ধর্মান্দোলনের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হতে ‘কর্তাভজা সম্প্রদায়' নামে একটি বিশিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। নিজেদের আরাধ্য দেবতাকে ‘কর্তা বলে অভিহিত করে বলে এই সম্প্রদায়ীদের নাম ‘কর্তাভজা। ঘোষপাড়াকে কেন্দ্র করে উদ্ভব ও প্রসার এবং প্রতি বৎসর দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে ঘোষপাড়ার মেলায় এই সম্প্রদায়ীদের সম্মেলন ঘটে বলে এদেরকে ঘোষপাড়া মতাবলম্বীও বলা হয়।

আউলাচাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বলে এই সম্প্রদায়ীদের আউল বা আউলিয়া নামেও অভিহিত করা হয়(১)। এই সম্প্রদায়ীদের কিছু কিছু আঞ্চলিক নামও পাওয়া যায়। বর্তমান বাংলাদেশের অন্তগর্ত যশোহর খুলনা অঞ্চলের ‘ভগবানিয়া’ নামক মুসলমান জাতি এবং রুসত্য' নামক সম্প্রদায় বহুত কর্তাভজা সম্প্রদায়ীদের শাখা বিশেষ(২)।

প্রধানত হিন্দুদের মধ্যে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মুসলমানদের মধ্যে এই মতাবলম্বীদের সন্ধান মেলে। বস্তুত এরা হিন্দু বা মুসলমান, কিন্তু ধর্মজীবনের সাধন পদ্ধতিতে এবং মতবিশ্বাসের ক্ষেত্রে এরা একটি বিশিষ্ট সম্প্রদায়ভুক্ত। বাঙ্গালী সমাজে এই সম্প্রদায়ীর সংখ্যা ঠিক যে কত-তা কোন আদমশুমারী রিপোর্ট হতে জানা যায় না। কারণ এই সম্প্রদায়ীরা নিজেদেরকে হিন্দু বা মুসলমান বলে উল্লেখ করে থাকে। তবুও বাংলাদেশে একদা এই সম্প্রদায়ী সংখ্যা যে প্রচুর ছিল এবং আজও যে এদের সাধন পদ্ধতির সক্রিঃ অনুসরণকারীর সংখ্যা নিতান্ত কম নহে- এ অনুমানের যথেষ্ট ভিত্তি আছে।

( ১. অউল নামক একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের কথা আরো অনেকে বলেছেন। কিন্তু তারাও স্বীকার করেছেন এ না বস্তু কর্তাভজা এবং বর্তমানে এদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কদাচিৎ সৃষ্ট হয়। ( They (Auls) are otherwise known as Saha jia Kattabhaja... The followers of this sect are rarely seen nawadays'. The Vaisnaya Sects of India : Swami Tattwananda, p. 55. এসও এই অধ্যায়ের ৫ম অনুচ্ছেদ ।

২. যশোহর খুলনার ইতিহাস-সতীশচন্দ্র মিত্র : প্রথম খণ্ড পৃঃ ৪৪ এবং ৮৭৮। )

যিনিই এই মত সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেছেন তিনিই সেযুগে এই মতাদশের জনপ্রিয়তার কথাও উল্লেখ করেছেন। উইলসন সাহেব তাহার "Hindu Religions or An Account of the Various Religious Seots of India” গ্রন্থে এই সম্প্রদায়ভুক্ত “Nurnerous disciples” এর উল্লেখ করেছেন(১)। Nadia District Gazetteer-এ এই সম্প্রদায় প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে “propagated ••••••over all the districts of the Presidency Division.” ভঃ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় লিখেছেন যে ১৮৭১ হতে ১৯৯১ পর্যন্ত পর পর সেন্সাস রিপোর্ট কর্তাভজাদের সম্পর্কে যেরূপ দীর্ঘ বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে অন্য কোন সম্প্রদায় সম্পর্কে সেরূপ নাই। সংখ্যা যাই হক-- সেযুগে এই ধর্ম-সম্প্রদায় এবং ধর্মমত যে বাংলাদেশে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই(২)। কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ এদের কথা বিস্মৃতির অতলে লুপ্ত হতে চলছে।

বাংলার বৃহত্তর সামাজিক ইতিবৃত্তে এই সমস্ত ছোটখাটো সম্প্রদায় ও স্বল্পখ্যাত মতবাদের ইতিহাসও একান্ত অপরিহার্য উপাদান। কোন্ বিশেষ সামাজিক পটভূমিকায় কোন বিশেষ বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে এই ধর্মমতের উদ্ভব ঘটেছিল, এই সমস্ত ধর্ম-সম্প্রদায় গঠনে বাঙ্গালী মনের কোন প্রবণতা কার্যকরী হয়েছিল, সে সমস্ত বিষয় অনুসন্ধান করা ও তাহার বিবরণ লিপিবদ্ধ করা তাই বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়।

যে কোন ধর্মান্দোলনের ইতিহাস আলোচনা করলেই পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পস্থা একটি বিশেষ যুগে তার জনপ্রিয়তা এবং যুগপরিবর্তনে তার পতনের ধারা লক্ষ্য করা যায়। বিশ্লেষণী দৃষ্টি নিয়ে বিচার করলে যুগ ও সমাজ জীবনের প্রভাবই এই উত্থান পতনের ইতিহাসের পশ্চাতে কারণ বলে অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না। সামাজিক প্রয়োজনে বিশেষ একটি যুগে বিশেষ কোন ধর্ম সাধনা প্রাধান্য লাভ করে আবার সামাজিক বাতাবরণের পরিবর্তনে তার রূপান্তর ঘটে। এই রূপান্তরের অন্তরালে সমাজ ইতিহাসের একটি ধারাবাহিক অগ্রগতির পরিচর্যাও লুক্কায়িত থাকে। কর্তাভজা ধর্মও একটি বিশেষ যুগের অনতি-পরিচিত একটি ধর্মসাধনা হলেও এর মধ্যে যুগাগত ধারাবাহিকতা তাই অনতি-সংলক্ষ্য নয়। বরং বাঙ্গালী জীবনের চিরকালীন

ঐতিহধারায়-একটি বিশিষ্ট প্রবাহের নামই কর্তাভজা ধর্ম।

(১. ward-এর লেখাতেই কর্তাভজাদের সম্পর্কে প্রথম লিপিবদ্ধ বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে শিষ্য সংখ্যা চার লক্ষাধিক বলা হয়েছে। যারা কিছুটা বিরূপতা নিয়ে এদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন তারাও এদের জনপ্রিয়তার কথা স্বীকার করেছেন। **অক্ষয়কুমার দত্তের উক্তি, লক্ষ লক্ষ লোক এই ধর্ম অবলম্বন করিয়াছে। **যোগেন্দ্রনাথ গুট্টাচার্য কর্তাভজা সম্পর্কে farstað, The most important of the class that may be called as Guruwor shippers of Bengal'।**রমেশচন্দ্র মজুমদার বাংলাদেশের ইতিহাস'-এ লিখেছেন : ক্ৰমে এই সম্প্রদায়ের খুব সমৃদ্ধি হয় এবং ভক্তের সংখ্যা অসম্ভব বৃদ্ধি হয়।'-পৃঃ ২৬৯। আরো আলোচনা সংযোজন-এ দ্রষ্টব্য।

২. সুকুমার সেন এবং উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য কর্তাভজাকে পশ্চিমবঙ্গের একটি বৃহৎ সম্প্রদায় হিনাকে উল্লেখ করেছেন। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে উদ্ভুত হলেও পরে মধা ও পূর্ববঙ্গেও একদা এই সম্প্রদায়ের বিপুল প্রতিপত্তি ছিল। , পশ্চিমবঙ্গের পূজাপান ও মেলা (২য় খণ্ড) : অশোক মিত্র সম্পাদিত। পৃ: ৩২৫। )

---------------ক্রমশ ----------

বিষয়: বিবিধ

১৫০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File