লিওনার্দো দা ভিঞ্চি
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ০৫ মার্চ, ২০১৯, ০৯:২১:০৪ সকাল
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি
কোন-কোন মানুষের উপর দৈব আশীর্বাদ যেন ঝরে পড়ে অজস্রধারে। কখনও বিশেষ একজন মানুষের মধ্যেই যেন যাবতীয় অতিপ্রাকৃত গুণাগুণের চমকপ্রদ সমাবেশ লক্ষ করা যায়। সৌন্দর্য ও সৌষ্ঠবের স্বাভাবিক বোধ ও প্রতিভা এমনভাবেই তার মধ্যে বিকশিত হয় যে যে-কাজে তিনি হাত দেন, তাতেই যেন স্বর্গীয় সুষমার ছোঁয়া লাগে। আর এভাবে সমসাময়িক অন্যান্য সকলকে পিছনে ফেলে তিনি এগিয়ে যান বহুদূর, যেন এ কথাই স্পষ্ট করে তোলার জন্য যে নিছক জাগতিক শিক্ষায় নয়, তিনি সরাসরি ঐশ্বরিক প্রজ্ঞায় ভূষিত। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি(১) সম্বন্ধে এ কথা বলা যায় নিঃসংঙ্কোচে। ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক মাধুর্য ছাড়াও তার প্রত্যেক কাজে অসাধারণত্বের ছাপ তো ছিলই, উপরন্তু ছিল সেই বিরল ক্ষমতা, যার দৌলতে যে বিষয়ের দিকেই তার মনোযোগ আকর্ষিত হোক না কেন, যতই কঠিন হোক না তার অন্তর্বস্তু, তিনি তা সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে ফেলতেন প্রায় অনায়াসে। তার ক্ষেত্রে অসাধারণ সামর্থ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মনের অভিজাত বলিষ্ঠতা ও অকুণ্ঠ সাহস। জীবৎকালে তাঁর খ্যাতি ছিল যেমন ব্যাপক, মৃত্যুর পরেও তার নাম তেমনই সতত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।
সার পিয়েরো দা ভিঞ্চির(২) সন্তান লিওনার্দো যথার্থই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন, ঈশ্বরের আশীর্বাদ তার উপর সত্যিই বর্ষিত হয়েছিল অজস্রধারে। কিন্তু তার প্রতিভা যদি এত বিচিত্র পথে ধাবিত না হত, তার চরিত্র যদি এত পরিবর্তনশীল ও অস্থির না-হত তাহলে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি অবধারিতভাবেই অগ্রগতির চূড়ান্ত স্বাক্ষর রেখে যেতে পারতেন। বস্তুত বহু কিছু তিনি শুরু করেও শেষ করে যেতে পারেননি।
(১. ফ্লোরেন্সের পশ্চিমে আনচিয়ানোর কাছে পাহাড়ী অঞ্চলে ছোট এক গ্রামের নাম ভিঞ্চি। ২. লিওনার্দোর জন্ম ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল। আইন-সংক্রান্ত পেশায় নিযুক্ত সার পিয়েরো-র অবৈধ সন্তান ছিলেন তিনি, কিন্তু যৌবনপ্রাপ্তির আগেই তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। লিওনার্দোর মা, স্থানীয় কৃষকবালিকা কাতেরিনা, পরে অন্য একজনকে বিয়ে করেন। )
অথচ শৈশবেই তিনি অঙ্ক শিক্ষা করতে গিয়ে অল্প সময়ে এত দূর এগিয়ে যান যে সংশয়ের উত্থাপনে ও প্রশ্নের জটিলতায় প্রায়শ তিনি তার শিক্ষককেই বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিতেন। সঙ্গীতের চর্চাও শুরু করেছিলেন তিনি, ভেবেছিলেন বীণাবাদনের কৌশল সম্পূর্ণ আয়ত্ত করবেন। উন্নত কল্পনা ও প্রাণশক্তির প্রাচুর্যে বীণার সঙ্গে তিনি গানও গাইতেন অপূর্ব, গানের বাণী ও সুর সৃষ্টি করতেন তাৎক্ষণিক।
এত বিচিত্র বিষয়ের আকর্ষণ ও অনুশীলনে তাঁর মানোযোগ বিভক্ত হলেও চিত্রাঙ্কন ও নতোন্নত ভাস্কর্যের (রিলিফ) কাজ তিনি কখনও পরিত্যাগ করেননি, তার কারণ বোধহয় এই একটি কাজ তাকে আকর্ষণ করত সর্বাধিক। সার পিয়েরো তা দেখে, সন্তানের অসাধারণ প্রতিভার কথা বিবেচনা করে একদিন লিওনার্দোর কিছু ছবি তার অন্তরঙ্গ বন্ধু আন্দ্রেয়া দেল ভেরোচিও-কে দেখান এবং এ কাজে আত্মনিয়োগ করলে লিওনার্দোর সাফল্যলাভের কোন সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চান। আন্দ্রেয়া লিওনার্দোর কাজ দেখে চমৎকৃত হন এবং অচিরেই তার পরামর্শে সার পিয়েরো লিওনার্দোকে আন্দ্রেয়ার বোতেগা বা কর্মশালায় শিক্ষার্থে প্রেরণ করেন(৩)।
লিওনার্দো উৎসাহের সঙ্গে সেখানে যোগ দেন এবং অল্প সময়ে শিল্পের সমস্ত শাখায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। প্রথম যৌবনেই পোড়ামাটিতে তিনি কয়েকটি অপূর্ব মুখমণ্ডলের ত্রিমাত্রিক রূপ সৃষ্টি করেছিলেন, যার মধ্যে শিশুমুখের কয়েকটি ভাস্কর্য দেখে তো মনে হয় যেন কোন দক্ষ ভাস্করের কাজ। স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিতল ও সমগ্ৰ অট্টালিকার নানান নকশা প্রস্তুত করেন। অসাধারণ জ্যামিতিক জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার প্রভায় এ সমস্তই তাঁর কাছে সহজ ও স্বাভাবিক ছিল। এমনকী সেই যুবকবয়সে তিনিই প্রথম আরনো নদীর গতিপথে সামান্য পরিবর্তন করে পিসা থেকে ফ্লোরেন্স পর্যন্ত জলপ্রণালী নির্মাণের কথা বলেন(৪)।
শস্য পেষাই ও ধৌতিসহ অন্যান্য আরও কিছু যন্ত্রের পরিকল্পনা তিনি করেন, জলের সাহায্যে যা চালানো যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিত্রাঙ্কনকেই যেহেতু তিনি পেশা হিশেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন, সেহেতু চাক্ষুষ প্রকৃতির অনুশীলন ও অঙ্কনেই ক্রমে অধিকাংশ সময় ব্যয় করতে থাকেন(৫)।
(৩. ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে লিওনার্দো আন্দ্রেয়া ভেরোচিও-র কর্মশালায় প্রবেশ করেন। দেমেনিকো
গিলানদিও, পিয়েত্রো পেরুজিনো ও সান্দ্রো বতিচেল্লিও ঐ একই কর্মশালায় শিক্ষানবিশ ছিলেন।
৪. গালিলেও-র শিষ্য ভিনসেনজিও ভিভিয়ানি বাস্তবে প্রায় ২০০ বছর পর এই জলপ্রণালী নির্মাণ
করেন।
৫. ফ্লোরেন্সের সন্তু লক সমিতি অর্থাৎ চিত্রকরদের ভ্রাতৃসংঘে ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে লিওনার্দোর নাম প্রথম নথিভুক্ত হয় ও স্বাধীন শিল্পী হিশেবে তিনি স্বীকৃতি পান। )
কখনও মাটি দিয়ে তিনি বিভিন্ন অবয়ব তৈরি করতেন, প্লাস্টারে ডুবিয়ে তার উপর কাপড়ের কোমল পর্দা লাগিয়ে সূক্ষ্ম বুনােটের মসৃণ কেমব্রিক বা লিনেনে অসম্ভব ধৈর্যের সঙ্গে শাদা-কালােয় তার অতুলনীয় সব রেখাচিত্র আঁকতেন। কাগজের উপরেও গভীর যত্ন নিয়ে এত নিখুঁত সব ছবি আঁকতে পারতেন যে নিঃসন্দেহে বলা যায় এক্ষেত্রেও দক্ষতায় তার সঙ্গে তুলনীয় কাউকে খুঁজে পাওয়া শক্ত। আমার কাছে লিওনার্দোর আঁকা আলো-ছায়ার সূক্ষ্ম বিন্যাসে উদ্ভাসিত মুখমণ্ডলের একটি ছবি আছে, এককথায় যা অপ্রাকৃত, স্বর্গীয়। শক্তি ও সুষমায় ঈশ্বরের আশীর্বাদে তিনি এতই প্রাণিত, বিভিন্ন বিষয়ে তার স্বকীয় ধারণার নিখুঁত প্রকাশে তিনি এতই শাণিত যে যুক্তির জোরে, আলােচনায় প্রাখর্যে তিনি প্রায় সকলকেই অনায়াসে স্বপক্ষে জয় করে নিতেন। তাঁর স্মৃতিশক্তিও মনে হয় সর্বদা তার বুদ্ধির সেবায় ক্লান্তিহীনভাবে নিয়োজিত ছিল।
পাহাড় কেটে বা সরিয়ে সুড়ঙ্গপথে যাতে একদিকের সমভূমি থেকে অন্যদিকের সমভূমি অঞ্চলে সহজে যাতায়াত করা যায় তার পরিকল্পনামাফিক নমুনা ও নকশা তৈরিতে তাঁকে একসময় প্রায়শ ব্যস্ত থাকতে দেখা যেত। লিভার, ক্রেন ও স্ত্র-এর সাহায্যে কীভাবে বিশাল ভারি কোন বস্তুকে ওঠানো বা সরানো যেতে পারে তা-ও তিনি ছবি এঁকে দেখিয়েছেন। বন্দর ও পোতাশ্রয় এভাবে সর্বদা সুশৃঙ্খল ও ব্যবহারের উপযোগী থাকতে পারবে, উপরন্তু এই পদ্ধতিতে প্রয়োজনে গভীর অতল থেকে জলও উত্তোলন করা যাবে। এ জাতীয় বহু বিচিত্র সম্ভাবনা সম্পর্কে অনুমান ও গবেষণায় তার কোন ক্লান্তি ছিল না। এ সমস্ত কাজে তার অসম্ভব পরিশ্রম ও নিবিড় ধ্যানের ফলাফল ও দৃষ্টান্ত হিশেবে থেকে গেছে গণনাতীত রেখাচিত্র-সম্বলিত অনেকগুলি খাতা ও পৃষ্ঠা, যার কিছু কিছু আমি স্বয়ং দেখেছি(৬)।
গুরুত্বপূর্ণ নানান বিষয় ছাড়াও সামান্য সুতো বা দড়ির সাহায্যে গ্রন্থিবন্ধনের কৌশল উদ্ভাবনেও তিনি কিছু কম সময় ব্যয় করেননি। এর মধ্যে জটিলতম ও কঠিনতম গ্রন্থির নকশাটি ধাতুর পাতে চিত্রিত অবস্থায় পাওয়া যায়, যার মাঝখানে ‘লিওনার্দাস ভিঞ্চি আকাদেমিয়া’ শব্দ কটি খােদাই করা রয়েছে। এইসমস্ত রেখাচিত্র ও নকশার মধ্যে একটির সাহায্যে লিওনার্দো ফ্লোরেন্সের তৎকালীন গণ্যমান্য নাগরিকদের বুঝিয়েছিলেন যে সান জিওভানি-র বিখ্যাত গির্জাটির বিন্দুমাত্রও ক্ষতি না করে গোটা সৌধটিকে একটু উঠিয়ে
(৬. মিলানের আমব্রোসিয়ান লাইব্রেরিতে একদা লিওনার্দোর লেখা ও চিত্র-সম্বলিত প্রায় ১৩টি
বাঁধানো খণ্ড ছিল। বর্তমানে তার যেটুকু ইতালি, প্যারিস ও ইংল্যান্ডেছড়িয়ে আছে, তাতে ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের আগের কোন তারিখ পাওয়া যায় না। এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় তার বহু বিচিত্র বিষয়ে গবেষণা-সম্পর্কিত পাণ্ডুলিপির অধিকাংশই চিরকালের মতো নষ্ট হয়ে গেছে। অবশিষ্ট অংশ থেকে অশেষ পরিশ্রম করে জাঁ পোল রিষটার পরবর্তীকালে সেসব দু’খণ্ডে প্রকাশ করেন। )
তার নিচে নাকি আরও কয়েকটি ধাপ তৈরি করা যেতে পারে। তার পরিকল্পনার পক্ষে তিনি তথ্য ও যুক্তিসহ এত বিশদে সওয়াল করেন যে সেসময় প্রকল্পটি সকলের স্বাভাবিক বলেই মনে হতে থাকে। অবশ্য অচিরেই বোঝা যায় ব্যাপারটা অসম্ভব। প্রিয়ভাষী বলে তিনি যেমন সকলের হৃদয় জয় করে নিতে পারতেন অনায়াসে, তেমনই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির পরিমাণ তার ক্ষেত্রে সামান্য হলেও এবং নিজে সেভাবে কখনও উপার্জনের চেষ্টা না করলেও তিনি সর্বদা বন্ধু ও ভৃত্য-পরিবৃত হয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। জীবজন্তুর প্রতি তার গভীর মমতা ছিল, বিশেষত ঘোড়ার প্রতি তার আকর্ষণ ছিল তীব্র। শোনা যায় যেখানে খাঁচায় করে পাখি বিক্রি হচ্ছে এমন কোন জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি প্রায়ই প্রয়ােজনের অতিরিক্ত দাম দিয়ে সেসব বন্দী পাখি কিনে উড়িয়ে দিতেন আকাশে। প্রকৃতি যথার্থই তার প্রতি ছিল অকৃপণ, ফলে যে-বিষয়ের দিকেই তার চিন্তা ও মনোযোগ আকৃষ্ট হত, তাতেই তিনি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতেন। যে-কাজই তিনি করতেন, তাতেই সত্য মাধুর্য সততা সৌষ্ঠব ও সুষমার স্বাভাবিক প্রকাশ দেখা যেত।
শিল্প-সম্পর্কিত বহু প্রকল্পে হাত দিয়েও তিনি তার অনেকগুলিই শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত অবস্থায় পরিত্যাগ করেন, কারণ তার মনে হয়েছিল যে হাতের পক্ষে হয়তো কোনদিনই বিমূর্ত চিন্তার নিখুঁত আকার যথাযথভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। বস্তুত তিনি লক্ষ করেছিলেন তাঁর মন যত দ্রুত যত কঠিন ও সূক্ষ্ম সব পরিকল্পনা রচনা করতে পারে, অত্যন্ত সক্ষম ও দক্ষতম হাতের পক্ষেও তৎক্ষণাৎ তার পূর্ণ রূপায়ণ অসম্ভব। তার মনের গতিও ছিল অতি বিচিত্র, জাগতিক বস্তু নিয়ে দার্শনিকতার সূত্রে তিনি কখনও উদ্ভিদের চরিত্র অনুধাবনে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন, সেখান থেকে হয়তো তার মন চলে যেত মহাজাগতিক বস্তুপুঞ্জের সন্ধানে, অবশেষে সূর্যের পরিক্রমণ পথ বা চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধির তত্ত্বে হয়তো স্থিত হলেন। আন্দ্রেয়া ভেরোচিও-র কর্মশালায় সান জিওভানি-কর্তৃক যিশুখ্রিস্টের অভিসিঞ্চন বিষয়ক একটি ছবিতে লিওনার্দো আনুষ্ঠানিক পোশাক-হাতে এক দেবদূতের ছবি এঁকেছিলেন, তখন যদিও তিনি নিতান্ত যুবক, তথাপি এতই দক্ষতার সঙ্গে তিনি তা এঁকেছিলেন যে শোনা যায় স্বয়ং শিক্ষকের পক্ষেও তা মর্মঘাতী হয়েছিল।
সার পিয়েরো দা ভিঞ্চির প্রজাস্থানীয় এক কৃষক একবার ডুমুর গাছ থেকে কাঠের একটি ফলক তৈরি করে তার কাছে এসে ফ্লোরেন্স থেকে তার উপর ছবি আঁকিয়ে এনে দেওয়ার অনুরোধ করে। লোকটি পাখি ও মাছ-ধরায় অত্যন্ত দক্ষ ছিল এবং প্রায়শ সার পিয়েরো-র নানা কাজে সাহায্য করত বলে তিনি তার কথা ফেলতে পারলেন না। লিওনার্দোকে এর কোন কিছু না জানিয়ে তিনি ফলকটি তাকে দিয়ে তার উপর ছবি এঁকে দেওয়ার কথা বলেন। লিওনার্দো ফলকটির আপাত অমসৃণ, সৌষ্ঠবহীন চেহারা দেখে প্রথমে তা নানান পদ্ধতি প্রয়োগ করে ছবি আঁকার পক্ষে যথাযথ করে তুলে ভাবতে থাকেন বিশেষ কী এমন এর উপর আঁকা যায় যা দেখে, ধরা যাক লোকে খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়বে। অন্যের প্রবেশাধিকার নেই এমন একটি ঘরে এই মতলব মাথায় নিয়ে তিনি অসংখ্য ফড়িং, টিকটিকি, শজারু, সাপ, চামচিকে, গোসাপ, পঙ্গপাল ইত্যাকার বিচিত্র সব প্রাণী জড়ো করেন এবং তাদের নানান বৈশিষ্ট্য নানাভাবে ব্যবহার করে আগুনের ঘেরাটোপে গরল ও অগ্নিস্রাবী এক ভয়ঙ্কর দানব সৃষ্টি করেন। যতদিন না ঐসব প্রাণী মরে-হেজে সারা ঘর অসহ্য দুর্গন্ধে ভরে যায় ততদিন ছবিটির পিছনে তিনি অসম্ভব পরিশ্রম করেন – অবশ্য কাজের নেশায় ঐ দুর্গন্ধ নিশ্চয়ই তার নাকে ঢুকত না। এভাবে ছবিটি শেষ হলে তিনি সার পিয়েরোকে সে কথা জানালেন। একদিন সকালে তদনুযায়ী ছবিটি নিতে এলে লিওনার্দো তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে ফলকটিকে ইজেলের উপর এমনভাবে রেখে আসেন যাতে জানালা দিয়ে আগত মৃদু আলোয় তা আরও ভয়ঙ্কর লাগে। সার পিয়েরো ঘরে পা দিয়ে প্রথম দৃষ্টিপাতেই চমকে ওঠেন, ফলকটিকে চিনতে না-পেরে, তার দেখা ভয়প্রদ দানবটি যে আসলে একটি ছবি মাত্র এমনকী সে কথাও বুঝতে না-পেরে দৌড়ে বেরিয়ে আসেন। লিওনার্দো তখন তাকে আশ্বস্ত করেন, বলেন, ছবিটি তো এই উদ্দেশ্য নিয়েই আঁকা হয়েছে, ফলে বোঝা যাচ্ছে এক অর্থে তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ছবিটি বিস্ময়করের চেয়েও বেশি কিছু বলে মনে হয় সার পিয়েরোর, লিওনার্দোর কল্পনাশক্তির অকুণ্ঠ প্রশংসাও করেন, কিন্তু সকলের অজান্তে আর-একটি ফলক কিনে তার উপর তীরবিদ্ধ হৃদয়ের একটি ছবি এঁকে ঐ কৃষককে ফেরৎ দেন। বলা বাহুল্য যে লোকটি তাতেই খুশি হয় ও আজীবন তার কাছে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ থাকে।
ছবিতে বস্তু বা অবয়বের উচ্চবচতা বা নতোন্নতি যতদূর সম্ভব স্পষ্ট করে তোলার জন্য গাঢ়তম ছায়ার চেয়েও গাঢ় ছায় আবিষ্কার করার লক্ষ্যে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন, অর্থাৎ আমাদের জ্ঞাত যাবতীয় কালোর চেয়েও অধিক গাঢ় এক কৃষ্ণকালোর সন্ধান করেছিলেন তিনি, যার প্রয়োগে ছায়া তো গাঢ়তর হয়ে উঠবেই, উপরন্তু আলোও হয়ে উঠবে আরও উজ্জ্বল। এইভাবে এমন নিচ্ছিদ্র অন্ধকার সৃষ্টির কথা তিনি কল্পনা করেছিলেন, যেখানে আর আলোর কোন চিহ্ন থাকবে না, দিনের আলোয় দেখা গড়নের স্পষ্টতা নয়, চেয়েছিলেন রাতের আঁধারে প্রায় প্রচ্ছন্ন দৃশ্যের মতো হয়ে উঠবে চারিপাশ আর এ সমস্ত কিছুরই অন্তিম লক্ষ্য ছিল শিল্পের ঔৎকর্ষ।
অ-সাধারণ বা বিশিষ্ট কোন মুখমণ্ডল, এমনকী চুল বা দাড়িরও বিচিত্র কোন বিন্যাস চোখে পড়লে লিওনার্দো তার আকর্ষণ এড়াতে পারতেন না, বাড়ি ফিরে স্মৃতি থেকে তার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি আঁকতে পারবেন এই বিশ্বাসে যতক্ষণ না পৌছতেন ততক্ষণ সহজে তার পিছু ছাড়তেন না।এভাবে অঙ্কিত অনেকগুলি মুখের কিছু ছবি আমার নিজের সংগ্রহেই রয়েছে - যার মধ্যে নারী ও পুরুষ দুই-ই রয়েছে(৭)।
১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে মিলানের ডিউক জিওভানি গালিয়াৎজোর মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন লুডোভিকো স্ফোরজা। বীণাবাদন শুনতে তিনি বিশেষ ভালোবাসতেন। লিওনার্দোর অপূর্ব বাজনা যাতে তিনি নিয়মিত শুনতে পান সে জন্য তিনি তাকে যথোচিত সম্মানের সঙ্গে মিলানে আমন্ত্রণ জানান। মিলানে (৮)যাওয়ার সময় লিওনার্দো সুরের মাধুর্য ও তীব্রতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিকল্পিত স্বহস্তে নির্মিত প্রায় সম্পূর্ণ রুপোর তৈরি একটি যন্ত্র সঙ্গে নিয়ে যান। ডিউকের সামনে সমবেত অন্যান্য গুণী সঙ্গীতজ্ঞদের এই একটি বিষয়ে প্রথমেই তিনি অতিক্রম করেন, তদুপরি তিনি ছিলেন তৎকালে তাৎক্ষণিক কাব্যরচনায়ও সেরা – ফলে ডিউক তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় ও তার অসাধারণ প্রতিভার বিচিত্র প্রকাশে আশাতীত খুশি হন। যিশুর জন্ম-বিষয়ক একটি ছবি পূজাবেদির পশ্চাৎপটে স্থাপনের জন্য তখন আঁকার ফরমাশ দিয়েছিলেন তাঁকে, পরে যা ডিউক স্বয়ং সম্রাটকে উপহার হিশেবে পাঠান। মিলানের সান্তা মারিয়া দেল গ্রাজি-র দোমিনিক সম্প্রদায়ের সাধুদের জন্য লিওনার্দো অন্তিম ভোজসভারও একটি বিস্ময়কর ছবি আঁকেন -- সৌন্দর্যের বিচারে যার তুলনা মেলা ভার। এই ছবিতে যিশুর অনুগামী শিষ্যদের রূপায়ণেই তিনি এত সৌন্দর্য ও গরিমা প্রদান করেন যে খ্রিস্টের ছবিটি তাকে বাধ্যত অসম্পূর্ণ রাখতে হয়; সঙ্গত
(৭. সমসাময়িক একজন লেখক লিখেছেন তিনি নিজে একটি ভােজসভায় উপস্থিত ছিলেন যেখানে
লিওনার্দো কয়েকজন কৃষককে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আর তাদেরকে অনবরত নানান হাসির গল্প বলে উত্তেজিত করে তুলছিলেন। তার পরেপরেই হাসির দমকে বিকৃত সেসব মুখ তিনি এঁকে রাখছিলেন এমন ভঙ্গিতে, যা দেখে হাসি সামলানোও মুশকিল। ৮.ফ্লোরেন্স ছেড়ে লিওনার্দো মিলানে ঠিক কবে গিয়েছিলেন এ নিয়ে সংশয় আছে। বিষটার মনে করেন লিওনার্দো ফ্লোরেন্স ছেড়েছিলেন ৮২-তে, কিন্তু মিলানে গিয়েছিলেন ৮৭-তে, মাঝের সময়টুকু তিনি ছিলেন আর্মেনিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে। অনেকের মতে সাঙ্গীতিক দূত হিশেবে তাকে মিলানে প্রেরণ করেছিলেন লােরেঞ্জো দ্য ম্যাগনিফিশেন্ট, কিন্তু পরবর্তী সতেরো বছর লিওনার্দো স্ফোরজা-র রাজসভায় বহু বিচিত্র ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভাসারি-প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে এই সমস্ত তারিখের মিল নেই। )
কারণেই তার মনে হয়েছিল খ্রিস্টকে সকলের চেয়ে আলাদা করার মতো স্বর্গীয় মহিমা-প্রকাশক ভাষা তার জানা নেই। ক্ষুদ্রতম অনুপুঙ্খও ছবিটি অবর্ণনীয় ধৈর্য ও পরিশ্রমের আলোয় সমুজ্জ্বল। অন্যান্য সব কিছুর কথা বাদ দিয়ে শুধু টেবিল ঢাকা দেওয়ার কাপড়টির কথাই যদি বলা যায়, তাহলে বলতে হয় যে সম্ভবত আসল লিনেন কাপড়ও এর পাশাপাশি রেখে দেখলে তা এর চেয়ে বেশি বাস্তব বলে মনে হবে না(৯)।
কথিত আছে যে মঠাধ্যক্ষ লিওনার্দোকে ছবিটি শেষ করার জন্য অযথা উত্ত্যক্ত করেছিলেন। তার পক্ষে বোঝা অসম্ভব ছিল যে শিল্পী কেন অনেক সময় রঙের একটি আঁচড়ও না-দিয়ে ছবিটির সামনে প্রায় সারাদিনই চিন্তামগ্ন হয়ে বসে থাকতেন। সময়ের নিদারুণ অপচয় ছাড়া তার কাছে এ আর কিছুই নয়, তার বাগানে যারা মাটি কোপায় তাদের মতোই তিনি আশা করতেন লিওনার্দোও তার হাত থেকে পেন্সিল নামাবে না। কোনভাবেই তাকে দিয়ে দ্রুত কাজ করাতে না পেরে মঠাধ্যক্ষ একদিন ডিউকের কাছেই তার বিরুদ্ধে নালিশ করেন। বাধ্য হয়ে ডিউক লিওনার্দোকে দ্রুত ছবিটি শেষ করতে বলেন, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে এ কথাও জানাতে ভোলন না যে মঠাধ্যক্ষের তাড়নাতেই এই অন্যায় অনুরোধ তাকে করতে হচ্ছে। লিওনার্দো জানতেন ডিউক যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও বিবেচক, তাই তাকে তিনি সব কিছু খুলে বলতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু মঠাধ্যক্ষের সঙ্গে কোনরকম যুক্তিতর্কে জড়াতে তার স্পষ্ট আপত্তি ছিল। এই প্রসঙ্গে নিয়েই আলোচনাক্রমে তিনি মন্তব্য করেন যে প্রতিভাধর লোকে তখনই সবচেয়ে বেশি সৃষ্টিশীল থাকেন যখন বাহ্যত তারা পরিশ্রম করেন সবচেয়ে কম, কেননা সে সময় তাদের মন ব্যস্ত থাকে উদ্ভাবনে ও সেই সমস্ত ধ্যানধারণার সম্পূর্ণতায় যার রূপায়ণ ও প্রকাশ তাঁদের হাতে ঘটবে হয়তো অনেক পরে।
ডিউককে তিনি জানান যে মডেল হিশেবে আরও অন্তত দুটি মুখ তার দরকার, যার একটি হলো স্বয়ং খ্রিস্ট, এ মরজগতে যাঁর সঙ্গে তুলনীয় কোন মুখের সন্ধান পাওয়ার আশা নেই, আবার দিব্য সৌন্দর্য ও মহিমায় ভূষিত মূর্ত ঈশ্বরের রূপায়ণে যে-কল্পনাপ্রতিভার দরকার, দুর্ভাগ্যবশত তা-ও তার নেই। দ্বিতীয় মুখটি জুসের, সে নিয়েও তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কেননা প্রভুর কাছ থেকে নানাভাবে উপকৃত হওয়ার পরও তার ও এই জগতের স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসহন্তা, নীচ সংকীর্ণ হৃদয়ের সেই লােকটির মুখবৈশিষ্ট্যও তার পক্ষে বােধহয় কল্পনায় আনা সম্ভব নয়।
(৯. ‘দ্য লাস্ট সাপার' নামে খ্যাত এই ছবিটি লিওনার্দো শুরু করেন সম্ভবত ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে। তুঙ্গ
রেনেসাঁর প্রথম ও প্রতিনিধিস্থানীয় ছবি হিশেবে সমালোচকরা ছবিটিকে গণ্য করে থাকেন। )
অবশ্য দ্বিতীয় মুখটি নিয়ে তার সন্ধান জারি থাকলেও যদি শেষ পর্যন্ত উপযুক্ত বিকল্প নাই পাওয়া যায়, তাহলে উপায় একটা আছে - সে হলো ঐ নির্লজ্জ মঠাধ্যক্ষকেই জুডাসের মডেল হিশেবে ব্যবহার করা। এ কথায় ডিউক প্রবলভাবে হেসে ওঠেন এবং তৎক্ষণাৎ লিওনার্দোকে কাজের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। বেচারা মঠাধ্যক্ষ আরও বিভ্রান্ত হয়ে অগত্যা বাগানের দেখাশোনাতেই ফিরে যান এবং তখনকার মতো লিওনার্দোকে রেহাই দেন।
এ সময়েই লিওনার্দো অশ্বপৃষ্ঠে আরূঢ় ডিউকের বিরাট এক মূর্তি ব্রোঞ্জে ঢালাই করার প্রস্তাব দেন, যা পরে তাঁর স্মৃতিসৌধে স্থানান্তরিত হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত ঐ মূর্তির মডেলই এমন বিশাল আকার ধারণ করে যে বোঝা যায় প্রকল্পটি কার্যত অসমাপ্ত থেকে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। লোকেও ঈর্ষাবশত বলে বেড়াতে থাকে যে আরও বিভিন্ন প্রকল্পের মতো লিওনার্দো কাজ শেষ করার সদিচ্ছা ছাড়াই এ কাজের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন। এত বৃহৎ মাপের ঢালাইয়ের কাজে অবশ্য বিপদে পড়াটাই স্বাভাবিক, কারণ একবারে এ মূর্তি ঢালাইকরা অসম্ভব। কিন্তু অন্য দিক থেকে, তার উন্নত মনের মহত্ত্বই বোধহয় এইখানে যে তা সম্ভাব্যের সীমানা স্বতই পেরিয়ে যেতে চায়, উৎকৃষ্টের উপরও আর-এক প্রস্থ ঔৎকর্ষের কথা ভাবে, আর মনের এই বৈশিষ্ট্যই বোধহয় শেষ পর্যন্ত তার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। প্রস্তাবিত মডেলটি যাঁরাই দেখেছেন, তারা সকলেই স্বীকার করেছেন যে এর চেয়ে সুন্দরতর, এর চেয়ে মহিমান্বিত কোন মূর্তি তারা কোনদিন কল্পনাও করেননি। একই মূর্তির মোমের তৈরি ছোট্ট কিন্তু নিখুঁত একটি মডেলও মূল মূর্তিটির মতই বিনষ্ট হয়ে গেছে। ঘোড়ার অঙ্গসংস্থান নিয়ে তার অনুশীলন-সম্বলিত খাতাটিও একই সঙ্গে হারিয়েছে। পরবর্তীকালে তিনি মানবদেহের অঙ্গসংস্থানেই যাবতীয় মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন। মারকানতোনিও দেল তোরে নামক একজন প্রথিতযশা দার্শনক এবং লিওনার্দো এ বিষয়ে পরস্পরকে সহযোগিতার মাধ্যমে এগোতে থাকেন। অঙ্গ-সংস্থানবিদ্যার বৈজ্ঞানিক আলোচনায় মারকানতোনিও-র অবদান অসামান্য, বলা যায় তিনিই এই শাস্ত্রকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসেন। এ কাজে লিওনার্দোর প্রতিভা ও পরিশ্রম তাকে প্রভূত সাহায্য করেছিল। এই কাজের সূত্রে নিজের হাতে ব্যবচ্ছেদিত মানবদেহ থেকে একটি খাতায় লিওনার্দো মানুষের সামগ্রিক অম্বিকাঠামো ও তার অস্তি-র সাধারণ বিন্যাস ও সংস্থান সযত্নে এঁকে রেখেছিলেন। তার ওপর যােগ করেছিলেন বিভিন্ন স্নায়ু ও পেশীর অবস্থান। পেশীর প্রথম স্তরটি যেমন যুক্ত থাকে অস্থির সঙ্গে, দ্বিতীয় স্তরটি সুসঙ্গতি ও সংযুক্তির শক্তি প্রদান করে এবং তৃতীয় স্তরটি গতির ধারক। এরকম প্রত্যেকটি পৃথক অংশ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা তিনি পাশে-পাশেই লিখে রেখেছিলেন তীক্ষ ও অমার্জিত হরফে, বাঁহাতে উল্টোছাদে লেখা পাণ্ডুলিপির এই সমস্ত পৃষ্ঠা আয়নার সাহায্য ছাড়া পড়া কঠিন। এ বিষয়ে অনধিকারী, পাঠাভ্যাসহীন কোন লোেক যাতে আদৌ এর অর্থ উদ্ধার করতে না পারে তার জন্যই তিনি এ কৌশল গ্রহণ করেছিলেন(১০)।
মানবশরীরের অঙ্গসংস্থান বিষয়ক এই সমস্ত রেখাচিত্ৰই এখন মিলাননিবাসী এক ভদ্রলোক, ফ্রানসেস্কো দা মেলজো-র সংগ্রহে রয়েছে। শৈশবে সরল সৌন্দর্যের অধিকারী মেলজো লিওনার্দোর অশেষ স্নেহভাজন ছিলেন, এখন তার যথেষ্ট বয়স হলেও এই অমূল্য শিল্প-ঐশ্বর্য তিনি পুরাবস্তুর মতোই সংরক্ষণে একনিষ্ঠ(১১)।
এছাড়াও পবিত্র স্মৃতির মতাে তাঁর সংগ্রহে রয়েছে লিওনার্দোর একটি অসাধারণ প্রতিকৃতি(১২ )।
ফ্রানসেস্কো দেল জিওকোন্দো-র অনুরোধে তার স্ত্রী মোনা লিসা-র একটি প্রতিকৃতি আঁকতে শুরু করেছিলেন একবার, কিন্তু প্রায় বছর-চারেক মগ্ন থাকার পর এ ছবিটিও লিওনার্দো অসমাপ্ত
(১০. রিষটার তার প্রস্তাবনায় লিখেছেন, লিওনার্দোর পাণ্ডুলিপির মাত্র কয়েকটি পৃষ্ঠাও সংগ্রহ করার
জন্য যে-উন্মাদনা দেখা গেছে বা তার জন্য যে-দাম দিতে সংগ্রাহকরা এগিয়ে এসেছেন, তার একাংশ উৎসাহও এই সমস্ত পৃষ্ঠায় পাঠ্যবস্তু কী আছে তা জানার জন্য দেখা যায়নি। তার সহজ কারণ ছিল লিওনার্দোর হস্তাক্ষর প্রায় দুর্বোধ্য, এমনকী তার বিচ্ছিন্ন কয়েকটি পংক্তি উদ্ধার করার জন্যও রীতিমতো অনুশীলন দরকার। তার ওপর আছে নানা বিকল্প পাঠের মধ্যে থেকে অর্থবহ সমগ্রতা খুঁজে পাওয়ার সমস্যা। লিওনার্দো লিখতেন উল্টোছদে, ডানদিক থেকে বাঁদিকে, রীতিমতো অমার্জিত হরফে। রিষটার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন আয়নার সাহায্যে প্রথমদিকে এ লেখা পড়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা হলেও পাণ্ডুলিপির আয়তন ও পৃষ্ঠাসংখ্যার কথা বিচার করলে বোঝা যায় এ পদ্ধতি অযথা ক্লান্তিকর এবং বাস্তবে মোটেই অনুসরণযোগ্য নয়। এছাড়া লিওনার্দোর ভাষা ব্যবহারেও নানান স্বকীয়তা আছে -- কখনও ছোট-ছোট কয়েকটি শব্দকে তিনি একটি শব্দে পরিণত করেন, কখনও কোন বড় শব্দকে আকস্মিকভাবে দুভাগে ভেঙে দেন, তার ওপর তার লেখায় বিরতিচিহ্নের কোন বালাই নেই, উচ্চারণের বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্ন বা আকসেন্টও তিনি কখনও ব্যবহার করেননি। লিওনার্দোর এই পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায় কী আছে তা নিয়ে তাই অন্যদিকে কৌতুহলের শেষ ছিল না।
১১, মৃত্যুর মাত্র নদিন আগে, ২৩ এপ্রিল ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে লিওনার্দো তার সমস্ত পাণ্ডুলিপি উইল করে
বন্ধু ও শিষ্য ফ্রানসেস্কো মেলদোকে দিয়ে যান। ভাসারি ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে মিলানে মেলাজো-র এই সংগ্রহ দেখেন। ১৫৭০-এ মেলঙ্গো মারা যাওয়ার পর তার পুত্র ওরাজিও ১৫৯০ নাগাদ ভাস্কর পম্পেও লিয়নিকে এর অধিকাংশ বিক্রি করে দেন। লিয়নি অন্তত দশটি বাঁধানো খণ্ড ও বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন পৃষ্ঠা এভাবে সংগ্রহ করেন। জীবনের শেষ পর্বে লিয়নি তার সংগ্রহের অধিকাংশ স্পেনে নিয়ে যান, যেখানে তিনি রাজসভার ভাস্কর হিশেবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৬০৮-এ মাদ্রিদে তিনি মারা যান। মিলানে লিয়নি-সংগ্রহের অবশিষ্টাংশ তার নাতির কাছ থেকে কিনে নেন গালিয়াজো আরকোনাতি ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৬৩৭-এ আমব্রোসিয়ার লাইব্রেরিতে তা দান করেন। স্পেনে লিয়নি-সংগ্রহের প্রধান অংশ এর অনেক আগেই বিভিন্ন নিলামে হস্তান্তরিত হয়ে যায়, সেসবের অস্তিত্ব সম্পর্কে এখন আর স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়। বোধহয় তার একাংশ
অষ্টাদশ শতকে কোনভাবে ব্রিটেনের রাজ সংগ্রহে স্থান পায়। )
অবস্থায় পরিত্যাগ করেন। ফঁতেনব্ল-তে ফ্রান্সের রাজা সিস-এর সংগ্রহে আপাতত ছবিটি রয়েছে। শিল্প শুদ্ধ প্রকৃতিকে কতদূর পর্যন্ত অনুসরণে সার্থক হতে পারে, চর্মচক্ষে তা দেখার আকাঙক্ষা যাদের রয়েছে তারা এই প্রতিকৃতির ঔৎকর্ষে তা দেখতে পাবেন, যেখানে বলা যায় মুখের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই চরম সূক্ষ্মতায় পুনরুৎপাদিত হয়েছে। যেমন তার চোখ ঔজ্জ্বল্যের দীপ্তি ও আর্দ্রতার সম্মিলনে বাস্তবানুবর্তী, তেমনই চোখের চারিপাশে স্নান লালিমা ও নীলাভার বৃত্ত সমেত অক্ষিপহ্মের সূক্ষ্মতা স্বাভাবিকতায় উদ্ভাসিত। ভূবিন্যাসের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য এখানে এমনভাবে প্রদর্শিত যে মনে হবে তার চেয়ে স্বাভাবিক আর কিছু হয় না। গোলাপি-কোমল নাসাছিদ্র-সহ ঐ সুন্দর নাসিকাকেও জীবন্ত ভাবলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মুখের রূপরেখা চমৎকার, গোলাপি আভায় ঠোঁটদুটি মুখের সঙ্গে সুসমঞ্জস, গালের রক্তিমাভা তো চিত্রিত কৃত্রিম বলে ধরাই সম্ভব নয়, বরং মনে হয় যেন রক্তমাংসে সঞ্জীবিত। গলার নিচে যিনি একটু মন দিয়ে দেখবেন, তার পক্ষে এমনকী ধমনীর স্পন্দনও অনুভব করা অসম্ভব নয়। বস্তুত এই একটি ছবি এমন বিচক্ষণতার সঙ্গে অঙ্কিত যে দক্ষতম শিল্পাচার্যও এর সামনে দাঁড়িয়ে কেঁপে উঠবেন, উৎকৃষ্ট শিল্পের সঙ্গে তার পরিচয় যত গভীরই হোক না কেন রসিক দর্শককেও এ ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হতে হবে। মোনা লিসা ছিলেন অতুলনীয় সৌন্দর্যের অধিকারী, তার উপর লিওনার্দো তাঁর প্রতিকৃতি আঁকার সময় বিশেষভাবে চেয়েছিলেন যে তার মুখে যেন তখন কোনভাবেই বিষাদের ছায়া না-পড়ে, বরং তাকে সর্বক্ষণ প্রফুল্ল রাখতে গানবাজনা-সহ নানান বিনোদনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সে কারণে এ ছবিতে মাধুর্যের এমন এক প্রকাশ দেখা যায় যে মনে হয় যেন অলক্ষিতে এ ছবিতে কোথাও দৈবের ছোঁয়া লেগেছে। প্রাণ ও জীবনের এর চেয়ে
(১২. লিওনার্দোর প্রতিকৃতি বলে প্রচলিত বিভিন্ন ছবি একে অপরের থেকে ভীষণই আলাদা। এখানে
কাজেই ঠিক কোন্ প্রতিকৃতির কথা বলা হচ্ছে তা বলা দুরূহ। অপরূপ প্রকাশ আর কিছু হতে পারে না বলে এ ছবি বিস্ময়কর কীর্তি হিশেবে প্রথম থেকে ই স্বীকৃত। )
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিলেন আত্মিক শক্তিতে চরিত্রবান, তার সমস্ত কাজে ছিল ঔদার্যের ছাপ। শোনা যায়, একবার ব্যাঙ্ক থেকে তার জন্য পিয়েরো সোদোরিনি-কতৃক বরাদ্দ মাসিক বেতন তুলতে গেলে কোষাধ্যক্ষ তাকে খুচরো পয়সার কয়েকটি কাগজের খাম দিতে যান। বিরক্ত লিওনার্দো, ‘আমি তোমাদের ঐ দু’পয়সার ছবি-আঁকিয়ে নয় হে’ বলে তা নিতে অস্বীকার করেন।
পোপ দশম লিও-র সন্ত পিটারের পদে অভিষেকের সময় লিওনার্দো রোমের যাত্রাপথে ডিউক গিলিয়ানো দ্য মেদিচি-র সঙ্গী হন। যাজক ভদ্রলোকের দার্শনিক অন্বেষা ছিল, বিশেষত অ্যালকেমি বা কিমিয়াশাস্ত্রে তার গভীর আসক্তি ছিল। লিওনার্দো পথেই মোম থেকে একজাতীয় পিণ্ড তৈরি করে অর্ধতরল অবস্থায় তার থেকে কয়েকটি প্রাণীর অবয়ব বানালেন, কঁপা ও অত্যন্ত সূক্ষ্ম বুনোটের পুতুলগুলির মধ্যে তারপর হাওয়া ভরে ফুলিয়ে আকাশে ভাসিয়ে দিলেন। হাওয়া বেরিয়ে গেলেই অবশ্য সেসব আবার মাটিয়ে পড়ে যায়। একদিন বেলভের-এর দ্রাক্ষাকুঞ্জের এক মালি ভারি বিচিত্র এক সরীসৃপ-জাতীয় প্রাণী দেখতে পায়, লিওনার্দো ঐ জাতীয় অন্য একটি সরীসৃপের চামড়া থেকে তার জন্য ডানা বানিয়ে দেন। সেই ডানার উপর পারদের প্রলেপ লাগিয়ে তারপর তার চোখ, শিং এবং দাড়ির ব্যবস্থা করে তাকে পোষ মানান। যে-কেউ তখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসত তাদের সঙ্গে সোৎসাহে তিনি এই প্রাণীটির পরিচয় করিয়ে দিতেন, আতঙ্কিত হয়ে অচিরেই তারা ছুটে পালাত। ঠিক এভাবেই ভেড়ার অস্ত্র পরিষ্কার করে তাতে হাপর দিয়ে হাওয়া ভারে যেতেন তিনি, অন্তত ততক্ষণ যতক্ষণ না তা ফুলে-ফেঁপে সারা ঘর ভরিয়ে ফেলে। তারপর মন্তব্য করতেন, এ হলো প্রতিভা বা সহজাত ক্ষমতার যথার্থ প্রতীক, আগে ছোট্ট একটুখানি জায়গায় আবদ্ধ থাকলেও তা প্রয়োজনে বিরাট জায়গা অধিকার করে নেওয়ার সামর্থ্য রাখে। দর্পণ ও দৃষ্টিধর্ম-সংক্রান্ত নানান যন্ত্রপাতি নিয়ে তিনি প্রচুর পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। শাোনা যায় তৈলচিত্রের জন্য বিশেষ ধরনের তেল এবং ছবি সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত বানিশ তৈরির পিছনেও তিনি অনেক সময় ব্যয় করেছেন। কথিত আছে যে একবার পোপ লিও-র কাছ থেকে কোন একটি ছবির ফরমাশ মেলার সঙ্গে-সঙ্গে বার্নিশের জন্য ভেষজ গুল্ম ও তেল নিষ্কাশন করতে শুরু করেন তিনি। তা দেখে যাজকমহোদয় বলে ওঠেন যে হায়, এ যে কাজ শুরু করার আগেই তার শেষের চিন্তা, বোঝাই যাচ্ছে লোকটা কাজের কাজ কিছুই শেষ পর্যন্ত করবে না। মিচেলাগনোলো ব্যুনারোক্তির সঙ্গে লিওনার্দোর বিরোধ ছিল বরাবরের, উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শেষ পর্যন্ত প্রথমজন ফ্লোরেন্স ত্যাগ করেন, তার অজুহাত হিশেবে ডিউক গিলিয়ানো বলেন যে সান লোরেঞ্জোর সম্মুখভাগ সজ্জার জন্য রোম থেকে স্বয়ং পোপ তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এ কথা লিওনার্দোর কানে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তিনিও দেশ ছেড়ে ফ্রান্সে গিয়ে উপস্থিত হন। ফ্রান্সের সম্রাট ফের তাকে নতুন ছবির ভাৱ দিলেও লিওনার্দো তার স্বভাবানুযায়ী শুধু বিদগ্ধ কথার জাল বিছিয়েই দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত বার্ধক্যে পৌছে অসুস্থ মুমূর্ষ অবস্থায় তিনি ক্যাথলিক আচার-অনুষ্ঠান ও খ্রিস্টধর্মের মত ও পথে আস্থা জ্ঞাপন করেন। অনেক অঞ ও অনুতাপে স্বীকারোক্তির পর অবশেষে পবিত্র অনুগ্রহ লাভ করেন, তখন আর তার দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই, ভৃত্য ও বন্ধুদের কাধে ভর দিয়ে কোনক্রমে এই ধর্মানুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। সম্রাট, যিনি প্রায়ই তার কাছে আসতেন, এর পরপরই তাকে দেখতে আসেন। সম্রাটের সামনে লিওনার্দো উঠে বসেন ও প্রসঙ্গক্রমে দুঃখ করে বলতে থাকেন যে শিল্পের চর্চায় যতটা পরিশ্রম তার করা উচিত ছিল তা না করে বস্তুতপক্ষে ঈশ্বর ও মানুষ – উভয়ের কাছেই হয়তো তিনি চরম অন্যায় করেছেন। কথা বলতে-বলতেই হঠাৎ বেদনার তীব্র আক্রমণে ঢলে পড়লে স্বয়ং সম্রাট তাঁকে নিজের কোলে টেনে নেন, এর চেয়ে মহত্তম সম্মান যে আর হয় না সে কথা বুঝতে পেরে লিওনার্দো ৭৫ বছর বয়সে সম্রাটের বুকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন(১৩)।
লিওনার্দোর মৃত্যু, যাঁরা তাকে জানতেন, তাদের সকলের কাছেই গভীর বেদনাবহ। তার মুখমণ্ডলে সৌন্দর্যের অনুপম দীপ্তি গভীর বিষাদগ্রস্ত চিত্তেও আনন্দের সঞ্চার করত, কথার শক্তিতে ভয়ানক অবাধ্যও সহজেই তার বশীভূত হয়ে পড়ত। শারীরিকভাবে তিনি এতটাই শক্তি ও সামর্থ্যের অধিকারী ছিলেন যে হিংসার চরম প্রকাশও তাঁর সামনে সংযত হয়ে পড়ত, লোহার কড়া বা নাল তিনি অনায়াসে এক হাতেই বাঁকিয়ে দিতেন। আবার চরিত্রের স্বাভাবিক ঔদার্যবশে ধনীদরিদ্র নির্বিশেষে যে-কোন বন্ধুর জন্য তার কাছে আশ্রয় ও আতিথ্যের কখনও অভাব ঘটত না। আতিথ্যলাভের শর্ত ছিল শুধু একটাই : কোন না কোন কাজে তাকে দক্ষ বা কুশলী হতে হবে। তার অঙ্কিত ছবিতে দরিদ্রতম, তুচ্ছতম বাড়ির দেওয়ালও সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। লিওনার্দোর জন্মের ফলে ফ্লোরেন্স ঈশ্বরের অযাচিত দানে যেমন পুষ্ট হয়ে উঠেছিল, তেমনই তার মৃত্যুতে এ শহরের ক্ষতিও হলো অবর্ণনীয়।
(১৩. লিওনার্দোর বয়স তখন পঁচাত্তর নয়, ছিল সাতষট্টি বছর। সম্রাটের কোলে মৃত্যুবরণের গল্পটিও
এখন আর বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করা হয় না। )
বইঃ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নোটবুক- জর্জিও ভাসারি-অবলম্বনে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির জীবনি
বিষয়: বিবিধ
১১০৮ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন