ইন্দিরা গান্ধীর আরেক রূপ
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ০৩:৪৪:৪৭ দুপুর
ইন্দিরা গান্ধীর আরেক রূপ
| কে পি মাথুর ঞ্জ অনুবাদ : মোহাম্মদ হাসান শরীফ
(ইন্দিরা গান্ধী (১৯১৭-১৯৮৪)। পিতা জওয়াহেরলাল নেহরুর পর ভারতের সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী। অনেকের কাছে লৌহমানবী হিসেবে পরিচিত এই নারী রাজনৈতিক নির্মমতা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত করার জন্য নিন্দিত। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ভারতের উত্থানও হয়েছে তার আমলে। তার দোর্দণ্ড প্রতাপ আরাে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছিল জরুরি অবস্থাকালে (১৯৭৫-১৯৭৭)। পাঞ্জাব বিদ্রোহ দমনে নৃশংসতার জের ধরে ইন্দিরা গান্ধীকে তার শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হতে হয়েছিল। | তবে তার এই পরিচয়ের বাইরেও একটি দুনিয়া ছিল। সেটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটাই তুলে এনেছেন তার একসময়ের ব্যক্তিগত
- ফিচার।
চিকিৎসক কে পি মাথুর। এখন তার বয়স ৯২ বছর। তিনি “দি আনসিন ইন্দিরা গান্ধী’ নামের বইতে যে চিত্র তুলে ধরেছেন, এখানে তার কিছু বিবরণ তুলে ধরা হলো]
আমি প্রধানমন্ত্রীকে নিজ হাতে ডিভানের বেডকভার বদলাতে দেখেছি। বাংলাদেশ যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক দিন পরের ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেছেন। সকালে আমি যখন তার সাথে। সাক্ষাৎ করতে গিয়ে তাকে ধুলা-ময়লা পরিষ্কার করতে দেখলাম। খুব সম্ভবত এটা আগের রাতের টেনশন কমাতে তাকে সাহায্য করছিল। তার সাথে আমার পরিচয়ের প্রথম দিককার আরেকটি ঘটনায় আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। একটা আয়তাকার হলুদ ম্যাট্রেস। ফ্লোরে। বিছানো ছিল। আমি তার পিএকে বিষয়টা জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি আমাকে বললেন, প্রধানমন্ত্রী সকালের ব্যায়াম আর যোগ করতে এটা ব্যবহার করেন। এক দিন, তিনি এই ম্যাট্রেসের দিকে আমার তাকিয়ে থাকাটা লক্ষ করলেন। তিনি তখন আমাকে ইতিহাসটা বললেন। তিনি জানালেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীতে চলাফেরা করতেন। ম্যাট্রেসটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল রেলের কম্পার্টমেন্ট বার্থের জন্য।
কুশনগুলো পরীক্ষা করলেন প্রধানমন্ত্রী। জুলফিকার আলী ভুট্টোর (ওই সময়ের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তিনি গিয়েছিলেন শিমলা চুক্তির জন্য) প্রিয় পানীয়, সিগারের ব্যবস্থা করা হলো। সম্মেলনের (১৯৭২ সালে) প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল হেলিকপ্টারে করে শিমলা গেলেন। তারা আনন্দল হেলিপ্যাডে নেমেছিলেন। ভুট্টোর থাকার জন্য নির্ধারিত হিমাচল ভবনের সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না তা সরেজমিন দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রী নিজে সেখানে গেলেন। কয়েকটা ব্যাপারে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। তার নির্দেশনায় পর্দা, বেড লিনেন, নতুন সােফাসহ গৃহসজ্জায় বেশ কয়েকটা ব্যাপারে পরিবর্তন আনা হলো। _ এ ধরনের সব ঘটনায় রুচিসম্মতভাবে ফার্নিচার, কাটলারি, ফুলসজ্জা ইত্যাদি সবকিছু হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী খুবই সচেতন থাকতেন। সব অতিথি যাতে খাবার উপভােগ করতে পারেন। করতেন।
সে জন্য তিনি মেনু তদারকি করতেন। এমনকি তার ব্যক্তিগত ডিনার ম্যাট্রেসটা যাতে নিখুঁত হয়, সে ব্যাপারে সবকিছু করতেন। সবাই যাতে খাবার ও বিশেষভাবে তৈরি সঙ্গ উপভোগ করতে পারে, সেজন্য তিনি বসার ব্যবস্থা খতিয়ে করা হয়েছিল দেখতেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি ভবনে আনুষ্ঠানিক ডিনারে যেখানে স্টাফরা সবাই হতেন প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ, মেন্যু ও বসার ব্যবস্থা সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করতেন। এ ধরনের একটি ঘটনায় ওই সময়ের এমপি জে জয়ললিতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তার বার্থের জন্য | আসন রাখা হয়েছিল প্রধান অতিথি বসার প্রধান টেবিল থেকে বেশ দুরে। প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুত বুঝে ফেলেছিলেন, ভারতের রাজ মঞ্চে জয়ললিতা উদীয়মান তারকা। তিনি তার ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দিয়ে অল্প সময়েই শীর্ষে উঠে আসবেন। ইন্দিরা সম্মানিত লােকদের আসনে জয়ললিতাকে বসানোর ব্যবস্থা করে পরিসি সামাল দিলেন। জয়ললিতার স্থান হলো প্রধান টেবিলে প্রধান অতিথির পাশে। সহজাত ক্ষমতাবলে জয়ললিতার সম্ভাব্য উত্থান তখনই উপলরি করতে পেরেছিলেন তিনি।
০০অবসরের পর থিয়েটার দল গড়ব
অনেক সময়, লাঞ্চের পর ইন্দিরা কার্ড খেলতে পছন্দ করতেন। তার প্রিয় কার্ড গেম ছিল কালি ম্যাম। আমাদের কেউ আবার এই খেলাটি জানত না। এক দিন (১৯৭০ সালে) তিনি অভিনয় প্রদর্শনীর আয়ােজন করলেন। কে কোন ভূমিকায় অভিনয় করবে, তা একটি ছােট কাগজে লিখে রাখা হলো। কাগজের টুকরাগুলো আবার রাখা হলো একটি বড় জারে। প্রত্যেককে একটা করে কাগজ তুলে তার ভূমিকায় অভিনয় করতে বলা হলো। ইন্দিরার পিএ যশপাল কাপুর যে কাগজটা তুললেন তাতে লেখা ছিল সাপুড়ে। তিনি হাত দিয়ে বিণের মতো ভঙ্গিমা করে ঝাপি থেকে সাপ বের করে খেলা দেখানোর অভিনয় করলেন। সাপুড়েরা যেভাবে সাপের ফণার কাছে একটি হাত নাচায়, তিনিও তা করে দেখাতে লাগলেন। প্রত্যেকেই হাসল। আমার পালা এলে আমি কাগজ তুললাম। লেখা ছিল ‘তেল ও গ্যাসের আরব শেখ”। তখন আন্তর্জাতিক তেল সঙ্কট চলছে। পত্রপত্রিকাজুড়ে এই খবর। আমার মনেও সেটা ভর করেছিল। তবে অন্যদের চেয়ে এটা ছিল কঠিন চরিত্র। তবে নার্ভাস যে হয়ে গেছি, তা কাউকে বুঝতে দেইনি। আমি একটা টাওয়েল আমার মাথায় পেঁচিয়ে দিলাম, আরবদের হেডগিয়ারের মতো করে। তারপর একটা বেডশিট নিয়ে আরবদের গাউনের মতো করে পরে নিলাম। একটা খালি কোকা-কোলার বােতলকে ব্যবহার করলাম। জ্বালানি তেলের প্রতীক হিসেবে। ছোট ছোট পায়ে মুখ দিয়ে হিস হিস ।
শব্দ করতে করতে এগিয়ে গেলাম। শব্দটা এমন মনে হচ্ছিল, যেন তেলকূপ থেকে গ্যাস লিক করছে। প্রত্যেকেই হাসলেন। প্রধানমন্ত্রী। নিজে আমার অভিনয়ের প্রশংসা করলেন। আমাকে দেখিয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন : “শুনুন, সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের পর . আমি একটা থিয়েটার কোম্পানি চালু করব, আর আমার দলে আপনিই হবেন প্রধান অভিনেতা।
০০আমরা গৃহবিবাদ চাই না
প্রধানমন্ত্রী স্বাভাবিক সময়ে জাগতেন, নাশতার সময় পত্রিকা পড়তেন। সবসময় ছিলেন। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য তিনি বাড়ির কয়েকটি ঘরে হাঁটতেন। সবসময় ছিলেন পারফেকশনিস্ট। তিনি ফার্নিচার, ছবি এবং দেয়ালচিত্রগুলো যথাযথ আছে কি না খেয়াল রাখতেন। তিনি নিজের ঘর ঝেড়ে পরিষ্কার করতেন, রান্নাঘরে ঢু মারতেন। তার কোনো অফিস, স্টাফ কার এমনকি নিজের গাড়িও ছিল না।
তার জন্য বরাদ্দ করা স্টাফ কারটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছিল' (১৯৭৭)। তার কোনো টেলিফোন অপারেটর ছিল না, বন্ধুদের নম্বর ভুলে গিয়েছিলেন। তার শত্রুরা এই গুজবও ছড়াতেন, তিনি তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন, চোখ-মুখ খুলে বাড়ির চার পাশে এলো মেলো ভাবে ঘোরাফেরা করেন। তার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে সঞ্জয়ের (তার ছেলে) থেকে সরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাদের মতে, সঞ্জয়ের অসংযত আচরণ, অবিবেচক কর্মকাণ্ডের কারণেই সবাই তার শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এক দিন তিনি আনমনে বিষয়টি উল্লেখ করলেন : “আপনি কি মনে করেন, এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে আমরা পারিবারিক কলহে জড়িত হই?”
*
০০নারীদের ডেনিসের কাছে ছেড়ে দিন
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পরেছিলেন সালােয়ার-কামিজ এবং ক্যানভাস পিটি স্যু। (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) মিসেস থ্যাচার পরেছিলেন স্ন্যাকস ও ব্লাউজ। উভয়ে ছিলেন ছুটির দিনের সাজে ও মুডে। প্রধানমন্ত্রী ও মার্গারেট থ্যাচার একে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়েদরজার দিকে এগিয়ে এলেন। ড. পি সি আলেক্সান্ডার (তার মুখ্যসচিব) ও আমি সেখানে। দাঁড়িয়ে ছিলাম। আলেক্সান্ডারকে লক্ষ করে ইন্দিরা গান্ধী বললেন, নারীদের শপিং বা সাইটসিয়িংয়ের কোনাে ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে তাে দেখছি না।' তিনি জবাব দেয়ার আগেই মিসেস থ্যাচার হস্তক্ষেপ করলেন, নারীদের নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না। তাদেরকে ডেনিসের কাছে ছেড়ে দিন (তার স্বামীও এই সফরে ছিলেন), তিনি জানেন, কিভাবে নারীদের সামলাতে হয়। দুই নেতা খুব করে হাসলেন, তারপর স্কুলবালিকাদের মতো প্রায় দৌড়ে বিচে পিকনিক করতে চলে | গেলেন।
মস্কোতে একবার তীব্র শীতে এক সােভিয়েত নেতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে যােগ দিতে গিয়ে তারা দুজন একই স্থানে আমি দেখলাম, উঠেছিলেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর (ইন্দিরা গান্ধী) সাথে হেঁটে রেড স্কয়ারে } গারেট থ্যাচার যাচ্ছিলাম। সেখানেই অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। জায়গাটা ছিল পিচ্ছিল,
| তার পেছনে আমি দেখলাম, মার্গারেট থ্যাচার তার পেছনে হাঁটছেন। হাইহিল । থাকায় তিনি পেরে উঠছিলেন না। তবে গামবুট পরায় ইন্দিরার কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। আমি মিসেস থ্যাচারের কষ্টের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর থাকায় তিনি নজরে আনলাম। চলতে দাও, তিনি ফিসফিস করে বললেন।
তারা দু'জন শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। তারপর প্রধানমন্ত্রীর।তবে গামবুট গামবুটের দিকে তাকিয়ে থ্যাচার কিছু বললেন। প্রধানমন্ত্রী এসব টুকটাক অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সচেতন থাকার জন্য তার পরায় ইন্দিরার ব্যক্তিগত সহকারীর প্রশংসা করলেন। মিসেস থ্যাচার জবাব দিলেন, কোনো সমস্যা ‘আমারও যদি এমন একজন থাকত। দু'জনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল দুই সখীর মতো।
বিষয়: বিবিধ
৮৪২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন