নোয়াখালিতে হিন্দু নিধন
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২৬ জুন, ২০১৭, ০৭:৩৯:৪২ সন্ধ্যা
নোয়াখালিতে হিন্দু নিধন
১৯৪৬ সালে ১৬ আগস্ট কলকাতায় হিন্দু-মেধ যজ্ঞে মুসলমান পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভ করতে পারেনি। দাঙ্গার তৃতীয় দিনে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখাজীর নেতৃত্বে হিন্দু-শিখ জনতা গড়ে তোলে প্রতিরোধ। সফল হয় না জেহাদের উদ্দেশ্য। ক্রুদ্ধ মুসলমান হিন্দুকে চরম শিক্ষা দিতে বেছে নেয় রাজধানী কলকাতা হতে বহুদূরে পূর্ব বাংলার নোয়াখালি জেলা।
**এই জেলার লোকসংখ্যার ৮২% মুসলমান; হিন্দু মাত্র ১৮% ।**
জায়গাটা নদী-খাল ঘেরা দুৰ্গম। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তদানীন্তন সম্পাদক আবুল হাশিম লিখছেন, ২৯ আগস্ট নোয়াখালি জেলায় হঠাৎ আকস্মিক উত্তেজনার সৃষ্টি হল। “মৌলানা গোলাম সারওয়ারের*{ দাঙ্গার পরে গান্ধী নোয়াখালি গেলে তঁরা দেখাশুনার দায়িত্ব দেওয়া হল মুসলীম লীগের M. L. A. এই গোলাম সারওয়ারের ওপর।}
নেতৃত্বে ৭ সেপ্টেম্বর নোয়াখালির মৌলবীদের এক সভায় ঘোষণা করা হয় যে কলকাতা হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুসলমানদের যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। নোয়াখালি এবং কুমিল্লার সর্বত্র দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল এবং সময়োচিত ব্যবস্থা গ্ৰহণ না করলে পূর্ববঙ্গের সমস্ত জেলাব্যাপী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ত।
সুরাওর্দি আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার আপ্ৰাণ প্রচেষ্টা করেছিলেন।” সুরাওর্দির এই আপ্রাণ প্রচেষ্টার রকমটা কি তা সুচেতা কৃপালনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। মৌলবীদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুরু হয় ব্যবস্থা গ্ৰহণ। হিন্দুদের পলায়ন পথ বন্ধ করতে রাস্তা কেটে দেওয়া হয়, উপড়ে ফেলা হয় রেল লাইন। নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার দিয়ে অবরোধ করা হয় জলপথ। অতঃপর ১০ অক্টোবর লক্ষ্মী পূজার দিন স্থানীয় বিধান সভার সদস্যের নেতৃত্বে ২৫০ বর্গমাইল ব্যাপী বিস্তৃত অঞ্চলে শুরু হয় ব্যাপকভাবে হত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ, শত শত হিন্দু নারী অপহরণ, ধর্ষণ ও চরম লাঞ্ছনা ও নির্যাতন সহ মুসলমানের ঘরে আটক রাখা, বলপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তর প্রভৃতি।
কোন কোন স্থানে সিমান্তে হিন্দু পরিবার প্ৰতিবাদ বা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে সেই পরিবারের সকলকে হত্যা করার ঘটনা মধ্যযুগের ব্যাপক বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে।
প্রায় এক সপ্তাহকাল সুরাবন্দির মন্ত্রিসভা অথবা বাংলা সরকারের নির্দেশে এই নিৰ্মম অত্যাচারের কাহিনী গোপন রাখা হয়েছিল, ১৭ অক্টোবর সর্বপ্রথম এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। “সংবাদপত্রের বিবরণ অনুসারে পাঁচ হাজার লোক হত ও ইহার বহুগুণ আহত এবং প্রায় দেড় লক্ষ লোকের গৃহ বিধ্বস্ত হয়।”
বাংলা সরকার এডওয়ার্ড স্কিনার সিম্পসন (Edward Skinner Simpson) একজন অবসর প্রাপ্ত জজ সাহেবকে ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেন। তাহার রিপোর্টে তিনি মুসলিম লীগ দল ও মন্ত্রিসভাকে এই বীভৎস ঘটনার জন্য দায়ী করেন। সরকার এই রিপোর্ট প্রকাশ না করে চেপে রাখেন।
যাহোক রিপোর্টের একটি কপি The Statesman পত্রিকার হস্তগত হয়। সম্পাদক অনেক কাটছাট করে যেটুকু ছেপেছিলেন, নিম্নে তার ভাবাৰ্থ দেওয়া হল :
“নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলার যেখানে যেখানে মুসলমান আক্রমন চালাইয়াছিল, তাহার প্রায় সর্বত্রই বাড়িঘর, জিনিসপত্র, দোকানপাটের এমন নির্মূল ভাবে ধ্বংস ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়াছে যে বিরাট ধ্বংসাবশেষের পুঞ্জীভূত স্তুপ ছাড়া আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। ...ত্রিপুরা জেলার চাঁদপুর থানার অন্তর্গত বাইচরের দৃশ্য অবর্ণনীয়। উন্মত্ত হিংস্ৰ জনগণের ধ্বংসাত্মক কার্যের সম্বন্ধে প্রকৃত ধারণা করিতে হইলে এই স্থানটি দেখা দরকার।
এই রিপোর্টে ধর্ষিতা হিন্দু-নারীর সংখ্যা নির্ণয়ের চেষ্টা করা হইয়াছে। কিন্তু অনেকে এই সম্বন্ধে কিছু বলিতে অনিচ্ছুক হওয়ায় সঠিক সংখ্যা বলা যায় না। কিন্তু উক্ত কর্মচারীটির কাছে অনেকে সাধারণভাবে রিপোর্ট করিয়াছেন এবং কোন কোন বাড়ীতে বা স্কুল ঘরে হিন্দু-স্ত্রীলোকদিগকে ৩/৪ দিন আটক করিয়া রাখা হইয়াছিল।
জোর করিয়া ব্যাপকভাবে দলে দলে হিন্দুদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত (Mass Conversion) করার বিবরণ প্রত্যেক গ্রামেই পাওয়া গিয়াছে। অনেক স্থানে পুরুষেরা আপত্তি করিলে তাহাদের স্ত্রীলোকদিগকে আটক করিয়া রাখিয়া তাহাদিগকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য করা হইয়াছে। অনেককে প্ৰাণবধের ভয় দেখাইয়া ধর্ম পরিবর্তন করিতে বাধ্য করা হইয়াছে।” { রমেশ চন্দ্র মজুমদার—বাংলা দেশের ইতিহাস—৪ খণ্ড, পৃঃ ৪২০}
নোয়াখালি দাঙ্গার বিশদ আলোচনা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। কেহ কেহ বলেন বাঙালী মুসলমান ভাল (যেন শুধু অবাঙালী মুসলমানই যত অশান্তির কারণ)। বাংলায় হিন্দুমুসলমান পাশাপাশি বাস করে। তাদের এক ভাষা, এক সংস্কৃতি। যদিও এই সকল ব্যক্তিরা জানেন যে মুসলমান কখনও মিজেকে বাঙালী, বিহারী বা মাদ্রাজী বলে পরিচয় দেয় না।
“মুসলমান”—এই তার একমাত্র পরিচয়। ভারতে হাজার বছর ধরে মাহমু,বাবর-নাদির শাহরা যে অত্যাচার করেছে, কলকাতা-নোয়াখালির বাঙালী (?) মুসলমানও বাঙালী হিন্দুর ওপর সেই একই অত্যাচার করেছে। অত্যাচারের পদ্ধতি ও প্রকৃতিও এক। এটাই তো স্বাভাবিক। **উভয়েরই মূল প্রেরণা তো পবিত্র ইসলাম ধর্ম।** নোয়াখালিতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ্য দিবালোকের ন্যায় উদভাষিত হয়েছে।
ইংরেজ আই. সি. এস. অফিসার এ. আই. রোম্যান (উত্তর প্রদেশে কর্মরত) উত্তর প্রদেশের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে বাংলার দাঙ্গা সম্বন্ধে এক দীর্ঘ পত্র লেখেন। সেই পত্রে তিনি বলেন : “এ সত্যটি গোপনের চেষ্টা করে লাভ নেই যে গুন্ডারা বাংলাকে ধ্বংস করছে তাদের নেতা হচ্ছেন সুরাওর্দি ও তীর মন্ত্রীরা।”1. শংকর ঘোষ—হস্তান্তর (৯ম পর্ব) সাপ্তাহিক দেশ—৭-৩-৯৮.
কলকাতা থেকে শংকর ঘোষ সহ চার জন সাংবাদিক গিয়েছিলেন নোয়াখালিতে দাঙ্গার রিপোর্ট করার জন্য। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা না থাকায় তঁরা নোয়াখালির অভ্যন্তরে ঢুকতে পারছিলেন না। সেই সুযোগ ঘটল যখন চাঁদপুর স্টেশনে হঠাৎ একদিন তদানীন্তন চীফ মেট্রোপলিটান ম্যাজিষ্ট্রেট রণজিৎ গুপ্তের সঙ্গে দেখা হয়। রণজিৎ গুপ্তকে (পরে ইনি পঃ বাংলার মুখ্য সচিব হয়েছিলেন) সুরাওর্দি সরকার নোয়াখালির দাঙ্গার তদন্তের ভার দিয়েছিলেন তার উপর তদন্তের ভার ছিল, লিখছেন শংকর ঘোষ, “কিন্তু নোয়াখালির অভ্যন্তরে হাজার-হাজার আটক হিন্দুদের উদ্ধার করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়নি। অথচ তদন্তের কাজে তিনি যেখানেই যেতেন সেখানেই হিন্দুরা তাদের দুর্দশা ও লাঞ্ছনার বর্ণনা করে বন্দিদশা থেকে উদ্ধারের জন্য তাকে বলতেন।.
তাই তিনি একটি কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন, তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য একটি সশস্ত্র রক্ষিবাহিনী সর্বত্র তাঁর সঙ্গে যেত। রণজিৎ গুপ্ত তদন্তেৰ জন্য যে গ্রামে যেতেন সেখানকার হিন্দুরা তাকে নিরাপদে কোনও আশ্রয়ে নিয়ে যেতে বললে তিনি তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিতেন যে তার সে ক্ষমতা নেই। তবে তারা ইচ্ছে করলে তিনি ফিরে যাবার সময় তার দলের পিছে আসতে পারেন। এই কৌশলে তিনি কয়েক হাজার নর-নারীকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। তাতে মুসলিম আক্রোশ বাড়তেই থাকে। একদিন যখন তীর সশস্ত্র রক্ষীদের পিছন পিছন এরকম একটি দুৰ্গতি নরনারীর দল গ্রাম ছেড়ে চলে আসছে তখন একটি বিরাট মুসলিম জনতা তাদের আক্রমণ করে খুন-জখম, লুঠপট শুরু করে দেয়।
রণজিৎ গুপ্ত তখন তাঁর রক্ষিদের গুলি চালাবার নির্দেশ দেন। যত দূর মনে পড়ছে, ওই গুলি চালনায় উন্মত্ত মুসলিম জনতার জন কুড়ি মারা গিয়েছিলেন। মুসলীম লীগ মন্ত্রিসভা রণজিৎ গুপ্তের কৈফিয়ত তলব করেছিল।”2. শংকর ঘোষ—হস্তান্তর (৯ম পর্ব) সাপ্তাহিক দেশ-৭—৩-৯৮
নোয়াখালির হিন্দু-নিধন সম্বন্ধে সাংবাদিক শংকর ঘোষ বলেন, ---“নোয়াখালি ও ত্রিপুরার হাঙ্গামা যে পর্যন্ত যা দেখেছিলাম এবং পরে গান্ধিজির সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে যা জেনেছিলাম তাতে কলকাতার দাঙ্গার সঙ্গে ওই দুটি জেলার হাঙ্গামার তফাতটি বেশ চোখে পড়ছিল।কলকাতায় যা ঘটেছিল সেটি দাঙ্গা, হিন্দু-মুসলমান দুটি সম্প্রদায়েই তাতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল.কিন্তু নোয়াখালি ও ত্রিপুরাতে যা হয়েছিল সবই একতরফা। এই দুই জেলায় যা ঘটেছিল তাকে দাঙ্গা বলা যায় না, হাঙ্গামা বললেও ঠিক বোঝানো যাবে না। কেননা এই দুই জেলায় কোথাও হিন্দু প্রতি-আক্রমণ তো দূরের কথা, প্রতিরোধও করতে পারেনি। বিশেষ করে নোয়াখালিতে যা হয়েছিল তা ছিল হিন্দুদের নিশ্চিহৃ করার অভিযান।”
আচার্য কৃপালনি, তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি। সুরাওর্দি সরকারের অসহযোগিতার জন্য দু’বারের চেষ্টায় তিনি নোয়াখালি যেতে পেরেছিলেন। তারপর গিয়েছিলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শরৎ বসু প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ।
বাংলার মেয়ে সুচেতা কৃপালনি স্বামীর সফর সঙ্গিনী হয়েছিলেন। **মুসলমানের যৌন লালসা হিন্দু নারীদের মধ্যে এরূপ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল যে সুচেতা কৃপালনি সঙ্গে নিয়েছিলেন তীব্র বিষ আর্সেনিক।** যদি প্রয়োজন হয়...। “তিনি প্রত্যহ সকাল বেলা বেরিয়ে পড়তেন বিধ্বস্ত এলাকা ঘুরে দেখার জন্য।...অনেকেই তার সঙ্গে ত্ৰাণ শিবিরে চলে আসতেন, অত্যাচার ও নির্যাতনসহ্য করে, ধর্ম ও সম্মান হারিয়ে তারা গ্রামে থাকতে চাইতেন না। স্থানীয় মুসলমানরা হিন্দুদের এই চলে আসা পছন্দ করতেন না। তঁরা বাধা দিতেন, মধ্যপথে শরণার্থীদের আক্রমণ করে তাদের খুন জখম করে তাদের অবশিষ্ট যা কিছু লুটপাট করে নিয়ে যেতেন। সুচেতা নিজেও বিপন্মুক্ত ছিলেন না। একদিন রাতে তারা খবর পান যে একটি মুসলিম জনতা তাদের আক্রমণ করতে আসছে। এই জনতাকে বাধা দেওয়ার শক্তি তাদের ছিল না। তারা মরার জন্য তৈরি হন। সুচেতা লিখেছেন “আমার সঙ্গে বিষ থাকায় গুণ্ডাদের হাতে পড়ার কোনও ভয় আমার ছিল না।” তার সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী ছেলেরা তা জানত না। তারা যে কোনওরকম বিপদের জন্য তৈরি হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত এই মুসলিম জনতা তাদের শিবিরের কাছে এসেও কোনও কারণে ফিরে যায়।”
সব কিছুরই তো একটা উদ্দেশ্য থাকে। সুচেতা কৃপালনি তঁর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা থেকে আত্মজীবনীতে লিখেছেনঃ “নোয়াখালি ও কুমিল্লায় হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের মর্যাীল এক্সটারমিনেশন। তাই নােয়াখালি ও ত্রিপুরায় নরহত্যা তত হয়নি যত হয়েছে ধর্ম ও সংস্কৃতি নাশের চেষ্টা। গ্রামের পর গ্রামে হিন্দুদের ধর্ম নাশ করার চেষ্টা হয়েছে, কলমা পড়ানো হয়েছে, গরুর মাংস খেতে, লুঙ্গি পরতে, নূর রাখতে বাধ্য করা হয়েছে, হিন্দু মেয়েদের জোর করে মুসলিম ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে হিন্দু মেয়েদের মুসলিম বাড়িতে রাত্রি যাপনে বাধ্য করা হয়েছে।”
বইঃমুসলিম শাসন ও ভারতবর্ষ----নিত্যরঞ্জন দাস
বিষয়: বিবিধ
১২৪১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন