বাংলার কিংবদন্তি কালাপাহাড় – ও মন্দির ভাঙার গল্প

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২১ জুন, ২০১৭, ০৭:৪০:০০ সন্ধ্যা

বাংলার কিংবদন্তি কালাপাহাড় – ও মন্দির ভাঙার গল্প ।

সুলেমান কররানী বাঙলার সুলতান হয়েছেন ১৫৬৫ সালে। সুলতান একদিন উজিরকে ডাকলেন।

বললেন-কাকে রাজধানীর ফৌজদার করা যায় ?

উজির যার নাম করলেন সুলতান তাকে পছন্দ করলেন না। বললেন - যুদ্ধে উনি সকলের আগে পালিয়ে যান। অমন মানুষকে আমি গৌড়ের ফৌজদার করতে পারি না।

উজির এবার আরেক জনের নাম মনে করে সুলতানকে বললেন---সুলতান আপনার নয়ান রায়ের কথা মনে আছে ?

কিন্তু নয়ান রায় মারা গেছেন সুলতান বললেন । শুনেছি তার একজন যোগ্য পুত্ৰ আছে।

সেই পুত্রের কথা আপনি জানেন ?

দরবারে একজন মৌলবি ছিলেন। তিনি সুলতানকে কুর্নিশ করে বললেন-নয়ান রায়ের পুত্ৰ কালাচাঁদ রায় আমার কাছে ফারসি শিক্ষা নিয়েছে। তার ডাকা নাম রাজু । মস্ত বীর, আর তার মত তীরন্দাজ সচরাচর দেখা যায় না।

সুলতান খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-তার স্বভাব-চরিত্র কেমন ?

মৌলবি সাহেব বললেন-বাপক বেটা, কালাচাঁদ নেমকহারামি জানে না। খুব ধাৰ্মিক।

সুলতান তখন উজিরকে বললেন-এই কালাচাঁদকেই রাজধানীর ফৌজদার করব ভেবেছি।

আপনি কী বলেন ?

উজির সসম্ভ্রমে বললেন-শাহানশাহ ঠিক মানুষটিকেই বেছে নিয়েছেন। কালাচাঁদ অবশ্যই রাজধানীর ফৌজদার হওয়ার যোগ্য।

সুলতান বললেন -তবে আর দেরি কেন । আমার জরুরি পরোয়ানা দিয়ে এখনই কালাচাঁদের কাছে সাওয়ার পাঠিয়ে দিন।

জরুরি পরোয়ানা নিয়ে সওয়ার ছুটিল বীরজওনের দিকে। বীরজাওনা গ্রামে কালাচাঁদের বাড়ি ।

স্বয়ং বাদশাহের জরুরি পরোয়ানা । কালাচাঁদ মাকে বললেন মা, বাদশাহ আমাকে গৌড়ে ডেকে পাঠিয়েছেন।

মা বললেন-বাছা, বাদশাহের হুকুম এসেছে যখন, যেতেই হবে।

মায়ের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে কালাচাঁদ চললেন গৌড়ের দিকে ।

সময় মতো হাজির হলেন বাদশাহের দরবারে । কালাচান্দকে দেখেই সন্তুষ্ট হলেন বাদশাহ।

যেমন শুনেছিলেন। তেমনি দেখলেন। বাদশাহ বললেন-তোমাকে কেন ডেকে এনেছি জানো ?

কালাচাদি কিছুই জানেন না । হুকুম পেয়ে ছুটে এসেছেন দরবারে । বাদশাহ বললেন-আজ থেকে তুমি গৌড়ের ফৌজদার।

উজিারের কাছ থেকে তোমার কাজ বুঝে নাও ।

কালাচাঁদ গৌড়ের ফৌজদার হলেন। গৌড়ের ফৌজদার হওয়া সোজা কথা নয়।

রাজপ্রাসাদের কাছেই ফৌজদারের আস্তান। অদূরে নদী । প্রত্যহ সকালে নদীতে স্নান করতে যান কালাচাঁদ। স্নান সেরে হাটা পথে গঙ্গাস্তব করতে করতে ফিরে আসেন নিজের আস্তানায় । হাতে থাকে সোনার কোশ, সঙ্গে থাকে ছাতাবরাদার। তখন কালাচাদের পরনে থাকে দামি গরদ । চমৎকার ফরসা চেহারা, মাথায় ঘন চুল, গলায় ধবধবে পৈতে-লোকে মুগ্ধ হয়ে কালাচাঁদকে দেখে, মুগ্ধ হয়ে শোনে কালাচাঁদের মুখের সুন্দৰ গঙ্গাস্তব । পুজো সেরে দরবারী পোশাক পরে দরবারে যান। সে সময়ে আগে বীরকন্দাজ, মধ্যিখানে ঘোড়ায় বা পালকিতে ফৌজদার কালাচাঁদ রায়, পিছনে ঘোড়সওয়ার সৈন্য ।

দিনের পার দিন যায়।

কালাচাঁদের প্রশংসায় সকলেই পঞ্চমুখ । রাজপ্ৰাসাদ থেকে বাদশাহের মেয়ে দুলালী দিনের পর দিন দেখেছেন কালাচাঁদকে। দিনের পর দিন দেখে-দেখে দুলালী মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন যে এই কালাচাঁদ রায়ই তার বর হবেন । রূপকথার কোনো কোনো রাজকন্যা যেমন নিজের বর নিজেই মনে মনে ঠিক করে রাখে ।

দুলালীর মনের কথা জানতে বাকি রইল না বেগমসাহেবার। আর ৰেগমসাহেবার মুখ থেকে শুনলেন বাদশাহ সুলেমান কররানী !

একদিন বাদশাহ নির্জনে ডেকে আনলেন কালাচাঁদকে । বললেন তুমি শাহজাদী দুলালীর কথা জানো ?

নাম শুনেছি।

কখনও চোখে দেখিনি ।

বাদশাহ বললেন-আমার আদেশ, তুমি শাহজাদীকে বিবাহ কর ।

কালাচাঁদ কুর্নিশ করে বললেন-জাহাপনা, আমি কেমন করে শাহজাদীকে বিবাহ করব ?

আমি শাহজাদীকে বিবাহ করলে আমার জাত যাবে। আমি হিন্দু ব্ৰাহ্মণ ।

বাদশাহ বললেন-আমি তো তোমাকে মুসলমান হতে বলিনি।

তুমি যেমন আছ তেমনি থেকে শাহজাদীকে বিবাহ করো।

কালাচাঁদ বললেন--হিন্দুসমাজ তা মানবে ?

অসম্ভব। আমার জাত যাবে, ধর্ম যাবে ।

বাদশাহ রাগে অস্থির হয়ে উঠলেন । বললেন-কালাচাঁদ জানো আমি কে ?

কালাচাঁদ বিনয় করে বললেন-জানি । হুজুর বাঙলার বাদশাহ, অধীনের জানপ্ৰাণের মালিক।

বাদশাহ বললেন - আমার আদেশ অমান্য করলে তোমার প্রাণদন্ড হবে ।

বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে কালাচাঁদ বললেন-প্ৰাণ যায় যাক।

কিন্তু আমার জাত থাক, আমার ধর্ম থাক ।

বাদশাহের হুকুমে বন্দী করা হল কালাচাঁদকে। বাদশাহের হুকুম -কাল কালাচাঁদের প্রাণদণ্ড ।

পরদিন সকালে বধ্যভূমিতে নিয়ে আসা হল কালাচাঁদকে। শেযমুহুর্তের আর বুঝি বাকি নেই।

কিন্তু এ কী আশ্চৰ্য কাণ্ড, পাগলের মতো ছুটতে-ছুটতে সেখানে এসে উপস্থিত দুলালী ৷

কী রূপ । যারা চিনত না তাবা ভাবল কে এই স্বর্গের দেবী ?

যারা চিনত তারা চিৎকার করে উঠল-শাহজাদী, শাহজাদী।

দুলালী নিৰ্ভয়ে বললেন - আমার প্রাণ থাকতে কেউ ফৌজদারের গায়ে হাত দিতে পারবে না।

আগে আমাকে মেরে তারপর ফৌজদারকে মারতে হবে।

কালাচাঁদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন দুলালীর মুখের দিকে। তাকে বাঁচানোর জন্য নিজের প্রাণ যে বলি দিতে রাজি সে তো সামান্য মেয়ে নয়। চোখের পলকে কালাচাদের মন আরেক রকম হয়ে গেল । এই মেয়েকে বিবাহ করলে জাত যাবে, ধর্ম যাবে ?

বরং কালাচাঁদের মনে হল এই মেয়েকে বিবাহ না করলে জাত থাকবে না, ধর্ম থাকবে না।

খবর পেয়ে সুলেমান কররানী ছুটে এলেন তরবারি হাতে নিয়ে।

কিন্তু কালচাদ তখন নিৰ্ভয় বললেন-বাদশাহ, এই শাহজাদী আমার ধর্মপত্নী ।

বিবাহের পর কালাচাঁদ আর ফৌজদার রইলেন না, সেনাপতি হলেন ।

সেনাপতির নতুন আস্তানা । দুলালীকে নিয়ে কালাচাঁদ নতুন আস্তানার বাসিন্দা হলেন ।

কালাচাঁদ বাদশাহের জামাতা হয়েছেন, সেনাপতি হয়েছেন ; কিন্তু নিজের ধর্মকর্ম ছাড়েননি। আগের মতোই তিনি প্ৰত্যহ সকালে নদীতে স্নান করতে যান, স্নান সেরে হাঁটাপথে গঙ্গাস্তব করতে করতে ফিরে আসেন নিজের আস্তানায়, হাতে থাকে সোনার কোশ, পরনে থাকে দামী গরদ, গলায় ধবধবে পৈতে ।

কিন্তু বীরজাওনে রটে গেছে যে গ্রামের ছেলে কালাচাদ শাহজাদীকে বিবাহ করে মুসলমান হয়েছেন। গ্রামের পণ্ডিতেরা একঘরে করে দিলেন তাকে ।

কালাচাঁদের মা উত্যক্ত হয়ে বললেন-কালাচাঁদ মন্দ কাজ করতে পারে না। সে যদি ভালো বুঝে বাদশাহের মেয়েকে বিয়ে করে থাকে তো বেশ করেছে। তা নিয়ে লোকজনের এত মাথাব্যথা কেন ?

বীরজওন থেকে খবর গেল যে মা কালাচান্দকে বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছে। কালাচাঁদ খবর পেল যে মা তঁর উপর অসন্তুষ্ট হননি ; তার উপর মায়ের আস্থা অটুট আছে।

কালাচাঁদ সাব্যস্ত করলেন এবাব বীরজওনে তিনি দুলালীকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন না ।

দুলালী আপত্তি করে বললেন-আমি মাকে দেখতে যাব না ? ?

কালাচাঁদ বললেন-এবার আমি একাই যাই। সময় হলে তোমাকে নিয়ে যাব।

বীরজওনে এসে কালাচাদ জানলেন যে গ্রামে তিনি একঘরে । কিন্তু মা সব শুনে অভয় দিয়ে বললেন- তুমি মানুষের মতে কাজ করেছ। এমন মেয়েকে বিবাহ না করলে তোমার অধৰ্ম হত । ভালো কাজ করলে কি কারও জাতধর্ম যায় ? যায় না। তবে পণ্ডিতদের জানো তো, তঁদের চক্রান্তে হয়তো তোমাকে কিছু দুঃখকষ্ট পেতে হবে ।

যে যাই বলুক, পণ্ডিতদের চক্রান্তে একঘরে হয়ে রইলেন কালাচাঁদ । একঘরে থাকলে লাঞ্ছনা-অপমানের জ্বালা দুঃসহ হয়ে উঠে।

অপরাধ না করেও কি তঁকে চিরদিন একঘরে হয়ে থাকতে হবে ? পণ্ডিতেরা বিধান দিলেন-পুরীর জগন্নাথদেব যদি আদেশ দেন তো কালচাদকে আর একঘরে হয়ে থাকতে হবে না ।

কালাচাঁদ চলে এলেন পুৱীতে। কিন্তু পণ্ডিতদের ষড়যন্ত্রের ফলে পাণ্ডাদের কাছে তিনি অপরাধী হয়ে আছেন। পাণ্ডারা তাকে মন্দিরে ঢুকতে দিল না।

কালাচাদি অগত্যা মন্দিরের বাইরে জগন্নাথের কাছে ধরনা দিলেন। প্রার্থনা করলেন-প্ৰভু, তুমি অন্তৰ্যামী, তুমি সব জানো। পণ্ডিতেরা আমাকে বিনাদোষে একঘরে করেছে, লাঞ্ছনা-অপমানের জ্বালা আমার আর সহ্য হচ্ছে না।

শুনেছি, তুমি অগতির গতি, তোমার কাছে সকলে সমান। তুমি আমাকে উদ্ধার করে।

মন্দিরের বাইরে চোখ বুজে কালাচাঁদ অনাহারে সাতদিন ধরন দিয়ে রইলেন। কিন্তু কোনো দৈব আদেশ পেলেন না। সাতদিন পায় উঠে বসলেন। রাগে ও অপমানে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন । মন্দিরের দিকে তাকিয়ে জগন্নাথকে বললেন-

“তুমি দেবতা নও, যদি দেবতা হতে তো বিনাদোষে আমাকে লাঞ্ছনা-অপমানের জ্বালা সইতে হত না, তোমার দরজায় সাতদিন আমাকে অনাহারে ধরন দিয়ে থাকতে দিতে না। তুমি কাঠের পুতুল, আর কিছু নও। আমার প্ৰতিজ্ঞা-মন্দিরে-মন্দিরে তোমার মতো কাঠ, মাটি ও পাথরের যত মূৰ্তি আছে, সব আমি নিশ্চিহ্ন করে ছাড়ব।“

কালাচাঁদ তখন রুদ্রমূর্তি। ফিরে এলেন রাজধানীতে। আর হিন্দু রইলেন না, মুসলমান ধর্মে দীক্ষা নিলেন। নতুন নাম হল - কালাপাহাড় ।

সুলেমান কররানীর আদেশ নিয়ে বিস্তর সৈন্যসমেত কালাপাহাড় চললেন উড়িষ্যার দিকে। পথে তমলুকে বর্গভীমাদেবীর বিখ্যাত মন্দির। বর্গভীমাদেবীর মূর্তি দেখে কালাপাহাড়, কেন কে জানে, মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি এই দেবীমূর্তি ও মন্দিরের তিলমাত্র ক্ষতি করেননি।

**বরং ফারসিতে একখানা দলিল লিখে দিয়ে গেছেন। দলিলখানা শোনা যায়, এখনও আছে বর্গভীমাদেবীর পূজারীদের কাছে। এই দলিলখানার নাম-বাদশাহী পাঞ্জা।**

কালাপাহাড়ের কাহিনীতে বর্গভীমাদেবীর অধ্যায় আজও পরম বিস্ময় হয়ে আছে।

কালাপাহাড় পুরীর মন্দির লুণ্ঠন করলেন ১৫৬৮ সালে। পাণ্ডারা জগন্নাথদেবের মূর্তি নিয়ে চিল্কা হ্রদের কাছে পারিকুদে একটি গর্তের মধ্যে লুকিয়ে রাখল। খবর গোপন রইল না। কালাপাহাড়ের কাছে। গর্ত থেকে সেই মূৰ্তি বের করে কালাপাহাড় টেনে নিয়ে এলেন, আগুনে পুড়িয়ে জলে ফেলে দিলেন।

পুবে আসাম, পশ্চিমে কাশী ও দক্ষিণে উড়িষ্যায় বিস্তর বিখ্যাত মন্দির; কালাপাহাড় কোনো-কোনো মন্দিরের অংশবিশেষ ধ্বংস করেছেন, কোনো-কোনো মন্দির পুরোপুরি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন।

কালাপাহাড়ের কাড়ানাকড়া বাজলে, লোকে বলে, সকল দেবমূর্তি কম্পিত হত। কালাপাহাড় সর্বনাশী নৃশংস অত্যাচারী।

১৫৭২ সালে সুলেমান কররানীর মৃত্যু হয়েছে। তারপর তঁর জ্যেষ্ঠপুত্র কয়েজিদ সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। অল্পকাল পর তিনি নিহত হয়েছেন।

তারপর সুলতান হয়েছেন তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা দায়ুদ কররানী। কালাপাহাড়, বলে রাখা ভালো, দায়ুদ কররানীর সেনাপতি। ইতিহাসে পাওয়া যায় মোগল সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধে কালাপাহাড় নিহত হয়েছেন।

কিন্তু লোকে সেকথা মানে না। কালাপাহাড় জগন্নাথদেবের মূর্তি আগুনে পুড়িয়ে জলে ফেলে দিয়েছেন, মনে আছে ? সেই পাপে, লোকে বলে, কালাপাহাড়ের হাত-পা খসে গেছে-কালাপাহাড়

মরেছেন ।

বিষয়: বিবিধ

১৫০৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383398
২১ জুন ২০১৭ রাত ১০:১৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : এই পুরা কাহিনিটাই কাল্পনিক এবং কোন হিন্দু চরমপন্থির রচনা। সুলতান সুলায়মান কররানির কন্যা একজন হিন্দুকে বিয়ে করবেন এটা হাস্যকর। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে রাজু ইসলাম ধর্ম গ্রহন এর আগেই মুর্তি ভাঙ্গতেন। সেনাপতি হওয়ার পর মুর্তি ভাঙ্গেননি।
383416
২৩ জুন ২০১৭ দুপুর ০১:৫৭
মুহাঃ মাসউদুল হাসান মামুন লিখেছেন : ভালো লাগলো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File