আরাকান ও মুসলমান : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১০:৩৮:১৬ রাত
আরাকান ও মুসলমান : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত
আরাকান অঞ্চলটি বর্তমানে মিয়ানমারের একটি প্রদেশ। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর ধরে এর স্বাধীন সত্তা, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা, রাজনৈতিক ঐতিহ্য প্রভৃতি ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
সময়ের ধারাবাহিকতায় মুসলমানগণ এখানকার অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্ৰীয় ক্ষেত্রে একটি অভিনব এবং স্বতন্ত্র অধ্যায় বিনির্মাণে সক্ষম হয়েছিল। অদ্যাবধি এখানকার মোট জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ ইসলামের অনুসারী।
--- এদের মধ্যে থান্তইক্যা, জেরবাদী, কামানচি,* রোহিঙ্গা” প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন নামে মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তবে রোহিঙ্গারা তাদের মধ্যে বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী। আরাকানে ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং আরাকান অঞ্চলের পরিচিতিমূলক ঐতিহাসিক পটভূমি , আরাকানের ভৌগোলিক পরিচিতি, রাজনৈতিক ইতিহাস ও অত্রাঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের চিত্ৰ খুব পরিচিত।
>>আরাকান পরিচিতিঃ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তবতী একটি অঞ্চল আরাকান। এটি উত্তর অক্ষাংশের ২১০২০” ও ১৬০২২" এর মধ্যে এবং পূর্ব দ্রাঘিমাংশে ৯২°২১" ও ৯৫০২০” এর মধ্যে অবস্থিত। এর উত্তরে চীন ও ভারত, দক্ষিণ ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, উত্তর ও পশ্চিমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তবতী নাফ নদীর মধ্যসীমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম। পূর্বে মিয়ানমারের সীমান্তবতী ইয়োম (Yoma) পর্বতমালা। এ সুদীর্ঘ, দুৰ্গম, সুউচ্চ ও বিশাল ইয়োমা পর্বতমালা দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মত আরাকানকে মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। যোগাযোগের সুবিধা ও ঐতিহ্যগত দিকদিয়ে মিয়ানমারের চেয়ে চট্টগ্রামই আরাকানের কাছাকাছি ও বন্ধুপ্রতীম অঞ্চল।
প্রকৃতপক্ষে ছোটখাট পর্বতমালা ও নাফ নদীর ব্যবধান ব্যতীত উভয় অঞ্চলের (চট্টগ্রাম-আরাকান) অভিন্ন গোত্রীয় জনবসতির তেমন আর কোন অন্তরায় ছিলনা। তাই চট্টগ্রামে অসিটকাদি জনগোষ্ঠী ও আরাকানে ভোট চীনা গোত্রীয় কিরাত জাতীয় লোকদের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়।” মিয়ানমারের সাথে দুৰ্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলেই সুদীর্ঘকালব্যাপী আরাকানের রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র ও নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব হয়েছিল ।
আরাকানের আয়তন নির্ণয় খুবই কষ্টসাধ্য। বাংলার সাথে আরাকানের সীমা প্রায়ই পরিবর্তন হতো। বাংলাদেশের কক্সবাজার, রামু ও চট্টগ্রামসহ একটি বিশাল অংশ দীর্ঘদিন যাবৎ আরাকানের শাসনাধীনে ছিল। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খান (১৬৬৩– ৭৭; ১৬৭৯-৮৮ খ্রি.) কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়ের পর থেকেই কেবল এর আয়তন সঠিক অর্থে নির্ধারিত হয়। এ হিসেবে বৃটিশ শাসন পর্যন্ত আরাকানের আয়তন ছিল ২০,০০০ (বিশ হাজার) বর্গমাইল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা উত্তর পার্বত্য আরাকান বার্মার চিন (Chin) প্রদেশে এবং দক্ষিণ আরাকানের কিছু অংশ লোয়ার বার্মার ইরাবতী অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করায় বর্তমানে এখানকার আয়তন ১৪,২০০ বর্গ মাইল।”
আরাকানের মানচিত্র অনেকটা বোয়াল মাছের মত। এর দৈর্ঘ্য ৩৬০ মাইল। কিন্তু প্রস্থে স্থান বিশেষে ভিন্নতা রয়েছে। উত্তর আরাকান অঞ্চলটি বেশ প্রশস্ত; যার প্রস্থ প্রায় ১০০ মাইল এবং আরাকানের দক্ষিণাংশে নিচের দিকে ক্রমশ সরু: যার প্রস্থ প্রায় ২০ মাইল। সমগ্র আরাকান অঞ্চল উত্তর-পশ্চিমে ১৭১ মাইলব্যাপী নীে ও স্থল সীমারেখা সহকারে বাংলাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত ।
আরাকানে বেশকয়েকটি উল্লেখযোগ্য নদী আছে যথা: নাফ (Naf) মায়ু (Mayu) কালাদান (Kaladan) ,লেমব্রু (Lembru), অনন (Ann), তনগু(Tangup), স্যান্ডোয়ে (Sandoway) প্রভৃতি। এর মধ্যে নাফ, কালাদান, লেশ্রু ও মায়ু আরাকানের প্রধান প্ৰধান নদী ।
নাফ নদী প্রস্থে ছোট মনে হলেও বেশ খরস্রোতা। এটি বাংলাদেশ ও আরাকানের মধ্যকার আন্তর্জাতিক সীমারেখা হিসেবে কাজ করে। নাফ নদীর পূর্বতীরে আরাকানের
মংডু টাউনশীপ এবং পশ্চিম তীরে বাংলাদেশের ককসবাজার জেলার টেকনাফ অঞ্চল । নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ মাইল এবং প্রস্থ ১ থেকে ১.৫ মাইল।
নাফ নদীর সম্মুখভাগে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্ৰ জিনজিরা বা সেন্টমাটিন । এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই আরাকানের হবিপাড়া থেকে এসে এ এলাকায় বসতি স্থাপন করেছে।
পরমা(Purma),মায়ুথিট (Myothit), সাবিবিনি(Sabebinyin), উশিঙ্গা (Ushingya), মায়ুথিট (Minglagyi), পিনবায়ু (Pyinbyu), কাইন(Kayin), তাতমাগি (Tatmagyi), গদুছারা (Gawdusara), তুন (Tun) এবং ঘাকুনডু (Ngakungdo) প্রভৃতি ছোট ছোট প্রবাহ নালা ও হ্রদ মায়ু পাহাড়ে উৎপত্তি হয়ে মংডু টাউনশীপের মধ্য দিয়ে নাফ নদীতে এসে মিশেছে। অবশেষে নাফ নদী গিয়ে মিলিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের সাথে ।
কালাদান (Kaladan) আরাকানের সবচেয়ে বড় ও প্রধান নদী। এটি ইয়াহু' (Yahaw) স্টেটের চিন পাহাড় থেকে বইনু (Bolinu) নামে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণের পার্বত্য আরাকানে প্রবেশের পর কালাদান নাম ধারণ করেছে। এটি প্রথমত দক্ষিণাভিমুখে অতঃপর উত্তরাভিমুখে এবং অবশেষে পূর্ব দিকে বাক নিয়ে সরাসরি লুসাই পাহাড় অঞ্চল অতিক্রম করে পুনরায় দক্ষিণ দিকে মোড় নিয়ে উত্তর আরাকানের শেষভাগ হয়ে আরাকানের পূর্বাংশে চলে গেছে; অবশেষে এটি আকিয়াব বন্দরের নিকটবতী স্থানে এসে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে।
বমীভাষায় Kala শব্দের অর্থ বিদেশী, Dan শব্দের দ্বারা স্থান অর্থাৎ কালান্দান বলতে বিদেশীদের স্থান বুঝানো হয়ে থাকে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সপ্তদশ শতক থেকে আরাকানীরা পর্তুগীজ জলদসু্যদের সহযোগিতায় দক্ষিণ ও পূর্ববাংলার নদী এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহ থেকে মানুষ অপহরণ করে নাফ নদীর তীর থেকে কালাদান নদীর উত্তর তীরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে তাদেরকে ধান উৎপাদনের জন্য ভূমিদাস রূপে নিযুক্ত করেছিল। তাই এ নদীর নাম কালাদান হয়েছে।
লেম্রু (Lemro) আরাকানের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪৪ মাইল।” এ নদীটি আরাকানের ইয়ামো পাহাড়ের পাদদেশীয় অঞ্চলের পানি গ্রহণপূর্বক উত্তর আরাকান হয়ে আকিয়াব শহরের ১০ মাইল উত্তর দিয়ে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে। এ নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সভ্যনগরী বৈশালী, লংগিয়েত, পেরিন এবং মাউক-উ রাজবংশের রাজধানী শহর মোহং যা বর্তমানে পাথুরেকেল্লা নামে প্ৰসিদ্ধ ; আরাকানের অন্যান্য প্রসিদ্ধতম নদীগুলোর অন্যতম হলো মায়ু (Mayu) নদী। এটি প্রায় ১০ মাইল দীর্ঘ; যা আরাকানের রাথিদং ও বুচিদং টাউনশীপের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে এবং বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হবার পূর্বে কালাদান নদীর সাথে একত্রিত হয়েছে।
মায়ু নদীর সম্মুখভাগে (upper portion) এসে এটি কালাপানিজিন (Kalapanzin) নদী নামে পরিচিত হয়। পাহাড় থেকে নেমে আসা অসংখ্য ঝর্ণা-নালা, এহিদ এর সাথে এসে মিলিত হয়েছে।
আধুনিক আরাকান অঞ্চলটি সুদূর অতীতে চারটি ভৌগোলিক সীমানায় বিভক্ত ছিল। সীমানাগুলো হচ্ছে –
ধন্যাবতী (Dhannyarwadi),
রামাবতী (Ramawadi),
মেখাবতী (Mekhawadi) এবং
দারাবতী (Darawadi)
তৎকালীন ধন্যাবতী অঞ্চলটিই বর্তমান আরাকানের রাজধানী এলাকা । এছাড়া রামাবতী বর্তমান রামব্রী দ্বীপ (Rambree Island), মেখাবতী বর্তমান চৌদুবা এবং দারাবতী বলতে আধুনিক স্যাণ্ডোয়েকে বুঝানো হয়ে থাকে ।
এখানকার সমুদ্রতট সংলগ্ন স্বীপসমূহের মধ্যে রামব্রী ও চােদুবা সবচেয়ে বড় ; রামগ্ৰী উপকূলে একটি গভীর প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় আছে যা চবপিউ শহর থেকে মাত্র কয়েক মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এ গভীর প্রাকৃতিক সামুদ্রিক পোতাশ্রয়ে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের মত বড় জাহাজের সংকুলান হওয়া সম্ভব!
আরাকানে প্রায় ছোটবড় ১৭টি শহর আছে! শহরগুলো হলো আকিয়াব (Akyab), কিয়াউকপায়ু(Kyaukpayu), স্যান্ডোয়ে (Sandoway), কিয়াকতাউ(Kyauktaw), বুচিদং(Buthidalung), মংডু (Maundaw), মিনবিয়া (Minbya), ম্রউক (MraukU), গোয়া (Gva), টঙ্গু(Tangup),পিউকতাউ(Pauktaw), পেন্নাগিউ(Pannagun), মেবন (Maybon), মেনাং(Manaung), রামব্রি(Rambree), রাথিদং(Rathidaung) ও অন(Ann) প্রভৃতি।
এ শহরগুলোর রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব ব্যাপক থাকলেও মূলত স্যাণ্ডোয়ে, সিটওয়ে, মায়ু এবং কিয়াকপাউ- এ চারটিই আরকানের প্রশাসনিক ইউনিট।
আকিয়াব শহরটি কালাদান নদীর মোহনায় অবস্থিত। বর্তমানে এটি উত্তর আরাকানের প্রধান সমুদ্ৰ বন্দর। আরাকানের পরিবহন ও যোগাযোগের জন্য নদী পথই প্রধান। যাতায়াতের জন্য গোটা আরাকানে কোন রেলপথ নেই। পক্ষান্তরে সকল মৌসুমে গাড়ি চলাচলের উপযোগী মাত্র ২টি রাস্তা আছে। একটি আকিয়াব থেকে ইয়ানবিয়েন (Yeehanbyan) পর্যন্ত; যা মাত্র ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। অন্যটি মংভু থেকে বুচিদং পর্যন্ত যা ২৪ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত; কয়েকটি দুর্গম গিরিপথ আরাকান ও বার্মার মধ্যে একমাত্র স্থল পথ; যা সর্বসাধারণের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।
জলপথে উভয় অঞ্চলের মধ্যে যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকলেও তা সব সময় নিরাপদ নয়। ফলে আরাকানের মূল জনগোষ্ঠী বাৰ্মা থেকে অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন! আরাকানের জমি খুব উর্বর। সমুদ্রের তীরবতী হবার কারণে এখানকার আবহাওয়া মধ্যম প্রকৃতির; যা কৃষি কাজের জন্য বেশ উপযোগী ! অঞ্চল ভেদে আরাকানের একেক স্থানের মাটি একেক রকম। এর কিয়দাংশ এঁটেল মাটি এবং বাকী অধিকাংশ অঞ্চলের মাটিই দোআঁশ, পলি ও বেলে। আকিয়াবের রাথিদং ও মংড় অঞ্চলের অধিকাংশ অঞ্চলই বেলে মাটি ।
এছাড়া আরাকানের উপত্যকাসমূহের উঁচু অঞ্চলজুড়ে বর্ষার পাহাড়ী ঢল ও জল প্রবাহের কারণে উর্বর পলি মাটি সমৃদ্ধ। আরাকানের অধিবাসীরা মূলত কৃষিকে মূল পেশা হিসেবে গ্রহণ করে থাকে, তবে আবাদযোগ্য সকল জমিই কৃষির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। সেখানকার ৯,৫৪,২৫৭ একর আবাদযোগ্য জমির মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৮,৫৪,৭২৪ একর জমি চাষ করা হয়।
** ***বর্তমানে অনেক মুসলমান কৃষককে দেশ থেকে বিতাড়িত করে সেখানে মগদের পুনর্বাসন করাই এর অন্যতম কারণ ।
ধান আরাকানের প্রধান উৎপাদিত ফসল। এছাড়াও এখানে ভুট্টা, আখ, তামাক, চীনাবাদাম, আলু, বেগুন, টমেটাে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, রসুন, পিয়াজ, আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কলা, লিচু, বরই, কমলালেবু, বাতাবি লেবু, তরমুজ, জলপাই প্রভৃতি শস্য, শাকসবজি ও ফলমূল জন্মে। আরাকানে কৃষি কাজের জন্য সাধারণত গরু-মহিষের লাঙ্গল ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে আধুনিক যন্ত্ৰচালিত চাষ পদ্ধতিরও প্রয়োগ শুরু হয়েছে। গৃহপালিত পশু হিসেবে সেখানে গরু-মহিষ, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতিই প্রধান।
আরাকান গভীর জঙ্গলাপূর্ণ পাহাড়ী এলাকা হেতু সেখানে টাইগার, চিতাবাঘ, হরিণ, ভালুক, বুনো শুকর এবং বুনো হাতিও রয়েছে। বিশেষ করে ইয়োমা পাহাড়ের জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে হাতি, গণ্ডার, বুনো গোখরা সাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ এবং স্রোতস্বিনী নদীর মোহনায় কুমির কৃষির পাশাপাশি আরাকানের একটি উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী মাছ শিকারকে তাদের প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। আরাকানের মংড় থেকে শুরু করে ওয়াচং (Gwachaung) হয়ে ইরাবতি বিভাগের থাবাং সীমান্ত অঞ্চল কিয়াকচামচং (kyaukchamchaung) পর্যন্ত প্রায় ৩৬০ মাইলব্যাপী মনোরম সমুদ্রোপকূলীয় অঞ্চল। এসব অঞ্চলের বিভিন্ন মােহনায় পর্যাপ্ত সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়ে। এছাড়া নদী মাতৃক আরাকানের নদীসমূহেও পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যায়। বিশেষ করে নাফ নদী ও কালাদান নদীর উপকূলীয় চিংড়ি ঘের থেকে পর্যাপ্ত উন্নতমানের চিংড়ি উৎপন্ন হয়। আধুনিককালে পুকুর ডোবাতেও মাছ চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
আরাকানে পর্যটন শিল্প খুব সম্ভাবনাময়। সরকারিভাবে আরাকানকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হলে আকিয়াব, কিয়াকপাউ, স্যাভোয়ে, ঘাপালী (Ngapali) প্রভৃতি অঞ্চলে পর্যটকদের জন্য সমুদ্রবন্দর, সমুদ্র সৈকত ও প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় হিসেবে আকর্ষণ করতে পারবে।
আরাকানের মোট আয়তনের প্রায় ৭০% পাহাড় ও বনাঞ্চলসমৃদ্ধ। এখানকার বনাঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে উন্নত মানের কাঠ উৎপন্ন হয়। আরাকানের পাহাড়ী অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন সেগুনকাঠ মিয়ানমারের মোট উৎপাদিত কাঠের প্রায় ১৫ শতাংশ ।
এছাড়া আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চলে পিনকেডু নামে পরিচিত আয়রন কাঠ, বাশ, দারুচিনি ও ওক (Oak) গাছসহ প্রচুর পরিমাণে বনজ ও ঔষুধী। গাছ জন্মে। বনাঞ্চলের মধু আরাকানে খুব প্রসিদ্ধ। খনিজ সম্পদের দিক থেকেও আরাকান অঞ্চল খুব সম্ভাবনাময়। এখানে পেট্রোল, কয়লা ও তেলসহ বিভিন্ন ধরনের খনিজ সম্পদের সন্ধান রয়েছে। এমনকি সেখানে সোনা ও রূপার খনিরও অস্তিত্ব বিদ্যমান।
কিন্তু খনন কাজের উপযুক্ত প্ৰযুক্তির অভাবে তা উত্তোলন ও ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হচ্ছে না। চাল আরাকানের প্রধান রপ্তানী পণ্য ; অতীতে আরাকান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাল রপ্তানী করা হতো বলে ঐতিহাসিকভাবে আরাকানকে ধন্যবতী (Granary of Rice) বলা হয়ে থাকে। চাল ছাড়াও মাছ, লবণ, মশলা, তামাক, কাঠ প্রভৃতি আরাকানের প্রধান রপ্তানীযোগ্য পণ্য। প্রধান আমদানীকৃত পণ্যের মধ্যে ঔষধ, বৈদ্যুতিক সামগ্ৰী, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, কাপড় এবং প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত বিলাস সামগ্ৰীই প্ৰধান। আরাকানের জনসংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান প্ৰদান করা খুবই কষ্টসাধ্য। সামরিক জান্তা শাসিত রুদ্ধদ্বার দেশ হিসেবে সেখানকার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ পরিস্থিতি এবং জনসংখ্যার বিন্যাস উভয় ক্ষেত্রেই অস্পষ্টতা রয়েছে। তাছাড়া স্বাধীনতা উত্তর মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে কোন আদমশুমারীও হয়নি। ফলে এ বিষয়ে মতপার্থক্যের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
>>>এক- বাংলাদেশের পত্র/পত্রিকার ভাষ্য ও আরাকানের মুসলিম লেখকদের মতানুসারে আরাকানের মোট জনসংখ্যা ৫০। (পঞ্চাশ) লক্ষ। তন্মধ্যে ৩০ (ত্ৰিশ) লক্ষ মুসলমান; যা প্ৰায় সমগ্ৰ জনগোষ্ঠীর ৬০% **
>>দুই-. ড. আবদুল করিম এর মতে, আরাকানের মোট জনসংখ্যা ৪০ লক্ষ, তন্মধ্যে ২০ লক্ষ মগ-বৌদ্ধ, ১৪ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান, ৪ লক্ষ সর্বপ্রাণবাদী (Animist) এবং ২ লক্ষ হিন্দু ও খ্রিস্টান।**
>>তিন- U.S. Committee for Refugees 453 VRNS "Arakans Population is
estimated to be 3 to 3.5 million persons of whom approximately 1.4 million are Rohingya.”
**আরাকানী মুসলিম লেখকদের মতানুসারে প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান বিভিন্ন সময় নির্যাতনের মুখে আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এর মধ্যে সৌদি আরবে ৫ লক্ষ, পাকিস্তানে ২ লক্ষ ৫০ হাজার, বাংলাদেশে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার, গালফ স্টেটসমূহে ৫৫ হাজার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যাণ্ডে ৪৩ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ১০ হাজারেরও বেশী মুসলমান আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়েছে।”
এছাড়া ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের গণহত্যার সময় লক্ষাধিক মুসলমানকে হত্যা করা হয় এবং ৫ লক্ষাধিক মুসলমান দেশ থেকে বিতাড়িত হয়। তৎকালীন বৃটিশ প্রশাসন বর্তমান গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানার সুবিরানগরে এবং কক্সবাজারের সমুদ্রোপকূলে শরণার্থ ক্যাম্প তৈরী করে এদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চালায়।’
এভাবে বিভিন্ন সময় হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও বিতাড়নের ফলে মুসলমানদের সংখ্যা অনেকাংশে হাস পেয়েছে। তদুপরি আরাকানী মুসলিম লেখকদের পরিসংখ্যানটি উত্তর আরাকান বিশেষত বুচিদং ও মংড় এলাকার পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ; সেইসাথে দুই ও তিন নম্বরের পরিসংখ্যানের সাথে বিতাড়িত ও নিহত মুসলমানদের সংখ্যা যোগ করলে আরাকানী মুসলিম লেখকদের পরিসংখ্যানের সাথে মিলে যায় ।
কেননা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারী মোতাবেক আকিয়াবের মুসলমান ছিল ৩৩%।* অনুরূপভাবে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারী অনুযায়ী আরাকানের লোকসংখ্যা হচ্ছে ১২,৯৯,৪১২ জন। এর মধ্যে বৌদ্ধ ৮,৭৮,২৪৪ জন, মুসলমান ৩,৮৮,২৫৪ জন, হিন্দু ৩,২৮১ জন, খ্রিস্টান ২,৭৫৩ জন এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ছিল ২৫,৮৮০ জন। সুতরাং মোটামুটিভাবে বলা যায়, বর্তমানে আরাকানের মোট জনসংখ্যা প্ৰায় পঞ্চাশ লক্ষ । এর মধ্যকার ৪০% লোক মুসলমান।
আরাকান নামটি অনেক পুরাতন হলেও বর্তমানে সরকারি নথিপত্রে এ নামটি বিলুপ্ত প্ৰায় { মিয়ানমারের সামরিক শাসক নে উইন ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের নাম পরিবর্তন করে ‘রাখাইন স্টেট' নামকরণপূর্বক এটিকে একটি অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা দিয়েছে। ২৩ সে অবধি সরকারিভাবে আরাকানকে “রাখাইন স্টেট' নামে অভিহিত করা হয় ! ঠিক কখন থেকে এ রাজ্যটি আরাকান নামে পরিচিত তাও সঠিকভাবে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে
প্রাচীনকালে আরাকানীরা তাদের জন্মভূমিকে রাখইঙ্গা (Rakhaling) নামে অভিহিত করত ’ এ রাখইঙ্গ শব্দটি সংস্কৃত ‘রক্ষ' (Raksha) এবং পালি 'যকখো।' (Yokkho)
অর্থাৎ রক্ষা ও যক্ষ শব্দ হতে উৎপন্ন হয়েছে বলে মনে করা হয় ; কেননা বৌদ্ধরা লঙ্কা বা সিংহল অর্থাৎ আধুনিক শ্ৰীলংকা জয় করার পূর্বে আরাকানের আদিম অধিবাসীদের রক্ষ বা যক্ষ নামেই অভিহিত করত ।
অনুরূপভাবে ভারতীয় আর্যরা আরাকানের দ্রাবিড় ও মঙ্গলীয়দের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হবার পূর্বে এ নামে অভিহিত করতেন । রাখাইং শব্দের অর্থ হলো দৈত্য বা রাক্ষস। রাখাইংরা তাদের জন্মভূমিকে রাখাইংপে (Rakhaingpyi) ,রাখাইং ভূমি (Land of the Rakhaing) বলত।রাখাইন বলতে আরাকানের অধিবাসী আর পে (Phi) বলতে দেশ বুঝানো হতো।
ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদদের বর্ণনায় আরাকানের বিভিন্ন’ নাম পাওয়া যায়। তবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মতে আরাকান নামটি অনেক পুরনো। এ নামের বিকৃতিতেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উচ্চারণ হয়েছে। আরাকান শব্দটি মূলত আরকান; যা আরবী আররেকন বা আরব্রুকন শব্দের অপভ্রংশ ।
* রুকন শব্দের অর্থ হলো স্তম্ভ বা খুঁটি। ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদকে রুকন বলা হয়। তাই তাদের ধারণা, সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে তৎকালীন মুসলমানরা আরাকানকে ইসলামের বুনিয়াদের দিকে খেয়াল রেখে আরকান নামকরণ করেছে।
সূত্রঃআরাকানের মুসলমানদের ইতিহাস—ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ।
বিষয়: বিবিধ
১৩৪৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গুরুত্বপূর্ণ লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন