প্রাচীনকালের চিকিৎসা বিজ্ঞান
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ০৯ এপ্রিল, ২০১৬, ০৯:০১:৩৭ রাত
****প্রাচীনকালের চিকিৎসা বিজ্ঞান
চিকিৎসকদের গাড়িতে সচরাচর একটি প্রতীক ব্যবহাত হয়--তু’টো সাপসহ একটি দণ্ড এবং একটি ডানাযুক্ত টুপি । জিউসের পুত্র হামেস এই প্রতীকটি ব্যবহার করতেন এবং এই প্রাচীন প্রতীকের সাহায্যে অধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞান প্রাচীন কালের জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে তার ঋণ স্বীকার করে ।
মিশরে রাজাদের উপত্যকাসমহে সাম্প্রতিক এক খননকার্যে বেশ কিছু মমী উত্তোলিত হয়েছে । এসব মর্মীতে দেখা গেছে বাধানো নকল দাত, আশ্চর্যজনকভাবেই যা কোন আধুনিক ডেন্টিস্টের কাজ বলে মনে হয়। বহু হাজার বছর আগে প্রচীন মিশরে দন্ত-চিকিৎসার ক্ষেত্রে দক্ষতার এমন প্রমাণ কোন বিজ্ঞানীই আশা করেন নি । মেক্সিকোর কম্পেসি অঞ্চলে জায়না উপকূলে খনন করে পাওয়া মায়া গোষ্ঠীর করোটিসমূহের কয়েকটিতেও দন্ত-চিকিৎসার ক্ষেত্রে অদ্ভুত দক্ষতার সন্ধান পাওয়া গেছে । বহু বছর আগে ব্যবহৃত ক্রাউন ও ফিলিং এখনো যথাস্থানে রয়ে গেছে । বোঝা যায় খচিত অংশের ডিলিং ও সেটিং যে চিকিৎসকরা করেছিলেন তারা দাতের ভাইটাল অংশকে সবসময় সমীহ করেছে। ফিলিংএর কাজে কি বস্তু
ব্যবহৃত হতো তা জানা না গেলেও ব্যবহৃত বস্তুটি অত্যন্ত উন্নতমানের ছিলো, কারণ ফিলিংগুলো এখনো অক্ষত অবস্থায় । পেরুতে ইনকাদের পুর্ববর্তী সময়ের শল্য-চিকিৎসকরা ২,৫oo বছর আগে ডেলিকেট ব্রেন-অপারেশন সম্পন্ন করেছিলেন । আধুনিক শল্য-চিকিৎসায় টেপানেশন একটি নতুন পদ্ধতি, অথচ পেরুতে সাফল্যজনক ভাবে মাথার খুলিতে ফুটো করে অপরেশন করা হয়েছে, এমন হাজার হাজার করোটির সন্ধান পাওয়া গেছে । এই কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল ব্রোঞ্জের তৈরী ছুরি, তীরের সুক্ষ্ম অগ্রভাগ, সাড়াশী, ক্ষুদ্র আকারের ছুরি এবং ক্ষতস্থান সেলাইয়ের জন্যে সুই । উল্লেখ্য যে, একই ধরণের অপারেশন ১৭৮৬ সালে প্যারিসে সম্পর্ণরুপে ব্যর্থ হয়ে ছিল । একইভাবে বহু শতাব্দী আগে দক্ষিণ আমেরিকায় এ্যমপুটেশনও সম্পাদিত হয়েছিল । ইনকা চিকিৎসকরা ড়ে সিং-এর জন্যে গজ এবং চেতনা নাশের জন্যে সম্ভবতঃ কোকেন ব্যবহার করতো । ইনকারা অনেক প্রয়োজনীয় ওষুধ আবিষ্কার করেছিল, যেমন, কোকেন কুইনিন, বেলাডোনা প্রভৃতি । প্রাচীন ব্যবিলনে অসুস্থকে এক অস্তু ত প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা করা হতো । হেরোডোটাসের বর্ণনা থেকে জানা যায় অসুস্থ ব্যক্তিকে রাস্তার পাশে এনে রাখা হতো । তার অসুবিধে সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা পথচারীদের নৈতিক কর্তব্য ছিলো । নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে পথচারীরা বিভিন্ন ব্যবস্থা বা ওষুধের পরামর্শ দিতো যা তারা ফলপ্রসু হিসেবে শুনেছে, কিংবা নিজেই একই অসুবিধায় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ
বা সেই ওষুধ ব্যবহারে ৩ারোগ্য লাভ করেছে। এই ভাবে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ'পা ওষুধ ব্যবহার করে রোগী অবগত হতো কোনটি তার জন্যে সুফলতম । পরবর্তীকালে এর ওপর ভিত্তি করেই রোগ নির্ণয় ও ওষুধ প্রস্তুত প্রণালী গড়ে উঠেছিল। আমাদের এখনকার সময়ের এক আশ্চর্য ওষুধ পেনিসিলিন, টেরামাইসিন প্রভৃতিরও উৎপত্তি স্থল প্রাচীন মিশর। মিশরের একাদশ গোত্রের মেডিক্যাল ইতিহাস সম্বলিত প্যাপিরাস গ্রন্থে এক ধরনের ফ্যাঙাসের উল্লেখ রয়েছে । স্থির-আবদ্ধ পানিতে সৃষ্ট এই ফ্যাঙাস আঘাত বা উন্মুক্ত ক্ষতের চিকিৎসার জন্যে ব্যবহার করা হতো । তবে কি ফ্লেমিং-এর চার হাজার বছর আগেই পেনিসিলিন তাদের আয়ত্তে ছিলো ? -. এ্যান্টিবায়োটিক ও প্রাচীনকালের লোকদের কাণ্ডে তাপরিচিত ছিলোন। ক্ষত সারানোর জন্যে, ফোড়া এবং এমন কি কারণধীল বিনাশ করার জন্যে প্রাচীন গ্রীক ও চীনারা এ্যান্টিবায়োটিক ধৰ্মসম্পন্ন ওয়ার্ম-সয়েল এবং সয়-বিন থেকে তৈরি মলম জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করতে । অপারেশনের সময় চেতন-নাশ করার জন্যে মিশরীয়রা এক অদ্ভুত খনিজ ব্যবহার করতো । তারা মানব দেহের বিভিন্ন নার্ভ এবং বিভিন্ন গ্রন্থের মিলন সম্পর্কে অবগত ছিলো, সুতরাং তারা জানতো প্যারালাইসিস কেন হয় কিভাবে হয়। মিশরের স্মিথ প্যাপিরাসে চিকিৎসা সম্বন্ধীয় ৪৮টি ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে । নীল নদের প্রাচীন অধিবাসীরা হাইজিন পদ্ধতিতে অভ্যস্থ ছিলো। তাদের তৈরি ওষুধ এতোই উন্নতমানের ছিলো যে ইউরোপে মধ্যযুগে সেই পদ্ধতির বহু
ব্যবহার ও অনুশীলন ঘটেছে । - পিরামিডের দেশের চিকিৎসকরা হাট ও আর্টারীর বিভিন্ন কাজ সম্পর্কে অবহিত ছিলো, তারা নাড়ী গুণতেও জানতো, অর্থাৎ ব্লাড প্রেসার সম্বন্ধেও তাদের ধারণা ছিলো । অনুমান করা হয় ইতিহাসে স্বীকৃত প্রথম চিকিৎসক হচ্ছেন জোসার পিরামিডের স্থপতি ইমহোটেপ, সময় খৃষ্টপূর্ব ৪,৫০০ অব্দ । প্রাচীন ভারত-বর্ষও চিকিৎসা বিজ্ঞানে যথেষ্ট উন্নত ছিলে । দেহের বিপাক, রক্ত-চলাচল, সন্তান কিভাবে হয়, স্বায়ুতন্ত্র এবং এমন কি বংশ পরম্পরায় নিদিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিবর্তন সম্পর্কেও ভারতের চিকিৎসক’র অবগত ছিলেন। আর্য চিকিৎসকরা বিষাক্ত গ্যাসের কুফল নিবারণের চিকিৎসা-পদ্ধতি জানতেন, সিজারিয়ান এবং ব্রেন-অপারেশন সম্পাদন করেছিলেন । চেতনা-নাশক ওষুধ ও তাদের সংগ্রহে ছিলো। প্রাচীন ভারতে খৃষ্টপূর্ব ৫oo অব্দের এক তালিকায় বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের ১১২oটি প্রক্রিয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। ১২১ ধরেনের সাজিক্যাল যন্ত্রপাতি এবং প্লাষ্টিক সাজারী করার প্রথম চেষ্টার বিবরণও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে । আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের সকতো গ্রন্থম নামক এক গ্রন্থে বসন্ত রোগে টিকাদান সম্পর্কে নিম্নলিখিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে-‘শরীরের প্রদাহের অংশের বস্তু ছুরি’র ডগায় নাও, তা বাহুতে প্রবেশ করিয়ে রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে দাও। জ্বর দেখা দেবে, কিন্তু এরপর খুব সহজেই শারীরিক পীড়া ভালো হয়ে যাবে এবং কোনো জটিলতার স্থষ্টি হবে না।” উল্লেখ্য, এডওয়ার্ড জেনার
(১৭৪৯-১৮২৩) কে টিকাদান পদ্ধতি আপিস্কারের জন্যে সম্মান দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মনে হয় প্রাচীন ভারতের দাবী তারো । আগের ।
এখন বেশ কিছু উন্নত দেশে সরকারী উদ্যোগে মেডিক্যাল এইড প্রোগ্রাম প্রভ.তি পালন করা হয় । কিন্তু ইনকা সাম্রাজ্যে এবং ফ্যারাওদের মিশরে চিকিৎসকরা সরকার থেকে পুরুস্কৃত হতেন এবং মেডিক্যাল এইডও সবাই বিনামূল্যে লাভ করতে। চীনের রাজা শীন-সী ( খৃষ্টপূর্ব ২৫৯-২১০ অব্দ)’র একটি যাত্র আয়না ছিলে। যার সামনে দাড়ালে শরীরের অস্থিসমূহ দেখা যেতো । প্রাচীন চীনে এক্স-রে ব্যবস্থা ? আয়নাটি আকারে ছিলো ১,৭৬ × ১,২২ মিটারের । যখন কেউ এর সামনে দাড়াতে৷ তখন যদিও তার প্রতিবিম্বকে মনে হতো বিপরীত দিকে ফিরে আছে, তথাপি তাতে আধুনিককালের ফ্লোরস্কোপ-এর মতোই সমস্ত বোন আর অর্গান স্পষ্ট দেখা যেতে । আর আরো আশ্চর্য, ঠিক এখনকার মতো রোগ নির্ণয়ের কাজেই আয়নাটি ব্যবহৃত হতো। ওদিকে চীনেই আঠোরোশ’ বছর আগে চেতন নাশক দ্রব্য ব্যবহার করে এক সার্জন এক অপারেশন সম্পন্ন করেছিলেন । পরবর্তী হান গোত্রের (২৫-২২০) ঘটনাপঞ্জীতে আধুনিক কোনো মেডিক্যাল সাময়িকীর রিপোর্টের মতো এই অপারেশনের পুরো বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে পশ্চিমা ছনিয়ায় ব্লাড ট্রান্সফিউশন চালু হয়, অথচ হাজার বছর ধরে অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীরা এই ব্যবস্থায় অভ্যস্থ । তারা এখনো বংশপরম্পরায় এই প্রাচীন জ্ঞান
আয়ত্তে রেখেছে । তারা সঠিক ভাবে জানে কোন বিশেষ শির। থেকে রক্ত নিতে হবে, এবং এমন কি রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার আধুনিক পদ্ধতি জান না থাকলেও, সঠিক রক্ত দানকারী ও গ্রহণকারীকে শনাক্ত করতে তাদের কোনো অসুবিধে হয় না । তাই দুই গ্র-পের রক্ত মিলে রোগীকে কখনো কোনো অসুবিধায় পড়তে হয়নি । এ এক আশ্চর্য প্রাচীন বিজ্ঞান, যার রহস্য ভেদ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীরা শুধুমাত্র রোগীকেই রক্ত দেয় না, বুদ্ধের সজীবতা ফিরিয়ে আনার জন্যে প্রয়োজন বোধে তাকেও রক্ত দেওয়া হয় । সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যখন অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীরা খরা বা এ জাতীয় কোনো কারণে খাদ্য সংকটের সম্ম খীন হয় তখনই মহিলারা কন্ট,াসেপটিভ ব্যবহার করতে আরম্ভ করে । এই জন্ম-নিরোধ বড়ির আকারে তৈরী করা হয় এক বিশেষ ধরণের উদ্ভিদ থেকে । এই ব্যবস্থাও হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে । আসলে আমাদের এই সূর্যের নিচে কিছুই নতুন নয় ।
বিষয়: বিবিধ
১৪১৬ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন