বাংলা সাহিত্যে প্রথম মুসলমান গদ্য লেখক(দ্বিতীয় পাঠ)

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ০৮ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৪:০৮:৫২ বিকাল

বাংলা সাহিত্যে প্রথম মুসলমান গদ্য লেখক(দ্বিতীয় পাঠ)

-----------------------------------------------

*উনিশ শতকের মধ্যভাগে খোন্দকার শামসুদ্দিন মুহম্মদ সিদ্দিকী “ভাবলাভ ও শুরতজান” নামে দু’খানা কাহিনী কাব্য রচনা করেন। মুহম্মদ আবদুল হাই সম্পাদিত ‘সাহিত্য পত্রিকা'র ১৩৬৪ সালের বর্ষা সংখ্যায়, আশুতোষ ভট্টাচার্য উনবিংশ শতাব্দীর একজন মুসলমান কবি’ শীর্ষক প্রবন্ধে সিদ্দিকীর কবি-কর্মের বিস্তৃত পরিচয় দেন । তিনি ‘উচিত শ্রবণ” গ্রন্থের বা সিদ্দিকীর গদ্য রচনার কোন উল্লেখ করেন নি । তার অলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, সিদ্দিকী মধ্যযুগের ধারা অনুসরণ করেই কাব্য রচনা করেছিলেন এবং তার আদর্শ ছিল কবি ভারতচন্দ্র ।

*‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে “উচিত শ্রবণ” সম্পর্কে খুব অল্প আলোচনা করা হয়েছে। তাতে দেখা যায় পুস্তকটির বিষয় বস্তু পরমার্থিক । এতে সাধুরীতিতে লিখিত কিছু গদ্যের নিদর্শন আছে। ধর্মের গূঢ় রহস্য বোঝাতে গিয়ে লেখক এর ভাষাকে জটিল এবং আড়ষ্ট করে ফেলেছেন । সমাজ সচেতনতা বা বাস্তববোধের কোন পরিচয় 'উচিত শ্রবণে” নেই।

* তবে বাংলা গদ্যের প্রথম পরিচয় পাওয়া যায় গোলাম হোসেনের 'হাড়জালানী'তে। এটি ১২৭১ সালে অর্থাৎ ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে ছাপানে হয় ।বাস্তব পরিবেশ সম্পর্কে যে সচেতনতা বাংলা গদ্য সৃষ্টির মূল কথা মুসলমান লেখকের মধ্যে তার পরিচয় 'হাড় জ্বালানী’ পুস্তকেই প্রথম লক্ষ্য করা যায়।আর এটিই এ পর্যন্ত মুসলমান লেখক বা কবি লিখিত গদ্য পুস্তকের প্রাচীনতম নির্দশন।

>>কাজেই গোলাম হোসেনকে প্রথম মুসলমান গদ্য লেখক বলে ধরা যায়।

**হাড়জ্বালানীঃ

হাড়জালানী ১৬ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা। এটি ১২৭১ সালে 'কলিকাতা গরণ হাটা ষ্ট্রটের ৯২ নং ভবনে এংলো ইণ্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রিত হয়। বইয়ের শেষে এর প্রকাশকের নাম, ঠিকানা ও দাম দেওয়া হয়েছে :

>প্রকাশকঃ “শ্ৰী সেখ জমিদর্দী

>সাংঃ বন্দিপুর

>জেলঃ হুগলী

>থানাঃ হরিপাল

>মূল্যঃ এক আনা মাত্র

বইটিতে কোন চরিত্রেরই নামকরণ করা হয় নি। মা, ছেলে, বউ এবং তাদের কয়েকটি বাচ্চা নিয়ে একটি ছোট পরিবার । ছেলে বাড়ি থেকে দূরে কোন এক জায়গায় কাজ করে এবং সেখানেই থাকে । এদিকে বাড়ীতে বউ এবং শাশুড়ীতে কতৃত্ব নিয়ে অশাস্তি সৃষ্টি হয়েছে। বুড়ী শাশুড়ী হয়েছে বউয়ের চক্ষুশূল, তাকে সংসার থেকে না তাড়ানো পর্যস্ত তার আর শাস্তি নেই । শাশুড়ীর ভাল মন্দ কোন কথাই বউয়ের সহ্য হয় না। একদিন কথায় কথায় ঝগড়া বেধে যায় এমোন ভাবে---

*শাশুড়ীঃওগে বউ তুই যে আজ বড় চুপ করে বসে রয়েছিস, কায কৰ্ম্ম কি কিছু নাই । *বউঃ যাগো বাবু পোড়ার ঘর কন্না থাকলেই কি না থাকলেষ্ট কি ?

* শাশুড়ীঃ কেন গো বউ তোর যে আজ কথাগুলো উণ্টো ২ লাগচে, রোজ সকাল বাসি কৰ্ম্ম কায সারিস আজকে একবারে সব ছেড়ে দে বসেছিস ।

*বউঃ (শাশুড়ীর প্রতি ) যারে বাবু তোর তাজ গিন্নিপনা মোর গায়ে সহেন । তুই যত ভালবাসিস তা জান আছে ।

*শাশুড়ীঃ ওমা তুষ্ট কি বলিস গে। আমি তোকে প্রাণের অধিক ভালবাসি, আমার এই বৃদ্ধ পাল কোনদিন মরি কোনদিন বাচি, তোর পর কন্ন তুই বুঝে করবি । আমি যতদিন বেঁচেছি আর কি ততদিন বাচবো গো ।

*বউঃ হেঁ তোমাদের এখন মরণ আছে তা মরবে।

*শাশুড়ীঃ হেঁগা বউ তুই আজ আমাকে এমন কথাটা কেমন করে বল্লিগা” বউটি মুযোগের সন্ধানেই ছিল । এই ঝগড়ার ফলে সে শাশুড়ীকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। বিতাড়িত হয়ে বুড়ী প্রতিবেশীর বাড়ীতে আশ্রয় নেয় এবং ছেলেকে চিঠি লিখে :

“পয়ার ।

আশীৰ্বাদ করি বাব পুত্রটি আমার ।

মাটি যেন সোন হয় করেতে তোমার।

সুখে খাও সুখে পরে সুখে সৰ্ব্বক্ষণ ।

সুখের সমুদ্রে জেন রাখে নিরাঞ্জন।

বিবরিয়া কহি বাবা আমার কাহিনী ।

বৃদ্ধকালে তুঃখ পাই তোমার জননী ।

অন্নত্যাগ করেছেন বউটি আমার ।

তুমি ঘরে এলে পরে হইবে বিচার ॥

বৃদ্ধকালে এই মোর ছিল যে কপালে ।

কার কাছে গিয়ে বাবা চাব হাত তুলে ।

প্রতিবেশীগণে বাবা রেখেছে আমায় ।

মম মুখ চাহ যদি আসিবে ত্বরায়।”

গল্পের ভাষ্য মতে -- হয়ত কোন বিধবা নারী একমাত্র পুত্রের জন্য একটি টুকটুকে মেয়ে ঘরে এনে সোনার সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল । কিন্তু ‘কলির বৌ প্রবল আত্মপ্রতিষ্ঠার তাড়নায় তাকে বৃদ্ধ জীবনের শেষ আশ্রয় থেকে বঞ্চিত করে যে মৰ্ম্মান্তিক বেদন সৃষ্টি করেছিল, গোলাম হোসেন 'হাড়জালানী’তে তারই একটি জীবন্ত চিত্র অঙ্কন করেছেন । মনে হয় কোন বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই নক্সাজাতীয় রচনাটি লিখিত হয়েছে । এতে কোন চরিত্রের নামকরণ না করার মূলেও ঐ কারণটি বিদ্যমান থাকা অসম্ভব নয় । তবে লেখক যে তার কাছের মানুষকেই বইটিতে চিত্রিত করেছেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । চার পাশের মানুষের জীবনকে ঔৎসুক্যপূর্ণ দৃষ্টিত দেখার ও সেই জীবনের ভাল এবং মন্দ, আনন্দ এবং বেদনাকে রূপায়িত করার যে অপরিসীম কৌতুহল এ কালের শিল্পীচিত্তকে অস্থির করে তুলেছিল, যার প্রকাশ অসংখ্য প্রহসন, নক্স এবং নাটকে ব্যাপ্ত হয়ে আছে তারই একটি ক্ষুদ্র নিদর্শন গোলাম হোসেনের 'হাড়জালানী’ পুস্তিকা। এ সব রচনায় সাহিত্য স্থষ্টির যে ব্যাকুল প্রয়াস স্থূপীকৃত হয়ে আছে তাতে ফুৎকার দিয়ে হয়ত শিল্পের কোন ফুলিঙ্গ আজ আর আবিষ্কৃত হবে না কিন্তু একথা বিস্মৃত হলেও চলবে না যে এরই উপর অমান শিখায় প্রদীপ্ত হয়ে আছে আমাদের আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ।হাড়জ্বালানী এর ভাষাও সেজন্য কথা—সহজ এবং অনাড়ম্বর । এতে পশ্চিম বঙ্গ অঞ্চলের মুসলমানদের কথারীতির নমুনা পাওয়া যায়। ১৮৬৪ সালের কিছু পরে বাংলা গদ্যের প্রচলিত সাধুরীতিকে অবলম্বন করে মুসলমানদের সাহিত্য রচনার পরিচয় পাওয়া গেলেও সে সময়ের মুসলমান সমাজের মুখের ভাষার নিদর্শন অত্যন্ত দুর্লভ ।

বিষয়: বিবিধ

১১০৪ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

356468
০৮ জানুয়ারি ২০১৬ বিকাল ০৫:৫৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
০৯ জানুয়ারি ২০১৬ সকাল ০৯:০৮
295953
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
০৯ জানুয়ারি ২০১৬ সকাল ০৯:০৮
295954
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
০৯ জানুয়ারি ২০১৬ সকাল ০৯:০৮
295955
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File