বাংলা সাহিত্যে প্রথম মুসলমান গদ্য লেখক(প্রথম পাঠ)
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ০৬ জানুয়ারি, ২০১৬, ০১:১০:৪১ রাত
বাংলা সাহিত্যে প্রথম মুসলমান গদ্য লেখক(প্রথম পাঠ)
------------------------------------------------
পৃথিবীর সব সাহিত্যেই কাব্যের তুলনায় গদ্য কিছুটা নতুন । বাঙলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের পুরানো হলেও গদ্য অনেকখানি হালের সৃষ্টি । এর ইতিহাস পুরো দুশ' বছরেরও নয়। অথচ কাব্যের তুলনায় গদ্যের বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি খুব কম নয়। সম্প্রতি কালে গদ্য সাহিত্য কাব্যকে একরকম কোণঠাসাই করে ফেলেছে । যে কোন বছরের প্রকাশিত গ্রন্থের তালিক। দেখলে বা পত্রপত্রিকার পাতা উল্টালেই তার প্রমাণ পাওয়া যায় । স্বাধীনতা লাভের পর পূর্ব পাকিস্তানে যে সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে তার ও প্রধান অংশ গদ্য ।
উনিশ শতকের শুরুতে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং সেখানকার পণ্ডিতগণের বাংলা পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নের প্রচেষ্টাকে নিয়েই আমাদের গদ্যের ধারাবাহিক ইতিহাসের সূচনা । এদেশে ইউরোপীয় বাণিজ্যের স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাশ্চাত্য শাসন এবং তার সঙ্গে এসেছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা ও খৃষ্টান ধর্ম । বাঙলা দেশের হিন্দু সমাজ ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্রে, এর শাসন ব্যবস্থায় শরীক হওয়ার ক্ষেত্রে এবং নতুন শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন । ফলে নতুন শিক্ষা সঞ্জাত চেতনা তাদের মধ্যেই প্রথম দেখা দিয়েছিল এবং সেই চেতনার সঙ্গে পুরানো জীবনের সংঘাত এবং খৃষ্টান ধর্মের সংঘর্ষও তাদের মধ্যেই প্রথম সংঘটিত হয়েছিল । আর এ সবেরই পরোক্ষ সৃষ্টি হচ্ছে বাঙলা গদ্য সাহিত্য | প্রায় পঞ্চাশ বছর অর্থাৎ উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কে বলা যেতে পারে গদ্যের প্রস্তুতি কাল । এ সময়ে হিন্দু সমাজ মানদের বিক্ষোভ ও বিবর্তন প্রধানত গদ্যের মারফতেই ব্যক্ত হয়েছে । সে সব রচনার শিল্পমূল্য নগণ্য হলেও ঐতিহাসিক মূলা অপরিসীম। পরবর্তীকালের সমৃদ্ধ সাহিত্যের পটভূমি
ঐ সব বিক্ষিপ্ত ও অকিঞ্চিৎকর রচনার দ্বারাই গড়ে উঠেছে। বিতর্কমূলক প্রস্তাব থেকে রস সমৃদ্ধ প্রবন্ধ এবং প্রহসন-নক্স থেকে নাটক-উপন্যাস সৃষ্টি করে হিন্দু সাহিত্যিকগণ, বাঙলা গদ্যকে পরিপুষ্ট এবং নিজেদের ভাব ভাষা ও ভঙ্গিকে ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন ।
গদ্যের ক্ষেত্রে মুসলমানদের আবির্ভাব অনেক পরের ঘটনা। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে, পাশ্চাত্য শাসন ও শিক্ষার মাধ্যমে যে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি এ দেশের মানুষের মধ্যে প্রাণ-চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল তার থেকে মুসলমানরা দীর্ঘকাল বিচ্ছিন্ন ছিলেন। ইংরেজের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশীদার হিন্দুগণ, নব সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল কোলকাতায়, নিজেদের ক্রমবৰ্দ্ধমান সমাজ গড়ে তুলেন এবং সেখান থেকে তাদের বিচিত্র ভাবনা প্রকাশিত হয়। পত্র পত্রিকার মারফতে দেশের বৃহৎ অংশের সঙ্গেও তার যোগাযোগ সৃষ্টি করেন। কিন্তু বাঙ্গালী মুসলমানের ক্ষেত্রে এ সব কথা দীর্ঘদিন সত্য হয়ে উঠেনি। উনিশ শতকের প্রধান মুসলমান গদ্য সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, বঙ্কিমচত্রের বঙ্গদর্শন পত্রিকা প্রকাশের দু’বছরের মধ্যেই, আজীজন নেতার নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। হুগলী কলেজের মুসলমান ছাত্রদের সহযোগিতায় তিনি অল্পকাল পত্রিকাটি পরিচালিত করেন। যুগ-সচেতন শিল্পী মশাররফ হোসেন, সাহিত্যের ক্ষেত্রে পত্রিকা ও সংগঠনের প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করেছিলেন । তিনি সে প্রয়োজন সিদ্ধ করার চেষ্টাও করেছিলেন কিন্তু সফল যে হয়েছিলেন এমন মনে হয় না । তার এই ব্যর্থতার নানাপ্রকার কারণ অনুমান করা যেতে পারে । সে সময় মুসলমান পরিচালিত পত্রিকার লেখক ও পাঠকের অভাব, পত্রিকা পরিচালকের ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যয় অথর্ব সমসাময়িক সমাজের সঙ্গে তার মত পার্থক্য। এ শতকে মশাররফ হোসেনের দৃষ্টি ধর্মের চেয়ে সাহিত্য-শিল্পের দিকেই নিবদ্ধ ছিল বেশী । কিন্তু উনিশ শতকের শেষদিকে যে মুসলমান সাহিত্যিক গোষ্ঠীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তাদের মূল ভাবনা ছিল ধর্ম । আর তাদেরই সংঘবদ্ধ চেষ্টায় ১৮৮৮ খৃষ্টাব্দে এসলামতত্ত্ব নামে দু’খণ্ড ধৰ্মমূলক গদ্যগ্রন্থ, ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দে সুধাকর নামে সাপ্তাহিক এবং ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে মিহির ও ইসলাম প্রচারক নামে ছ’খান মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় । তখন থেকে মুসলমানদের মধ্যে কিছু ব্যাপক আকারে ধর্ম প্রচার ও সমাজ সংস্কার এবং তারই সঙ্গে সাহিত্য চর্চা শুরু হয়েছে। স্বীয় সমাজের দুঃখ দুর্দশা সম্পর্কে তারা সচেতন হয়েছেন, এটাকে মনে করেছেন তাদের জাতীয় গতি এবং বাঙলা ভাষায় পত্র পত্রিকা প্রকাশ ও সাহিত্য চর্চাকে জাতীয় কল্যাণের একমাত্র পন্থা বলে বার বার নির্দেশ করেছেন । এ সময় থেকে মুসলমানদের বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির ইতিহাসও কিছুটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ।
**প্রচলিত ধারণায় মশাররফ হোসেনকেই আমরা আধুনিক গদ্য সাহিত্যের প্রথম
মুসলমান লেখক মনে করি । তিনি হয়ত এখন পর্যস্ত প্রধান এবং শ্রেষ্ঠ মুসলমান গদ্য সাহিত্যিক কিন্তু মুসলমানদের গদ্য রচনার ইতিহাস তাকে দিয়েই শুরু হয়নি ।
**তারও আগে কয়েকজন গদা লেখকের সন্ধান পাওয়া যায় । এরা হচ্ছেন:
১।লেখক গোলাম হোসেন-- হাড় জ্বালানী
২।লেখক খোন্দকার শামসুদিন মুহম্মদ সিদ্দিকী-- উচিত শ্রবণ এবং
৩।লেখক সেখ আজিমদ-- কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রথম মুসলমান গদ্য লেখক হিসাবে আমরা কাকে ধরতে পারি। কে সে দুর্লভ সম্মানের অধিকারী ?
**এ প্রশ্নের মিমাংসা করার প্রথম চেষ্টা করেন ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব । ১৩৫৮ সালে, ইমরোজ পত্রিকার স্বাধীনতা সংখ্যায়, তিনি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম মুসলমান গদ্য লেখক’ নামে এক প্রবন্ধে খোন্দকার শামসুদিন মুহম্মদ সিদ্দিকী ও তার গ্রন্থ 'উচিত শ্রবণ সম্পর্কে আলোচনা করেন।
**পরবর্তীকালে জনাব মুহম্মদ আবদুল হাই ও জনাব সৈয়দ আলী আহসান রচিত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে, খোন্দকার শামসুদিন মুহম্মদ সিদ্দিকীকে প্রথম মুসলমান গদ্য লেখক এবং তার গদ্য-পদ্যে রচিত 'উচিত শ্রবণ” গ্রন্থটিকে মুসলমান রচিত গদ্যের প্রথম নিদর্শন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে গ্রন্থটি কোন সময় রচিত হয়েছিল বা ছাপা হয়েছিল কিনা সে কথা তারা কেউই সঠিক বলতে পারেন নি ।(চলমান)
>> সূত্রঃবাংলা সাহিত্যের হারানো ধারা
বিষয়: বিবিধ
১৯২১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন