বাংলা সাহিত্য ও আরকান রাজারা
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ০৪ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৪:৫৫:৩৬ বিকাল
বাংলা সাহিত্য ও আরকান রাজারা
-------------------------------
আরকান রাজ্যসভা বা এর শাসককুল বাংলাদেশে বা বাংলা সাহিত্যে পরিচয় মূলত বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন রচনার জন্য। আর এই যোগসূত্র আমাদের মাঝে স্থাপন করেন বাঙালী কবি আলাওল। বাঙলা ভাষায় তিনি তার কাব্য রচনা করেছেন । কিন্তু যে সময় তিনি কাব্য-ক্ষত্রে দেখা দিয়েছিলেন, তখন বাংলা সাহিত্যের চচর্ণ বাংলা দেশের চেয়ে বেশী হতো—আরাকানের মগের মুলুকে ।
খ্ৰীষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত— প্রধানতঃ পশ্চিম এবং উত্তর বাংলার মাঠ, বাট, ঘাট —সর্বত্র বৈঞ্চবীয় ভাবে ভরপুর ছিল । বৈঞ্চব কবিতার ললিত পদ-বিন্যাস, সহস্ৰ বৈচিত্র্য-সম্পাদনে এবং অজস্র রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনী বর্ণনায় নরহরি সরকার ( ৪৭৮—১৫৪০ ), গোবিন্দ দাস (১৫১৫-১৬১২ ), জ্ঞানদাস(১৫৩০),
যদুনাথ দাস, প্রেমদাস, কবি শেখর - বাংলা দেশ থেকে পদাবলী ছাড়া অন্য সর্ব প্রকার সাহিত্য রচনাকে-একেবারেই নির্বাসন দিয়েছিলেন। ( আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য-আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ও ডাঃ এনামুল হক। পৃঃ-২)
বাংলা সাহিত্য তখন আশ্রয় পেয়েছিল, আরাকানের দস্যুভূমি পার্বত্য প্রদেশে । সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্য আরাকানরাজসভায় যে ভাবে গড়ে উঠেছে—আপন ভূমিতে তেমন হয়নি। আরাকান-রাজসভার মুসলমান কবিদের হাতেই বাংলা ভাষা নুতন রূপ ও নবীন প্রেরণা পেয়েছিল।
খ্ৰীষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে, মুসলমানদের হাতে আরাকানে যখন বাংলা সাহিত্য পরিপুষ্ট হচ্ছিল – তখন মুসলমান কবিরা এ দেশকে (আরাকানকে) ‘রোসাঙ্গ (রখইঙ্গ ) নামে জানতো । এ নাম তাদের নিজেদের তৈরী নয়,- এটা আরাকানেরই প্রাচীন নাম । ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়,— যে খ্ৰীষ্টীয় অষ্টম এবং নবম শতাব্দী থেকেই আরাকানের ও চট্টগ্রামের সঙ্গে মুসলমান ধর্মাবলম্বী আরবদের ব্যবসা বাণিজ্য শুরু হয় এবং ইসলামী সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের ফলে তার একটা প্রভাবে তারা প্রভাবান্বিত হয় ।
এই সময় আরাকান যদিও মূলতঃ বৌদ্ধ রাজাদের অধীনে ছিল—তবু এই রাজাদের ওপর মুসলমান ধর্মের প্রভাব অতটা তীব্ৰ হ’য়ে দেখা গিয়েছিল যে ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় । এমন কি র্তাদের নিজেদের বৌদ্ধ নামের পরিবর্তে স্বয়ং গ্রহণ করা মুসলমানী নাম ব্যবহার করতেই যেন তারা বেশী তৃপ্তি পেতেন । ৪৩৪ খ্ৰীষ্টাব্দ থেকে ১৬৪৫ খ্ৰীষ্টাব্দ পর্যন্ত ২০০ বৎসরেরও অধিক কাল স্বাধীন আরাকানের বৌদ্ধ রাজার মুসলমানী নাম ব্যবহার করেছেন। ( আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য-আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ও ডাঃ এনামুল হক। পৃঃ-৬)
*বৌদ্ধ নাম --মুসলমানী নাম-- রাজত্বকাল
১।মেনখরী---আলী খাঁ --১৪৩৪–১৪৫৯ খৃঃ
২।বচৌপিয়া(Basawpyu) -- কলিমা শাহ--১৪৫৯-১৪৮২খৃঃ
৩।মেঙ বেঙ—মিন বিন(Mengbeng–Min-bit)—সুলতান-১৫৩১-১৫৭১খৃঃ
৪।মেঙ-ফলৌঙ (Meng-Phalaung)--সিকান্দরশাহ—১৫৭১-১৫৯৩খৃঃ
৫। মেঙ-রাদ জা গ্যি(Meng-Radza-gyi)—সলীম শাহ--১৫৯৩-১৬১২খৃঃ
৬। মেঙ, খা মৌঙ(Meng-Kha-moung )—হুসয়ন শাহ—১৬১২-১৬২২ খৃঃ
৭।থিরী-থু-ধম্ম(Thiri-thu-dhamma)—দুষ্পাঠ্য ফরাসি নাম--১৬২২-১৬৩৮ খৃঃ
৮।নরপদিগ্যি (Narapadigyi) --দুষ্পাঠ্য ফরাসি নাম--১৬৩৮-১৬৪৫ খৃঃ
এ ছাড়া ১৭৩৬ খ্ৰীষ্টাব্দ থেকে ১৬৪৫ খ্ৰীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দুই শতাধিক বৎসর আরাকানের স্বাধীন বৌদ্ধ রাজারা তাদের মুদ্রায় মুসলমানী নাম ব্যবহার করে এসেছে। আরো আশ্চর্য হই আমরা তখন, যখন লক্ষ্য করি যে বৌদ্ধ আরাকানী রাজার মুসলমানী নাম গ্রহণ করলেও তৎকালীন বাংলা দেশের মুসলমান রাজাদের সঙ্গে এদের বিন্দুমাত্রও সদ্ভাব ছিল না। কিন্তু তবু সর্বশ্রেষ্ট ইসলাম ধর্ম এবং তার জীবন-ব্যবস্থার প্রতি তাদের অশেষ শ্রদ্ধা ছিল এবং এরই জন্যে সেনাধ্যক্ষ থেকে শুরু করে রাজ শাসনের প্রতিক্ষেত্রে তারা মুসলমান কর্মচারী নিঃসঙ্কোচে নিয়োগ করতেন। আরাকান রাজসভায় এই মুসলমান প্রভাব পরিপূর্ণ রূপ নেয় সপ্তদশ শতাব্দীতে। এরই ফলে সাহিত্যে এবং সংস্কৃতি বিস্তারের প্রতিক্ষেত্রে সপ্তদশ শতাব্দীর আরাকানের ইতিহাস —মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের বাংলা সাহিত্য প্রীতির ইতিহাস হয়ে দেখা দিয়েছে এবং আলাওলই এই আরাকানী কবিদের মধ্যে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ । আরাকানী রাজাদের পৃষ্ঠ-পোষকতায় মুসলমান কবি সাহিত্যিকগণ বাংলা সাহিত্যের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। তাদের হাতে কাব্যে নূতন আদর্শ দেখা দিল । প্রাচীন কাব্যাদর্শের পরিবতন করে মুসলমান কবি অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। আর তার নির্দেশন “দৌলত কাযী তার সতী ময়ণা । ময়নাবতীর সতীত্ব, লোরের যৌবন চাঞ্চল্য ও কামনা, চন্দ্রানীর মটিপন এবং অসংযম, ছাভনের লাম্পট্য, রওনা মালিনীর ধূতত, চতুর্য ছোট ছোট ঘটনা প্রবাহে ফুটিয়ে তুলেছেন কাব্য ধারার নতুন এক দিক।
>> সূত্রঃ বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবি ও কাব্য—অধ্যাপক এ,কে,এম,আমিনুল ইসলাম।
বিষয়: বিবিধ
১৩০৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন