দ্যা প্রিন্সেস/শাহজাদি সুলতানা

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০২:০৭:৪৯ দুপুর



>>দ্যা প্রিন্সেস/শাহজাদি সুলতানা

>>লেখকঃ জিন স্যাসন

>>অনুবাদঃসাদ উল্লাহ(অনন্যা-২০০৩)/আন্দালিব রশিদ(নালন্দা-২০১২)

** বইটি নতুন বছরের উপহার আপনাদের জন্য। রাত ১২ টায় পিডিএফ উম্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তার আগে একটু পড়ে দেখুন।

>>বই থেকে হুব হু

**স্বীকারোক্তি—লেখকেরঃ

আমি যখন স্থির করলাম যে আমি এই বইটি লিখবো, তখন কাছে রক্ষিত সুলতানার নোটগুলো ও ডাইরির পাতা মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। আমি সুলতানার

তথ্যগুলোকে বাছাই করলাম। মনে হলো আমি একজন ঝানু ডিটেকটিভ -এর ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছি। তবে আমি ঐ সব তথ্যগুলো থেকে কিছু ছাটাই করেছিলাম যা তার জীবনকে আরো বিব্রতকর করে তুলতে পারতো। এই পুস্তকের শব্দগুলো আমার, কিন্তু বক্তব্য সুলতানার।

সুলতানা তোমাকে ধন্যবাদ তোমার সাহসী ভূমিকার জন্য, কেননা, তা-না হলে তোমার জীবন-চরিত সম্বন্ধে মূল্যবান তথ্য থেকে পৃথিবীর পাঠক বঞ্চিত হতো। তোমার এই সাহসী পদক্ষেপের জন্য আরবদের মানবীয় করতে সাহায্য করবে এবং আরব সম্বন্ধে পৃথিবীর যে ভ্রান্ত ধারনা ছিল তা হয়ত দূর হবে। একজন আরবীয় রমনী হিসাবে তোমার জীবনের যে তথ্যগুলো উদঘাটিত হলো, তাতে আরবদের সম্বন্ধে পৃথিবী জুড়ে যে নেতিবাচক ধারনা তা দূর করতে সাহায্য করবে। এই গল্পের পাঠকরা অবশ্য কোন সাহায্য করতে পারবে না, তবে বুঝতে পারবে যে দুনিয়াতে যে কোন দেশে মন্দের সাথে কিছু ভালো জিনিষও বর্তমান । আমরা পশ্চিমে যারা আছি তারা আরবদের সম্বন্ধে- বিশেষ করে সউদী আরবের সম্বন্ধে মন্দ কথা শুনি । তুমিও জানো এবং আমিও জানি যে তোমার দেশে সেই প্রাচীন নিষ্ঠুর আদি প্রথা মেয়েদের বেঁধে রেখেছে- এমন কি তোমার মতো মেয়ে- যারা শ্রদ্ধার ও প্রশংসার পাত্র তারাও শতাব্দী ধরে এই অত্যাচার সয়ে আসছে।

লিজা দাওসন কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। লিজা আমার পাণ্ডুলিপির প্রথম পাঠ দিয়েই সুলতানার জীবন-কাহিনীর প্রেমে পড়ে যান। পাণ্ডুলিপিতে তিনি তার মন্তব্যে ও এডিটিং -এ আরো কিছু যোগ দিয়ে পুস্তকটির কলেবর বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত হৃদয়গ্রাহী করেছেন।

আমার সাহিত্য-এজেন্ট পিটার মিলার কে ও ধন্যবাদ জানাই তার আগ্রহ ও তড়িৎ প্রকাশনার কাজে উৎসাহ যোগান দেয়ার জন্য ।

বিশেষ ধন্যবাদ জানাই ড. প্যাট এল. ক্রিচ কে যিনি শুরু থেকেই আমাকে উৎসাহিত করেছেন এবং সম্পাদনায় সাহায্য করেছেন, যে কারনে এই পুস্তকটির আকর্ষন অনেক বেড়ে গেছে । -

আমার পরিবারের অকুণ্ঠ সহযোগিতা না থাকলে হয়তো এই পুস্তক প্রকাশে বাধা-বিপত্তি আসতে পারতো। তাই বিশেষভাবে আমি আমার পিতা-মাতা – নেটউড ও মেরী পার্কস -এর কাছে ঋণী ও কৃতজ্ঞ। তাদের অফুরন্ত ভালোবাসা ও সহায়তা আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি এই পুস্তক রচনার কাজে- যে পুস্তক একান্ত ব্যক্তিগত ।

প্রিন্সেস সুলতানার কাহিনী সত্য ঘটনা। লেখিকা শুধু তার শব্দ দিয়ে ভরিয়েছেন প্রিন্সেসের বলা কাহিনীকে । মানব জীবনের বিয়োগাওক যেসব ঘটনা এই পুস্তকে বিধৃত তা সত্যতায় পরিপূর্ণ।

স্থানে স্থানে নামের পরিবর্তন ও ঘটনার বিন্যাসে কিছু মুসাবিদা আছে শুধু কতকগুলো চিহ্নিত ব্যক্তিত্বের মুখ রক্ষার জন্য।

এই সত্য গল্প বলার বা লেখার পেছনে গ্রন্থকার কিংবা প্রিন্সেসের - উভয়েরই ইসলামী বিশ্বাসে কারোর অনুভূতিকে আহত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না বা নেই ।

**গৌর চন্দ্রিকা

এই একটা দেশ যেখানে রাজতন্ত্র এখনো চলছে, আমি সে দেশের এক প্রিন্সেস । তোমাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি- আমার নাম সুলতানা। আমার আসল নাম বলছি না এই কারনে যে আমার জীবনালেখ্য প্রকাশিত হবার পর আমার ও আমার পরিবারের উপর বিপদ আসতে পারে।

আমি সউদী প্রিন্সেস এবং বর্তমান সউদ পরিবারের একজন সদস্য- যারা এখনো সউদী আরব শাসন করছে। পুরুষ শাসিত একটি দেশের নারী হিসাবে, আমি পাঠকের কাছে সরাসরি কিছু উদঘাটন করতে পারি না, তাই আমার এক আমেরিকান বন্ধু জীন স্যাসন কে অনুরোধ করেছিলাম আমার কাহিনী শুনতে এবং সে কাহিনী প্রকাশ করতে |

আমি স্বাধীন জন্ম লাভ করেও আজ আমি শৃঙ্খলিত জীবন যাপন করছি। বোধোদয় হওয়ার পর থেকেই আমি আগাগোড়া আচ্ছাদিত, অদৃশ্য অবয়বে চলাফেরা করছি- যা আমার জীবনকে ভীতিকর করে তুলেছে।

জনের পর প্রথম চার বছরের ঘটনা আমার স্মরনে নেই। আমি মণে করি শৈশবে আমি আর সকলের মত হেসেছি, খেলেছি। পরবর্তীতে আমার জীবনের মূল্য কি হবে ধারনা ছিল না। যেহেতু আমার পুরুষাঙ্গ নেই, তাই আমার দেশে আমি অস্তি তৃহীন একটা শুধু বস্তু, আমার জন্মভূমে ।

বর্তমান আল-সৌদ গোত্র যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নেজদে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আবদুল আজিজ, আমার পিতামহ, তখন শিশু মাত্র। মরুভূমির যুদ্ধ-জীবনে যে কষ্ট এবং একস্থান থেকে অন্যস্থানে মরুপথ অতিক্রম করে কি ভাবে বেঁচে ছিলেন আশ্চর্য লাগে। তাঁর মনে আছে সেই শোচনীয় অবস্থা, যখন তার পিতা এক ছালায় পুরে উটের পিঠে আসনের আংটার সাথে ঝুলিয়ে রেখেছিল। তাঁর বোন নূরা অন্য একটি ব্যাগের মধ্যে ঐ উটের পিঠে অন্য দিকে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। এই অবস্থা আব্দুল আজিজকে পীড়া দিত যে তখন কেন তিনি যুবক ছিলেন না, তা হলে পরিবারের পক্ষে তিনি লড়াই করতে পারতেন। পরিবারের এই পরাজয় ও গোত্রের অবমাননা তার অন্তঃকরণে সবসময়েই সুপ্ত থাকতো। ফলে পরিনত বয়সে সারা জীবন যুদ্ধ করে সউদ বংশকে তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।

দু'বছর মরুভূমিতে যাযাবর জীবন যাপনের পর সউদ পরিবার কুয়েতে আশ্রয় পেল। এই মোহাজের জীবন আব্দুল আজিজকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে তুলে, তাই কিশোর বয়স থেকেই তার নিজের দেশোদ্ধারের স্বপ্ন তাঁকে তাড়িত করতো।

অবশেষে ১৯০১ খ্ৰীষ্টাব্দে আব্দুল আজিজের বয়স যখন পচিশ বছর তখন তিনি নিজের দেশে ফিরলেন। ১৯০২ সালে ১৬ই জানুয়ার অনেক কষ্টের পর তাঁর

লোকজন রশীদকে পরাজিত করে। পরের বছরের মধ্যে মরুগোত্রদের কাছে তিনি স্বীকৃতি পান এবং তিনশতের অধিক বিবাহ করেন- যা থেকে তার পঞ্চাশ জন পুত্র এবং আশি জন কন্যা জন্মে। তাঁর প্রিয় স্ত্রীদের পুত্রেরাই বেশী সুবিধা লাভ করে এবং তারা বড় হলে দেশের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় বসে যায়। আব্দুল আজিজের সবচেয়ে প্রিয়তম স্ত্রী ছিলেন হাস্সা সুদাইরী । এই হাস্সার পুত্রেরা আল-সউদের কম্বাইন্ড ফোর্সের মাথায় বসে রাজ্য শাসন করছে। বর্তমান বাদশা ফাহদ এই পুত্রদের একজন।

তাঁর অনেক ছেলে ও মেয়েদের বিয়ে হয়েছে কাজিনদের সাথে- যে সব পরিবারের মধ্যে আল-তুরকিস, জিলুইস এবং আল-কবির অন্যতম । বর্তমানে এই সব পরিবারে প্রিন্সরাই আল-সউদের মধ্যে প্রভাবশালী । ১৯৯১ সালে আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২১,০০০ (একুশ হাজারে)। এই সদস্য সংখ্যার মধ্যে প্রায় এক হাজার প্রিন্স কিম্বা প্রিন্সেস আছে যারা সরাসরি আমাদের মহান নেতা আব্দুল আজিজের বংশধর।

আমি সুলতানা সেই বংশধরদের মধ্যে একজন। আমার জীবনের প্রথম স্মরণীয় ঘটনা উৎপীড়নের একটি অংশ। আমার মনে আছে চার বছর বয়সে আমার স্নেহময়ী মায়ের হাতে এক বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় খেয়েছিলাম। বলবেন, কেন ? কারন, আমি আমার পিতার প্রার্থনা (নামাজ) কে অনুকরন করেছিলাম। মক্কার দিকে মুখ না করে আমি আমার সামনে রেখেছিলাম আমার ভাই আলীকে। ভেবেছিলাম সে-ই ঈশ্বর। আমি কেমন করে জানবো সে তা ছিল না ? বত্রিশ বছর পর, আমি সেই থাপৃপড়ের জ্বালা স্মরণে এনে নিজের মনে প্রশ্ন করেছিলাম, যদি আমার ভাই ঈশ্বর না হবে, তাহলে তাকে সেভাবে পরিবারে সমাদর করা হয় কেন ?

পরিবারে দশজন কন্যার মধ্যে সে ছিল একমাত্র পুত্র সন্তান। পরিবারের মধ্যে মা-বাবা সর্বদাই এই ভয় করতো যদি মৃত্যু তাদের একটি মাত্র সন্তানকে তুলে নেয়, আর কোন পুত্র সন্তান যদি না হয়। কারন পরিবারে দশটি কন্যা সন্তানকে মনে করা হতো যে ঈশ্বরের অভিশাপ স্বরূপ। আমার মা যখনই গর্ভবতী হতো দোয়া পড়তো যেন পুত্র সন্তান জন্মে, কিন্তু হত কন্যা। একটার পর একটা কন্যা সন্তান দশ সংখ্যা পৌছলে ঈশ্বরের অভিশাপ নয়তো কি ? তাই একমাত্র পুত্র ছিল ঈশ্বরের প্রতীক ।

আমার মায়ের ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা ছিল কখন আমার বাবা আর একটা তরুণী স্ত্রী বিয়ে করে বসে। অবশেষে সেই দুশ্চিন্তা সত্যে পরিনত হল। বাবা বিয়ে করলেন তরুনী মেয়ে পুত্র সন্তানের জন্য। নতুন স্ত্রী পর পর তিনটি পুত্র সন্তান প্রসব করে সত্যি কিন্তু সবগুলোই ষ্টিল-বর্ন- অর্থাৎ মৃত সন্তান। বাবা তাকে তালাক দিল। অবশেষে চতুর্থ স্ত্রী বাবাকে পুত্র সন্তানে সুখী করে। আমার ভাই আলী জৈষ্ঠ পুত্র সন্তান হিসাবে পরিবারে সর্বেসর্বা ছিল । অন্যান্য বোনদের মতো আমি ভাই আলীকে শ্রদ্ধা দেখানোর ভান করলেও আমি তাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করতাম- তার নিপীড়ন সহ্য হতো না। আর নিপীড়িত যারা তাদেরই অন্তরে ঘূণা জন্মে- বাইরে শ্রদ্ধার আবরন থাকলেও।

আমার মায়ের বারো বছর বয়সে আমার বাবার সাথে বিয়ে হয় তখন বাবার বয়স বিশ বছর । ১৯৪৬ সাল। মাত্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে। সে সময় তেল উৎপাদন বন্ধ ছিল। তেল সম্পদ এখন যেমন সউদী আরবের ধনের উৎপত্তি স্থল সে সময় এতোটা ছিল না এবং আমাদের সউদী পরিবারে তখন এতো গৌরবও ছিল না। যুদ্ধের শেষে ব্রিটেন আমাদের বাদশাকে সম্মান প্রদর্শন করে একটা রোলস রয়েস গাড়ী উপহার দিল। প্রধান মন্ত্রি চাচিল এই কাজটি করলেন। বাদশা কিন্তু এই রাজকীয় উপহারের বৈশিষ্ট্য দেখে খুশী হলেন না- এতো আয়াসের গাড়ী তার সরল জীবনের উপহাসক স্বরূপ মনে করে তার প্রিয় ভ্রাতা আব্দুল্লাহকে গাড়ীটি দিলেন ব্যবহারের

জন্য ।

আব্দুল্লাহ আমার বাবার চাচা ছিলেন এবং বন্ধুও । তাই তাদের বিয়ের হানিমুনের জন্য গাড়ীটি ব্যবহার করতে দিলেন। আমার বাবা-মা ঐ গাড়ীতে মধুচন্দ্রিমায় জেদ্দায় গেলেন। আমার মা এই প্রথম মোটর গাড়ীতে চড়লেন । ১৯৪৬ সালেও মধ্য প্রাচ্যে যান-বাহনের মাধ্যম ছিল উট । এবং তিন দশক পরে সউদী আরবের সাধারন মানুষ গড়পড়তায় মোটর গাড়ীতে চড়তে শুরু করে ।

এই ১৯৪৬ সালে আমার বাবা-মা এক সপ্তাহ চুটিয়ে হানিমুন করলো জেদায়। এর আগে বিয়ের পর পর রিয়াদে সঙ্গত কারনেই ও তাড়াহুড়োর মধ্যে বাসরযাপন সম্ভব হয়নি। কারন তখন তাঁবুতে বাস করতে হতো চারিদিকে দাস-দাসীদের

মধ্যে ।

এই জেদায় এক সপ্তাহ হানিমুনের দিনগুলো আমার মায়ের জীবনে স্মরণীয় ঘটনা। একবার আমার মা আমাকে বলেছিল যে এই হানিমুনের দিনগুলো তার যৌবনকে শেষ করে দিয়েছে, কারন জীবন ও যৌন সম্বন্ধে সম্যক উপলব্ধির ও ধারনার পরিপক্কতা তখন ঐ অল্প বয়সে তার হয়নি। আমার মায়ের বাবা-মা মারা গিয়েছিলো মহামারী আকারের জ্বর-গ্রস্ত হয়ে। তখন তার বয়স আট বছর । বারো বছর বয়সে তার বিয়ে হয়, বিশ বছরের এক যুবার সাথে যে যৌনতায় নিষ্ঠুর ছিল । আমার মা ঐ বয়সে আজ্ঞা পালন ছাড়া আর কোন উপায়ে যন্ত্রনা থেকে মুক্ত হতে পারে নি।

জেদায় কিছুদিন অবস্থানের পর আমার বাবা-মা রিয়াদে ফিরে এলেন। আমার বাবা দয়া-মায়াহীন নিষ্ঠুর ব্যক্তি ছিলেন- মা কে সারা জীবন বিষগ্নতায় ভুগতে দেখেছি। এই বিষময় দাম্পত্য জীবনে আমার মা এক এক করে ষোলটি সন্তান প্রসব করলেন তার মধ্যে ভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকলো এগারোটি । এই এগারো জনের মধ্যে দশজন মেয়ে, মাত্র একটি পুত্র। আজকে এই দশটি মেয়ের জীবন দশজন পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত- যারা তাদের স্বামী-দেবতা। বংশের একমাত্র সন্তান- বর্তমানে সউদী প্রিন্স ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী চার নারীর স্বামী এবং অগনিত মিষ্ট্রিস (উপপতুি) নিয়ে বেশ আরামে আয়াসে ও মহা উল্লাসের মধ্যে জীবন যাপন করছেন ।

আমি পড়াশোনা করে জানতে পেরেছি যে বর্তমান সভ্য মানুষরা তাদের অশিক্ষিত ও অজ্ঞ পূর্ব-পুরুষদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি কে ভ্রুকুটি করে ব্যঙ্গ হাসি হাসে ।

সভ্যতার উন্নয়নের সাথেও ব্যক্তি স্বাধীনতা ও আলোকিত জীবনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে । মানব সমাজ জ্ঞান আহরন করে পরিবর্তনের দিকে ছুটে চলেছে । কিন্তু আশ্চর্য, এখনো আমাদের বর্তমান উওর-পুরুষরা এই আধুনিক পরিবর্তনশীল যুগেও হাজার বছরের কৃষ্টি ও কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতায় পাগলপ্রায়। সত্যি বটে, আধুনিক আকাশ-ছোয়া ভবন ও বিল্ডিং উঠছে, আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন স্বাস্থ্য-কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, কিন্তু মেয়েদের জীবন যাত্রার ও দাসত্ব-শৃঙ্খলের জীবন সেই হাজার বছরের নিগড়ে নিবদ্ধ। সউদী পুরুষরা এ বিষয়ে এখনো উদাসীন।

আমাদের সমাজে মেয়েদের এই যে মানবেতর জীবন যাত্রা তার জন্য মুসলিম ধর্ম-বিশ্বাসকে দোষ দেয়া যায় না ; যদিও কোরআনে বলে মেয়েরা পুরুষের এক ডিগ্রি নীচে, যেমন বাইবেলে বলেছে। কিন্তু আমাদের প্রফেট মেয়েদের প্রতি সমান আচরণের উদাহরণ ও বাণী রেখে গেছেন। আমাদের পুরুষরা কিন্তু প্রফেটের সেই মহান বাণী ও উদাহরণ কে ভুলে গিয়ে অন্ধকার যুগের সেই নির্মম আচরণকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। আমাদের প্রফেট নিষ্ঠুর মেয়ে-শিশু হত্যার প্রথা রহিত করেছিলেন। বলেছিলেন- যাদের কন্যা জন্মাবে, তারা যেন তাকে জ্যান্ত কবর না দেয়, কিম্বা দুর্ব্যবহার না করে, কিম্বা পুরুষদের প্রাধান্য না দেয়। যারা ছেলে ও মেয়ে উভয়কে সমভাবে প্রতিপালন করে তাদের জন্য স্বর্গের দ্বার উন্মুক্ত।

তবুও এই দেশের পুরুষ সেই মহান বাণী বিস্মৃত হয়ে শুধু পুত্র সন্তানের আকাংখা বেশী করে- মেয়েদের কোন মূল্য নেই, এরা প্রাণহীন বস্তু, খেলনার জিনিষ । ছেলে মেয়েদের ওজন করা হয়, মূল্য নির্ধারন হয় শুধু একটি বিশেষ অঙ্গ দিয়ে, আত্মা দিয়ে নয়।

যারা নারীদের উপর কর্তৃত্ব ও অত্যাচার করে এসেছে এবং মেয়েদের সম্রম ও কুমারীত্ব রক্ষা করার দায়িত্ব একমাত্র তাদেরই। পরিবারের সম্রম ও মর্যাদা নারীর যৌন জীবনের উপর নির্ভরশীল। তাই মেয়ের যৌন-জীবন রক্ষার দায়িত্ব তাদের; কারণ বিপথগামী মেয়ে পরিবারের মর্যাদা জনসমক্ষে ধূলোয় মিশিয়ে দেয়- অথচ বিপথগামী পুরুষ পরিবারের মর্যাদা বাড়িয়ে দেয় যেন। এ দেশের পুরুষদের ধারণা যে মেয়েরা তাদের যৌনেচ্ছাকে সংযত রাখতে অক্ষম, তাই পুরুষের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে থাকা প্রয়োজন। মেয়েদের উপর এই কর্তৃত্ব প্রেম-ভালোবাসা উদগত নয়, পুরুষের মানসম্রম নষ্ট যাতে না হয় এই ভয়ে ।

সউদী পুরুষের কর্তৃত্ব অপরিসীম। তার স্ত্রীগণ ও ছেলে-মেয়েদের জীবনমরণ তার ইচ্ছা নির্ভর। পরিবারে পুরুষই সর্বময় কর্তা, রাষ্ট্র স্বরূপ । পরিবারের এই মিশ্র অবস্থা পুরুষের কিশোর অবস্থা থেকেই শুরু হয়। ছোট বেলা থেকে বালকদের শেখানো হয়, তাদের কাছে মেয়েরা মূল্যহীন। মেয়েরা মেয়ে, যারা শুধু পুরুষের বিনোদন ও ভোগের সুবিধার জন্য। একটি শিশু ছোটকাল থেকে লক্ষ্য করে তার বাবা তার মা ও বোনদের উপর কেমন ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য ভরে ব্যবহার করছে এবং কেমন

আদর করে পুত্র সন্তানদের সরিয়ে রাখছে বোন ও অন্য কাজিনদের কাছ থেকে দূরে, বিপরীত মেরুতে । এইভাবে একটি পুরুষ শিশু বেড়ে উঠে পরিণত বয়সে যখন বিয়ে করে, তখন স্ত্রীকে জীবন-সঙ্গীনি ভাবে না, ভাবে ভোগ্যা, চ্যাটেল ।

ভাইদের দ্বারা হয় ঘূনিত, স্বামীর দ্বারা নিপীড়িত। এই যে চক্র, একে ভাঙা মুস্কিল; তাই নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবন হয় অসুখী- মালিক ও দাসীর সম্পর্ক। নারী সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। বয়স হয়ে গেলে হয় পরিত্যক্ত। স্বামী একের পর এক নতুন মেয়ে গ্রহন করে পত্নীরূপে (চারটার বেশী নয়) আর অগনিত উপপত্নী । শুধু যৌনাকাঙ্খা মেটানোর জন্য। এই কারণে নারী ও পুরুষের এদেশে সহচররূপে বাস করা অকল্পনীয়।

আমাদের নারীর ইতিহাস কালো ঘোমটার আবরণে প্রথিত । আমাদের জন্ম ও মৃত্যুর কোন ঘটা নেই, তথ্য নেই, যদিও পুরুষের জন্মের তারিখ ও গোত্রের ঠিকুজি অতি সূক্ষ্মভাবে লেখা থাকে। এই ঠিকুজিতে বা জেনোলজিতে মেয়েদের-মায়েদের নাম থাকে না । মেয়ে জনালে পরিবারে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। শহরে যদিও এখন হাসপাতালে মেয়েদের জন্ম তারিখ রেকর্ড করা হচ্ছে, কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে মেয়ে শিশুর জন্ম তারিখ কেউ মনে রাখে না। সউদী আরবে আদম শুমারী করা হয় না- নারীদের কোন সংখ্যাতত্ত্ব নেই।

সময় সময় আমার মনে হয়- আমরা এই মরুর মেয়েরা অস্তিত্বহীন। কারণ আমাদের জন্ম-মৃত্যুর কোন তথ্য রাখা হয় না। যদি আমাদের কেউ না জানলো সে তথ্য, তাহলে হয়তো আমারও কোন অস্তিত্ব নেই।

আমাদের দেশের মেয়েদের প্রতি এই যে অন্যায় আচরণ- এই আচরণই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে আমার জীবন কাহিনী তোমাদের শোনানোর জন্য। আমাদের দেশের মেয়েরা হয়তো সারা জীবন কালো ঘোমটার আড়ালে কাটিয়ে দেবে এবং তাদের শাসন করবে দেশের কড়া পুরুষতন্ত্র। কিন্তু হয়তো পরিবর্তন আসবে একদিন, যখন এই নিপীড়িত জীবন যাত্রা থেকে নারীরা মুক্তি পাবে।

আমার এগারো বছর বয়স থেকে আমি একটা গোপন ডাইরী রক্ষা করছিশৈশবের কিছু স্মরণীয় ঘটনাও এতে উল্লেখ করা আছে। সেই ডাইরী থেকেই আমি সউদী রাজপরিবারের এক রাজকুমারী হিসাবে আমি আমার জীবন চিত্রিত করার প্রয়াস পাচ্ছি। এর সাথে আমি আমার পরিবারের বাইরে অগুণতি সউদী নারীর জীবন যাত্রাকে উন্মোচিত করার চেষ্টা করবো।

আমার আখ্যানের সত্যতা অতি সরল, কেননা আমি ঐ সব রমনীর একজন যারা পিতার দ্বারা অবহেলিত, ভ্রাতার দ্বারা ঘূনিত এবং স্বামীর দ্বারা নিপীড়িত। এ দেশে আমি একা নই- আমার মতো এখানে অনেকেই আছে যাদের জীবন-কাহিনী বিবৃত করার কোন সুযোগই নেই।

সউদী রাজপ্রাসাদ থেকে সত্য ঘটনা বাইরে সাধারনত বের হয় না, কারণ কড়া গোপনীয়তা রক্ষার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমি যা বলেছি এবং গ্রন্থকার যা লিখেছে এই পুস্তকে সবই সত্য ঘটনা।

বিষয়: বিবিধ

২৫০৭ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

355809
৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৪:০৪
আবু জারীর লিখেছেন : পিডিএফ কপির অপেক্ষায় রইলাম।
৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৫:১৪
295453
গোলাম মাওলা লিখেছেন : আপনি তো ফেবুকে রয়েছেন, ওখানেই দেব
355830
৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ রাত ০৮:৩১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : বইটা ইংরেজিতেই পড়েছিলাম। প্রথমে ভালই লেগেছিল কিন্তু তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখি এটার বেশিরভাগই মিথ্যা ও সাজান। এই ধরনের নারি বাদি বই দিয়ে কখনও প্রকৃত অবস্থা প্রকাশিত হয়না।
০১ জানুয়ারি ২০১৬ রাত ১২:২৬
295510
গোলাম মাওলা লিখেছেন : আপনি ফাতিমা মারনিসি র * বিয়ন্ড দ্য ভেইল * উইমেনস এন্ড ইসলাম পড়তে পারেন
০১ জানুয়ারি ২০১৬ দুপুর ১২:২১
295542
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : পড়েছি। সবগুলিই মুলত প্রপাগান্ডা। কিছু সত্যি কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনার উপর ভিত্তি করে ইসলাম বিরোধিতা প্রচার এর চেষ্টা।
০১ জানুয়ারি ২০১৬ বিকাল ০৪:৪৮
295569
গোলাম মাওলা লিখেছেন : নিরপেক্ষ দিক হতে তাদের দাবি কিন্তু খুব অযৌতিক
না
355887
০১ জানুয়ারি ২০১৬ রাত ১২:২৩
গোলাম মাওলা লিখেছেন : **নতুন বছরের শুভেচ্ছা বন্ধুরা
** বই কিনুন বই পড়ুন

>> দ্যা প্রিন্সেস/শাহজাদি সুলতানা
>>লেখকঃ জিন স্যাসন
>>অনুবাদঃ সাদ উল্লাহ(অনন্যা-২০০৩)/আন্দালিব রশিদ(নালন্দা-২০১২)
>>HQ পিডিএফ—৭.৫ মেগাবাইট
>>লিংকঃ সাদ উল্লাহ(অনন্যা-২০০৩)
http://www.pdf-archive.com/2015/12/31/the-princess/
**ধন্যবাদ: Kazi Mahmud Rumman, জদিও আমার কাছে আন্দালিব রশিদ(নালন্দা-২০১২) এর অনুবাদ ছিল।

>>ঘটনাঃ এই একটা দেশ যেখানে রাজতন্ত্র এখনো চলছে, আমি সে দেশের এক প্রিন্সেস । তোমাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি- আমার নাম সুলতানা। আমার আসল নাম বলছি না এই কারনে যে আমার জীবনালেখ্য প্রকাশিত হবার পর আমার ও আমার পরিবারের উপর বিপদ আসতে পারে।
আমি সউদী প্রিন্সেস এবং বর্তমান সউদ পরিবারের একজন সদস্য- যারা এখনো সউদী আরব শাসন করছে। পুরুষ শাসিত একটি দেশের নারী হিসাবে, আমি পাঠকের কাছে সরাসরি কিছু উদঘাটন করতে পারি না, তাই আমার এক আমেরিকান বন্ধু জীন স্যাসন কে অনুরোধ করেছিলাম আমার কাহিনী শুনতে এবং সে কাহিনী প্রকাশ করতে |
আমি স্বাধীন জন্ম লাভ করেও আজ আমি শৃঙ্খলিত জীবন যাপন করছি। বোধোদয় হওয়ার পর থেকেই আমি আগাগোড়া আচ্ছাদিত, অদৃশ্য অবয়বে চলাফেরা করছি- যা আমার জীবনকে ভীতিকর করে তুলেছে।
359564
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সকাল ০৯:১৪
কাঁচের বালি লিখেছেন : আসলেই অনেক খারাপ লাগলো গল্প পড়ে নারীদের ভোগপন্য ছাড়া বিশেষ করে সৌদির পুরুষেরা কিছুই মনে করে না , অথচ ইসলামে নারীদের সম্মান কত উপরে , কুরআনেও বলা হয়েছে আমাদের প্রিয় নবী ও নারীদের সম্মানের কথা বলে গেছেন , ওরা ধর্মের নামে শয়তানি করে , আর তাতে করে সব ইসলামের আর মুসলমানদের বদনাম হয় ।
359565
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সকাল ০৯:১৪
কাঁচের বালি লিখেছেন : আসলেই অনেক খারাপ লাগলো গল্প পড়ে নারীদের ভোগপন্য ছাড়া বিশেষ করে সৌদির পুরুষেরা কিছুই মনে করে না , অথচ ইসলামে নারীদের সম্মান কত উপরে , কুরআনেও বলা হয়েছে আমাদের প্রিয় নবী ও নারীদের সম্মানের কথা বলে গেছেন , ওরা ধর্মের নামে শয়তানি করে , আর তাতে করে সব ইসলামের আর মুসলমানদের বদনাম হয় ।
২৩ মার্চ ২০১৬ রাত ০৯:৫৫
301307
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File