ইতিহাসের আলকে ধর্মপূজা যৌনপূজা
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০১:১৮:০০ রাত
বইঃ ইতিহাসের আলকে ধর্মপূজা যৌনপূজা
লেখকঃ ওয়াহিদ রেজা
প্রকাশনীঃ মহাকাল /২৪০
নিষিদ্ধ গোপন অবৈধ বিষয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ সেই প্রাচীন কাল হতে আজ অবধি মানুষের মনের একটি অন্ধকার দিক। আর সেই অন্ধকার একটি দিকের রস আস্বাদন হল যৌনতা। এই যৌনতা যেমন মানব সভ্যতার চাবিকাঠি তেমনি এ নিয়ে সবার কৌতূহল অদম্য। আর একে অস্বীকার করবার উপাই আমাদের নেই। এই গ্রন্থ আমাদের সামনে নিয়ে আসে সেই সব অন্ধকারের একটি আলোময় দিক। এ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীরা নানা ধরনের অভিমত ব্যক্ত করলেও একটি বিষয়ে সবাই একমত যে, আদিম-মানুষ বিশ্বপ্রকৃতির অনেক স্বাভাবিক দুর্বোধ্যতা, যেসব তারা তখনো বুঝে উঠতে সক্ষম হয়ে ওঠেনি; সেসব বিষয় ও ঘটনার অন্তরালে তারা কল্পনা করতো নানা ধরনের তথাকথিত অলৌকিক সব শক্তির অস্তিত্ব। সেসব শক্তির বিবর্তিত রূপই হলো দেবতা বা দেবদেবী এবং তাদের সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল যৌনতা। যাদের রাগ, ক্ষোভ নিরসন ও মনসস্তুষ্টির জন্যে পালন করা হতো বিভিন্ন ধরনের আচারবিধি। কালক্রমে পূজা বা উপাসনা রীতির যাত্রা তারই সূত্র ধরে। এবং প্রথম থেকেই যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যৌনপূজা। তথাকথিত আদম-ইভের যৌন সম্পর্কের কথা বাদ দিলে, মানবপ্রজাতির নর-নারীর জৈবিক ব্যাপারে যৌন-বিষয়ক শাস্ত্রীয় প্রথা অর্থাৎ যৌনপূজা বা লিঙ্গপূজার প্রচলনের ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে ।
ওয়াহিদ রেজার এটি একটি অগতানুগতিক ও সাহসী গ্রন্থ। আমাদের সমাজের প্রথাশাসিত সঙ্কীর্ণ রুদ্ধদ্বার সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে দুঃসাহসীই বলা যায়। এই গ্রন্থে একটি চিরন্তন বিষয়ের ইতিহাসভিত্তিক পর্যালোচনা পরিবেশিত হয়েছে। সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকে যৌনতা মানুষের জীবনের অন্যতম বাস্তবতা রূপে সক্রিয় তাকে পূজা করেছে নানাভাবে । মানুষ যৌনতার বহু প্রতীক সৃষ্টি করেছে, যৌনপূজার জন্য মন্দির বানিয়েছে, নানা উৎসবের আয়োজন করেছে। আর এর পরিচয় বিধৃত আছে সারা বিশ্বজুড়ে।
তিনি বিভিন্ন পুরানের কাহিনীর কথা বলেছেন, যেমন প্রাচ্যের তেমনি প্রতীচ্যের। আমরা এই গ্রন্থে ব্ৰহ্মা, ভৃগু, বিষ্ণু ও শিবের উপাখ্যান পাই। আমরা জিউস, জুনো, ভেনাস ও আইসিসের কথা শুনি । আমরা ডায়োনিসাসের আরাধনার পাশাপাশি বৃক্ষ পূজার কথাও শুনি। এ গ্রন্থের একটি চমৎকার অংশ হচ্ছে যৌনতার বিভিন্ন প্রতীকের আলোচনা। গ্রন্থকার জানান যে ত্রিভুজ একটি আদিম ও অকৃত্রিম যৌন প্রতীক। নিনেঙের ধ্বংসস্তুপ থেকে প্রাপ্ত অতিপ্রাচীন পোড়ামাটির নারীমূর্তির গোপনাঙ্গে সুস্পষ্ট ত্রিভুজ চিহ্ন দেখা গেছে। মিশরের দেবী আইসিসের কটিবস্ত্রের একটি নির্দিষ্ট অংশে আঁকা থাকতো ত্রিভুজ। পুরুষের লিঙ্গ এবং নারীর যোনি সম্পর্কিত এমনি নানা অজানা কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য পাঠককে উপহার দিয়েছেন ওয়াহিদ রেজা। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে তিনি কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছেন যা পাঠকচিত্তে নিঃসন্দেহে কল্যাণকর অভিঘাত ফেলবে, তাকে বিজ্ঞানমুখী, যুক্তিবাদী এবং কুসংস্কারমুক্ত হতে সাহায্য করবে। যেমন, একটি অধ্যায়ের শুরুতে তিনি বার্ণাড শ'-র একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন: “রক্ষণশীল ব্যক্তিরাই সমাজের ও জগতের অগ্রগতিকে প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত করে।” ওয়াহিদ আরেকটি অধ্যায়ের শুরুতে জা পল সাত্রের একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন: “মানুষের শক্তি ও সামর্থ্য অফুরনীয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় মানুষ তার ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞাত নয়।” এমনি আরো উদ্ধৃতি আছে যা পাঠকচিত্তকে আলোকিত করবে। সামগ্রিক বিচারে আমি ওয়াহিদ রেজাকে তার এই ব্যতিক্রমধর্মী গ্রন্থের জন্যে অভিনন্দন জানাই। তিনি একজন ব্যতিক্রমী মানুষও । আমাদের সাহিত্যের অন্যতম প্রথাবিরোধী বহুমাত্রিক লেখক তিনি। এবং একজন প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী। বর্তমান গ্রন্থটি তার প্রগতিশীল ব্যতিক্রমী চরিত্রকে আরো উজ্জ্বল ও সংহত করবে ।
>>তার কথায়ঃ আমি গবেষক নই। তবে শখের অনুসন্ধানী। এ গ্রন্থটি লিখতে আমার সময় লেগেছে দীর্ঘ চার বছর। বিভিন্ন সময়, বিচ্ছিন্নভাবে লেখা রচনাগুলোর একটি পূর্ণাঙ্গ সমন্বয় এই– ‘যৌনপূজা যুগে যুগে ৷গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৮ যিশুসালের অমর একুশের বইমেলায় ‘যৌনপূজা যুগে যুগে শিরোনামে। সে বছরই এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে ব্যক্ত করতে হচ্ছে যে, পাঠকের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাবাজারের একটি কুচক্রি মহলের অপতৎপরতার কারণে গত ছ' বছর এ গ্রন্থটি কোনো প্রকাশক পুনর্মুদ্রণে সম্মত হয়নি। শেষ পর্যন্ত জার্মান প্রবাসী লেখক সুলতানা আজীমের প্রচেষ্টায় মহাকাল’ এ গ্রন্থের নতুন সংস্করণ প্রকাশে সম্মত হয়। মহাকাল-এর প্রকাশক মো. মনিরুজ্জামানের এ সাহসী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। যৌনপূজা যুগে যুগের এই নব সংস্করণে বেশ কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন করা হয়েছে। পরিবর্তন করা হয়েছে এর শিরোনাম : ইতিহাসের আলোকে ধর্মপূজা যৌনপূজা ।
>>>>লেখকঃ
সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে ওয়াহিদ রেজা এখন আলোচিত নাম । দেশের অন্যতম প্রথাবিরোধী, অনুসন্ধানী, বহুমাত্রিক লেখক তিনি। লেখালেখির সূচনাকাল থেকেই প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে; বিপরীত স্রোত, বিপরীত মেরুতে তার অবস্থান । কলম তার অত্যন্ত তীক্ষ্ম-শাণিত-নির্ভীক, কিন্তু অবান্তর বা অবাস্তব নয়। তার আকুতি, সন্দেহ, জিজ্ঞাসা পাঠককে প্রচলিত সত্যের সঠিকতার প্রশ্নের মুখোমুখি দাড় করায় । তার রচনার গভীরের অনুসন্ধিৎসু উপলব্ধি এতোটাই স্পষ্ট ও অশণিতীক্ষ্ম ভাষায় বিন্যস্ত যে সব লেখকের পক্ষে যা সম্ভব নয়। চিন্তা-চেতনায় তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র । সবসময় গতানুগতিক, ট্রাডিশনাল লেখালেখির বিপক্ষে পরিচালি৩ তার কলম । গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, সমালোচনা, উপন্যাস, পুরাতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণামূলক রচনায় শক্ত কবজির যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ওয়াহিদ রেজা । জন্ম : প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ শহরের এক সম্বাস্ত পরিবারে ২৫ অক্টোবর । বাবা ডা. শাহাদাত হোসেন, মা আনোয়ারা হোসেন । এ পর্যন্ত তার গ্রন্থ সংখ্যা একত্রিশটি ।
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন