বাংলাদেশে সূর্যবাদ – পাঠ এক

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১১ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৫:৪৫:১১ বিকাল



বাংলাদেশে সূর্যবাদ – পাঠ এক



লৌকিক ধর্ম তথা লোককৃতির অন্যতম প্রধান অবদান দেবতা। এই দেবতার সৃষ্টি সাধিত হয়েছে দ্বিবিধ বুনিয়াদে, দ্বিবিধ পন্থায় ।

আদি কৃষিয়ুগের সেই পর্যায়, যখন মানুষ তার খাদ্য উৎপাদন-প্রক্রিয়ার ওপর প্রাকৃতিক কিছু বস্তু বা ঘটনার প্রভাব লক্ষ্য করে। অবশ্যি, কার্যকারণের কোনো সম্পর্কগত ব্যাখ্যা না জেনে । দ্বিতীয় পন্থায় দেবদেবীর জন্ম হয় মানুষের হাতে বাস্তব ঘটনা বা ইতিহাসের অতিরঞ্জনের মাধ্যমে পুরাণ (mythology) সৃষ্টির ফলে, সংশ্লিষ্ট ঘটনা বা ইতিহাসের নায়কও যাতে ফোলানো-ফাপানো ।

**সিসিলির দার্শনিক ইউহিমেরাসের (Euhemerus—খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক) ভাষায়, ‘magnified man'. এভাবে দেবদেবীর সৃষ্টি বস্তুত বীরপুজোর এক বিশেষ ধরন।

এখানে বিবেচ্য বিষয় আদি কৃষিয়ুগের খাদ্য উৎপাদকের হাতে দেবতার সৃষ্টি। মানুষ যখন তার প্রাণধারণের জন্যে খাদ্যের উৎপাদন নয়, কেবল আহরণের ওপর নির্ভর করেছে, তখনই তার ধারণা ছিলো, তার পরিবেশের সকল কিছুরই আত্মা আছে, যেমন গাছগাছালির, পাহাড়-পর্বতের, তেমনি পশুপাখির। এরপর কৃষিকর্মে ব্ৰতী মানুষ দেখে, তার এ-কর্মের সাফল্য-বিফলতা বিশেষভাবে নির্ভরশীল আত্মাধারী কয়েকটি বস্তুর ওপর। তাদের একটি হল সূর্য। যার তাপ ফসল উৎপাদনে সহায়ক – এমনকি, অপরিহার্য। সেকালের মানুষ আরো ধরে নিয়েছে, আত্মা আসলে বিশেষ এক শক্তির দান, যার নাম দেবতা এবং সেই দেবতা কোনো-না-কোনো আকারের দেহ ধারণ করে বিরাজমান থাকেন। সাকারে বা নিরাকারে পুজোর মাধ্যমে তার তুষ্টিবিধান তাই কৃষিকর্মে সাফল্যলাভের জন্যে জরুরি। এবং সাকারের পুজোর মূলে দেবতার যে কল্পিত রূপ থাকে, তারই বাস্তব অনুবাদ তার মূর্তি বা প্রতিমা ।

সে যা-ই হোক, কৃষিজীবী মানুষের কাছে অতি প্রভাবশালী সূর্য প্রথমে এমনি করেই পরম পূজ্য সূর্যদেবরূপে প্রতিষ্ঠা পান, তার উদ্দেশে নিবেদিত হতে থাকে ভক্তের স্তুতি ।

>>বিভিন্ন স্থানে সূর্যদেবতার আবির্ভাবঃ

বলা নিম্প্রয়োজন, এটি যদিও কৃষিজীবী মানবসমাজের একটি বিশেষ ধারণা তথা পরিস্থিতির ফল, বিশেষ কোনো স্থানের বা কালের কৃতি নয়—বিশেষ কোনো মানবগোষ্ঠী বা গোত্রেরও। বরং স্বীকার করা বাঞ্ছনীয়, বাস্তবে অনুকূল পরিস্থিতিতে এমন ঘটনা, এমনিভাবে সূর্যের দেবতারূপে প্রতিষ্ঠালাভ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কালে এবং বিভিন্ন গোত্রে বা গোষ্ঠীতে ঘটা সর্বতোভাবেই সম্ভব এবং ঘটেছেও তেমনিভাবেই।

*প্রমাণঃ আজও এমন সব সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী বা উপজাতির মধ্যে সূর্যপুজোর প্রচলন দেখা যায়, যেগুলির ভেতর কোনো কালেই ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য বা সামাজিক ঐক্যের বন্ধন ছিলো বলে ধরে নেয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া, সূর্যদেব এক-এক দেশে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই অঞ্চলে এক-এক কালে পূজিত হয়েছেন

--এক-এক নামে, এক-এক পদ্ধতিতে।

---কোনো কোনো দেশে সূর্যদেবতার সংখ্যা একাধিক।

মানবসমাজে সূর্যের প্রভাববিস্তারের কারণের প্রতি কোনো কোনো পণ্ডিতের এক পরোক্ষ, ব্যতিক্ৰমি দুর্বলতা লক্ষণীয়। এতে সূর্য ঠিক সরাসরি দেবতারূপে প্রতিষ্ঠিত নন। কিন্তু কৃষিকৰ্ম আর জীবন-মৃত্যুর প্রবল নিয়ন্ত্রকরূপে স্বীকৃত, যার প্রমাণ মেলে প্রাচীনকালের ঋতুভিত্তিক—বিশেষত, ক্রান্তিকালীন উৎসবগুলিতে । এসব উৎসব অনুষ্ঠিত হত ধমীয় অনুষ্ঠানের আকারে, সাধারণত শীতের শেষে ফসল বোনাবুনির আয়োজনকালে এবং শরতে অথবা শীতের শুরুতে ফসল তোলার সময় ৷ নভেম্বরে পালিত এমনি এক অনুষ্ঠান সম্পর্কিত ছিলো মৃতজনের সাথে। এর বর্ণনা দিতে গিয়ে Oxford Junior Encyclopaedia- তে বলা হয়েছে--- When the days were shortening as autumn passed into winter, and men's minds were turned towards death and decay, the departed were thought to return to their old homes and haunts and assembled round the fireside.

Bonfires were lighted to renew the energy of the sun, lest it should burn itself out and leave the world without its light and warmth." * Oxford junior Encyclopaedia, vol. 1, (1960), pp. 175-6

এ-তত্ত্ব মূলত জীবনের অনিত্যতা আর পুনর্জনাবাদের। কিন্তু এখানে আলো এবং তাপের উৎস হিসেবে সূর্যের যে উপস্থাপন, আদি কৃষিজীবী সমাজেও তার অনুরূপ কৃতি দেখা গেছে। সূর্যের প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হত খাদ্য আহরণকারী মানুষের জীবনও। কিন্তু এই প্রভাব তখন সরাসরি অভিজ্ঞতায় শনাক্তকৃত নয়— শনাক্তকরণের অভিজ্ঞতার সূচনা কৃষিজীবী সমাজে। সুতরাং একথা বললে অন্যায় হবে না যে, জীবন-মৃত্যুর সাথে গ্রথিত সূর্যভাবনাও কার্যত আদি কৃষিজীবী সমাজেরই দান।

অবশ্যি, জীবন-জীবিকার সম্পর্ক দিয়ে দেবতারূপে সূর্যের আবির্ভাব ব্যাখ্যা করা সবসময় সম্ভব নয়। বিশেষ করে, যখন দেখি, কৃষকের ফসল উৎপাদনে বা মানুষের জীবনরক্ষায় কোনো কোনো সূর্যদেবতা আগ্রহী নন।

**এমনই এক সূর্যদেবতা গ্রিস আর রোমের অ্যাপোলো, যিনি পুজো পেতেন প্রধানত কাব্য, সঙ্গীত, চিকিৎসাশাস্ত্র, ধনুর্বিদ্যা আর কূটনীতি দেবতা হিসেবে। কৃষির দেবতা হিসেবে তখন ওসব দেশে পূজিত ছিলেন শনি। প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ্য, অ্যাপোলো গ্রিক পুরাণের একমাত্র সূর্যদেবতা নন। সেখানে তার এক প্রবলপ্রতাপ দোসর বা প্রতিদ্বন্দী হেলিয়োস এবং অ্যাপোলো হেলিয়োসের রথের সারাথ! সূর্যপুজোর ইংরেজি প্রতিশব্দটিও (heliolatry) ওই হেলিয়োসেরই নাম থেকে।

>>সূর্যদেবতার প্রথম দেশঃ

দেবতারূপে সূর্যের প্রতিষ্ঠালাভের প্রসঙ্গে আরো দুই-একটি কথা বিশেষভাবে স্মরণীয়। সূর্যদেবতার জন্ম এবং প্রতিষ্ঠালাভ প্রথমে আদি কৃষিজীবী সমাজে। কৃষিজীবী সমাজ প্রথম দেখা যায় আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে। এর অর্থ, সূর্যদেবতার—বস্তুত, কোনো দেবতারই—বয়েস নয় হাজার বছরের বেশি নয়। অন্য দিকে, নৃবিজ্ঞানীদের মতে, কৃষির সূচনা এবং প্রথম বিকাশ ঘটে প্রাচীন মিশরে। এই মতের অনুসৃতিতে বলতে হয়, দেবতারূপে সূর্যের আবির্ভাব এবং প্রথম প্রতিষ্ঠালাভও ওই দেশে। কিন্তু তাই বলে এমন কথা নিশ্চিতরূপে ধরে নেয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয় যে, প্রাচীন মিশর থেকেই সূর্যপুজো পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কৃষিকৰ্ম সম্ভব এক বিশেষ অনুকূল পরিবেশে । এর সুযোগ এক-এক এলাকার মানুষ নেয় এক-এক সময়ে, প্রায় সর্বত্রই অন্যনিরপেক্ষভাবে । ঠিক এমনি কথাই প্রযোজ্য সূর্যপুজোর প্রসঙ্গেও। সমাজবিকাশের কোনো কোনো স্তরে গোত্র বা কওমের ধর্মবিশ্বাস অন্য গোত্র বা কওমে সংক্রমিত হয়েছে অবশ্যই। কিন্তু সমগ্র মানবসমাজের ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসে তা বস্তুত ব্যতিক্রম।

আসলে তো পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকা তথা মানবগোষ্ঠী আপন আপন সূর্যদেবতা সৃষ্টি করেছে স্বাধীনভাবে, আপন আপন অভিজ্ঞতাজাত ধারণার বুনিয়াদে, যার এক প্রমাণ বিভিন্ন দেশ তথা মানবগোষ্ঠীতে সৃষ্ট সূর্যদেবতার গুরুত্ব, রূপ, বাহন ইত্যাদির বিভিন্নতা। মিশরে সূর্য একদা ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান দেবতা, অন্যান্য দেশে অন্যতম প্রধান বা গৌণ দেবতা। নীলনদের অববাহিকায় তিনি হন দেহাংশে মানুষ, কিন্তু মাথায় বাজপাখি। গ্রিস-রোমের অ্যাপোলো তিলোত্তম পুরুষ। নিম্ন মিশরের হেলিয়োপলিসের হেলিয়োস আকাশ পরিক্রমা করতেন চার ঘোড়ার রথে, ভারতের সূর্যদেব সাত ঘোড়ার রথ নিয়ে, মিশরের রা সোনার নৌকোয় ।

>>মানুষ ও সূর্যদেবতাঃ

এখানে একটি সতর্কবাণী । দেবতাদের জন্ম প্রাচীন কৃষিজীবী সমাজের আত্মা-সম্পর্কিত কল্পনায় । সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে একথার সত্যতা অবশ্যই তর্কাতীত । কিন্তু তারা আবার দেবতার জন্মের অন্যতর কারণও নির্দেশ করে দেন— যার ইঙ্গিত ইউহিমেরাসের মতবাদের উল্লেখের মাধ্যমে। আমাদের তাই মানতে হয়, দেবতাসৃষ্টির সকল কৃতিত্ব কেবল প্রাচীন কৃষিজীবী সমাজের নয়।

--প্রাচীন আজটেক সমাজে সূর্য ফসলের তথা কৃষিকর্মের অন্যতম দেবতারূপে পূজিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে সূর্যদেবতার আবির্ভাব আদি কৃষিজীবী আজটেকদের কল্পনায় সংঘটিত বলে ধরে নিতে কোনো বাধা নেই । কিন্তু কোনো সূর্যদেব যখন মানবসূলভ গুণাবলিতে অন্বিত হন— কিংবা মানুষের মতো সংসারধর্ম পালনে উৎসাহী অথবা বীরসুলভ কোনো কীর্তির জন্যে স্মরণীয় বা প্রতিষ্ঠিত— তখন তার ক্ষেত্রে ইউহিমেরাসের তত্ত্ব প্রয়োগ ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

--গ্রিসের সূর্যদেব অ্যাপোলো ছিলেন বিবিধ সদগুণ বা নিষ্কলুষতার অধিকারী । অন্য দিকে, তার প্রতিষ্ঠা পাইথন নামক এক ড্রাগনহত্যার মাধ্যমে। গ্রিসের আর-এক সূর্যদেব হাইপারিয়ন, ভারতের সূর্য প্রমুখের সংসারধর্ম পালনের কাহিনী সর্বজনজ্ঞাত। মিশরের সূর্যদেবতা আমনকে ঠিক সংসার বলে জানিনে । কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, তিনিও নারীভোগে উৎসাহী ছিলেন।

--কোনো সূর্যদেবের জন্ম বা লালনের জন্যে উপরি-উক্ত দুই কারণই একই সঙ্গে দায়ী কি না, তা অবশ্যি নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়। প্রথম কারণে জাত সূর্যদেবের সাথে দ্বিতীয় কারণে জাত ফোলানো-ফাপানো মানুষের সংমিশ্রণ ঘটা অসম্ভব নয় ।

--একদা বহু রূপে এবং বহু ভূমে পূজিত, প্রবলপ্রতাপ সূর্যদেবতা এখন, স্বাভাবিক আর অনিবাৰ্য কারণেই, পৃথিবীর অধিকাংশ মানবগোষ্ঠীতেই বর্জিত বা বিস্তৃত— বড়ো জোর স্মৃতিবাসী, আরো অসংখ্য দেবতার মতো। প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে মানুষের যে অস্পষ্ট, অসম্পূর্ণ বা অবাস্তব ধারণা তার জনের কারণ, তার ক্রমবিকশিত বিজ্ঞানমনস্কতায় তার মৃত্যু বা প্রতিষ্ঠালোপ। একদা যিনি কোনো কোনো দেশে রাষ্ট্রীয় ধর্মের কেন্দ্র অবধি জুড়ে বসেছেন, এখন তিনি জাগ্রত আর পূজিত কেবল কয়েকটি অনুন্নত খণ্ড জাতির মনে আর গোড়া সম্প্রদায়ের মন্দিরে। এবং তাদের মধ্যেও তার প্রভাব ক্রমক্ষীয়মাণ। আর কতো দিন তিনি টিকে থাকতে পারবেন, বলা মুশকিল। তবে, তার জন্যে আশার কথা, তিনি ইতিমধ্যেই, পৃথিবীর অনেক দেশেই, পুরাণ-কাহিনীর অন্যতম প্রধান পুরুষে—এবং তাই কৌতহলী নৃবিজ্ঞানীর অনুসন্ধিৎসার লক্ষ্যে—পরিণত । দ্বিতীয়ত, তিনি এখন কিছু নতুন শক্তির প্রতীকও ৷

------------ চলমান।

বিষয়: বিবিধ

১১০১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

353566
১২ ডিসেম্বর ২০১৫ রাত ১২:৫৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১২ ডিসেম্বর ২০১৫ দুপুর ০৩:৩৪
293619
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
353593
১২ ডিসেম্বর ২০১৫ রাত ০৩:০০
হাফেজ আহমেদ লিখেছেন : তাই!
১২ ডিসেম্বর ২০১৫ দুপুর ০৩:৩৪
293620
গোলাম মাওলা লিখেছেন : কি তাই

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File