প্রিয় সব চরিত্র -- পাঠ এক

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ৩০ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:৫৭:৪০ রাত

প্রিয় সব চরিত্র -- পাঠ এক

আমার বই পড়া শুরু ক্লাশ থ্রিতে। প্রথম উপন্যাস ক্লাশ ফাইভে-- কাজি ইমদাদুল হক এর আব্দুল্লাহ। আসলে এটি ছিল আমার সব বড় ভায়ের ক্লাশ টেনের সহপাঠ। এর পর শহরে(রাজশাহীতে--ক্লাশ ফাইভে গিয়েছিলাম) এসে ক্লাশের বন্ধুদের বদৌলতে প্রথম পরিচয় তিন গোয়েন্দা। এরপর একে একে রানা, ফেলুদা, কুয়াশা, টেনিদা, ঘনাদা, ঋজুদা, ব্যোমকেশ বক্সী, প্রোফেসর শংকু-র সাথে পরিচয়। জিবনে বই পড়ার মত লাইফে আনন্দ আর কিছুতে পেয়েছি বলে মনে হয় না।আর এই বইকেই আজো প্রিয়/প্রিয়া হিসেবে আমার বড় সত্তা জুড়ে বিরাজমান। আজ আমার কিছু প্রিয় চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।

১।তিন গোয়েন্দা:

তিন গোয়েন্দার বই প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালের আগস্ট মাসে সেবা প্রকাশনী হতে। কিশোর পাশা, রবিন মিলফোর্ড ও মুসা আমান- এই তিনজন মিলেই তিন গোয়েন্দা। রবার্ট আর্থারের ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’ সিরিজ এবং এনিড ব্লাইটনের ‘ফেমাস ফাইভ’ সিরিজ সহ অন্যান্য বিদেশী বইয়ের ছায়া নিয়ে রচিত হয়েছে বইগুলো। ‘তিন গোয়েন্দা’ নামে প্রথম বইটি প্রকাশিত হবার পর থেকে রকিব হাসান টানা ১৬০ টি বই লেখেন, পরবর্তীতে শামসুদ্দিন নওয়াব তিন গোয়েন্দার কিছু বই লিখেন। বর্তমানে রকিব হাসান অনিয়মিত ভাবে সেবা প্রকাশনী থেকে তিন গোয়েন্দা লিখছেন। তিন গোয়েন্দার বাস প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস-এর রকি বীচে। কিশোর পাশা বাঙ্গালী, ছোটবেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মা মারা যাবার পর হতে চাচা রাশেদ পাশা ও মেরী চাচীর কাছে বড় হয়। রবিন মিলফোর্ড বইপাগল আমেরিকান আর মুসা আমান দলের পেশীশক্তি, আমেরিকান-আফ্রিকান। পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ডে পুরনো এক মোবাইল হোমে তাদের হেডকোয়ার্টার। তিন গোয়েন্দার বইতে আরো দেখা মেলে জর্জিনা পার্কার, কুকুর রাফি, চিরশত্রু শুটকি টেরি, হলিউড মুভি পরিচালক ডেভিড ক্রিস্টোফার, গোয়েন্দা ভিক্টর সাইমন, রাঁধুনী নিসান জাং কিম, ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার, ওমর শেরিফ, ফগর্যাোম্পারকটের।

২।মাসুদ রানা:

কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্ট চরিত্র মাসুদ রানা- বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর এজেন্ট। গুপ্তচরবৃত্তি তার পেশা, কখনো কখনো পৃথিবীকে বাঁচানোর অথবা বন্ধুকে রক্ষার মিশনেও তাকে দেখা যায়। লেখকের ভাষায় কোমলে-কঠোরে মেশানো, টানে সবাইকে কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না। মাসুদ রানা চিরতরুণ। সাংকেতিক নাম এম আর-নাইন। তার পরিচালিত একটি গোয়েন্দা সংস্থা আছে, নাম “রানা এজেন্সী”। মাসুদ রানার পিতা জাস্টিস ইমতিয়াজ চৌধুরী। ইয়ান ফ্লেমিং-এর জেমস বন্ডের আদলে তৈরি মাসুদ রানা। মাসুদ রানার প্রথম বই “ধ্বংস পাহাড়” ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয়। সেই যে শুরু, এখন পর্যন্ত চার শতাধিক বই বেরিয়েছে। সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইগুলোর কয়েকটি বাদে বাকি প্রায় সব বিদেশী বই বা মুভির ছায়া অবলম্বনে রচিত। মৌলিক বইগুলো হল- ধ্বংস পাহাড়, ভারতনাট্যম, হ্যাকার। এলিস্টেয়ার ম্যাকলীন, রবার্ট লুডলাম, জেমস হেডলী চেয, উইলবার স্মিথ , ক্লাইভ কাসলার, ফ্রেডরিক ফরসাইথ- এমন বিখ্যাত লেখকদের বইয়ের ছায়া অবলম্বনে রচিত হয়েছে বইগুলো। বইতে আরো যেসব পরিচিত চরিত্রের দেখা মেলে তারা হলঃ মেজর জেনারেল রাহাত খান, সোহেল, সোহানা, রুপা, গিলটি মিয়া, বিজ্ঞানী কবির চৌধুরী। মাসুদ রানা অবলম্বনে চলচ্চিত্র এবং নাটকও নির্মিত হয়েছে।

৩।কাকাবাবু:

বাংলা সাহিত্যের অকুতোভয় সাহসী চরিত্র কাকাবাবু ওরফে রাজা রায়চৌধুরী-র স্রষ্টা পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রাক্তন সরকারী চাকুরে কাকাবাবুর একটি পা ভাঙ্গা, হাঁটেন ক্র্যাচে ভর দিয়ে। প্রখর বিশ্লেষণ ক্ষমতা সেই সাথে দুই হাতে প্রবল শক্তি। কাকাবাবু বিয়ে করেননি। রোমাঞ্চপ্রিয় কাকাবাবু রহস্যের খোঁজ পেলেই অভিযানে ছুটে যান। কাকাবাবুর সঙ্গী সন্তু ওরফে সুনন্দ যে তাঁর সব অভিযানের সাক্ষী। সন্তুর বন্ধু জোজো-ও অভিযানে তাঁদের সঙ্গী হয়। জোজো মহা চাপাবাজ, তিলকে তাল বানাতে তার জুড়ি নেই। কাকাবাবুর বইতে অন্যান্য পরিচিত চরিত্র হলঃ দেবলীনা দত্ত, শৈবাল দত্ত, রিনি, নরেন্দ্র ভার্মা। কাকাবাবুর কাহিনী ১৯৭৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় আনন্দমেলা পত্রিকায়, ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ শিরোনামে। পরবর্তীতে সমগ্র আকারে প্রকাশিত হয় ভারতের আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত লেখক মোট ৩৬ টি কাকাবাবুর কাহিনী লিখে গেছেন। কাকাবাবুর কাহিনী হতে মুভি, টিভি সিরিজ, টেলিফিল্ম, এনিমেশন, কমিকস তৈরি হয়েছে।

৪।মেজর রাহাত:

মাসুদ রানার বস যার কথা ভাবলেই রানার বুক ধড়ফড় করে্, কাঁচাপাকা ভ্রূর গুরুগম্ভীর চরিত্র মেজর জেনারেল (অবঃ) রাহাত খানকে নিয়েও সেবা প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশিত হয়েছে। কাজী আনোয়ার হোসেন, নিয়াজ মোরশেদ, রওশন জামিল, ইফতেখার আমিন প্রমুখের লেখা এই সিরিজটি অনিয়মিতভাবে ১৯৮২ সাল থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সবগুলো বই বিশ্ববিখ্যাত লেখকদের ওয়ার থ্রিলার থেকে ছায়া নিয়ে রচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ‘ওয়ান্ডার বয়’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নির্ভিক এক বাঙ্গালী মেজর রাহাত। স্ট্রাইক ফোর্সের নেতৃত্ব দানকারী এই নির্ভীক, অকুতোভয় মেজর একের পর এক শত্রুপক্ষের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেয়। নব্বইয়ের দশকে সিরিজের শেষ বইটি লেখা হয়েছিল।

৫।ব্যোমকেশ বক্সী :

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সী-র স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখক ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে ১৯৩২ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মোট ৩৩ টি কাহিনী লিখেছেন। ব্যোমকেশের প্রথম বই ‘সত্যান্বেষী’। ব্যোমকেশের আছে অনবদ্য বিশ্লেষণী দক্ষতা। ধারালো নাক, লম্বা চেহারা, নাতিস্থুল অবয়বের অধিকারী ব্যোমকেশ শুধু বুদ্ধি দিয়ে যাবতীয় জটিল রহস্যের জট খোলে। সে পুলিশের চাকরী করে না, শুধু খেয়ালের বশে শখ করে সত্যান্বেষী হয়ে উঠে। ব্যোমকেশ স্বল্পভাষী, বাইরে থেকে দেখে তার ভেতরের জ্ঞানের গভীরতা বোঝা যায় না। বন্ধু অজিত ব্যোমকেশের সহযোগী। সত্যবতী ব্যোমকেশের স্ত্রী, এই কৃশাঙ্গীর সাথে একটি খুনের মামলা তদন্ত করতে যেয়ে তার পরিচয়। ব্যোমকেশের সবগুলো কাহিনী আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত ‘ব্যোমকেশ সমগ্র’-তে পাওয়া যায়। ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে টিভি সিরিজ, মুভি ও রেডিও অনুষ্ঠান নির্মিত হয়েছে।

৬।টেনিদা:

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্র টেনিদা ওরফে ভজহরি মুখার্জি। কলকাতার পটলডাঙায় টেনিদার বাস। টেনিদা গল্পের রাজা, ফুটবল মাঠের সেরা খেলোয়াড়, ক্রিকেট খেলার ক্যাপ্টেন। লোকের বিপদে সবার আগে সে উপস্থিত হয়ে যায়। তার বিখ্যাত সংলাপ - "ডি-লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক"। মৈনাক পর্বতের মত তার নাক। টেনিদার সঙ্গী প্যালারাম তার কাহিনীগুলো বর্ননা করে। হাবুল সেন ঢাকাই ভাষায় কথা বলে আর ক্যাবলা চারজনের মাঝে সবচেয়ে চালাক। টেনিদা তার টীম নিয়ে বিভিন্ন অভিযানে যায় এবং রহস্যের সমাধান করে। এছাড়াও টেনিদার বীরত্বের অতিরঞ্জিত গল্প নিয়েও কিছু বই লেখা হয়েছে। টেনিদাকে নিয়ে লেখা মোট ৫ টি উপন্যাস, ৩২ টি গল্প আর ১ টি নাটিকা সংকলিত করে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে টেনিদা সমগ্র। টেনিদার কাহিনী নিয়ে কমিকস, মুভি ও অ্যানিমেটেড সিরিজ নির্মিত হয়েছে।

৭।ঘনাদা:

প্রেমেন্দ্র মিত্রের জনপ্রিয় চরিত্র ঘনাদা ওরফে ঘনশ্যাম দাস। ঘনাদার প্রথম গল্প ‘মশা’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ঘনাদার মোট পনেরটি বই বের হয়, এই বইগুলো একত্রে আনন্দ পাবলিশার্স হতে ঘনাদা সমগ্র ১ এবং ২ নামে প্রকাশিত হয়। ঘনাদার বইতে সরাসরি অভিযানের দেখা পাওয়া যায় না বরং তাঁর মেসের প্রতিবেশী চার যুবককে নিজের জীবনের নানা অভিযান সম্পর্কে অবিশ্বাস্য ও আজগুবি গল্প মুখে মুখে বানিয়ে শোনান। আবার কিছু গল্প কলকাতা লেকের পাড়ে বসেও বলতে দেখা যায়। ঘনাদার গল্পগুলি বানানো হলেও, এর অধিকাংশ তথ্যই বাস্তব ভিত্তিতে গৃহীত। ঘনাদার বসবাস ৭২ নং বনমালী নস্কর লেনের একটি মেসে। মেসে তাঁর সঙ্গী আরো চারজন বাসিন্দা – শিবু, শিশির, গৌর আর সুধীর। ঘনাদা গল্পগুলোতে তিনি নিজেই নায়ক। গল্পের ঘনাদা বুদ্ধিতে ও শক্তিতে অপরাজেয়। ঘনাদা ভোজনরসিকও বটে। ঘনাদার গল্পে রহস্য-রোমাঞ্চ-ইতিহাস-ঐতিহ্য-বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ফুটে উঠেছে। ঘনাদার কাহিনীতে আরো যাদের দেখা পাওয়া যায় তারা হলঃ রাঁধুনি রামভুজ, বানোয়াড়ী, বাপী দত্ত, সুশীল চাকীর।

৮।প্রোফেসর শঙ্কু:

সত্যজিৎ রায়ের চরিত্র স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যাপক প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর প্রথম কাহিনী ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী’ ১৯৬১ সালে সন্দেশ পত্রিকায় বের হয়। শঙ্কু একজন পদার্থবিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক। তিনি ৬৯ টি ভাষা জানেন। অকুতোভয়, আত্মভোলা শঙ্কুর কর্মস্থল বিহারের গিরিডিতে। শঙ্কু অবিবাহিত। বিজ্ঞানী হিসেবেও শঙ্কুর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তাঁর ৭২ টি আবিষ্কারের মাঝে আছেঃ মিরাকিউরল, স্নাফগান, ম্যাঙ্গোরেঞ্জ, অ্যানাইহিলিন, নার্ভিগার, অমনিস্কোপ, ক্যামেরাপিড ইত্যাদি। শঙ্কু দেশপ্রেমিক, পোষা বিড়াল নিউটন আর চাকর প্রহ্লাদ তাঁর নিত্যসঙ্গী। এছাড়াও দেখা মেলে প্রতিবেশী অবিনাশ চট্টোপাধ্যায় ও হিতাকাঙ্ক্ষী নকুড়বাবুর। সাহারা মরুভুমি, সমুদ্রের তলদেশ, মঙ্গল গ্রহ, ইংল্যান্ড, জার্মানি, জাপান, স্পেন সহ আরো জায়গাজুড়ে তাঁর অভিযান পরিচালনা করেছেন। সত্যজিৎ রায় শঙ্কুকে নিয়ে ১৯৬১ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত মোট ৩৮ টি সম্পুর্ণ ও ২ টি অসম্পুর্ণ কাহিনী লিখেছেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে শঙ্কু সিরিজের মোট আটটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে আনন্দ পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ শঙ্কুসমগ্র-তে সকল গল্প সংকলিত হয়।

৯।কুয়াশা:

সুলেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্ট চরিত্র কুয়াশা। কুয়াশা-১ নামে এই সিরিজের প্রথম বইটি সেবা প্রকাশনী হতে ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়। কুয়াশা বিজ্ঞানী- বিজ্ঞানের সাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করেছে। কুয়াশার বাড়ি কুষ্টিয়াতে। সতের বছর বয়সে কুয়াশা জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল ব্যান্ডেনবার্গের সাথে বাংলাদেশ ছাড়ে। পনের বছর পর সে আবার দেশে ফিরে আসে তার গোপন গবেষণা চালানোর জন্য। তার একমাত্র ছোট বোন মহুয়া। মানকল্যাণের জন্য কুয়াশা গবেষণা করে আর এর টাকা জোগাড় করতে সে অবৈধ পথ বেছে নিতেও দ্বিধাবোধ করে না। এজন্য কুয়াশা আইনের চোখে অপরাধী, একজন ফেরারী আসামী। কুয়াশার বইগুলোতে অন্যান্য পরিচিত চরিত্র হলঃ শখের গোয়েন্দা শহীদ, কামাল, ডি কস্টা, গফুর, মি সিম্পসন, লিনা, রাসেল, ড ওয়াই। কুয়াশা সিরিজের প্রকাশনা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। মাসুদ রানা সিরিজের ৪ নং বই সেই কুয়াশা দিয়ে তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

১০।ফেলুদা:

সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট কিংবদন্তী গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা ওরফে প্রদোষচন্দ্র মিত্র। ফেলুদার প্রথম গল্প ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত মোত ৩৫ টি সম্পূর্ণ ও ৪ টি অসম্পুর্ণ ফেলুদা কাহিনী বের হয়েছে। ফেলুদা কলকাতার ২১ রজনী সেন রোডে বাস করে। শার্লক হোমসের বিশাল ভক্ত ফেলুদা শারিরীক শক্তি বা অস্ত্রের পরিবর্তে অসামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিরল বিশ্লেষণী দক্ষতার মাধ্যমে রহস্য সমাধান করতে পছন্দ করে। ফেলুদার ট্রেডমার্ক চারমিনার সিগারেট। ফেলুদার সঙ্গী তোপসে ওরফে তপেশরঞ্জন মিত্র, যেকিনা যেকিনা ফেলুদার সব অভিযান লিপিবদ্ধ করে। ফেলুদার বন্ধু জনপ্রিয় লেখক লালমোহনবাবু ‘জটায়ু’ শিরোনামে রহস্য উপন্যাস লেখেন। এছাড়াও ফেলুদার বইতে দেখা পাওয়া যায় সিধুজ্যাঠা, মগনলাল মেঘরাজের। ফেলুদার কাহিনী হতে বই, মুভি, টিভি সিরিজ, টেলিফিল্ম নির্মিত হয়েছে।

১১।গোয়েন্দা বরদাচরণ:

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সৃষ্টি গোয়েন্দা বরদাচরণ। তার আছে গোয়েন্দার শাণিত বুদ্ধি, অদম্য মনোবল আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। বরদাচরণের দাদু অম্বিকাচরণ যেকিনা ভোররাতে উঠে দেড়শো বুকডন আর তিনশো বৈঠক দেয়- তাঁরও দেখা পাই বরদাচরণের গল্পে। শীর্ষেন্দু বরদাচরণ কে নিয়ে সাতটি গল্প লিখেছেন যা স্থান পেয়েছে ‘নাথ পাবলিশিং’ প্রকাশিত ‘গোয়েন্দা বরদাচরণ সমগ্র ও অন্যান্য’ বইতে।

১২:দস্যু বনহুর :

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক রোমেনা আফাজের চরিত্র ‘দস্যু বনহুর’ নিয়ে মোট ১৩৬ টি গোয়েন্দা কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। দস্যু সর্দার কালু খাঁ মনিরকে কুড়িয়ে পান ও তাকে পরবর্তীতে দস্যু বনহুর রুপে গড়ে তোলেন। বনহুর যেমন গরীবের বন্ধু তেমনি সন্ত্রাসীদের শত্রু। অত্যাচারীদের সম্পদ লুটে নিয়ে ভাগ করে দেয় বঞ্চিতদের মাঝে। সে অশ্বপৃষ্ঠে জঙ্গলে চলাচল করে। মাথায় বারান্দাওয়ালা টুপি, রুমালে ঢেকে রাখা মুখ। বনহুরের সহযোদ্ধা রহমান ও কায়েস। তার দুইজন স্ত্রী- মনিরা ও নুরী। মোট আটটি সমগ্রে সালমা বুক ডিপো প্রকাশিত দস্যু বনহুরের সবগুলো কাহিনী পাওয়া যায়।

১৩।ঋজুদা:

বুদ্ধদেব গুহের সৃষ্টি ঋজুদা যে তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। ঋজুদা যেমন রহস্যের সমাধান করে তেমনি তার কাহিনীতে পাওয়া যায় এডভেঞ্চার আর শিকারের গল্প। ঋজুদার আরো দুই সঙ্গী তিতির এবং ভটকাই। মজার ব্যাপার হল ঋজুদা কাহিনীর কোনটার পটভূমিই কল্পিত নয়। লেখক নিজে যেসব স্থানে ঘুরতে গেছেন তার পটভূমিতেই রচিত ঋজুদার গল্পগুলো। লেখক নিজেই বলেন যে, “পূর্ব আফ্রিকা থেকে ভারত মহাসাগরের সেশ্যেলস আইল্যান্ডস, বা মণিপুর মিয়ানমার বা আন্দামান আইল্যান্ডস বা ভারতের নানা প্রান্তের সব বনভূমিতে আমি নিজে ঘুরে আসার পরই ঝজুদা কাহিনি লিখতে বসেছি তোমাদের জন্যে। তাই এগুলি শুধুমাত্র গোয়েন্দা বা শিকার কাহিনি নয়, এগুলি পড়লেও বাড়ি সুদ্ধ সকলের নতুন নতুন নানা জায়গাতে বেড়িয়ে আসার সুযোগ হবে এই সব লেখার মাধ্যমে”। ঋজুদার প্রথম বই ‘ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে’ । আনন্দ পাবলিশার্স হতে ঋজুদার মোট পাঁচটি সমগ্র বেরিয়েছে।

১৪।তারা

তারা হলেন নক্ষত্ররাজ্যের দেবী। তারা বৃহস্পতির স্ত্রী। বৃহস্পতি দেবতাদের পুরোহিত। তারা অতি সুন্দরী যুবতী। একদিন সোম বা চন্দ্র তারাকে দেখে তাঁর রূপে এত অধীর ও মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে, তারাকে বৃহস্পতির কাছ থেকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে নিজের প্রাসাদে আটকে রাখেন। বৃহস্পতি বা ব্রহ্মার শত অনুরোধেও সোম তারাকে ফিরিয়ে দেন না। সমস্ত দেবকুল তখন সোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সোমের হয়ে লড়াই করে অসুরগণ, যার অধিপতি শুত্রু। বিশাল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মারামারি, কাটাকাটি করে সর্বাংশে ধ্বংস হয়ে যাবার ভয়ে ব্রহ্মা আবার ফিরে আসেন সোমের কাছে; সোমকে তিনি বোঝান। সোম এবার রাজি হন এবং তারাকে মুক্ত করে দেন। তারা ফিরে আসেন বৃহস্পতির কাছে। কিন্তু অচিরেই টের পাওয়া যায়, তারা অন্তঃসত্ত্বা। বৃহস্পতি জানতে চান, এই সন্তানের পিতা কে - তিনি না সোম? কিন্তু তারা কিছুতেই তার জবাব দেন না। বৃহস্পতি তখন সন্তান জন্মের আগে তারাকে গ্রহণ করতে অসম্মতি জানান। বলেন, যতক্ষণ পুত্র জন্মলাভ না করছে তারাকে তিনি গ্রহণ করবেন না। এ-কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তারার গর্ভের পুত্র জন্মগ্রহণ করে ফেলে। উজ্জ্বল সুন্দর দিব্যকান্তির পুত্রকে দেখে সোম ও বৃহস্পতি উভয়েই তাকে নিজের সন্তান বলে দাবি করেন। তাদের মধ্যে এত রেষারেষি, কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব দেখে শিশুটি রেগে গিয়ে উভয়েকেই অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে ব্রহ্মা আবার আসেন তাদের উদ্ধারে। তিনি তারাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বিশেষভাবে জানতে চান আসলেই এই শিশুর পিতা কে - বৃহস্পতি না সোম। তখন তারা স্পষ্ট জানান, সোম। সোম সানন্দে পুত্রকে গ্রহণ করেন এবং তার নাম রাখেন বুধ।

পুরাণে তারার কাহিনি এভাবে বর্ণিত হলেও বীরাঙ্গনা কাব্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের চোখে সোম-তারার সম্পর্ক ভিন্নভাবে, নবরূপে ধরা দিয়েছে। মধুসূদন তাদের সম্পর্ককে অনেকটা কচ-দেবযানীর সম্পর্কের মতো করে এঁকেছেন। এখানে তারাকে তিনি দেবযানীর মতো গুরু-কন্যা না করে কল্পনা করেছেন গুরুপত্নী হিসেবে। গুরুপত্নী প্রায় মায়ের স্থলাভিষিক্ত। ফলে এই প্রেম বৈধ নয়। মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যে দেবতাদের পুরোহিত বৃহস্পতি সোমের গুরু। শিক্ষাশেষে সোম যখন গুরুগৃহ ত্যাগ করতে উদ্যত, তখন তাঁর সান্নিধ্যের জন্যে উদ্গ্রীব, তাঁর প্রেমে অধীর গুরুপত্নী তারা সোমকে তাঁর গভীর প্রণয়ের কথা প্রকাশ করে একখানা পত্র লেখেন। সোমের আসন্ন বিরহে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন তারা, যদিও তিনি সম্পূর্ণ অবগত যে, বৃহস্পতি সোমের গুরু। সেই হিসেবে গুরুপত্নীর সঙ্গে রোমান্টিক প্রেমের সম্পর্ক সম্পূর্ণ অনৈতিক। এর জন্যে তারার মনেও বহু দ্বিধা, সংকোচ ও অপরাধবোধ। কিন্তু সোমের প্রতি তাঁর বাঁধভাঙা ভালোবাসার কাছে ভেসে যায় সেই শাস্ত্রীয় নিয়মকানুন, সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সতীত্বরক্ষার অলিখিত নির্দেশ। আসন্ন বিদায়ী সোমকে লেখা তারার সেই চিঠিতে অনেক উদ্ধৃতি, অনেক অতীত দৃশ্যের অবতারণা, অনেক যৌথ অভিজ্ঞতার উল্লেখ রয়েছে। এসব থেকে পাঠককুল নিশ্চিন্ত হবেন যে, তারা এবং সোম দুজনেই দুজনকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন - অনেক দিন থেকেই। ফলে বীরাঙ্গনা কাব্যের ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্র পাঠ করলে মনে হবে সোমের এই তারা-অপহরণ প্রকৃতপক্ষে কোনো অপহরণ ছিল না। অথবা এই সাজানো অপহরণ তারার সহযোগিতা বা ইন্ধনেই ঘটেছিল। কিন্তু পুরাণে তাদের অপহরণপূর্ব কোনো সম্পর্ক বা সোমের অন্তঃপুরে স্বেচ্ছায় তারার গমনের কোনো উল্লেখ নেই। এমনকি সোম যে বৃহস্পতির শিষ্য, সে-কথাও কোথাও লিপিবদ্ধ নেই।

১৫।হিমু

একটি হুমায়ুন আহমেদ রচিত জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র। হিমু একজন বেকার যুবক যার আচরণ কিছুটা অজাগতিক।হিমুর প্রথম উপন্যাস ময়ূরাক্ষী। এর প্রাথমিক সাফল্যের পর হিমু বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন উপন্যাসে প্রকাশিত হতে থাকে।সে নিজেই নিজের পরিচয় দেয় এভাবে--- ‘আমি’টি হচ্ছে হিমু। বিশ্বের এক নম্বর ফাজিল ছেলে!হুমায়ুন আহমে এই চরিত্র অনুসারে হিমু এর আসল নাম হিমালয়। হিমু যখন ছোট ছিল তখন তার বাবা তার নাম রেখেছিলেন হিমালয়, যা হিমালয় পর্বতের ন্যায় মহত্ব প্রকাশ করে। হিমুর বাবা তাকে একজন মহাপুরুষ হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি তার ছেলের এমন নাম রেখেছিলেন। পরে ছাত্রজীবনে এই নাম নিয়ে তাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তার দাদা (পিতামহ) তার অন্য নাম রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হিমু তার বাবার দেয়া নামই রাখে।

লেখক হিমু এর বাবাকে বর্ণনা করেছেন একজন বিকারগ্রস্ত মানুষ হিসেবে; যার বিশ্বাস ছিল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার যদি প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা যায় তবে একইভাবে মহাপুরুষও তৈরি করা সম্ভব। তার একটি মহাপুরুষ তৈরির স্কুল ছিল যার একমাত্র ছাত্র ছিল তার সন্তান হিমু। হিমু এর পোশাক হল পকেট বিহীন হলুদ পাঞ্জাবী। ঢাকার পথে-পথে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম। মাঝে মাঝে তার মধ্যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রকাশ দেখা যায়। যদিও হিমু নিজে তার কোন আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কথা স্বীকার করে না। হিমু এর আচার আচরণ খুবই বিভ্রান্তিকর। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার প্রতিক্রিয়া অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করে। এবং এই বিভ্রান্ত করা হিমুর অত্যন্ত প্রিয় একটি কাজ।

উপন্যাসে হিমুর কিছু ভক্তশ্রেণীর মানুষ থাকে যারা হিমু কে মহাপুরুষ মনে করে। এদের মধ্যে হিমুর খালাতো ভাই বাদল অন্যতম। মেস ম্যানেজার বা হোটেল মালিক- এরকম আরও কিছু ভক্ত চরিত্র প্রায় সব উপন্যাসেই দেখা যায়। হিমুর একজন বান্ধবী আছে, যার নাম রূপা; যাকে ঘিরে হিমুর উপন্যাসে অজানা রহস্যময়তা আবর্তিত হয়।

হিমুর বয়স ১৮-২৫ বছরের মধ্যে। সে দেখতে খুব সুন্দর নয়,বরং তার পোশাক ও গেট-আপ বিরক্তিকর। সে সবসময় হলুদ রঙের পাঞ্জাবী (অধিকাংশ সময়ে যেটার পকেট থাকে না) পরে। রাতের বেলায় রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে। তার খালাতো ভাই/ফুপাতো ভাই বাদল তার অন্ধভক্ত। যে তার আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতি নিঃসন্দিহান, এবং তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। হিমু মাঝে মাঝে ভবিষ্যতবাণী করে যা প্রায় সময়েই মিলে যায়। সে তার যুক্তি-বিরোধী মতানুসারে কাজ করে, এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করে দেয়।

১৬। দ্রৌপদী

দ্রৌপদী সম্ভবত পুরাণের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও বিতর্কিত নায়িকা। দ্রৌপদী (পঞ্চালী, কৃষ্ণা) পঞ্চাল রাজ্যের রাজা দ্রুপদের কন্যা। তাঁর গাঢ় গাত্রবর্ণের জন্যে তাঁর আরেক নাম কৃষ্ণা। পূর্বজন্মে দ্রৌপদী এক ঋষির কুটিরে বাস করতেন এবং সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন। শঙ্কর দেবতাকে অনুক্ষণ তপস্যা করতে করতে শঙ্করের আবির্ভাব ঘটে। শঙ্কর তাকে বর প্রার্থনা করতে বলেন। দ্রৌপদী তখন তাঁর কাছে পরজন্মে সর্বগুণে গুণান্বিত স্বামী পাবার জন্য বর ভিক্ষা করেন। শঙ্কর যতবার তাঁকে বর দিতে চান ততবারই দ্রৌপদী একই কথা বলেন। পাঁচবার বলায় পরজন্মে দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী হয়। পরজন্মে তাঁর স্বয়ংবর সভায় অর্জুন জলে প্রতিফলিত ছায়া দেখে তার অব্যর্থ তীর ধনুক দিয়ে ঝুলন্ত মাছের চক্ষু ভেদ করে প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে দ্রৌপদীকে বিবাহ করতে সমর্থ হন। যখন দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব বাড়ি আসে, বাইরে থেকে তারা জানায়, ‘মা, আমরা তোমার জন্যে ভিক্ষা করে এনেছি এক রমণীয় পদার্থ।’ ভেতর থেকেই কুন্তি বললেন, ‘যা এনেছ, পাঁচ ভাই ভাগ করে নাও।’ কুন্তি জানতেন না তাঁরা দ্রৌপদীকে নিয়ে এসেছেন। এদিকে দ্রৌপদীকে স্বয়ংবর সভায় দেখা অবধিই পাঁচ ভাই কামার্ত হয়ে পড়েছিলেন। মায়ের এই আদেশের পরে তখন যুথিষ্ঠিরের কথায় পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গেই দ্রৌপদীর বিয়ে হয়। তবে পরবর্তীকালে ভীম আর অর্জুন দ্রৌপদী ছাড়াও আরো কয়েকটি বিয়ে করেন এবং প্রতি স্ত্রীর সঙ্গেই তাদের একটি করে পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। তাই দেখা যায়, দ্রৌপদীর পঞ্চ স্বামী ছিল দ্রৌপদীর ইচ্ছেয় নয়, পান্ডবদের মাতৃ-আজ্ঞা পালনের কারণে। অথবা পূর্বজন্মের বরের বিরোধিতা করলেন না কেন দ্রৌপদী, তিনি কি জানেন না, স্বয়ংবর-সভায় যার গলায় মালা দেওয়া হয় কেবল তিনিই হন তাঁর স্বামী? দ্রৌপদীর অবস্থা দেখে প্রতিভা বসু মন্তব্য করেন, দ্রৌপদী ‘যেন খেলার বল। একের কাছ থেকে (যাচ্ছে) অপরের কাছে।’

পাঁচ স্বামী ছাড়াও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ছিল দ্রৌপদীর। তাঁর বিপদের দিনে কৃষ্ণ বারবার এসে তাঁকে রক্ষা করেছেন। একবার উন্মুক্ত রাজসভাস্থলে দ্রৌপদীকে পণ রেখে পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের সঙ্গে হেরে গেলে দুঃশাসনের মাধ্যমে দুর্যোধন দ্রৌপদীর বস্ত্র খুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। সকল পান্ডব ও কুরুদের সামনে, এমনকি তাঁর পঞ্চস্বামীর সামনে সেটা ঘটতে যাচ্ছে দেখে দ্রৌপদী তাঁর স্বামীদেরসহ তাঁর শ্বশুরালয়ের সকল গুরুজনকে তিরস্কার করেন তাঁরা অধর্মের পথে যাচ্ছে বলে। তিনি এই অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করেননি। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ এসে তাঁর কাপড়ের দৈর্ঘ্য ক্রমাগত বাড়িয়ে দিয়ে দ্রৌপদীকে এই প্রচন্ড অসম্মান থেকে, লজ্জা থেকে, রক্ষা করেন। দ্রৌপদীর এই বহুল আলোচিত বস্ত্র-হরণের ঘটনাটিকে গল্পকার মাহবুব সাদিক সমসাময়িক এক ধর্ষণের দৃশ্যে নান্দনিকভাবে ব্যবহার করে গল্পটি শেষ করেছেন এই বলে যে, ‘এ-কালের কোনো শাড়িই আর অন্তহীন নেই।’ এছাড়া কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে আরেকবার খুব সাহায্য করেছিলেন। পান্ডবরা তখন বনে, দুর্বাসা মুনি পান্ডবদের কুটিরে উপস্থিত হন তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মধ্যভোজনের জন্যে। দুর্বাসার মেজাজের জন্যে সকলে তাঁকে ভয় করে। দ্রৌপদীর ঘরে কণামাত্র খাবার রয়েছে। তাঁর অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ এসে সেই কণা থেকে সকলের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে উপাদেয় খাদ্য তৈরি করে দেন। দুর্বাসা খুশি হয়ে চলে যান। এবারো দ্রৌপদী তাঁর অসমর্থ ও নিশ্চল স্বামীদের তিরস্কার করেন তাঁদের কোনো ভূমিকা না রাখার প্রতিবাদে।

পাঁচ স্বামীর সঙ্গে যাতে শান্তিপূর্ণভাবে দ্রৌপদী বাস করতে পারেন, নারদ মুনি নিয়ম করে দেন, দ্রৌপদী এক বছর এক স্বামীর সঙ্গে থাকবেন। অন্য স্বামীরা তখন অপেক্ষা করবেন। এক বছর পর অগ্নির ভেতর দিয়ে গিয়ে পুনরায় পবিত্র ও সতী হয়ে তিনি দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে থাকতে শুরু করবেন। এভাবে প্রতি স্বামীকে চার বছর অপেক্ষা করতে হবে এক বছর দ্রৌপদীর সঙ্গলাভের জন্যে। অর্জুন একদা এই নিয়ম ভঙ্গ করার অপরাধে তাঁকে এক বছরের জন্যে ব্রহ্মাচার্যে যেতে হয়েছিল আরো দূর বনে। সেখানে গিয়ে অবশ্য অর্জুন ব্রহ্মাচার্যের বদলে আরো তিনখানি বিয়ে করেন - চিত্রাঙ্গদা, সুভদ্রা (কৃষ্ণের বোন) ও উলুপীকে।

দ্রৌপদী সকল স্বামীকে শুধু শান্তিতে রাখেননি, সকলের আগে ঘুম থেকে উঠে সামান্য কিছু খেয়ে সারাদিন সমস্ত কাজকর্ম শেষে সকলের পরে শুতে যেতেন। তবে দ্রৌপদী একটা নিয়ম করে দেন তাঁর স্বামীদের, যা তাঁদের মেনে চলতে হয়। দ্রৌপদী জানতেন তাঁর স্বামীদের কারো কারো আরো স্ত্রী রয়েছে। কিন্তু দ্রৌপদীর নির্দেশে তাঁরা কেউ প্রাসাদে ঢুকতে পারতেন না। তাঁদের সঙ্গে মিলিত হতে হলে তাঁর স্বামীদের বাড়ির বাইরে গিয়ে সেই স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে হতো। কৃষ্ণের সহোদরা অর্জুনের স্ত্রী সুভদ্রার বেলায় শুধু এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছিলেন দ্রৌপদী। পাঁচ স্বামীর মধ্যে অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর কিছুটা পক্ষপাতিত্ব থাকলেও ভীমই একমাত্র স্বামী যিনি স্ত্রীর বিপদের দিনে এগিয়ে এসে সাহায্য করেন। বনবাসকালে রাজা বিরাটের স্ত্রী সুদেষ্ণার ভাই কীচক দ্রৌপদীকে জোর করে ভোগ করতে চাইলে দ্রৌপদীর অনুরোধে আর কেউ নয়, ভীম এসে কীচককে খুন করেন। রাজসভায় সকলের সামনে দ্রৌপদীকে জিম্মি রেখে পাশা খেলে যুধিষ্ঠির হেরে গেলে দুর্যোধনের আজ্ঞায় দুঃশাসন দ্রৌপদীর কাপড় খুলতে উদ্যত হলে স্বামীদের ভেতর একমাত্র ভীমই বাধা দেন।

কৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামার কাছে দ্রৌপদী স্বীকার করেছেন, পাঁচজন স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখতে তাঁকে কতগুলো কঠিন নিয়ম মেনে চলতে হয়। দ্রৌপদী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, বাস্তববাদী নারী। তিনি তাঁর প্রতি অন্যায় আচরণের জন্যে প্রতিশোধ চাইতেন, মুখ বুজে সহ্য করতেন না অবিচার। প্রতি স্বামীর সঙ্গে দ্রৌপদীর একটি করে পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁর পাঁচটি পুত্রকেই ঘুমন্ত অবস্থায় বধ করে অশ্বত্থামা। অশ্বত্থামার মা একজন ধর্মপ্রাণ নারী ও গুরু। সেই বিবেচনায় এবং পাঁচ পুত্রকে হারিয়ে নিজের শোকাতুর অবস্থা অনুধাবন করে সকলের পরামর্শ ও উপদেশ অগ্রাহ্য করে অশ্বত্থামাকে তিনি ক্ষমা করে দেন। দ্রৌপদী চান না তাঁর মতো করে আরেকটি মা এমন প্রচন্ড শোকে পান্ডুর হোক।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্যে অর্জুনের কাছে দ্রৌপদীর লেখা একখানা চিঠি সংযোজন করেন। মাইকেলের কল্পনায় অর্জুনের প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল দ্রৌপদী সেই চিঠিতে তীব্র প্রতিবাদ করেন স্বামীর ছলনা, এই দীর্ঘ বিরহ এবং তাঁর প্রতি অর্জুনের ঔদাসীন্যের জন্যে। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যখন পাশা খেলায় পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে বাস করছিলেন, মহাবীর অর্জুন শত্রুদমনের উদ্দেশ্যে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে সুরপুরে চলে যান। কিন্তু অস্ত্রশিক্ষার নাম করে সেখানে গিয়ে নানারকম ভোগবিলাসে মেতে ওঠেন অর্জুন। এর প্রতিবাদেই স্ত্রীর অধিকার নিয়ে লেখা তাঁর এই পত্রে বিরহী ও প্রতারিত দ্রৌপদীর মর্মবেদনা ও ঈর্ষা ফুটে ওঠে।

১৭।টম এবং জেরি:

কার্টুন দেখতে ভালোবাসে, অথচ টম অ্যান্ড জেরি পছন্দ করে না, এমন কাউকে সম্ভবত ইহ জগতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই দুই ‘চিরশত্রুর ক্ষেত্রে টমকে বাদ দিয়ে জেরিকে কিংবা জেরিকে বাদ দিয়ে টমকে প্রথম ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। একজনকে ছাড়া আরেকজনকে যে ভাবাই যায় না! এই দুই চরিত্র শুধু কাটুন চরিত্রেই থেমে থাকেনি, উঠে এসেছে বই এর পাতায়। কখনো কমিক হিসেবে বা কখনো গল্পের দুষ্ট মিষ্ট চরিত্র হিসেবে।

১৮।মিনা:

প্রথমে কাটুন চরিত্র হিসেবে এলেও পরে মিনার কমিক বই খুব জনপ্রিয় হিসেবে পিচ্চিদের কাছে প্রচার পেতে থাকে।বাংলাদেশের ছোট্ট একটা গ্রাম। বাবা, মা, দাদি, ছোট্ট একটা ভাই আর এক বোনের সঙ্গে থাকে ও। মিঠু নামে ওর একটা পোষা টিয়ে পাখিও আছে। মায়ের কাজে সাহায্য করে।ছোট ভাই রাজু স্কুলে যায়। কিন্তু ও যায় না। ওরও স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছের কথা বাবাকে জানাতেই বাবা বললেন, 'তুমি মাইয়্যা মানুষ, তোমার ইস্কুলে যাওনের দরকার নাই।'

বাবার কথায় মা-ও সায় দেন। কী আর করা! স্কুলে যখন যাওয়া হচ্ছেই না, তখন একটা বুদ্ধি করে ও। ছোট ভাই রাজুর সঙ্গে মিঠুকে স্কুলে পাঠায়। মিঠু স্কুল থেকে শিখে এসে ওকে শেখায়। এভাবে একসময় গুনতেও শিখে যায়। একদিন গুনতে গুনতেই ও বুঝে ফেলে, ওদের মুরগি চুরি হচ্ছে। ওর বুদ্ধি আর শেখার গুণে ধরা পড়ে চোর। শেষে মা-বাবা লেখাপড়ার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। ও স্কুলে যেতে শুরু করে।

[জনপ্রিয় কার্টুন ‘মিনা’ নামের বালিকা চরিত্রটি মেয়ে শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। ১৯৯১ সালে একজন ১০ বছর বয়সী বালিকা হিসেবে মিনা চরিত্রের সৃষ্টি। মিনা চরিত্রটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল তথা দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েশিশুদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি বালিকা চরিত্র। ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতি বছর ২৪ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী মিনা দিবস উদযাপন করছে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা। দক্ষিণ এশিয়ায় মূলত হান্না বারবারা ও রায়মোহন স্টুডিওর যৌথ সহযোগিতায় প্রথমে ১৩টি মীনা কার্টুন ছবি বানানো হয়। এসব ছবি দেখানো হয় টিভিতে।]

১৯।চাচা চৌধুরী:

কমিক মানেই ছোটদের অফুরন্ত মজার খোরাক। আর সেই মজা ও অ্যাডভেঞ্চারের মিশেলে ছোটদের অন্যতম প্রিয় কমিক চরিত্র হলো চাচা চৌধুরী ও সাবু।

ভারতের ডিজনি নামে পরিচিত কার্টুনিস্ট প্রাণের অমর সৃষ্টি এই চাচা চৌধুরী। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের লাল পাগড়ি পরা চাচা চৌধুরীর বুদ্ধি কম্পিউটারের চেয়ে প্রখর। নির্লোভ ও সৎ এই বুড়ো মানুষটির সঙ্গে আছে দূরের গ্রহ জুপিটার থেকে আসা লম্বা ও শক্তিশালী মানুষ সাবু।

এই দু’জন মিলে যেমন তাদের বুদ্ধি ও শক্তি দিয়ে অপরাধীদের দমন করেন, তেমনি ভিনগ্রহবাসী সাবুর বিচিত্র সব কাণ্ড অন্যরকম মজা দেয় ছেলে বুড়ো সবাইকে।

চাচা চৌধুরী কমিক সিরিজের প্রথম বই বাজারে আসে ১৯৭১ সালে। এরপর থেকেই হুহু করে ভারতে বাড়তে থাকে চাচা চৌধুরীর জনপ্রিয়তা। এক সময় এই জনপ্রিয়তা ভারত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে অন্যন্য দেশেও। বর্তমানে ভারতের ডায়মন্ড কমিকস প্রকাশিত চাচা চৌধুরী সিরিজটি বিশ্বের ১১টি ভাষায় অনূদিত হচ্ছে।

ছোট বড় সবার কাছে সাদা লম্বা গোফের চাচাজীই যে শুধু প্রিয় তাই নয়। বরং তার সঙ্গে সাবু, বিনি চাচি, পৃথিবীতে একমাত্র নিরামিষ ভোজি কুকুর রকেট, সবচেয়ে বেটে মানুষ টিঙ্গু মাস্টার, কিংবা অদ্ভুত আরক পান করে অমরত্ব পাওয়া ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী রাকাও অনেক জনপ্রিয়।

বাংলাদেশের শিশুদের কাছেও চাচা চৌধুরীর কমিক জনপ্রিয়। চাইলেই হাতের কাছের যে-কোনো বইয়ের দোকানে কিনতে পাওয়া যাবে চাচা চৌধুরী ও সাবুর এসব রোমাঞ্চকর কমিক।

২০।রবীন্দ্রনাথের ফটিক:

ফটিক আমার কৈশোরের আরেক ভালোবাসার চরিত্র। রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পের একটা সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা।। সেই সংজ্ঞার ভিতরে থেকে রবীন্দ্রনাথ চরিত্রচিত্রণে, পরিবেশচিত্রণে, সংলাপের ক্ষেত্রে অসম্ভব দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর গল্প পড়তে শুরু করলে খুব সহজেই পাঠকের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, এর ভেতরে ঢুকে যাওয়ার। প্রতিটি চরিত্রকে খুব পরিচিত মনে হয়।ছাপার অক্ষরের গল্পকে চোখের সামনে সেলুলয়েডের ফিতের মতো চিত্রায়িত হতে দেখা যায়।

ছুটি নামের গল্পটির মূল চরিত্র ছিল ফটিক নামের এক কিশোর। গল্পের কাহিনী এগিয়েছে গ্রামের একটি কিশোর ছেলেকে তার স্বাধীন মুক্ত জীবন থেকে শহরে ছোট্ট একটি খাঁচার মত একটা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে যেয়ে বন্ধ খাচার ছোট্ট বাড়িতে ফটিক মারা গেল। মূল গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু গল্পের ব্যাখ্যাটা হচ্ছে ফটিককে যখন স্টিমারে করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন পথে যেতে সে দেখেছিল স্টিমারের খালাশিরা জল মাপে- এক বাঁও মেলে না, দুই বাঁও মেলে। এটা ফটিকের মাথায় ঢুকে গিয়েছিল।

মৃত্যুর মুহূর্তে ফটিকের মনে এ ব্যাপারটা চলে আসে। মারা যাওয়ার সময় তার চোখে ভাসছিল ওই জল মাপার দৃশ্যটা যে ‘এক বাঁও মেলে না, দুই বাঁও মেলে’। এর অর্থটা কী? গল্পটার নাম ছুটি কেন? এই প্রশ্ন সেদিন কিশোর আমার কাছে এক অমিমাংসিত রহস্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। নিজের অজান্তেই কখন যেনো আমি ফটিক হয়ে উঠেছিলাম,জানতেই পারি নি। কিন্তু এখন এই সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এগুলো যত না প্রিয়, তার থেকে অনেক বেশি স্মৃতির একটা স্মারক, একটা উপলক্ষ বা অনুভূতির লিগেসি, হয়তো বা নস্টালজিয়া।

২১।পথের পাঁচালীর অপু:

মনে আছে নিশ্চিন্দিপুরের সেই অবাক চোখের কিশোর, নিস্পাপ পল্লীবালক অপুর কথা? পথের পাঁচালীর দুর্গার বোন অপুকে মনে পড়ে?

তাদের সেই ছোট্টগ্রাম নিশ্চিন্দিপুর, শাখারীপুকুর, ঘোঁষদের বাঁশতলা,দিগন্তুছোঁয়া সোনাডাঙ্গার মাঠ। বর্ষার ঢল নামা ইছামতি আর জলমগ্ন শিমুলতলা আর ঝোঁপেঝাড়ে ফোঁটা নাটাকাটা-বনকলমির ফুল বা নীল অপরাজিতায় ছাওয়া, বনের ধারের মায়াময় সব দৃশ্য।

অপু এক সদ্য-কিশোর; মানুষ ও প্রকৃতির পাঠশালায় পাঠ নিতে নিতে সে বড় হয়। এ যেন এক নিম্নবিত্ত, গ্রাম্য, বাঙালী ব্রাহ্মণ পরিবারের চিত্র যেন হাজার বছরের আবর্তে আবর্তিত হচ্ছে অপুর মধ্যদিয়ে।

অপু আমাকে দেখতে শিখিয়েছিলো পৃথিবীকে। অপু আমাকে শুনিয়েছিলো অন্য এক জীবনের গল্প। যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের..সর্বোপরি একজন মানুষের। যে জানে বেঁচে থাকার মুহুর্তগুলো কীভাবে সজীব রাখতে হয়।যে গল্প একান্তই মানুষের।রেলের থার্ডক্লাস বগির বাদুরঝোলা লোকটা কিংবা গ্রামের পথে ছিন্ন পোশাকপড়া উস্কুখুস্কু চুলের মেয়েটাও যে ভাবনার বিষয় হতে পারে, গভীরভাবে সিক্ত করতে পারে হৃদয়কে, আমি এটা শিখেছিলাম অপুর কাছে। এই বন তার শ্যামলতা নবীন স্পর্শটুকু তাহার আর তাহার দিদির মনে বুলাইয়া দিয়াছিলো। বোনাফল কিংবা বৈচির রস আমি কখনো আস্বাদন করি নি।

পথের পাঁচালী’ পড়ার সময় আমি সবসময় নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে অবচেতনভাবে ঘুরে আসি। আমি থাকি অপু-দুর্গার ছায়ার আড়ালে। দুঃখদারিদ্র্যে জর্জরিত অপু-দুর্গার মা সর্বজয়াকে নিজের মায়ের মতো মনে হয়। মনে হয় সর্বজয়ার হাতের ভাতের লোকমাটা অপুর মুখে নয়, আমার মুখে পড়ছে। সংসারের কর্তা ব্যক্তি বাউলের প্রকৃতির ব্রাহ্মণ হরিহরের পরাজিত জীবনটাও আমাকে মর্মাহত করেছে। অপু-দুর্গার প্রতি তার দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতায় ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। যার ফলে চিকিৎসার অভাবে দুর্গাকে অকালে পরপারে পাড়ি দিতে হয়েছে। এই মৃত্যুটাকে সহজভাবে নিতে পারিনি। বুকের গুমরে উঠেছে অভিমান আর চোখের জল টপটপ করে পড়েছে। দুর্গার মৃত্যুর সংবাদটা যখন পড়েছি তখন চোখের সামনে ভেসে উঠেছে উষ্কখুষ্ক চেহারার একটি কিশোরীর ছবি। যার সাধ-আহদ্মাদ কখনো পূরণ হয়নি। দুর্গার অসহায় চিত্র যখন আমার চোখের সামনে উপস্টি’ত হয়, তখনই সর্বজয়ার ওপর সাংঘাতিক ক্ষোভ হয়। কথায় কথায় মারধর আমি সহ্য করতে পারিনি এবং সহ্য করতে পারিনি অপুদের দেশান্তরী হওয়া। যখন ওদের গরুগাড়ি নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম ত্যাগ করে, সে সময় গ্রামের দিকে অপুর করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় আমি ভীষণ মর্মাহত হয়েছি। মনে হচ্ছে অপু নয়, আমি দেশান্তরী হচ্ছি। তার হদয়ের শেষ আকুল প্রার্থনাটাও ছিল মর্মান্তিক যা পাঠকদের বিচলিত করেছে। সে মনে মনে বলেছে, ‘আমাদের যেন নিশ্চিন্দিপুর ফেরা হয়।

২২।গোপাল ভাঁড়:

ভারতীয় উপমহাদেশে 'ভাড়' শব্দটি বিশেষভাবে পরিচিত। সম্ভবত মোগল শাসন আমল থেকে ভাড়দের উৎপত্তি। মোগল শাসকগণ রাজকার্য পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রে ভাড়দের সহযোগিতা নিতেন। রাজার পরামর্শ সভায় বা বিচারকার্যে ভাড়রা অনেকসময় পরোক্ষ ইঙ্গিত দিতেন।

১৭০০ শতাব্দীতে গোপাল ভাঁড়ের জন্ম হয় কৃঞ্চনগরের এক নিম্নবিত্ত বাঙালী পরিবারে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ না পেলেও, তিনি তার বুদ্ধিদীপ্ত বাদানুবাদ ও ব্যবহারের জন্যে ভীষন পরিচিতি লাভ করেন। হাস্য-রস ও বুদ্ধিদীপ্ত আচরনের জন্য কৃঞ্চনগরের (বর্তমান পশ্চিমবাংলার নদীয়া অঞ্চল) রাজা কৃঞ্চচন্দ্র তাকে রাজ্যসভায় স্থান দিয়েছিলেন। তিনি হাস্য-রস দিয়ে রাজাকে আমেদিত করতেন এবং অনেক সমস্যা সুরাহায় সাহায্য করতেন।

**একবার মুর্শিদাবাদের নবীন নবাব সিরাজউদ্দোলা বেড়াতে বেড়াতে কৃঞ্চনগর রাজ্যে এসে পৌঁছালেন। রাজার পিতৃশ্রাদ্ধের জন্যে রাখা ষাড়টি আলগা খেয়ে খেয়ে আরো মোটা তাজা হয়ে উঠেছে। একদিন নবাবের সামনে এসে পড়ল ষাড়টি। ভোজন বিলাসী নবাব আলগা ষাড়টি মালিকবিহিন মনে করে ধরে নিয়ে গেলেন তার ক্যাম্পে। মজাদার ভোজ হবে ষাড়টি দিয়ে।

খবরটি পৌঁছল রাজা কৃষচন্দ্রের কাছে। চিন্তায় পড়লেন তিনি। ষাড়টি ফেরৎ চেয়ে নবাবকে ক্ষ্যাপানো ঠিক হবে না। তাছাড়া তার রাজ্যে মুসলমান নবাব গরু জবাই করে খেলেতো হিন্দু ধর্মের আর মান থাকবে না। চিন্তায় চিন্তায় বিষন্ন হলো রাজা। গোপাল দরবারে এসে জানতে চাইলো রাজা এতো বিষন্ন কেন। ঘটনা শুনে গোপাল রাজাকে অভয় দিয়ে বললো, “আমি অনায়াসে ষাড়টাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবো”। রাজা বললো, “দেখিস, নবাব যেন ক্ষেপে না যায়”। রাজাকে সম্নান জানিয়ে গোপাল রওয়ানা হলো নবাবের ক্যাম্পের দিকে।

গোপালের হাসি-ঠাট্টা নবাবের অজানা নয়। অনেক হাস্য-রস বিনিময়ের পর গোপাল জিজ্ঞেস করলো, “নবাব সাহেব, এই ষাড়টি এখানে বাঁধা রয়েছে কেন?” “ষাড়টি জবাই করে বিরাট এক ভোজের আয়োজন করছি কাল,” বললো নবাব। গোপাল বললো , “হুজুর হলেন দয়ার সাগর, বেড়াতে এসেও কৃষনগরের লোকদের উপকার করতে ভুলেননি। নবাব কিছু বুঝে উঠতে পারলোনা। জিজ্ঞেস করলো, “ভোজের জন্যে ষাড় জবাই দেবো – এতে কৃষনগরের লোকের উপকার হবে কিভাবে?” গোপাল জানালো, “নবাব বোধহয় জানেন না যে এই ষাড়টি শাক-সবজি নয় মানুষের মল ও শুকুরের বিষ্ঠা খেয়ে এতো নাদুস নুদুস হয়েছে। ফলে ষাড়টির গায়ে ভীষন গন্ধ এবং এলাকার লোকজন এটাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচে”।

নোংরা খাবার খেয়ে ষাড়টি নাদুস-নুদুস হয়েছে কথাটা ভেবে নবাবের ভোজের জন্যে ক্ষুধা মিটে গেল! তিনি আদেশ দিলেন ষাড়টি দুরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসতে। গোপাল নবাবকে সেলাম ঠুকে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে গেল। রাজা কৃষচন্দ্র ষাড়টি ফিরে পেয়ে গোপালকে পুরস্কার দিলেন।

২৩।শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত:

“কিন্তু কি করিয়া ভবঘুরে হইয়া পড়িলাম সে কথা বলিতে গেলে প্রভাত জীবনে এ নেশায় কে মাতাইয়া দিয়াছিল, তাহার একটু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। তাহার নাম ইন্দ্রনাথ।“

“বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না- ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে। ছোটখাট প্রেমের সাধ্যও ছিল না- এই সুখৈশ্বর্য পরিপূর্ণ স্নেহ স্বর্গ হইতে মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য আমাকে আজ এক পদও নড়াইতে পারিত।”

এমন অসংখ্য টুকরো টুকরো জৈবনিক ভাষ্য আর অনুপম রসদে গড়া হয়েছে আমার প্রিয় চরিত্র শ্রীকান্ত। দার্শনিক শিল্পী ও কবি-স্বভাব শরৎচন্দ্র তাঁর ‘শ্রীকান্ত’ প্রথমপর্বটি (১৯১৫) সাজিয়েছেন ভ্রমণকাহিনি ও আত্মজীবনীর এক দারুণ ও অভাবনীয় মিশেলে।

তবে ‘আমি’কে দূরে রেখে শ্রীকান্তর দেখবার ও জানবার আনন্দ ও কৌশলের ভেতর দিয়েই নিজেকে প্রকাশ করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত ভাবনা ও অনুভূতির সাথে লেখক সহজেই মিলিয়ে দিতে পেরেছেন প্রকাশশৈলী, বর্ণনাচাতুর্য, কাব্যময়তা আর চরিত্রকে তাদের আপন আপন জায়গাটিতে দাঁড় করিয়ে উপস্থাপনের বিশেষ কায়দা। তবে বইটিতে ঘটনার সমাবেশ চোখে পড়ে না; লেখকের অনুভবজ্ঞান এবং আত্ম-আবিষ্কারের এক অপ্রকাশ মহাকাব্য এটি। কল্পনার চেয়ে এখানে অনুভূতির আন্তরিকতা বেশি। যে আন্তরিকতা আমাকে বারংবার আচ্ছ্বন্ন করেছে। আমি হঠাৎ করে কখনো উঠে পড়েছি অজানা কোন ট্রেনে।

কল্পনায় তৈরী করে নিয়েছিলাম নিজের জগৎ। যেখানে রাজলক্ষী, ইন্দ্রনাথরা ‘শ্রীকান্ত’ একটি সাহিত্যিক-শৈল্পিক আত্মদর্শন, আত্মবিবরণ এবং আত্ম-প্রতিফলন। শ্রীকান্তের জীবনে ও চলার পথে প্রবেশ করা অন্নদাদিদি, পিয়ারী, রাজলক্ষী, অভয়া, সুনন্দা, কমললতা সকলেই প্রাতিস্বিকতায় আলাদা।আমার কৈশোরকে বোহেমিয়ানবোধে আক্রান্ত করে ফেলা শ্রীকান্ত আমাকে আজও তাড়িয়ে ফেরে। ফেলে-আসা দিনগুলোতে যে চরিত্রগুলো শ্রীকান্তের অনুভবকে তাড়িত ও শাণিত করেছে, তাদেরকে সে অনুভবের শৈল্পিক বারান্দায় স্থান দিয়েছে পরম মমতায়। আমি সেটা পারি নি। আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার অতীতকে।তাই বর্তমানের পথে দেখা মেলে না আলোকের রেখা। শুধুই কেবল ছুটে চলা।

নির্লিপ্ততা কিংবা অনাসক্তির ভেতরেও যে প্রবল এক আকর্ষণ-আকর্ষণ কিংবা বিকর্ষণ-আকর্ষণ চেতনা খেলা করে তার বাস্তবতাকে শ্রীকান্ত অস্বীকার করতে পারে নি কিছুতেই। আর তাই, প্রেম-বিরহ-আকাক্ষা-আবেগ- এ সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে শ্রীকান্তের আভিজাত্য।যে জীবন আমি দেখেছি শ্রীকান্তের পাতায় পাতায়, সে জীবন অন্য কোন জীবনের কাছে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে প্রতিনিয়ত।

২৪।জাফর ইকবালের দীপু:

“কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে ক্লাসের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রাঙ্গামাটি জেলা স্কুলে সদ্য অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া মুহম্মদ আমিনুল ইসলাম হক ওরফে দীপু হঠাৎ বুঝে গেলো রোলকল করতে থাকা রাশভারী শিক্ষক আসলে তার সাথে মজা করছেন। সেই মুহূর্তে কিভাবে যেন হঠাৎ সবাই দীপুর খুব আপন হয়ে গেলো। ফি-বছর বাবার বাউন্ডুলে স্বভাবের কারণে স্কুল পাল্টাতে বাধ্য হওয়া দীপুর এভাবে পুরো ক্লাসের সবাইকে একসাথে ভালো লেগে যাওয়াটা একটু অদ্ভুতই বটে।

সেটা আরও মজার হল যখন সবাই হঠাৎ আবিস্কার করল যে এই ক্লাসে আরেকটা দিপু আছে। যেহেতু একজনের অঙ্ক ভুল গেলে আরেকজনের মার খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, সুতরাং ঠিক হল নতুন দিপুর নাম হবে দিপু নাম্বার টু।” এভাবেই শুরু হয় দীপু নাম্বার টু নামের বইটি। কিন্তু বিই অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটির দিপু চরিত্রটি ছিলো আমার প্রিয় চরিত্র।তখনও আমি বই টি পড়ি নি। সুতরাং আমার শৈশবের নায়কের একজন হয়ে গেলো সিনেমার দীপু। মুভিটি যেখান থেকে শুরু ঠিক সেখানেই শেষ।

একটি পাহাড়ি নদীর ধাঁরে বসে আছে দীপু। চারদিক উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঘেরা, নদীতে সারি বেঁধে সাঁতার কাটছে হাসগুলো। বাংলার চিরচেনা গ্রামীণ সেই আবহ ফুটে উঠেছে সিনেমাটির চলচ্চিত্রায়নে।দীপুর কথা আমার হৃদয়ের কোথায় যেনো আঁকা হয়েছিলো, জানার সুযোগ কখনো হয়ে উঠে নি।শুধু জানি, দীপুরা আমাকে কখনোই ছেড়ে যায় না।

২৫ ।জিব্রাইলের ডানার কিশোর নায়ক নবী:

“আজিমপুর হয়ে যে রাস্তাটা পিলখানা রোডের দিকে চলে গেছে, তারই বা পাশে গাছপালার ভেতর এগিয়ে গিয়ে একখানি ছোট কুটির। মরচেধরা বহু পুরোনো টিনের সুরাখ দিয়ে দেখা যায় নীল আসমান।” এভাবেই শুরু হয়েছে শাহেদ আলীর জিব্রাইলের ডানা। আমার কৈশোরের নায়ক, জিব্রাইলের ডানার কিশোর নবী তার অবহেলিত জীবনের অভিযোগবার্তা নিয়ে ঘুড়ি পাঠায় আসমানে। আরশে। আরশের পায়ায় রশি পড়িয়ে নামিয়ে আনবে মর্ত্যের পৃথিবীতে। ফনিমনসায় ঘেরা ছোট্ট গোপন আস্তানা থেকে আসমানের সুবিশাল বিস্তীর্ণতায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছে দোকান পালানো এক কিশোর। উড়ছে তার ঘুড়ি..।

আমি অবাক বিস্ময়ে দেখছি, ছোট্ট নবী কী অনায়াস প্রচেষ্টায় পৌঁছে দিচ্ছে আসমানে তার দুর্দশার চিঠি। কল্পনার স্বর্ণঈগল তার বার্তা নিয়ে ডানা মেলেছে আসমানে। জিব্রাইল পৌঁছে দিচ্ছে তার কথাহুলো মহামহিম স্রষ্টার কাছে। সেদিন নবী তার বার্তা আরশের ডাকবাক্সে পৌঁছুতে পেরেছিলো কিনা, জানি না। কিন্তু, সেদিনের সেই প্রত্যয়ী কিশোর আমার পছন্দের একজন হয়ে উঠেছিলো, একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি।

২৬।হাতেম তাই:

অনেক অনেক দিন আগে আরব দেশে হাতেম তাই নামের এক বীর, সাহসী ও পরোপকারী লোক বসবাস করতো। সে একদিন বনবিহারে বের হয়ে মুনির নামের এক যুবকের দেখা পায়। মুনির মনের দুঃখে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হাতেম তাই তাকে তার দুঃখের কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো, মুনির এক অপূর্ব সুন্দরী রাজকুমারীকে ভালোবাসে। কিন্তু রাজকুমারী মুনিরকে বিয়ে করতে রাজি এক শর্তে, রাজকুমারীর ৭টি প্রশ্নের উত্তর যেখান থেকে হোক মুনিরকে এনে দিতে হবে। হাতেম তাই মুনিরকে নিয়ে রাজকুমারীর কাছে যায়। গিয়ে জানতে পারে, রাজকুমারী যদি প্রশ্নের জবাব ছাড়া মুনিরকে বিয়ে করে তাহলে বিয়ের প্রথম রাতেই মুনির মারা যাবে, এটাই বিধির লিখন। দুই প্রেমীকে মিলিয়ে দিতে হাতেম তাই প্রশ্নগুলোর উত্তরের খোঁজে পথে বেরিয়ে পড়ে। হাতেম তাইয়ের এই অভিযানের গাঁথা খুবই দুঃসাহসিক ও রোমাঞ্চকর। হাতেম পথে অনেক প্রতিকূলতার শিকার হয়, সেসব প্রতিকূলতাকে জয় করে করে সে তার লক্ষ্যে পৌছে। অভিযানের এক পর্যায়ে ভালুক-রাজকন্যা শাকিলাকে সে বিয়ে করে। জীন, দানব, রাক্ষস, ডাইনি, সমুদ্রপুরী, পাতালপুরী ইত্যাদি অলৌকিক উপাদানের সমারোহে হাতেম তাই এক পৌরাণিক নায়ক হিসেবেই আমাদের সামনে হাজির হয়।

*ফার্সি কবি শেখ সাদি তার বিখ্যাত ‘বুস্তান’ গ্রন্থে হাতেম তাইকে উদারতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ‘বুস্তান’-এর গল্পটি হলো, তুর্কি বাদশা শুনেছে হাতেমের একটি তেজী ও বলবান ঘোড়া আছে এবং ঘোড়াটি হাতেমের খুবই প্রিয়। হাতেমের দানশীলতার পরীক্ষা নিতে বাদশা ঘোড়াটি চেয়ে কয়েকজন দূত পাঠান হাতেমের কাছে। রাতে গিয়ে দূতরা হাতেমের বাসায় পৌছায়। হাতেম তাদের খুব সেবা-যত্ন করলো অতিথি আপ্যায়নেও কমতি রাখে না। রাতের মতো দূতরা হাতেমের ঘরেই ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে তারা হাতেমের কাছে বাদশার ইচ্ছের কথা বলে, কথা শুনে হাতেম দুঃখে-লজ্জায় প্রায় কেঁদেই ফেলে। বলে, ‘আপনারা আগে বলবেন না এ কথা! আমি তো ঘোড়া জবাই করে গত রাতে আপনাদের আপ্যায়ন করিয়েছি। কেননা আপনাদের আপ্যায়নের জন্য প্রিয় ঘোড়াটি ছাড়া আমার ঘরে আর কিছুই ছিল না। আর আমার অতিথিরা রাতে খালি পেটে ঘুমাবেন, এটা হতে পারে না।’ হাতেমের এই মহত্ত্বের কথা শুনে তুর্কি বাদশা হাতেমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শেখ সাদি তার আরেক অনবদ্য গল্প সংকলন গুলিস্তান-এ মন্তব্য করেছেন, ‘হাতেম তাই এখন আর নেই, কিন্তু দানশীলতার জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন।’

*আরব্যোপন্যাস বা আরব্য রজনীতে (আনুমানিক ৯ম শতাব্দীর গল্প সংকলন) প্রথম হাতেম তাইয়ের অভিযানের গল্প উঠে আসে। এছাড়া ফার্সি পাণ্ডুলিপি ‘কিস্সা-ই-হাতিম তাই’-এ বিশদ ভাবে হাতেমের রোমাঞ্চকর কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়। হাতেম-কাহিনীর অগ্রগণ্য ইংরেজি অনুবাদক ডানকান ফোর্বস (The Adventures of Hatim Tai)। এভাবে হাতেম তাই মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য দেশে। উর্দু-হিন্দি অনুবাদ, টিভি সিরিয়াল ও চলচ্চিত্র মাধ্যমে ভারতবর্ষে হাতেম জনপ্রিয় হয়। শুধু তাই নয়, হাতেম আর আরবের থাকেনি, স্ব-স্ব দেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

*যাইহোক, গল্প-গাঁথা অনুসারে মোটামুটি এই হলো আমাদের কাছে হাতেম তাইয়ের চরিত্র। এবার ইতিহাসের আলোকে হাতেমকে দেখা যাক। হাতেম তাইয়ের পুরো নাম হাতেম ইবনে আব্দেল্লাহ সাদ আত-তাই। ‘হাতেম’ শব্দের অর্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। কেউ বলেন, এর অর্থ ‘দানশীল’, কেউ বলেন, ‘আত্ম-প্রত্যয়ী’। হাতেম একজন বিখ্যাত আরব কবি। সৌদি আরবের হাইল প্রদেশে তার জন্ম। তার পূর্ব-পুরুষরা ইয়েমেনের অধিবাসী ছিলেন। প্রাক-ইসলামিক জাহিলিয়া যুগের মানুষ তিনি। পরবর্তীতে তিনি সৌদির প্রভাবশালী ‘তাই’ সম্প্রদায়ের নেতা হন। এই সম্প্রদায় আরবের বানি আসাদ ও বানি তামিম অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল। সম্প্রদায়ের এক অংশ ছিল যাযাবর। অনেক গল্পে হাতেম তাইকে একজন মুসলমান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু হাতেম তাই ছিলেন একজন খ্রিস্টধর্মাবলম্বী। হাতেমের অবস্থান ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে, আর ইসলামের সূচনা ৭ম শতাব্দীতে এবং মহম্মদ (সাঃ)-এর জন্ম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। যদিও ইসলাম গ্রহণ করে পরবর্তীতে মহম্মদ (সাঃ)-এর সরাসরি অনুসারী হন তারই ছেলে সাহাবি আদি ইবনে হাতেম ও মেয়ে সাফানা বিনতে হাতেম। ইতিহাস হাতেমের দুঃসাহসিক ও রোমাঞ্চকর অভিযানের স্বীকৃতি না দিলেও, হাতেমের উদারতা ও পরোপকারী মনোভাবের কথা তারা মেনে নেন। হাতেমের কবিতাতেও তা প্রতিফলিত হয়েছে। হাতেম তার সময়েই প্রবাদপুরুষ হয়ে ওঠেন। তার সততা, পরোপকার ও দানশীলতার কথা মানুষের মুখে মুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ৫৭৮ অব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। হাতেমের সমাধি সৌদির একটি ছোট্ট গ্রাম আনোয়ারজ্-এ রয়েছে বলে দাবি করেছিলেন সুখ্যাত ফরাসি প্রাচ্যবিদ দ’হার্বেলট (D'Herbelot)। পরবর্তীতে হাইল প্রদেশেই হাতেমের সমাধি সনাক্ত করা হয়।

২৭।খনা:

********

খনা, কিংবদন্তির খনা। খনার বচন বাঙালির কৃষিজীবনে এখনো সংশয়মুক্তির পথ প্রদর্শক হিসেবে স্বীকৃত। বাঙালির বর্তমান সমাজেও কৃষকের মুখে মুখে কৃষিকাজের নানা প্রথা, কোন মৌসুমে কোন ফসল, কোন সময়ে বৃষ্টি কেমন হবে, কোন সময়ে বৃষ্টি কোন ফসলের জন্য কেমন এবং ফসলের উত্পাদন সম্পর্কিত খনার বিবিধ বচন ঘোরাফেরা করে। যেমন:'ষোল চাষে মূলা তার অর্ধেক তুলা/ তার অর্ধেক ধান বিনা চাষে পান; থোড় তিরিশে ফুল বিশে/ ঘোড়ামুখো তের দিন/ দেখে-শুনে ধান কিন্; থেকে গরু না বায় হাল/ তার দুঃখ চিরকাল; ব্যাঙ ডাকে ঘনঘন/ বৃষ্টি হবে শীঘ্র জানো; আষাঢ়ে রোঁয়া শ্রাবণে পোয়া/ ভাদ্রে যুবা, আশ্বিনে বুড়া/ কার্তিকে দেয় উড়া'—এমন হাজারো বচন আজও কৃষকসমাজের মানুষের কাছে খনার বচন হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই কিংবদন্তির 'খনা' কে?

আজ থেকে ১৫০০ বছর পূর্বে জন্ম নেওয়া ইতিহাসের এক কিংবদন্তি খনা বা ক্ষণা। কোন এক শুভক্ষণে তার জন্ম বলে নাম দেওয়া হয় ক্ষণা। আর ‘ক্ষণা’ থেকেই ‘খনা’ নামের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। খনা ছিলেন সিংহল রাজার কন্যা। কথিত আছে, উনার আসল নাম লীলাবতী। খনা ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী। খনার রচিত ভবিষ্যতবাণীগুলোই মূলত খনার বচন নামে আমরা জানি।

খ্রিস্টীয় ৫০০ অব্দে প্রাচীন ভারতবর্ষের অবন্তী রাজ্যের রাজা ছিলেন বিক্রমাদিত্য। তার রাজপ্রাসাদের প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ ছিলেন বরাহমিহির। বরাহের ঘরে পুত্রসন্তান জন্ম নিলে নাম রাখেন মিহির। শিশুটির কষ্ঠি বিচার করে তিনি দেখলেন, শিশুটির পরমায়ু মাত্র এক বছর। তাই বরাহ একটি পাত্রে মিহিরকে রেখে সমুদ্রজলে ভাসিয়ে দেন। পাত্রটি ভাসতে ভাসতে এসে উপস্থিত হয় সিংহল দ্বীপের উপকূলে। পরে রাজা তাকে তুলে নিয়ে লালন-পালন করেন এবং খনার সঙ্গে বিয়ে দেন। দু’জনই জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করেন। মিহির খনাকে নিয়ে নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসেন। পিতার মতো মিহিরও বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় প্রতিপত্তি লাভ করেন।

পুত্রবধূর এমন ঝলমলে উত্থান মেনে নিতে পারেন নি বরাহ। অন্যদিকে খনা মুক্ত প্রাণের টানে বাধনহারা হয়ে মিশে চলেন নতুন দেশের নতুন মানুষদের সাথে। লেখ্য ভাষ্যহীন প্রাকৃতদের কৃষি সংক্রান্ত জ্ঞানের রাজ্যকে বিকাশে গেঁথে চলেন বচনের পর বচন, যা কৃষকের মুখে আজো টিকে আছে তার শাশ্বত প্রাণ নিয়ে। গণনা করে খনার দেওয়া পূর্বাভাস রাজ্যের কৃষকরা উপকৃত হতো বলে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে দশম রত্ন হিসেবে আখ্যা দেন। বরাহ চেষ্টা করেন খনাকে বশে আনার। কিন্তু খনা চলেন নিজের ইচ্ছেমতো। খনার অবাধ্যতায় ক্রুব্ধ বরাহ পুত্রকে আদেশ করেন খনার জিহ্বা কর্তন করে তাকে যেন উৎসর্গ করা হয়। বাবার আদেশ এবং রাজসভায় প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে প্রতিহিংসায় মিহির খনার জিহ্বা কেটে দেন। এর কিছুকাল পর খনার মৃত্যু হয়। এমন বর্বরোচিত নির্মম পরিণতি লীলাবতীর, একি শুধু নারী হয়ে তিনি চাষাভুষোর সাথে মিশেছেন বলে!! কেবলই সত্যের পথে দাঁড়ানোর যে মৃত্যুনেশা তার, সে নেশা কি একরোখা জেদ? এভাবে খনা নিজেকে নিজেই করেছেন প্রশ্নের সম্মুখীন।

কিন্তু এই কিংবদন্তি কাহিনী সত্য কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, বিক্রমাদিত্যের শাসনামলে বরাহমিহির একজনই ছিলেন। তবে খনার বচনগুলোর অধিকাংশ লিখিত হয়েছে বাংলায়। বচনগুলোর ভাষা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলেছেন, এগুলোর রচনাকাল ৪০০ বছর আগের নয়। কিন্তু বরাহমিহিরের আবির্ভাবকাল প্রায় দেড় হাজার বছর আগে! বরাহমিহিরের জাতক প্রভৃতি জ্যোতিষ গ্রন্থের সঙ্গে খনার বচনের কতগুলো অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। কৃষিসংক্রান্ত নানা বিষয় সম্পর্কে খনার বচনগুলো অমূল্য সম্পদ এবং কৃষিজীবীদের কাছে খুবই আদরণীয়।

কিছু খনার বচন, দেখুন না একটু পড়ে…………………..

তপ্ত অম্ল, ঠাণ্ডা দুধ;

যে খায় সে নির্বোধ।

বৎসরের প্রথম ঈশানে বয়,

সে বৎসর বর্ষা হবে খনা কয়।

তাল, তেঁতুল, কুল

তিনে বাস্তু নির্মূল।

ঘোল, কুল, কলা

তিনে নাশে গলা।

আম নিম জামের ডালে,

দাঁত মাজও কুতুহলে।

শাল সত্তর, আসন আশি

জাম বলে পাছেই আছি।

তাল বলে যদি পাই কাত

বার বছরে ফলে একরাত।

নিত্যি নিত্যি ফল খাও,

বদ্যি বাড়ি নাহি যাও।

হাতিরও পিছলে পাও,

সুজনেরও ডুবে নাও।

গাঙ দেখলে মুত আসে

নাঙ দেখলে হাস আসে (নাঙ মানে – স্বামী)

ক্ষেত আর পুত,

যত্ন বিনে যমদূত।

গরু ছাগলের মুখে বিষ,

চারা না খায় রাখিস দিশ ।

সাত পুরুষে কুমাড়ের ঝি,

সরা দেইখা কয়, এইটা কি?

না পাইয়া পাইছে ধন;

বাপে পুতে কীর্তন।

কাচায় না নোয়ালে বাশ,

পাকলে করে ঠাস ঠাস!

যুগরে খাইছে ভূতে

বাপরে মারে পুতে।

দশে মিলে করি কাজ

হারি জিতি নাহি লাজ।

তেলা মাথায় ঢালো তেল,

শুকনো মাথায় ভাঙ্গ বেল।

মেয়ে নষ্ট ঘাটে,

ছেলে নষ্ট হাটে।

আল্লায় দিয়া ধন দেখে মন,

কাইড়া নিতে কতক্ষণ।

যদি থাকে বন্ধুরে মন

গাং সাঁতরাইতে কতক্ষণ।

২৮। জাকি আজাদঃ

শেখ আবদুল হাকিমের এক অসাধারণ গোয়েন্দা চরিত্র জাকি আজাদ। সুদর্শন, সাহসী, নির্ভীক, বুদ্ধিমান।মাসুদ রানার নামের সঙ্গে বেশ মিল তার নামের—মাসুদ=আজাদ/ জাকি=রানা । দুই এবং তিন নামের ক্যারিশ্মাটিক ব্যক্তিত্ব জাকি আজাদকে পুরান বই এ পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সিক্রেট সার্ভিস এর দুর্ধর্ষ এজেন্ট হিসেবে(প্রথম দিকের বই রুপের ফাদে-প্রকাশ১৯৭৪)।আবার তাকে মাসুদ রানার সংগঠন বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেঞ্চে এর এজেন্ট এবং মাসুদ রানার জিগরি দোস্ত লেডি কিলার জাকি আজাদ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে (রক্তের বদলে,প্রকাশ১৯৯৭) আবার নতুন বই এ তাকে লেখক পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সেলফ-ডিফেন্স এর ডিরেক্টর হিসেবে(লোতানি গুপ্তধন এ প্রকাশ২০১১)।

>>> জদিও বর্তমানে জাকি আজাদকে লেখক ফিরিয়ে এনেছেন বিভিন্ন বই এ।

২৯। রাক্ষস খোক্কশঃ

****************

রাতে ঘুমানোর আগে দাদা-দাদী/ঠাকুমা-দিদিমাদের হাত ধরেই ভয়, অপরাধ আর হিংসা জীবন্ত হয়ে উঠতো আমাদের দেশের শিশুমনে । আর সেই সব রাতে গল্প শুনতে শুনতে গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে অনেকে হয়তো হয়ে উঠত ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র গল্পের রাজকুমার বা রাজকন্য। নিছক রাজপুত্র, রাজকন্যা, পক্ষীরাজ ঘোড়া আর ব্যঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর মত নিরামিষ উপাখ্যানের সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরমার ঝুলিতে ভূত-পেত্নী, রাক্ষস-খোক্কশ সকলেরই জোরালো উপস্থিতি ছিল - আর ছিল মানানসই ছবি। এত বছর পরেও সবার মনে সজীব সেই সব আধ পাতা জোড়া সাদাকালো ছবি। মন্ত্রপূত শুকপাখীর গলা কাটতেই সুন্দরী রানী ভয়ংকরী রাক্ষসী হয়ে মাথা ঘুরে পরে যাচ্ছে, তার মুখে বড় বড় দাঁত, হাতে বিশাল নখ।ছবিটার তলায় লেখা-‘এইবার রাক্ষসী নিপাত যাও’।

৩০।দস্যু মোহনঃ

****************************

শশধর দত্তের অমর সৃষ্ঠি দস্যু মোহন। দস্যু মোহন জননন্দিত একজন দস্যু। নানা উপায়ে বদমাশ বিত্তশালীদের অর্থ লুণ্ঠন করে গরিব মানুষের কাছে বিলানো ও সমাজহিতৈষী কাজকর্মে দস্যু মোহনের সংযোগ ।[কাজের ক্ষেত্রে কিছুটা দস্যু বনহুর এর কপি বলা যায় অথবা রবিন হুডের কিছুটা বাংলা সংস্করণ। সেই একই রুপ ভিন্ন ভাবে। ] তার তথাকথিত কাজের ধরন ছিল বুদ্ধিদীপ্ত ও কৌশলী।তার কাজই হল মানুষের উপকার।আর অবশ্য ই তা গরিব মানুষের জন্য। এ সিরিজের (২০৬) দুইশ ছয়টি বই প্রকাশিত হয়।

>>এক সময় খুব জনপ্রিয় এই বই এর এই জনপ্রিয়তা কে কাজে লাগিয়ে দস্যু মোহন চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়। সুদর্শন অভিনেতা প্রদীপ কুমার দস্যু মোহন চরিত্রে অভিনয় করে নন্দিত হন।

৩১।শকুন্তলা

------------

*চররিত্র:শকুন্তলা

*সৃষ্টিকারী:মহাকবি কালিদাস(ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)

*উৎস:হিন্দু পুরাণ মহাভারত

শকুন্তলা চরিত্রটির সাথে প্রথম পরিচয় ক্লাশ টেনের বাংলা বই এ। মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটক অবলম্বনে ‘শকুন্তলা’ উপাখ্যান রচিত।‘শকুন্তলা’ বিদ্যাসাগরের মৌলিক রচনা নয়।এটি প্রথম প্রকাশ- ১৮৫৪ সালে।নির্বাচিত অংশটুকু ‘শকুন্তলা’র প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম অংশ থেকে সংকলিত।

* চরিত্র :

রাজা দুষ্মন্ত- প্রধান চরিত্র। ভারতবর্ষের সম্রাট। শকুন্তলার সাথে তাঁর পরিণয় হয়।

সারথি- রাজা দুষ্মন্তের রথের সারথি

দুই তপস্বী- মহর্ষি কণ্বের আশ্রমের দুই তপস্বী ব্রাহ্মণ। রাজা দুষ্মন্তকে সোমতীর্থে যাওয়ার আমন্ত্রণ করেন।

মহর্ষি কণ্ব- শকুন্তলাকে প্রতিপালন করেন।

শকুন্তলা- প্রধান চরিত্র। শকুন্ত পাখি তাকে রক্ষা করে এবং মহর্ষি কণ্ব তাঁকে প্রতিপালন করেন। পরে রাজা দুষ্মন্তের সঙ্গে তাঁর পরিণয় হয়।

অনসূয়া- শকুন্তলার সখি

প্রিয়ংবদা- শকুন্তলার সখি

*পরিচিতি:

শকুন্তলাছিলেন হিন্দু পুরাণে বর্ণিত দুষ্মন্তের স্ত্রী ও সম্রাট ভরতের মা। তাঁর উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে মহাভারত মহাকাব্যে। কালিদাস তাঁর অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ নাটকে এই কাহিনিটি নাট্যায়িত করেন।

ঋষি কন্ব বনে শিশুকন্যাটিকে "শকুন্ত" অর্থাৎ পক্ষীপরিবৃত অবস্থায় কুড়িয়ে পান। এই কারণে তিনি এর নামকরণ করেন "শকুন্তলা"। শব্দটির অর্থ "পক্ষীর দ্বারা সুরক্ষিতা"।

ঋষি বিশ্বামিত্রের ঔরসে অপ্সরা মেনকার গর্ভে শকুন্তলার জন্ম হয়। দেবরাজ ইন্দ্র বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গ করতে মেনকাকে তাঁর নিকট প্রেরণ করেন। মেনকা তাঁর কাজে সফল হন।তাঁর রূপ ও লাবণ্যের মোহে বিশ্বামিত্র বিচলিত হন। সংযম হারিয়ে তিনি মেনকার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। দীর্ঘকাল এইভাবে যৌনসংগম করার ফলে বিশ্বামিত্রর ঔরসে মেনকা গর্ভবতী হন। উভয়ের মিলনের ফলে একটি শিশুকন্যার জন্ম হয়। তপস্যার্জিত পুণ্যফল ক্ষয়ের জন্য ক্রুদ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্র মেনকা ও তাঁর কন্যাকে পরিত্যাগ করে চলে যান। এরপর মেনকাও তাঁর শিশুকন্যাকে একটি বনে পরিত্যাগ করে চলে যান। ঋষি কন্ব সেই কন্যাটিকে পক্ষীপরিবৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন। তিনি মেয়েটির নামকরণ করেন শকুন্তলা। এরপর শকুন্তলাকে নিজ আশ্রমে এনে লালন পালন করতে থাকেন।

রাজা দুষ্মন্ত মৃগয়ায় এসে একটি হরিণকে তাড়া করতে করতে কন্বের তপোবনে এসে উপস্থিত হন। এখানেই শকুন্তলার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তাঁরা পরস্পরের প্রেমে পড়েন ও আশ্রমেই তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়।বিবাহের পরে তারা সহবাস করে। এরপর জরুরি কাজে দুষ্মন্তকে রাজধানীতে ফিরে যেতে হয়। যাওয়ার আগে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে একটি রাজকীয় অঙ্গুরীয় দিয়ে যান এবং কথা দেন যে আবার ফিরে আসবেন।

এরপর শকুন্তলা অহর্নিশি দুষ্মন্তের কথা ভাবতে লাগলেন। একদিন কোপনস্বভাব ঋষি দুর্বাসা কন্বের আশ্রমে এলে শকুন্তলা পতিচিন্তায় মগ্ন হয়ে ঋষিসেবায় অবহেলা করে। এতে দুর্বাসা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে শাপ দেন যে, যাঁর কথা চিন্তা করতে করতে শকুন্তলা ঋষিসেবায় অবহেলা করেছে, সেই শকুন্তলাকে বিস্মৃত হবে। শকুন্তলার সখীরা তাঁর হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে, দুর্বাসা শান্ত হয়ে তাঁকে ক্ষমা করেন এবং বলেন যদি সেই ব্যক্তির দেওয়া কোনো উপহারসামগ্রী শকুন্তলা তাঁকে দেখায়, তবে আবার তিনি শকুন্তলাকে চিনতে পারবেন।

এদিকে দুষ্মন্ত ফিরে আসছেন না দেখে শকুন্তলা নিজেই দুষ্মন্তের রাজধানীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে নদীতে স্নান করতে নেমে তিনি দুষ্মন্তের দেওয়া অঙ্গুরীয়টি হারিয়ে ফেলেন। এরপর অঙ্গুরীয় ছাড়াই দুষ্মন্তের রাজসভায় উপনীত হলে, দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে চিনতে পারেন না। অপমানিতা শকুন্তলা বনে চলে আসেন। সেখানে জন্ম দেন এক পুত্রসন্তানের। তাঁর নাম হয় ভরত। শৈশবেই ভরত হয়ে ওঠেন অকুতোভয় ও প্রবল পরাক্রমী। ছেলেবেলায় তাঁর খেলা ছিল সিংহকে হাঁ করিয়ে তার দাঁতকপাটি গোনা।

ইতিমধ্যে এক ধীবর মাছ ধরতে গিয়ে একটি মাছের পেট থেকে রাজার অঙ্গুরীয়টি উদ্ধার করে। সেটি দেখে দুষ্মন্তের শকুন্তলার কথা মনে পড়ে যায়। তিনি তাঁকে খুঁজতে বের হন। অনেক খুঁজে তিনি শেষে সিংহের সঙ্গে ক্রীড়ারত এক বালকের সন্ধান পান। নাম জিজ্ঞেস করতে ছেলেটি বলে সে দুষ্মন্তের পুত্র ভরত। এরপর ভরত দুষ্মন্তকে শকুন্তলার কাছে নিয়ে যায়। আবার সকলের মিলন ঘটে।

মহাভারত-এর বর্ণনা অনুযায়ী, দুষ্মন্ত লোকনিন্দার ভয়ে শকুন্তলাকে গ্রহণ করতে চাননি।আর একটি পাঠান্তর অনুযায়ী, শকুন্তলা দুষ্মন্ত কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলে মেনকা তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যান। একবার স্বর্গে একটি যুদ্ধে দেবতাদের সাহায্য করার জন্য দুষ্মন্তের ডাক পড়ে। স্বর্গে এসে তিনি দেখেন একটি ছেলে সিংহের দাঁত গুনছে। এমন সময় ছেলেটির হাত থেকে তার কবচটি খুলে যায়। দেবতারা দুষ্মন্তকে জানান যে, একমাত্র ছেলেটির পিতা বা মাতাই এই কবচটি আবার বেঁধে দিতে পারবেন। দুষ্মন্ত ছেলেটির কবচ বেঁধে দিতে সক্ষম হন। ছেলেটি হতচকিত হয়ে তাঁকে মায়ের কাছে নিয়ে যায় ও বলে যে, এই লোকটি নিজেকে তার পিতা বলে দাবি করছে। এতে শকুন্তলা ভরতকে জানান যে, সেই ব্যক্তি সত্যিই তার পিতা। এভাবে দুষ্মন্ত স্বর্গে তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে ফিরে পান এবং তাঁরা মর্ত্যে ফিরে আসেন। ভরতের বংশেই পরবর্তীকালে পাণ্ডবদের জন্ম হয়।

৩২।বনলতা সেন

------------

*প্রিয় চরিত্র: বনলতা সেন

*স্রষ্টা : জীবনানন্দ দাশ।

*উৎস:বনলতা সেন কবিতা

বাংলা কবিতার সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র কোনটি এ নিয়ে যদি ভোটিং করা হয়, বনলতা সেন বোধহয় ১-৫ এর মধ্যে নির্বাচিত হবে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় কবি জীবনানন্দ দাশের চেয়েও বনলতা সেন বেশি জনপ্রিয়। বনলতা সেন আমাদের স্বপ্ন হয়ে আসে, বনলতা সেন আমাদের গান হয়ে আসে, বনলতা সেন আমার প্রেমিকার চরিত্র হয়ে আমার কাছে ধরা দেয়। প্রেমিকের কাছে তার প্রেমিকা বনলতা, প্রেমিকার নিজের কাছে সে নিজে বনলতা। বনলতা সেন জনপ্রিয়তম বাংলা কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কবিতাটির রচয়িতা বিংশ শতাব্দীর আধুনিক বাঙ্গালী কবি জীবনানন্দ দাশ। বনলতা সেন প্রধানত রোমান্টিক গীতি কবিতা হিসেবে সমাদৃত।

আপাতঃ দৃষ্টিতে 'বনলতা সেন' একটি প্রেমের কবিতা যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বনলতা সেন নাম্নী কোন এক রমণীর স্মৃতি রোমন্থন। শুরু থেকেই পাঠকের কৌতূহল বনলতা সেন কি বাস্তবের কোন নারী নাকি সম্পূর্ণ কল্পিত একটি কাব্যচরিত্র। এ কবিতার তিনটি স্তবকের প্রতিটির শেষ চরণে বনলতা সেন নামের এক নারীর উল্লেখ আছে।

প্রথম স্তবকের শেষ চরণঃ "আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন";

দ্বিতীয় স্তবকের শেষ চরণঃ "পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন"; এবং

তৃতীয় স্তবকের শেষ চরণঃ "থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন"।

**বনলতা' কে ছিলেন?

বনলতা সেনের চুলকে তুলনা করা হয়েছে বিদিশা নগরীর আঁধারের রহস্যময়তার সাথে, মুখশ্রীকে তুলনা করা হয়েছে শ্রাবস্তী’ র কালজয়ী শিল্প উপাদান হিসেবে। বনলতা’র চোখ পাখির নীড়ের মতো আশ্রয়দাত্রী, ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়া। মধ্যযুগের শিল্প-ঐশ্বর্য্যের ধারক বিদিশা’র অমোঘ আকর্ষণের মতো তার চুলের নেশা, শ্রাবস্তীর হাজারো স্থাপত্য আর লাখো শিল্পীর সযত্ন-মনসিজ মুখচ্ছবির মতো তার রূপ। সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসাদ পেছনে ফেলে পাখি যেমন সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরে তৃপ্তি পায়, বনলতা’র চোখ তেমনি।

কবি নির্মিত এই অপার্থিব নারীর অবয়ব নির্মাণে মাটির পৃথিবীর কোন নারী রসদ জুগিয়েছে তার রহস্য অনেকেই জানতে চান। সত্যিকারের 'বনলতা কে?' তা নিয়ে নানা ধরণের মতবাদ এসেছে।

১। কেউ কেউ মনে করেন (আমি এই দলের) বনলতা সেন নামটির ভেতর তার পরিচয় লুকিয়ে আছে। নামটির দু’টি অংশ বনলতা আর সেন। বনলতা প্রকৃতি আর সেন নারী। জন্মলগ্ন থেকেই মানবজাতি নারী আর প্রকৃতির কাছেই একমাত্র শান্তি খুঁজে পেয়েছে কবির মূল বক্তব্য এটিই। এই বিষয়টি স্পষ্ট করতেই কবি এই নামটি বেছে নিয়েছেন, সমসাময়িক আধুনিক নারীর নামের সাথে সাদৃশ্য রেখে কবি তার স্বভাবজাত রোমান্টিকতার আড়াল তৈরি করেছেন মাত্র।

২। বিশিষ্ট আমলা আকবর আলী খান তার 'পরার্থপরতার অর্থনীতি' বইয়ে বনলতা সেনের 'সেন' উপাধি আর তার বাসস্থান নাটোর এই দুইয়ের সংযোগে আরেকটি ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। ইনার ব্যাখ্যাটিও যথেষ্ট কনভিন্সিং। আকবর আলী খানের মতে 'নাটোর' শব্দটির ব্যবহার শুধু বনলতা সেনের ঠিকানা নির্দিষ্ট করতে নয়, তার পেশা নির্দিষ্ট করতেও। দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা যায় এ শতাব্দীর প্রথমদিকে নাটোর কাঁচাগোল্লার জন্য নয়, বিখ্যাত ছিলো রূপোপজীবিনীদের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে। 'সেন' শব্দটি তার বংশের পরিচয় বহন করছে, পেশা গ্রহণ করবার পর 'বনলতা' নামের আড়ালে সে তার নিজের আসল নাম গোপন করেছে। ‘দু’দণ্ড শান্তি’ কথাটির মূল অর্থ আদিম অভিসার, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ প্রশ্নটি এই হাহাকার প্রকাশ করে যে, কবিতার ‘আমি’ আগে দেখা দিলে, বনলতা রূপাজীবা’র পেশাটি গ্রহণ করতেন না। দুঃসময়ে কেন পাশে ছিলেন না, এই হাহাকার বনলতার বুক জুড়ে। আর এই কবিতায় আরোপিত 'অন্ধকার' বলে দেয়, বনলতা সেন’দের আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীতে পাওয়ার সুযোগ নেই। 'অন্ধকারে মুখোমুখি বসবার' স্মৃতিটুকু সাথে নিয়ে পাখির মতোই ঘরে ফিরে যেতে হয়; যেখানে অপেক্ষা করে সাধারণ নারী’।

৩। কিছুদিন আগে জীবনানন্দের ডায়েরির প্রথম অংশ প্রকাশিত হয়েছে কলকাতায়। ভূমেন্দ্র গুহের কাছে জীবনানন্দের ডায়েরি রাখা আছে। সেই ডায়েরিতে লিটারেরি নোটস্ হিসেবে Y নামে এক মেয়ের নাম লেখা আছে। জীবনানন্দ তার নিজের হস্তাক্ষরে লিখে রেখেছেন Y=শচী; এই ‘শচী’ জীবনানন্দের গল্প ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’র শচী। ডায়েরির অন্যান্য পৃষ্ঠা বিবেচনায় ভূমেন্দ্র গুহ বলেছেন, জীবনানন্দের চাচাতো বোন শোভনার প্রতি কবি দূর্বল ছিলেন। এই শোভনাই হচ্ছেন ওয়াই বা শচী বা বনলতা সেন। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ কবি এই শোভনা মজুমদারকে উৎসর্গ করেছেন। কবি হিসেবে উপেক্ষার অনেক কঠিন সময়গুলিতে জীবনানন্দের কবিতার মুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন শোভনা, দরজা বন্ধ করে প্রায়ই কবি শোভনাকে কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। অর্থাৎ ভূমেন্দ্র গুহের বিবেচনায় বনলতা সেন নিখাদ প্রেমের কবিতা।

৪। বনলতা সেন রচনার পচাত্তর বছর পূর্তিতে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে অশোক মিত্র জানাচ্ছেন তিনি নিজে কবি জীবনানন্দ দাশকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই ‘বনলতা সেন’ কে? কবি বনলতা সেন কে এই প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব দেন নি। শুধু বলেছেন, বনলতা সেন নামটি কবি পেয়েছিলেন পত্রিকা থেকে। সে সময় নিবর্তক আইনে বনলতা সেন নামে এক একজন রাজশাহী জেলে বন্দিনী ছিলেন। সেখান থেকেই কবি এই নামটি গ্রহণ করেন। এই বনলতা সেন পরে কলকাতার কলেজে গণিতের শিক্ষকতা করতেন।

**আবির্ভাব

বনলতা সেন কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় আশ্বিন ১৩৪২/ ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে। কবিতাটি তৎকালীন ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়, সে সময় কবিতা’র সম্পাদক ছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে দেখা যায়, কবিতাটি লেখা হয়েছিলো ১৯৩৪ সনে। সিটি কলেজের সহকারী লেকচারারের চাকরি হারানো সত্ত্বেও কবি তখন কলকাতায় বাস করছেন। জীবনানন্দ রুল করা এক্সারসাইজ খাতায় লিখতেন। কবিতাটি আট নম্বর খাতার (কবি নিজেই সেই খাতাগুলোকে ১,২,৩ করে নম্বর দিয়ে রাখতেন) ২৪ তম পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এর পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে।

৩৩।।টিনটিন

------------

*প্রিয় চরিত্র: টিনটিন

*স্রষ্টা : জর্জ প্রসপার রেমি( হার্জে)

*উৎস:টিনটিন কমিক্স

বিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে আলোচিত কমিক চরিত্রের নাম মনেহয় “টিনটিন”। যে চরিত্রটি আমার কিশোরবেলার অনেকটাই আপ্লুত করে রেখেছিলেন তার দুঃসাহসিক এডভেঞ্চার দিয়ে। আমার কিশোরবেলার কল্পনার অনেক জায়গাই আমি ঘুরেছি টিনটিনকে সাথে নিয়ে।

ছোটখটো গড়নের আর অদ্ভুত চুলের ছাঁটের এ তরুণ সাংবাদিকটি তার ছোট্ট কুকুর স্নোয়িকে নিয়ে দুনিয়ার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটে বেড়ায়, এমনকি চাঁদেও অভিযান চালায়।

টিনটিন তার সব অভিযানে নিয়ে গেছে তার পোষা কুকুর, ‘স্নোয়ি’কে। স্নোয়ি একদম তার নাম এরই মত। একদলা তুষারের টুকরো। সে তার মনিবের মতই বুদ্ধিমান, লড়াকু, loyal। কিন্তু মাঝে মাঝে একটু তরল পানীয় পেলে স্নোয়ি লোভ সামলাতে পারে না। কলকাতার আনন্দ প্রকাশনী টিনটিন এর official বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে। জানি না কেন তারা অনুবাদ করার সময় স্নোয়ি এর নাম পাল্টে রাখে কুট্টুস! কি জানি হয়তো original ভাষাতে ‘স্নোয়ি’ এর নাম ‘স্নোয়ি’ না। যাক! টিনটিন এর আরেক বন্ধু, সুযোগ পেলেই মাতাল হয়ে যাওয়া সমুদ্র পাগল captain Haddock। এই চরিত্রটি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বদরাগী। সে খুব অল্পতেই রেগে যায়, আর রেগে গেলে পুরাদ্দমে অসম্ভব মজাদার সব creative গালি শুরু করে। টিনটিন কিন্তু কখনোই অতি সহজে রাগে না, কিন্তু তার হরহামেশা দেখা হয় সমাজের সবচেয়ে নীচু মানের মানুষের সাথে, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সাথে। অনেক সময় মনে হয় টিনটিন এর মনের ক্ষোভ প্রকাশিত হয় তার সহ সঙ্গীদের মাধ্যমে; কুট্টুস/স্নোয়ি, হ্যাডক আর অসম্ভব প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ক্যালকুলাসমাধ্যমে।

আমরা বেশীর ভাগ পাঠক ১৯৩৪ পরবর্তী তরুন টিনটিন এর সাথে পরিচিত, যার পেশা হচ্ছে সাংবাদিকতা, সে একজন সৎ, মার্জিত এবং কর্মঠ টগবগে তরুণ যার রক্তে আছে অজানাকে জয় করার প্রবল ইচ্ছা। কিন্তু, ১৯৩৪ এর আগের টিনটিন লেখা হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। বালক টিনটিন চরিত্রটি ছিল একটি হাতিয়ার মাত্র, যা ব্যবহার করা হয়েছিল বেলজিয়ান শিশুদের কমিকস্ এর নামে ডানপন্থি সোস্যাল ক্যাথলিক রাজনীতির সাথে পরিচয় করাতে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর হার্জ এর চিন্তাধারা তুমুলভাবে পরিবর্তিত হয় এবং এর প্রভাব পড়ে তরুণ টিনটিনের পরবর্তী সবকটি ভ্রমন কাহিনীতে। টিনটিন শক্তের শক্ত, নরমের নরম। টিনটিন কোন কিছুর পরোয়া না করে দুর্বলের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।আমাদের নিজেদের সমাজেই আমরা প্রতিনিয়ত এরকম অনাচার দেখি। টিনটিন আমাকে শিখিয়েছে কখনো দুর্বলের উপর অন্যায় করতে নেই।

টিনটিন কমিকস সিরিজ যে অনবদ্য বৈশিষ্ট্যের কারণে পাঠকমহলে জনপ্রিয় তার মধ্য উল্লেখযোগ্য হল--

*গল্পের ঘটনার চমকপ্রদতা

*অদ্ভুত রসবোধ

*অসম্ভব ডিটেইলস ড্রয়িং

*সমসাময়িক ঘটনার নিঁখুত বর্ণনা

*সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের গল্প ইত্যাদি।

এই সিরিজের প্লটকে একাধিক বর্গের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। যেমন: ফ্যান্টাসির উপাদানসহ ডাকাবুকো অ্যাডভেঞ্চার গল্প, রহস্য, রাজনৈতিক থ্রিলার, কল্পবিজ্ঞান, ইত্যাদি।

৩৪।ঝান্ডুদাঃ

------------

*প্রিয় চরিত্র: ঝান্ডুদা

*স্রষ্টা : সৈয়দ মুজতবা আলীর

উতস:রসগোল্লা

স্কুলে থাকতে সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি লেখা পড়েছিলাম। নাম রসগোল্লা। গল্পের বিষয়বস্তু ইউরোপীয় এক এয়ারপোর্টের কাস্টম পুলিশের রসগোল্লা চিনতে না পারা এবং গল্পের নায়ক ঝান্ডুদার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও ব্যপক রসবোধর মাধ্যমে মধ্যবিত্ত বাঙালির রগচটা মেজাজটাই ফুটে উঠেছে গল্পে। ঝান্ডুদা সারাজীবনের জন্য আমার মগজে গেঁথে গিয়েছিলেলে বিশেষ করে তাঁর চামড়ার ব্যাগটার কারণে। সেটায় নানান দেশের, নানান এয়ারপোর্টের আগমন ও বহির্গমনের টিকেট সাঁটা যে তাকে হঠাত ইয়ারপোটে দেখলে বুঝা মুশকিল যে তিনি বিদেশ থেকে এলেন না বিদেশে যাচ্ছেন।( সৈয়দ মুজতবা আলী ঝান্ডুদাকে বর্ণনা করেছেন ----তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি দেশে ফিরছেন না দেশের বাইরে যাচ্ছেন।) মাঝে মাঝে আমার --সৈয়দ মুজতবা আলীকেই মনে হত ঝান্ডুদা। আর তাকেই কল্পনা করতাম রসিক ঝান্ডুদা হিসেবে।

ঝান্ডু দা, ইতালির ভেনিস বন্দরে নেমেছেন জাহাজ থেকে। হলুদ কাগজে ব্যবসায়ী ঝান্ডুদা বাক্সপেঁটরার যাবতীয় বিবরণ দেয়ার পর শেষে লিখলেন ‘এক টিন ভাকুয়াম পাকড ভারতীয় মিষ্টান্ন। মূল্য দশ টাকা।’ বন্দরে পদার্পণের কিছু সময়ের মধ্যেই কয়েক বোতল ‘কিয়ান্তি’ পরিচিত, অপরিচিত তথা চুঙ্গিঘরের সেপাই, চাপরাশি, কুলি, সবার মাঝে বিতরণ শেষ। লেখকের কথায়— ইতালির কিয়ান্তি বড়ই সরেস এবং সরস। গোল বাধালো চুঙ্গিওয়ালা। ঝান্ডুদাকে খুলতে বলল রসগোল্লার টিন। ঝান্ডুদা যতই বলে এতে ইন্ডিয়ান সুইটস, চুঙ্গিওয়ালার গোঁ ততই বেড়ে যায়। শেষটায় ঝান্ডুদাকে কাটতেই হয় টিন। সবার মাঝে বিতরণ করলেন রসগোল্লা। মেজাজ টঙে চড়িয়ে চুঙ্গিওয়ালাকেও সাধলেন। রসগোল্লা চুঙ্গিওয়ালার মুখের কাছে এগিয়ে নিলেই সে ঘাড়টা আরো পিছিয়ে নেয়। বাঁধ ভাঙে ধৈর্যের। একসময় ঝান্ডুদা সরেস ভুঁড়িখানা কাউন্টারে চেপে বাঁ হাতে চুঙ্গিওয়ালার কলার ধরে ডান হাতে এতটা রসগোল্লা থেবড়ে দিলেন ওর নাকের ওপর। সঙ্গে মোটা গলার অনুযোগ— ‘শালা, তুমি খাবে না! তোমার গুষ্টি খাবে। ব্যাটা, তুমি মস্করা পেয়েছ! পই পই করে বললুম, রসগোল্লাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে...।’ এতে মিষ্টি বিতরণের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বভাবজাত আন্তরিকতার ছবির সঙ্গে অলাপেতেই মেজাজ হারানোর গল্প ফুটে উঠেছে।

চুঙ্গীওয়ালার কল্যাণেই রসগোল্লার স্বাদ নিতে পেরেছেন বড় কর্তা। কিন্তু আফসোসের বিষয়, চুঙ্গীওয়ালাই সেই সরেস খাবার থেকে বঞ্চিত। বড় কর্তা তাকে বলছেন, ‘তুমি ত একটা আস্ত গাড়ল। টিন খুললে আর ওই সরেস মাল চেখে দেখলে না?’

এখনও বাড়িতে গেলে বাবার প্রিয় রসগোল্লা কিনে রসগোল্লা হাতে নিলেই মনে হয় আড়াই মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকি। তারপর চোখ বন্ধ করে আবার হাত বাড়াই আর একটির জন্য -- এটি মনে মনে প্রিয় ঝান্ডু দার জন্য ভালবাসা। সেই মুজতবা আলীর উত্তরসুরী হিসাবে আমরা একটু রস নিতেই পারি। আর গাইতেই পারি ----

---ইতালির প্রখ্যাত মহিলা-কবি ফিলিকাজা গেয়েছেন,

‘ইতালি, ইতালি, এত রূপ তুমি কেন ধরেছিলে, হায়!

অনন্ত ক্লেশ লেখা ও-ললাটে নিরাশার কালিমায়।’

রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে, হায়!

ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়!

৩৫। বৃদ্ধ দাদা

------------

*প্রিয় চরিত্র: বৃদ্ধ দাদা

*স্রষ্টা : পল্লী কবি জসীমউদ্দীন

*উৎস: কবর কবিতা

জীবনে যে কবিতাটি না পড়লে প্রত্যেক পাঠকদের জীবনে একটি আধুরা অধ্যায় থেকে যাবে তা হল পল্লী কবি জসীমউদ্দীন এর কবর কবিতা।

এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,

তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,

পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।

এই কবিতা প্রথম যেদিন পড়েছিলাম সেদিন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি, পরে যতবার পড়েছি ততবারি চোখের কোনে জলের আনাগোনা সব সময়ি হয়েছে। আর এতটা আবেগ আর কোন কবিতা পড়ে এসেছে বলে মনে আসছে না।

*কবি জসীমউদ্দীনের কলমের আঁচরে পল্লির জীবন-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কিংবদন্তি লাভ করে নবতর মাত্রা। পল্লির প্রকৃতি তাঁর কাব্যে নান্দনিক ও ঐশ্বর্যময় হয়ে ওঠে আধুনিক সৌন্দর্যচেতনার সংমিশ্রণে। গ্রাম-বাংলার চিরচেনা প্রকৃতি হয়ে ওঠে তাঁর উপমা-রূপক-প্রতীক ও চিত্রকল্প সৃজনের হাতিয়ার। আর এসব বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে ধৃত হয় তাঁর কবিখ্যাতি আনয়নকারী 'কবর' কবিতাটিতেই। শুধু 'কবর'নয়, এ ধারা অব্যাহত থাকে তাঁর পরবর্তী সকল সৃষ্টিকর্মের মধ্যে। সাহিত্যসাধনায় নিবেদিতপ্রাণ পল্লিদরদী এ কবি হাজার নদীর স্রোতধারায় বিধৌত রূপসী বাংলার রূপস্পর্শে অভিভূত হয়ে পল্লিপ্রকৃতির রূপ-মার্ধুয আকণ্ঠ পান করে ঘুরে-ফিরে বিচরণ করেছেন পল্লির মাঠে,ঘাটে ও প্রান্তরে। তাই বাইরের চাকচিক্যপূর্ণ নানা অনুকৃতির প্রাণহীন খেলার মধ্যে দিবস-যামিনী বুঁদ হয়ে থাকা ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় বন্দি শহুরে মানুষ আজও পল্লিকবির সুর ও ছন্দে ভেসে চলে কৃত্রিমতার জীবন ছেড়ে দূর-দূরান্তে,পল্লির পর্ণকুটিরে।

*বাস্তব জীবন অভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিকের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি ও হূদয়ানুভূতির সার্থক সমাবেশে 'কবর' কবিতাটি দুর্লভ শিল্পসার্থকতার অধিকারী। পল্লি বৃদ্ধের দুঃসাহস বেদনার চিত্র যেন সকল পল্লিবাসীরই দুঃখ বেদনার আন্তরিক ও প্রতিনিধি স্থানীয় চিত্র। বৃদ্ধের মুখে সকল পল্লিবাসীর যুগ-যুগান্তের পুঞ্জিভূত শোক-বেদনায় যেন ভাষা পেয়েছে 'কবর' কবিতায়। ব্যক্তিগত সুখ এখানে সার্বিক শোক-চেতনায় রূপান্তরিত হযেছে। বাংলা কাব্যে সাধারণ মানুষের জীবনের দুঃখ-বেদনার এমন মহিমাময় শিল্পসম্মত প্রকাশ আর দেখা যায় না। তাই তো অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত 'কবর' কবিতাকে বাংলা কবিতার নতুন দিগদর্শন বলে চিহ্নিত করে এর অনন্য সৃষ্টি-মহিমারই স্বীকৃতি জানিয়েছেন।

>>'কবর' কবিতায় বৃদ্ধের জীবন-বাস্তবের রূপকে আমরা দেখতে পাই সাংসারিক স্নেহ-প্রেমের নিয়তি-নিহত আরক্তিম মূর্তি। তার অপরাধ সংসারে সে স্নেহ-ভালোবাসার নীড় বেঁধে সুখী হতে চেয়েছিল। স্নেহনীড় সে বেঁধেছিল, সুখের স্পর্শও সে পেয়েছিল। কিন্তু সে সৌভাগ্যের বিদ্যুত্-চমকের পেছেনেই চরম দুঃখের বজ্রাঘাত নেমে এসেছিল তার জীবনে। তারই চোখের সামনে একের পর এক মৃত্যুর হাত ধরে বিদায় নিয়েছে তার প্রেমময়ী স্ত্রী, উপযুক্ত পুত্র, লক্ষ্মী পুত্রবধূ, আদরের নাতনি এবং স্নেহের পুত্তলী মেয়ে। শুধু তাকে স্নেহস্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যেই বোধহয় বেঁচে রইল বংশের একমাত্র প্রদীপ নাতিটি। তার স্নেহের নীড় ভেঙে গেল, জীবন হয়ে উঠলো দুঃস্বপ্নময়। চারদিকে দেখা দিল মরুর ঊষরতা। এক দুঃসহ বেদনায় তার অস্তিত্বকে বহন করে সে বেঁচে রইল। দিনরাত মৃত্যু কামনা তার সকল ভাবনার সার হরয় দাঁড়ালো।

বিষয়: বিবিধ

৫২২৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

352114
৩০ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:০৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার পোষ্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। তবে বেশি বড় হযে গেছে কয়েকটি পর্বে দিলে ভাল হতো। আপনার প্রিয় চরিত্রগুলির সাথে আমার প্রিয় চরিত্রগুলিরও বেশ মিল আছে। কয়েকটি পর্বে দিলে আরো বিস্তারিত ও আকর্ষনিয় আলোচনা সম্ভব হতো মনে হয়।
৩০ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০২:২০
292345
গোলাম মাওলা লিখেছেন : আসলে ফেসবুকে লিখা গুলি কয়েক পর্বে দিয়েছিলাম। আর সেগুলি এক জায়গায় রাখার জন্য আর ল্যাপটপে লিখা গুলি হারিয়ে যাচ্ছিল। তাই একেবারে আধা দিয়ে দিলাম

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File