তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যতবাণী ( পাঠ এক)
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২৯ নভেম্বর, ২০১৫, ১১:২৭:৩৩ সকাল
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যতবাণী ( পাঠ এক)
-------------------------------------------------------
>>কে এই নাস্ত্রাদামুসঃ
তাকে বলা হয় প্রহেলিকা। আর এর কারণ তার চতুষ্পপদী কাব্যিক ভবিষ্যতবাণী। যদিও প্রায় ৪৫০ বছর আগে মারা গিয়েছিলেন নাস্ত্রাদামুস, তবুও তার দ্রষ্টা সুলভ বিচারশক্তি আর তাঁর সেই অতীন্দ্রীয় ক্ষমতালব্ধ ইতিহাস বিচার তাকে তাঁর সমদশীদের মধ্যে প্রথম আসনে অভিষিক্ত করেছে । সভ্যতার ইতিহাসে নপত্রাদামুস হয়ে উঠেছিলেন যুগে যুগে আবির্ভুত ভবিষ্যত দ্রষ্টাদের মধ্যে এক অসামান্য অতিমানব আর আধ্যাত্মিক শক্তির আধার দ্রষ্টা ।
গবেষকরা একমত নাস্ত্রাদামুস এক আলৌকিক শক্তির অধিকারী, অন্যের কাছে যা অসাধ্য তা তিনি সময়ের আগেই স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন। তা না হলে কেমন করে ১৫৫৫ খ্রীস্টাব্দে (চতুষ্পপদী ‘Les Vrayes Century”) করা তার ভবিষ্যতবাণী পরে এমোন করে নির্ভুল প্রমানিত হয়?
নেপোলিয়ান-মুসোলিনি-হিটলারের উত্থান পতন, কেনেডী ,মাটি’ন লথার কিং হত্যা, ভিয়েতনাম সমস্যা, ওয়াটার গেট কেলেণ্ডকারী, ইন্দিরা-রাজীব গান্ধীর মৃত্যু, রাশিয়া-চীন-পূর্ব-- ইয়োরোপের অশান্তি, সোভিয়েত রাশিয়া-পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলিতে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান, দুই জামনিীর মিলন, উপসাগরীয় যুদ্ধ ইত্যাদি আরো অসংখ্য রোমাঞ্চকর আগাম ঘটনা সম্পকে দ্রষ্টার ভবিষ্যতবাণী নির্ভুল প্রমাণিত হয়েছে ।
ফ্রান্সের প্রভাস প্রদেশের সেন্ট রেমিতে ১৫০৩ খ্রীস্টাব্দে মিশেল দ্য নতরদামের (নাস্ত্রাদামুস) জন্ম হয় । তিনি বেড়ে উঠেছিলেন একজন ক্যাথকিক হিসেবে, যদিও তাঁর জন্ম হয়েছিল এক ইহুদী বংশে । বুদ্ধদীপ্ত, মেধাবী আর অনুসন্ধিৎসু নাস্ত্রাদামুস প্রকৃতি বিজ্ঞান, জ্যোতিবিদ্যা, দর্শন আর শরীরতত্ত্ব সম্বন্ধে গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা করতে চাইতেন—শেষের বিষয়টি তাকে এমনই অভিভূত করে বসে যে তিনি মস্তপেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাথী হয়ে ১৫২১ খ্রীস্টাব্দে ভেষজের চিকিৎসক হিসেবে স্নাতক হন। খুব অল্প দিনের মধ্যেই নাস্ত্রাদামুসের নাম সারা ফ্রান্সে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে ভয়ঙ্কর প্লেগ মহামারীতে যারা আক্ৰান্ত হয় তাদের চিকিৎসায় সাফল্যলাভের জন্য । তাছাড়াও অন্যান্য জীবিত রোগীর চিকিৎসার জন্যও ।
>> কেমন করে?
ইতিহাসের আগাম ছবি আর ঘটনার বিষয় নাস্ত্রাদামুস কেমন করে জানতে পারবেন?
এ সম্পকে নানা মত আছে, তবে নাস্ত্রাদামুস নিজে কখনও তাঁর পদ্ধতির বিষয় গোপন করেন নি । তার আমলে তখন জ্যোতিষ বিদ্যার প্রচলন প্রায় তুঙ্গে উঠেছিল, আর তিনি যখন তার সেই ভবিষ্যতবাণী পণ চতুষ্পপদী ‘Les Vrayes Century”—সত্য শতক ১৫৫৫ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশ করেন তখন সকলেরই বিশ্বাস জন্মায় তিনি ভবিষ্যতের ওই সব ঘটনার পূর্বাভাষ পেয়েছেন নক্ষত্র বিচার করে, ঠিক যেভাবে প্রাচীন কালের আসীরীয়ান আর ব্যাবলনীয়ান জ্যোতিষীরা তাদের ভবিষ্যত দর্শনের "বিজ্ঞানকে" কাজে লাগাতেন ।
*নাস্ত্রাদামুস কখনই অস্বীকার করেন নি যে বাস্তবিক ওই পদ্ধতির মধ্য দিয়েই তিনি তার কাজ করতেন, তবে অন্য পদ্ধতি কাজে লাগানোর কথাও তিনি বাতিল করেন নি। একথা আমরা অবশ্য জানি নাস্ত্রাদামুস নিস্তরঙ্গ একপাত্র জল পিতলের তেপায়ার উপর রাখার পর এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে বহু দুরাগত দৃশ্যের অস্তিত্ব টের পেতেন । ঠিক যেমন ভাবে জিপসি ভাগ্যগণকরা স্ফটিকের তৈরি বলের মধ্যে তাকিয়ে তাদের ভবিষ্যতবাণী করত ।
তার বেশির ভাগ ভবিষ্যতবাণী এই পথেই নাস্ত্রাদামুসের অন্তর ধরা পড়ত বা অন্য কোন অনুভূতির মাধ্যমে জন্ম নিত, না , কি তিনি সাহায্য নিতেন জাদুবিদ্যা, তাস বা আর কোন ডাকিনী বিদ্যার—সেকথা জানার কণামার সম্ভাবনাই নেই। তবে তা যেই পদ্ধতিই হোক না কেন-- আমরা এই উপসংহারে পৌছতে পারি যে নাস্ত্রাদামুসের মধ্যে জমে থাকা সেই জ্ঞানের নিয়ত প্রবাহ এতটাই ইতিহাসের গতি প্রবাহ সম্পকে ওয়াকিবহাল ছিল যে এরই সঙ্গে তিনি ভবিষ্যতের প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনাকে নিয়ন্ত্রিত বা অন্ততঃ পক্ষে প্রভাবিত করতে পারতেন । সেই প্রবাহ বা শক্তির আধার কি, আর তাঁর ওই ক্ষমতার পেছনে কে থাকতে পারেন একথা নাস্ত্রাদামুস কোন দিনই প্রকাশ করেননি । এটা এমন হওয়াও অসম্ভব হয়তো নয় যে নাস্ত্রাদামুস নিজেও বাস্তবিকই হয়তো এটা জানতেন না বা অজ্ঞ ছিলেন । যে রহস্যময় শক্তি তার ওই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করত বা ভবিষাতের ওই সব ঘটনা যার অঙ্গুলি হেলনে ঘটে চলত আর তাকে পথ দেখাতে চাইতো তিনি তার অস্তিত্ব সম্পকে অবহিত ছিলেন না । এক হিসেবে বলতে গেলে নাস্ত্রাদামুস মধ্যে এক স্বজ্ঞাত ক্ষমতার স্ফুরণ ঘটতে চাইত যা আজকের বহ দ্রষ্টার মতই যে নয় সেকথা বলা যায় না ।
*জানা যায় নাস্ত্রাদামুস যখন এক অল্প বয়সের যুবক, তখন তিনি ইতালী ভ্রমণ করছিলেন । সেই সময় একদিন তিনি জনৈক সাধকে দেখে তার সামনে হঠাৎ নতজানু হয়ে বলে উঠেছিলেন, পবিত্রতার প্রতিমূত্তি আপনার সামনে আমি আজ নতজানু । ওই সাধকের নাম ছিল ফেলিস পেরেতি । বহু মানুষই ওই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সেদিন । এর বেশ কিছুকাল পরে ওই শতাব্দীতেই ১৫৮৫ খ্রীস্টাব্দে ওই সাধু জ্ঞানী বয়স্ক অবস্থায় হয়েছিলেন পোপ পঞ্চম সিক্সটাস ।
* নাস্ত্রাদামুস এক ভয়ঙ্কর নেশায় মেতে উঠেছিলেন, আর এটা তার নিজেরও জানা ছিল । তার জীবনকালে সারা দেশে ছিল শুধু কুসংস্কারের অন্ধকার আর জ্যোতিষের বিধি নিষেধের বেড়াজাল । শুধু তাই না সে সময়টা ছিল ধমীয় উন্মাদনা আর বিচারের কাল, যে কালে লক্ষলক্ষ মানুষকে আগুনে জীবন্ত দগ্ধ করে হত্যা করা হত বা শূলে চড়িয়ে মারা হত, শুধু মাত্র ঐ জন্যই যে তাবা প্রচলিত ধমৰ্শমতের বিরোধী বা ডাইনি বিদ্যার চর্চা করেছিলেন। এরই সঙ্গে প্রতারক যাজকরা যেসব ঘটনা কোন ভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হতেন তাকেই অতিপ্রাকৃত বলে জাহির করতেন তারা । এই ধরনের অভিযোগ এড়ানোর জন্যই নাস্ত্রাদামুস তার ভবিষ্যতবাণী সংক্রান্ত তারিখ আর ঘটন সংক্রান্ত সব কিছুই কি ইচ্ছাকৃতভাবে হেয়ালিময় করে রেখেছিলেন, আর সেগুলো তিনি রচনা করেছিলেন সত্যিকার হতবুদ্ধিকর প্রতীক চিহ্ন দিয়ে । তার এইসব প্রতীক তিনি বেছে নিয়ে ছিলেন প্রাচীন ফরাসী, শব্দ বিন্যাস, লাতিন ও অন্যান্য সাহিত্য সম্পকিত পথে যাতে ধমীয় বিচারের অনুসন্ধানীদের বোকা বানানো চলে—যদি কখনও কোন ভাবে তারা তাকে অভিযুক্ত করার সুযোগ পেয়ে যায় ।
* নাস্ত্রাদামুস তাঁর ওই ভবিষ্যতবাণীর মূল রহস্য কারো কাছে প্রকাশ করেননি । যদি তা করেও থাকেন তিনি তাহলেও সেই রহস্যের চাবি শতাব্দীর ধুলিকণায় কোথাও চাপা পড়ে গেছে । এই রকম কোন চাবির সাহায্য পাওয়া যাইনি বলেই নাস্ত্রাদামুসের অসংখ্য চতুষ্পপদীর মধ্যে আবদ্ধ ভবিষ্যতবাণীর নানা ধরণের বিচিত্র ধারা আর ব্যাখ্যা ছড়িয়ে পড়েছে। তবুও একথা অনস্বীকার্য যে এই চাবিকাঠি না থাকলেও নাস্ত্রাদামুসের বহু ভবিষ্যতবাণী সত্যের এতটাই কাছাকাছি যে তার যে খ্যাতি ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ ভবিষ্যত দ্রষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তা আজও স্মপূর্ন অম্লান আর চিরস্মরণীয় । যদিও নাস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যতবাণী—প্রথম শত চতুঃপদীসহ গ্রন্থ প্রায় ১৫৫৫ খ্রীস্টাবেদ প্রকাশিত। তিনি ভবিষ্যতবাণী করতে আরম্ভ করেছিলেন এরও আগে সেই ১৫৪৭ খ্রীস্টাব্দ থেকে। তার করা আশ্চয় কিছু ভবিষ্যতবাণী নির্ভুল প্রমাণিত হলে ক্যাথরিন দ্য মেদিসি তার প্রতি আকৃটি হয়ে তাকে প্রাসাদে ডেকে পাঠিয়ে—ছিলেন। সেই সময়েই নবম চার্লস তাঁকে তাঁর সাধারণ চিকিৎসক নিযুক্ত করেন । যাই হোক, একজন চিকিৎসক হিসেবে নাস্ত্রাদামুসের খ্যাতি প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল মহামারী নির্মম হাত থেকে তিনি যখন নিজের পরিবারকেও রক্ষা করতে ব্যর্থ হন । তবে একজন মহাশক্তিধর দ্রষ্টা হিসেবে নাস্ত্রাদামুসের খ্যাতি প্রায় দিগন্ত স্পর্শ করেছিল ।
*ভবিষ্যত দর্শন করে চতুষ্পপদীর মধ্য দিয়ে তাঁর দৃষ্টির লব্ধ সব কিছু ধরে রাখার উদ্দেশ্যে নাস্ত্রাদামুস প্রায় ১ooo হাজার চার-পংক্তির কবিতা রচনা শর: করেন । প্রতিটি চতুষ্পপদীর মধ্যে বিধত/নিহিত ছিল ভবিষ্যতের কোন ঘটনার নির্দিটি ভবিষ্যতবাণী, আর তা লুকনো ছিল কিছু প্রতীকীর আড়ালে ।
শতাব্দীর সেরা প্রহেলিকা’–মানুষ নাস্ত্রাদামুস —কখনই তিনি প্রচলিত ধারণার বাইরে যাননি, আর গত ৪৫০ বছরে অসংখ্য গবেষক আর সমালোচক অন্ততঃ শ'খানেক বইতে তার চতুষ্পপদীর অর্থ ব্যাখ্যা করার কাজে গলদঘর্ম হয়েছেন । তাদের উদ্দেশ্য একটাই নাস্ত্রাদামুস প্রহেলিকার অর্থ বের করা । বড় কঠিন সেই কাজ— ব্যাখ্যার মধ্যে তাই দেখা দিতে চাইতো কিছু কিছু অসংলগ্ন অমিল—তা সত্ত্বেও যুক্তি সক্ষমতা কিছু বক্তব্য বা দায়িত্বশীল কিছু কিছু কাহিনীর অস্তিত্ব এর মধ্য থেকে আবিষ্কার অসম্ভব হতে পারত না, কারণ হিসেবে যদি অনুভব করা যায়--- সে আমলে ধর্ম বিচারের যে অশুভ ইঙ্গিত তাকে অহরহ বিপদের সংকেত জানাতে চাইত।
----------------------------ক্রমশ
বিষয়: বিবিধ
২১১৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন