বই এর যত্ন নিয়ে একটু খানি
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২৮ নভেম্বর, ২০১৫, ০৯:৪৩:৩১ সকাল
বই এর যত্ন নিয়ে একটু খানি
-----------------------------
প্রথমে বই বিষয়ে মনিষীর ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি উক্তি খুব মনে দাগ কাটে। তিনি বলেছিলেন---- “জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই”।
আর রবী বাবু তো আর এক কড়ি সরেষ, তিনি বলেছিলেন--- “বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেয়া সাঁকো” ।
তাই বই সবার জীবনে কমবেশি প্রয়োজনীয় উপকরণ বা অনুষঙ্গ। কেও কম কেও বেশি এই বই নিয়ে মাতামাতি সেই অতীত হতে বর্তমানে চলছে ভবিষ্যতেও চলবে, তা নিয়ে অ কথা বলার সুযোগ নাই।
ফেসবুকে বই গ্রুপ গুলিতে বা তার বাহিরে আমার জানা শুনা বা অচেনা অনেক বই প্রেমিক আছে। তাদের অনেকের কাছে কম হোক বা বেশি হোক বাড়িতে বই এর সংগ্রহ আছে সবারই। সেটা নিয়ে আমরা নিজেরা গর্ব বোধ করি, অনেক সময় মানুষকে সংগ্রহের পরিমান দেখিয়ে অহংকার করি। তার প্রমান মাঝে মাঝেই বই গ্রুপ গুলিতে নিজেদের সংগ্রহ করা বই এর ছবি দিয়ে অন্যের বুকের জ্বালা অন্তত একটু হলেও বাড়িয়ে দেই ( আমি অন্তত প্রতিনিয়ত তা করি, যেন নতুন বই এর সাথে পাঠকদের পরিচয় হয়- এটিই আসল উদ্দেশ্য) ।
এই যে বই নিয়ে পড়ুয়া মানুষগুলির বই নিয়ে এত ব্যস্থতা, এত গর্ব আর অহংকার- সেই বই এর সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে একটু অসাবধানতার জন্য।আর তাই আপনাদের জন্য এই লিখা। এর উদ্দেশ্য কেমন করে ভাল রাখবেন আপনার বই।
**প্রথম ধাপ কি কি কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে আপনার বই। তাই আসুন দেখে নিই নাম্বার ওয়ান-ক্ষতিকর বিষয়ঃ
>পোকায় কাটা জনিত ক্ষতি
>ধুলিবালি পড়া জনিত ক্ষতি
>আদ্রতা জনিত ক্ষতি
>পড়ার সময় ছিড়ে যাওয়া জনিত ক্ষতি
>তরল কোন কিছুর স্পর্শ জনিত ক্ষতি ( পাতা উল্টানোর জন্য থুতু বা অন্য কোন ভাবে)
>ফুল বা অন্য কিছু বই এর ভিতরে রাখা জনিত ক্ষতি
> বুক মার্কার ব্যবহার না করে পাতা মোড়ানো জনিত ক্ষতি
>কলম বা পেন্সিল দিয়ে লাইন দাগানো জনিত ক্ষতি
>নিজ প্রয়োজনে বই এর পাতা ছিড়া জনিত ক্ষতি
ক্ষতিগুলি তো দেখলাম। এর বাহিরেও আরও অনেক উপায়ে বই এর ক্ষতি হতে পারে।
**এবার আমরা দেখব এই সব ক্ষতি হতে সাবধান হবার উপায়ঃ
বই পড়ার সময় আমরা নূন্যতম এই কথাটা অন্তত জদি মাথায় রাখি—“আমি পড়ার পর বইটা অন্য কেও পড়বে”। এই কথা মাথায় রেখে একটু যত্ন নিয়ে পড়লে, একটু সচেতন হলে, একটু কষ্ট করলে এই গর্বের ধনগুলোকে দীর্ঘদিন অক্ষত রাখা সম্ভব।আর এ জন্য নিচের কথাগুলি একটু মাথায় রাখুন-----
--- বই এর সংগ্রহ কোথাও স্তুপ করে বা এলোমেলো করে না রেখে কোন এক জায়গায় সাজিয়ে রাখুন। সেরা পদ্ধতি হলো বুক শেলফ।বুক শেলফের মাপ অনুযায়ী বই রাখুন। গাদাগাদি করে রাখবেন না। বই রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো খাড়া করে পাশাপাশি রাখা । পাশাপাশি রাখা বইগুলো যেন একই দৈর্ঘ্যের হয়। একটি বড় বইয়ের সঙ্গে ছোট দৈর্ঘ্যের বই রাখলে বইয়ের শিরদাঁড়ায় অতিরিক্ত চাপ পড়ে। বই চাপাচাপি করে যেমন রাখবেন না, তেমনি ঢিলেঢালাভাবেও রাখবেন না। একটার উপর আরেকটি ঠেস দিয়ে রাখলে বইয়ের শিরদাঁড়ায় চাপ পড়ে। ফলে বই সহজে খুলে যায়।যদি একটি বইয়ের উপর আরেকটি রাখতেই হয় তবে কম ওজনের বইটি উপরে রাখুন। তবে নির্দিষ্ট সময়ের পর উপরের বইটি অন্য কোনো বইয়ের উপর রাখুন।আর বই আলোবাতাস যুক্ত শুকনো স্থানে রাখতে হবে।
---শেলফ থেকে বই নামানোর সময় পুরো বই ধরে নামান। শুধু ওপরের অংশ ধরে টানলে বই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।শেলফ থেকে বই নিলে পড়া শেষে শেলফের ঠিক জায়গায় রাখুন।এতে পরে অন্যের ঐ বই খুজে পেতে সহজ হ্যবে।
---দুর্লভ বইগুলো লেমিনেট বা বাঁধাই করে রাখতে পারেন বা তার পিডিএফ করে রাখুন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
---বই পড়ার সময় আমরা অনেক সময় নিজেদের সুবিধামতো কলম বা পেনসিলে দাগ দিয়ে থাকি বা কোনও বিষয়ে নোট নেওয়ার সময় বইয়ে আন্ডারলাইন করার প্রয়োজনে হালকাভাবে পেনসিল ব্যবহার করুন।ব্যক্তিগত বই না হলে এই বই পড়তে অন্যের সমস্যা হয়। তাই খুব প্রয়োজন না হলে দাগ কাটা থেকে বিরত থাকতে হবে।
----খেতে খেতে বই না পড়াই ভালো। পড়ার সময় খাওয়ার বা পানীয় থেকে বই দুরে রাখুন। তা না হলে এতে করে খাবারের দাগ বইয়ে লেগে বই নোংরা হয়ে যাওয়ার সঙ্গে বইয়ে পোকামাকড় আক্রমণের আশঙ্কা থাকে। খেতে পড়তে গেলে সামান্য অসর্তকতায় আপনার প্রিয় বইটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
---বই এর পাতা ভাঁজ / মুড়ে মার্ক করার অভ্যাস থেকে বিরত থাকুন। এতে পাতা নষ্ট হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। বুক মার্কার ব্যবহার করুন, ছোট্ট কাগজ বা অব্যবহৃত ভিজিটিং কার্ড বেস্ট বুক মার্কার বলে পরিচিত ( বই গ্রুপ গুলিতে অনেকে তার বা কাগজ দিয়ে সুন্দর সুন্দর নানা আকারের বুকমার্ক তৈরি করে পোষ্ট দেন, তাদের হেল্প নিতে পারেন) অনেকে বই এর পাতার নম্বর মনে রাখতে চেষ্টা করেন। এটাও বেশ কাজের। আবার একই সাথে স্মৃতিশক্তি নিয়ে একটু চর্চা করে নেয়া গেল!
---বই ভাঁজ করে পড়ার অভ্যাস বইকে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে।তাই বই ভাঁজ করে ভেঙে পড়বেন না, সোজা করে বই পড়লে তা বেশিদিন টেকশই হয়। বিশেষ করে পেপারব্যাক বই পড়ার সময় আমরা এই কাজটা করি। ম্যগাজিন বা সাময়িকীর ক্ষেত্রে এটা তেমন একটা ক্ষতিকারক বলে বিবেচিত হয় না, কারন সেগুলো আমরা সাধারনত সংরক্ষণ করি না। তবে বই এর বিষয়ে এটা অবশ্যই খেয়াল করা উচিত।
--- বইয়ের পাতা ওল্টানোর সময় অনেকে থুতু ব্যবহার করেন। এটা অস্বাস্থ্যকর। এতে করে বই এর পাতায় থুতু লাগা জায়গা নরম হয়ে নষ্ট হয পড়ে। তাই থুতু বা অন্য কোন পানি জাতীয় কোন কিছু আঙ্গুলে না লাগিয়ে পাতা ওল্টানোর অভ্যাস করুন।
--- বই রাখার ঘরের আর্দ্রতার ব্যপারে সব সময় সচেতন থাকুন।স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে বই রাখবেন না। স্যাঁতসেঁতে ভিজে আর্দ্রতা আপনার বই এর কাগজকে ধীরে ধীরে নরম করে তুলবে। বই এক সময় নিজে থেকেই নষ্ট হয়ে যাবে। শুকনো জায়গায় বই রাখুন, মাঝেমাঝে, সম্ভব হলে বছরে এক বা দুইবার বই বার করে সকালের রোদে এক দু ঘন্টা রেখে দিন। এটা বইতে আর্দ্রতার পরিমান কমাবে, বই এর আয়ু বাড়াবে।
--- পড়ার সময় বইয়ের পাতা কখনোই তাড়াহুড়া করে ওল্টানো উচিত নয়। এতে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে যেতে পারে।
---অনেকে আমরা নিজেদের দরকারের জন্য বই এর দু-একটি পাতা ছিঁড়ে নিই। এটা খুব অনুচিত কাজ।এতে ঐ বইটা অন্যের পড়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তাই পাতা না ছিড়ে ছবি তুলে বা দরকার হলে ফটোকপি করে নিন।
---যখন ভারী বই পড়বেন তখন বুক-কুশনে রেখে বই পড়ুন। এতে বইয়ের স্পাইন ভেঙে বই নষ্ট হবে না।
---পড়ার মাঝখানে বই উল্টে রাখবেন না, এতে বাইন্ডিং ছিঁড়ে যেতে পারে।
---নিউজপ্রিন্ট কাগজ পানি বেশি শোষণ করে, তাই এ কাগজের বইগুলোর দিকে আলাদা যত্ন নিন।
---বইয়ের মধ্যে ফুল বা অন্য রসালো কিছু চেপে রাখবেন না। এতে বইয়ের পাতার রং নষ্ট হয়ে যায়।
---বইয়ের প্রধান শত্রু হলো ধুলাবালি । এ জন্য কিছুদিন পর পর সুতি কাপড় দিয়ে বই মুছতে হবে। ভেজা বা নোংরা কাপড় দিয়ে মোছা উচিত নয়।
---বই এর আরেক প্রধান শ্ত্রু পোকামাকড় । সময় সময় ইদুরও কম যায় না । দেশীয় উপায়ে পোকামাকড় থেকে মুক্ত থাকতে চাইলে প্রতি বই এর মাঝে বা বইয়ের পাশে ডাইক্লোরো ডাইফিনাইল জাতীয় রাসায়নিক পাউডার বা ন্যাপথলিন গোটা কিংবা কচি নিমপাতা ছড়িয়ে দিলে কোন পোকাই প্রায় ধারে কাছে ঘেঁষে না । আবার বাড়তি নিরাপত্তার জন্য আপনি শেলফের বিভিন্ন জায়গাও নিম পাতা ছড়িয়ে রাখতে পারেন।এতে পোকামাকড় ধারেকাছে ঘেঁষবে না এবং উপদ্রব এর আশঙ্কা কমে যাবে। মাঝে মাঝে রোদে বই দিলে পোকামাকড় এর আশঙ্কা আরও কমে যাবে। কাঁচের দরোজা যুক্ত শেলফ ব্যবহার করলে বই অনেকাংশে পোকামাকড় মুক্ত থাকবে। আবার আলো যাওয়া-আসা করলে সেটাও উপকার হবে।
(সতর্কতা--ডাইক্লোরো ডাইফিনাইল খুবই বিষাক্ত রাসায়নিক পাউডার। শেলফে ছিটিয়ে দেয়ার কিছুদিন পর শেলফ ভালোমতো পরিষ্কার করে ফেলুন।)
--- ব্যক্তিগত শেলফে যখন বই গুছিয়ে রাখবেন, তখন বিষয় অনুযায়ী গোছালে সহজে পেতে সুবিধা হয়।ইচ্ছে করলে লেবেল এবং ট্যাগ লাগিয়ে নিতে পারেন। বই ছেঁড়া বা পাতা আলগা থাকলে বাঁধিয়ে নিতে হবে।
---বইয়ের দুর্গন্ধ এড়াতে বছরে দু একবার বই রোদে দিন বা চেষ্টা করুন রোদে দেবার । এতে পোকামাকড়ের আক্রমণও কমে যাবে। সরাসরি রোদে না দিয়ে ছায়া যুক্ত স্থানে দিন, তা না হলে বই এর পাতার আদ্রতা কমে গিয়ে পাতা ভেঙে যেতে পারে।এছাড়া সিলিকা জেল বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে দিয়ে রাখতে পারেন। বইয়ে কোনো রকম দুর্গন্ধ হবে না।
--- কাঁচের দরোজা যুক্ত শেলফ হলে বই তালা দিয়ে রাখাটা খারাপ বুদ্ধি না , বাড়িতে বাচ্চা থাকলে, পোষা প্রানী থাকলে, প্রচুর মানুষের আনাগোনা থাকলে এই কাজটা আপনার বইকে আলটিমেট সুরক্ষা দেবে। কারো বই চুরি বা বই মেরে দেবার মন থাকলে বই রক্ষা পাবে।
---বই কাউকে যদি দিতেই হয়, নিশ্চিত হয়ে নিন, সেই মানুষ বই এর যত্ন করতে জানে বা বইটি যত্নে থাকবে কি না এবং সময় মত বই ফেরত দেবার বিষয়ে সচেতন কি না । আর একটা ডায়েরী মেনটেন করুন, যেটাতে লেখা থাকবে কবে কাকে বই দিয়েছেন এবং কবে সেটা ফেরত দেবার কথা এবং মাঝে মাঝে চেক করুন ধার দেওয়া বই ফেরত পেয়েছেন কি না। ধার দেওয়ার সময় বইয়ের নাম, যাকে দিচ্ছেন তার নাম লিখে রাখুন। এতে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
---আপনি যখন কারও কাছ থেকে ধার নেবেন, মলাট দিয়ে ফেরত দিতে পারেন, তাতে আপনার সুরুচির পরিচয় মিলবে।কারও কাছ থেকে বই পড়তে নিলে সময়মতো ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করুন।
---যে ঘরে বই এর সেলফ থাকবে সেখানে সিগারেট বা মশার কয়েল জ্বালানো থেকে বিরত থাকুন। কাগজে ধোঁয়ার গন্ধ লেগে যায়, এবং হালকা হলুদ আস্তর পড়ে বই এর পাতাকে বিবর্ণ করে দিতে পারে।
---শুধু বই সংগ্রহ করে বসাএ ঘরের সুদর্শন বুক শেলফ ভর্তি করার সাথে সাথে যতটা সম্ভব নিয়মিত পড়ার অভ্যাস করুন। এতে বই ভালো থাকবে।
>>>> সুস্থ থাকুন , আর বই পড়ুন নিরন্তন।
>>>হ্যাপি রিডিং
বিষয়: বিবিধ
১৭৪১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন