দেবদাসী
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১৪ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:০২:০০ বিকাল
দেবদাসী
>>দেবদাসী আসলে কি?
দেবদাসী মন্দির সেবিকা। বর্ধিত অর্থে মন্দিরাঙ্গনের বারাঙ্গনা, দেহোপজীবিনী বা গণিকা।
দেবদাসীরা ঈশ্বরের সেবিকা। তাদের অতীতে বলা হতো কলাবন্তী যারা শিল্পকর্মে পারদর্শিনী। অভিজাত শ্রেণি তাদেরকে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত করত। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল মন্দিরের মেঝে ঝাড়ু দেওয়া, পবিত্র প্রদীপে তেল ঢালা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, পূজামন্ডপে ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় গান-নৃত্য করা এবং পূজার সময় প্রতিমাকে বাতাস দেওয়া। এ কাজের জন্য তাদেরকে মন্দিরের তহবিল এবং আয় থেকে যা প্রদান করা হতো তা তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অপ্রতুল ছিল। এ কারণে মাঝে মাঝে তারা ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে উঠত। আর এই জন্য একে বলা হত ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি (Sacred prostitution)। ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি হচ্ছে এক ধরনের সামাজিক রীতি যেখানে একজন মানুষ যৌন সংগম করে নিজ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্য কারও সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে। এ ধরনের কাজে যে ব্যাক্তি জড়িত থাকেন তাকে বলে দেবদাসী বা ধর্মীয় পতিতা।
এই রীতি শুধু ভারতেই না প্রাচীন সব সভ্যতাতেই ছিল তার প্রমান মেলে নিচের উধাহরণ থেকে--
**গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডটাস(খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৪-খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০/২০) বলেনঃ “ব্যাবলীয়ানদের সবচেয়ে খারাপ রীতি ছিল জীবনে একবার হলেও প্রত্যেক মহিলাকে বাধ্য করা আফ্রিদিতি মন্দিরে যেতে, যেখানে তাকে একজন অপরিচিত ব্যাক্তির সাথে যৌন কর্মে লিপ্ত হতে হত। যেসব মহিলারা ধনী ও গর্বিত ছিলেন তারা মিলিত হতে চাইতেন না। তাদের তখন দড়ি দিয়ে বেঁধে আনা হত মন্দিরে। প্রচুর অনুগামী লোক ভিড় করত তখন। এভাবে বিপুল সংখ্যক মহিলাকে আনা হত। মহিলারা বাড়িতে ফিরে যেতে পারত না যৌন কর্মে লিপ্ত হওয়ার আগে। অপরিচিত কোন লোককে অবশ্যই টাকা দিতে হত বন্দিনী মহিলার আঁচলে এবং তাকে আহবান করতে হত মাইলিত্তা দেবীর নামে। তাদের মন্দিরের বাইরে মিলিত হতে হত। টাকার পরিমাণ যাই হোক না কেন তা নিতে আস্বীকার করা পাপ। এভাবে সুন্দরী মহিলারা সহজেই মুক্তি পেত অল্প দিনে। অসুন্দরীদের থাকতে হত দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত কোন লোকের সাথে মিলনের আগ পর্যন্ত।
** খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ বছর আগে গ্রিসে জেনোফন নামের একজন অলিম্পিক বিজয়ী দেবীর মন্দিরে ১০০ জনের মতো তরুণীকে উপহার হিসেবে দান করে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। করিন্থ নামক ঐ শহরে দেবী আফ্রিদিতির মন্দির ছিল। রোমান যুগে ঐ মন্দিরে প্রায় হাজারের উপর দেবদাসী ছিল”।
**একই ধরনের পতিতাবৃত্তির চর্চা হতো সাইপ্রাস এবং করিন্থেও। এটি বিস্তৃত হয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলোতেও সংক্রমিত হয়, যেমন সিসিলি, ক্রটন, রোসানো ভাগলিও, সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা হয় এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের নাম। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সমাজে ভক্তিমূলক পতিতারা ছিল স্বাধীন এবং তারা বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করা ও কর দেবার ব্যাপারে আদিষ্ট ছিল। গ্রিক হেটায়েরার মতো জাপানেও এই প্রথার চল ছিল ।
** প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ ও কূটনীতিক মেগান্থিনিস প্রথম মৌর্যশাসক চন্দ্রগুপ্তের সময়ে ভারতে এসেছিলেন। অর্থশাস্ত্রে গণিকারা সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যারা দেহব্যবসা করতেন তাদের একটি তালিকা দেয়া আছে– যথা পুংশালী অর্থাৎ সাধারণ দেহব্যবসায়ী, সুরাসুন্দরী অর্থাৎ পানশালার ওয়েটার, বন্ধকী অর্থাৎ ঘটনাচক্রে দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়া গৃহবধূ, বেশ্যা অর্থাৎ কারুকুশীলব বা গুপ্তচর, সাধ্বি-ব্যঞ্জনা অর্থাৎ সতীত্বের ভান করে থাকা পুলিশের গুপ্তচর, দেবদাসী অর্থাৎ মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত পবিত্র বারাঙ্গনা, পরিব্রাজিকা অর্থাৎ আড়কাঠি বা দালাল । এঁদের সামাজিক মর্যাদা ছিল রাজঅনুগ্রহপুষ্ট গণিকাদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম । যুদ্ধক্ষেত্রে, শিকারে এবং আরো অনেক সময় রাজার সঙ্গে গণিকাদের থাকবার কথা লিখেছেন গ্রিক লেখকরা ।
আমার এই লিখার উদ্দেশ্য ভারত উপমহাদেশের দেবদাসী নিয়ে তাই অন্য দিক আলোচনা না করে সোজা এবার তীর চালিয়ে দিই ভারতের সমাজ ব্যবস্থারন দিকে।
>>উদ্ভব ও বিকাশঃ
**এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী, কৌটিল্যর আরেক নাম ছিল চাণক্য । তিনি প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রবিজ্ঞান গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্রের’রচয়িতা । তিনি প্রথম মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৭) কাউন্সেলর ও উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর রচিত বিখ্যাত অর্থশাস্ত্রের মতে, দেহব্যবসা একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা । পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপন নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এর অনুমোদন করে এবং সংগঠকের ভূমিকা নেয় । ঋগ্বেদ এবং জাতকেও এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন পণ্ডিতরা ।
কৌটিল্য জানান যে, তখন দেহব্যবসা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রীক। নগরজীবনের অবশ্যঅঙ্গ ছিল এটি। রাজকোষের আয়ের যে বিভিন্ন উৎস ছিল তার মধ্যে ‘দুর্গ’ নামক বিভাগটিতে বেশ্যা, জুয়াখেলা ও আবগারী বিভাগের পরিদর্শকের কথা বলেছেন কৌটিল্য। অর্থশাস্ত্রে এমনকি গণিকাধ্যক্ষেরও উল্লেখ আছে। তাঁর কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত ও দেখভাল করা । কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষের যে চিত্র পাওয়া যায় টা নিয়ে পণ্ডিতে-পণ্ডিতে মতদ্বৈধতা আছে ।
কৌটিল্য দেবদাসী প্রথা পর্যবেক্ষণের পর স্পষ্টভাবে বলেন যে, দেবদাসীদের মধ্যে যারা মন্দিরে সেবিকার কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছে বা অব্যাহতি নিয়েছে তাদের এবং সেসঙ্গে বিধবা, পঙ্গু মহিলা, সন্ন্যাসিনী বা ভিখারিনী, শাস্তিপণ পরিশোধে ব্যর্থ মহিলা, গণিকার মা এবং পশম, তুলা, শণ ইত্যাদি বাছাই-এর কাজে নিয়োজিত মেয়েদের মন্দির উপাধ্যক্ষগণ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করত।
**কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানীর মতে গর্ভধারণ ও পুনঃপ্রজননের দেবীর পূজাকে ভিত্তি করে দেবদাসী শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। মানবজাতির বংশবৃদ্ধির জন্য প্রাচীন হিন্দুসমাজে একটি মেয়েকে দেবীমাতার নামে উৎসর্গ করার প্রথা চালু ছিল।
** বৌদ্ধ গ্রন্থগুলোতে বিখ্যাত গণিকা অম্বাপালী, সালাবতী, সামা, সুলমা ছাড়াও এমন অনেকের কথা বলা আছে, যারা বুদ্ধি ও শিল্পীত দক্ষতার গুণে সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ তৎকালীন গণিকা নারীরা সমাজে-রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে সম্মান পেতেন এবং সাধারণ সভ্যসমাজের প্রতিনিধিরা ছাড়া রাজরাজড়ারাও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। তাদেরকে যখন তখন যে কেউ ভোগার্থে ব্যবহার করতে পারত না কিংবা মন্দ কথা বলতে পারত না। এমনকি গণিকাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিরও অধিকার ছিল। রাজকোষ থেকে বেতন ছাড়াও তাঁরা অলংকার, পোশাক-আশাক, অন্যান্য উপঢৌকন, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি লাভ করতেন। কোনো গণিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর সঙ্গে বা তাঁর অবিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে বলপূর্বক দেহমিলনের চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ আর্থিক সাজা হতো।
** “মহাভারতে উল্লেখ আছে যে,একজন বেশ্যা ভাল প্রকৃতির হলে উচ্চতর জীবনে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে । এই জীবিকা সম্বন্ধে বৌদ্ধ ধর্মেরও একই মত। মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক বিখ্যাত মুনি ঋষির নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁরা ‘স্বর্গবেশ্যা’ দেখে কামার্ত হয়ে তাঁদের সঙ্গে যৌন মিলন করেছিলেন। বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা – এরাই হলো সেইসব মুনি ! মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মান জনক বৃত্তি গুলির মধ্যে পতিতা বৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে পতিতাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। ঐ কারণেই বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ডঃ অতুল সুর লিখেছেন – ‘মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল’।
**বৈদিক যুগে গণিকা, বেশ্যা ইত্যাদি নানা নামের বারাঙ্গনা ছিল। মন্দির সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলে আনন্দ ও বিলাসপ্রিয় নতুন নতুন দেবতারও উদ্ভব হয়। ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে নর্তকীদের নিয়োগ করা হয়। দেবতাদের আনন্দ প্রদানের জন্য সৃষ্ট এ-প্রথা রাজা, শাসক ও সর্দারদের পৃষ্ঠপোষকতায় দ্রুত বিকাশ লাভ করে। এর ফলে ঈশ্বরের সেবা, মর্তে ঈশ্বরের প্রতিনিধিদের তথা রাজা, সম্রাট এবং ধর্মযাজক-এর সেবার সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়। ভারতের রাজপুত্র, রাজা এবং জমিদারগণ দেবদাসীদের যখন থেকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করতে শুরু করে তখন থেকে তাদের অবস্থা একটি নতুন রূপ পরিগ্রহ করে।
**অনেক দেবদাসীকে নিঃসন্তান পরিবারে নিয়োজিত করা হতো তাদের পরিবার এবং পারিবারিক সম্পত্তি বিলোপের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এক্ষেত্রে মেয়েদের ঈশ্বরের নিকট উৎসর্গ করে তাদেরকে উচ্চতর সম্প্রদায়ের বা অভিজাত লোকের সন্তান ধারণের জন্য যৌনমিলনের কাজে ব্যবহার করা হতো। এসব সন্তানরা পরবর্তীকালে ঠাকুরদাদার নাম ধারণ করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো।
**মূলত দেহকে মূলধন করলেও প্রাচীনকালে দেহ ব্যবসার অনেক রূপ ছিল-কারণ সেখানেও ছিল শ্রেণিবিভাগ । ছিল স্টেটাস। যেহেতু দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় নাচ-গান করতেন‚ দেবতাদের মনোরঞ্জন করতেন‚ সেহেতু রম্ভা‚ ঊর্বশী‚ মেনকা বা তিলোত্তমাকে কেউ পাতি ‘গণিকা’ বা ‘ যৌনকর্মী’ বলবে না। ঠিক সেভাবেই‚ মন্দিরে নাচগান করলে তাঁদের বলা হবে ‘দেবদাসী’‚ যতই তাঁদের পুরোহিতরা ভোগ করুন না কেন.
**পুরাণে বলে‚ ঋষি জমদগ্নি পুত্র পরশুরামকে আদেশ দেন তাঁর জন্মদাত্রীর মুণ্ডচ্ছেদ করতে । পিতার আদেশ পালন করেন পরশুরাম। পরিবর্তে বাবার কাছ থেকে তিনটি বর পান। তার একটা কাজে লাগিয়ে মা রেণুকার প্রাণ ফিরিয়ে আনেন পুত্র পরশুরাম। কিন্তু সমস্যা হয় রেনুকার কাটা মাথা নিয়ে ।সেটা কোথায় গড়িয়ে গিয়েছিল‚ সন্ধান মেলেনি । শেষে এক নিম্নবর্ণের নারী ইয়েল্লাম্মার মাথা এনে বসানো হল রেণুকার দেহে । এর ফলে‚ এক নিম্নবর্ণের নারীর উত্তরণ হল । এবং এভাবেই সমাজে এল নতুন ধারা । নিম্ন বর্ণের নারীর উচ্চবর্ণে উত্তরণ । দেবতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে । দেবতার দাসী হয়ে ।
** দেবদাসী প্রথার ব্যাপক প্রচলন হয় অষ্টম শতাব্দীতে, পুন্ড্রবর্ধন নগরে।
**বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্র গ্রন্থে সমসাময়িক ভারতে দেবদাসীদের সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন।
**গৌড় ও বাংলার ব্রাহ্মণ, সরকারি কর্মকর্তা, গৃহভৃত্য, ক্রীতদাস এবং দেবদাসীরা যথেচ্ছ যৌনাচারে অভ্যস্ত ছিল। পুন্ড্রবর্ধন নগরের দেবদাসীরা বিলাসী এবং কামাচারপূর্ণ জীবনযাপন করত। তাদেরকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
**দেওপাড়ায় প্রাপ্ত তাম্রফলক অনুযায়ী বিজয় সেন এবং ভট্ট ভবদেব তাদের মন্দিরে শত শত দেবদাসী নিয়োগ করেছিলেন।
**রামচরিতম এবং পবনদূত গ্রন্থে দেবদাসীদের জীবনযাত্রার সপ্রশংস বর্ণনা দেওয়া আছে।
**কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে এইরকম দেবদাসী অথবা নাচের মেয়ের উল্লেখ পাই। যারা তৎকালীন উজ্জয়িনী নগরের ‘মহাকাল মন্দিরে’ নাচ (ভারতনাট্যম) পরিবেশন করত! সেখানে এরকমই লেখা ছিল। কিন্তু বাস্তব বেরল অন্য রকম। বাস্তবে যা হয় তা হল কুমারী মেয়েদের দিয়ে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে! তাঁদের কে জোর করে ভগবানের নামে উৎসর্গ করে ভগবানের প্রসাদ ভাগ করে খাচ্ছে ধর্ম গোরু রা! ৯ থেকে ১৩ বছরের মেয়েদের সাধারণত দেবদাসী করা হয়। মেয়ে বলা ভুল, বলা যায় শিশুদের! এই শিশুদের ঋতু শুরু হওয়ার আগে অথবা প্রথম ঋতুর পরেই তাঁদের মন্দিরে উৎসর্গ করা হয়। সেখানেই কেটে যায় তাঁদের জীবনের বাকী দিন। অনেকে মেনে নেয় ধর্মের কথা ভেবে! আর এর সুফল ভোগ করে সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষ! তারা দিনের পর দিন ধর্ষণ করে চলে এদের! বাবার বয়সী দাদুর বয়সী মানুষের যৌন লালসার শিকার হয় এই শিশুরা! সাধারণত নিম্নজাতির অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের থেকেই মেয়েদের দেবদাসী করা হয়! কখনও পরিবারের মঙ্গল কামনায় এরকম ভাবে বলির পাঁঠা করা হয় মেয়েদের!
**দক্ষিণ ভারতে ‘দেবদাসী’ হলেও উত্তরভারতে এই রীতির নাম ‘মুখি’ | অনেকে এদের দেহপসারিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা, খানকি, উপপত্নী, জারিণী, পুংশ্চলী,অতীত্বরী, বিজর্জরা, অসোগু,গণিকা ইত্যাদি নামে ডেকে থাকে। প্রথার জন্মের আদিপর্বে দেবদাসীদের স্থান ছিল অত্যন্ত সম্মানের | অর্থ‚ জমি তো ছিলই | তাঁরা ছিলেন মন্দিরের অচ্ছেদ্য অংশ | তাঁদের নাচ-গান ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিল দেবতার আরাধনা | সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষ নিজেরা মেয়েদের উৎসর্গ করতেন দেবদাসী হওয়ার জন্য | বয়ঃসন্ধির আগেই করা হত উৎসর্গ | তারপর দেবদাসী হয়ে পারফর্ম করার জন্য নিতে হত নাচ-গানের কঠোর প্রশিক্ষণ | কন্যা উৎসর্গ করার রীতি দক্ষিণভারতে ‘মুট্টুকাট্টুভাডু’ এবং ‘দেভারিগে বিদুভাদু’ নামে পরিচিত |’মুট্টুকাট্টুভাডু’ মানে দেবতার সঙ্গে বিয়ে | এবং ‘দেভারিগে বিদুভাদু’ -এর অর্থ নিজেকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করা | একবার উৎসর্গ হয়ে গেলে সেই মেয়েরা আর ফিরতে পারত না স্বাভাবিক সমাজে | তাঁদের আর বিয়েই হত না |
কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের জায়গা থেকে চ্যুতি হল এই প্রথার | অবক্ষয় গ্রাস করল পুরোহিতকে | বোঝা গেল‚ পাথরের বিগ্রহকে উপেক্ষা করে মানুষই ভোগ করতে পারে ‘দেবদাসীকে’ | তখন আর উৎসর্গ টর্গ নয় | লুঠ করে আনা হত মেয়েদের | এমনকী‚ ব্যক্তিগতভাবে মেয়ে কেনাবেচাও হত | এই অবক্ষয়ের হাত ধরেই দেবদাসীদের মধ্যে চলে এল রূপভেদ‚ শ্রেণিবিভাগ | যাঁকে উৎসর্গ করা হয়‚ তিনি ‘দত্তা’| লুঠ করে আনা হলে তিনি ‘হ্রুতা’| কেনাবেচা করা হলে সেই কন্যে ‘বিক্রিতা’‚ কেউ নিজেই নিজেকে দেবতার পায়ে উৎসর্গ করলে তিনি ‘ভক্ত দেবদাসী’‚ অলঙ্কার-সহ কাউকে উৎসর্গ করা হলে তিনি ‘সালঙ্কারা’ ‚ যদি কেউ দেবদাসী হয়ে নিয়মিত পারিশ্রমিক পান ‚ তিনি গোপীকা বা রুদ্রাঙ্গিকা |
নাম যা-ই হোক না কেন‚ কাজ এবং পরিণতি একই ছিল | পরিবার-সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মন্দিরের অন্ধকারে দেবদাসীদের অভিশপ্ত জীবন কাটাতে হত | মন্দিরের মূল পুরোহিত (তাঁর মাধ্যমে নাকি দেবতা !) ভোগ করতেন দেবদাসীদের | যতদিন যৌবন‚ ততদিন ছিল এঁদের কদর | তারপর রক্তমাংসের বোঝা ছাড়া আর কিছু না |
**কথিত‚ উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির ছিল দেবদাসী প্রথার পথিকৃৎ | সেইসঙ্গে কোণারকের সূর্য মন্দির‚ দক্ষিণ ভারতের অন্য মন্দির-সহ ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে শিকড় বিস্তার করে এই প্রথা | যা ধর্মের দোহাই দিয়ে ছিল দেহ বা যৌন-ব্যবসারই আর এক রূপ |
**এমনকি আধুনিক যুগেও ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের ইয়াল্লামা, হনুমান এবং শিবমন্দিরে ২ লাখ ৫০ হাজার মেয়েকে নিয়োগ করা হয়।
** নেপালে বিশেষ করে দোতি, বাইতাদি এবং দাদেলধুরা জেলাসমূহে দেবদাসীদের এসব প্রতিষ্ঠান ছিল সনাতন প্রথা হিসেবে অতি প্রচলিত। এসব স্থানে অবিবাহিত মেয়েদের মন্দিরের সেবিকা হিসেবে কাজ করার জন্য প্রস্তাব করা হতো। অতি সম্প্রতি সরকারের কিছু কঠোর আইন বলবৎ হওয়ায় দেবদাসীর প্রথা বিলুপ্তির পথে।
**উনবিংশ শতকের সূচনায় বুকানন নামে এক ইংরেজ অভিযাত্রী এসেছিলেন দক্ষিণে । এদেশের দেবদাসী তারও নজর এড়ায়নি । তিনি লিখে গেছেন, কাঞ্চিপুরমের মন্দিরে দেবদাসী আছে কম পক্ষে একশ’ ।
**বিখ্যাত ভারত শাস্ত্রবিদ সার মনিয়ের উইলিয়ামস তাঞ্জোর মন্দির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন গত শতকের শেষ দিকে । তখনও সেখানে পনেরজন দেবদাসী ।
**দেশে তখন চলতি প্রবাদ—“খুলক-ই-খুদা, মুলুক-ই-সিরকার, হুকুম-ই-সাহিবান আলিসান!” অর্থাৎ নরকুল ঈশ্বরের, মাটি সরকারের, আর ক্ষমতা বলতে যা সব সাহেবদের । ইংরেজ রাজ-পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য অতএব তৎকালে চেষ্টার কোন ক্রটি ছিল না ।
*১৭৯১ সনে কর্ণাটকের নবাব মাদ্রাজের লাট-বাহাদুরকে ভোজের পরে নাচ সহযোগে আপ্যায়ন করেছিলেন । সার গ্রানট ডাফ-এর সম্মানে আয়োজিত এক ভোজসভায় ভারতীয় নর্তকীরা মান্ত অতিথির আবাহন করেছিলেন পশ্চিমী গীতবাদ্যে । কিন্তু সে দরবারী নাচ । ব্যক্তিগত আমোদ কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তার আয়োজনে কোন জাতিভেদ, ধর্মভেদ নেই।
*টিপু স্বলতানের বিশাল নর্তকী বাহিনী ছিল । নাচের দল ছিল, এমন কি ভবানীবাসী এক অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ রাজ-পুরুষেরও। কিন্তু দেবদাসী সাধারণ নর্তকী মাত্র নয়। তার আসরে সকলের অধিকার নেই। তবুও যুগের রীতি।
**লর্ড ডাফরিন দক্ষিণী মন্দিরে দেবদাসীর নৃত্য দেখেছিলেন। বিধর্মী বলে আপত্তি করল না কেউ, তাঞ্জোরের দশ দেবদাসী সানন্দে সার মনিয়েরকে তাদের নাচ দেখিয়ে পাকা করল বহুকাল ধরে কানে কানে শোনা খবরটা -- আমরা এখনও আছি ! ছিল যা, সে আরও বর্ণাঢ্য কাহিনী ।
**সে অন্য যুগ, অন্য জীবন। “ধারচারের (অর্থাৎ ধারওয়ারের ) এই মন্দিরে যার প্রতিমূর্তি মুখটি তার হাতির মত। তার শুড় আছে, দাতও আছে। কিন্তু মূর্তিটির ছ’দিকে তিনটে করে বাহু—সব মিলিয়ে ছয়খানা হাত । চারটে তার ইতিমধ্যেই অবলুপ্ত । ওরা বলে—বাকি দু’খানাও যখন থাকবে না, বিশ্বের বিনাশ তখন অনিবার্য । প্রতিদিন ওরা দেবপ্রতিমাটিকে খেতে দেয় । ওদের বিশ্বাস তিনি সে ভোগ গ্রহণ করেন । তিনি যখন ভোজন করেন মন্দিরের মেয়েরা তখন নাচে ।” —লিখেছেন বিখ্যাত পর্তুগীজ ভ্রমণকারী ডোমিনগো পায়েস ।
** ইতিহাসখ্যাত নরপতি কৃষ্ণদেব রায়ের রাজত্বকালে তিনি বিজয়নগর পরিভ্রমণে এসেছিলেন। তার এই বিবরণ ১৫২০ সন থেকে ২২ সনের মধ্যে লেখা । বিজয়নগর এবং তার অধিপতি কৃষ্ণদেব রায় তখন গৌরবের শীর্ষে । সম্ভবত রাজধানীর নর্তকীরাও ! শুধু মন্দিরে নয়, রাজকীয় অনুষ্ঠানে, ধর্মীয় উৎসবে সর্বত্র তারা । পুরোহিতের মত নর্তকীও যেন তখন যাবতীয় শুভ অনুষ্ঠানে অপরিহার্য। পায়েস রাজপ্রাসাদের এক উৎসবে তাদের বিবরণ দিছেনঃ মাথায় সুবর্ণ ঝারি, তাতে মুক্তোর ঝারল । অপূর্ব সেই ভাণ্ডের ভিতরে একটি করে প্রদীপ জ্বলছে । একের পর এক, ওরা সার বেঁধে আসতে লাগল। সবসুদ্ধ ষাটজন হবে হয়তো । প্রত্যেকে তরুণী, প্রত্যেকে রূপসী । সব ক’টিরই বয়স ষোল থেকে কুড়ির মধ্যে । ওদের অঙ্গে কি পরিমাণ সোনাদান কার সাধ্য তার হিসেব করে । কারও কারও হাতে এমন ভারি ভারি গহনা যে রূপসীরা নিজের হাতের ভার নিজে বইতে পারছে না । দু’পাশে ছ'জন পরিচারিকা নিয়ে হাটছে ! একই ঐশ্বর্ষের কাহিনী শুনিয়েছেন পায়েস অন্য এক উৎসব উপলক্ষে ; এদের ধন দৌলতের বিবরণ দেয় কার সে সাধ্য ! গলায় মণি-মুক্তে-ইরেখচিত চিক, হাতে জড়োয় বাজুবন্ধ, কঙ্কণ, বালা, চূড়া ; কোমরে বিছে..., পায়ে মল, নূপুর । পেশায় ওরা নর্তকী, কিন্তু তবুও কি অবিশ্বাস্ত ঐশ্বর্য। অনেকেরই আপন ভূসম্পত্তি আছে। সেগুলো তারা উপহার হিসাবে পেয়েছে। অনেকের পালকি আছে। শুধু কি পালকি ? আরও কত কি যে আছে তার কোন হিসেব নেই। এ নগরে এমন নর্তকীও আছে যার তহবিলে কমপক্ষে এক লক্ষ পারদাউস। পায়েস বলেন—এদেশের এক পারদাউস মানে ডাচদের এক ডলার। একালের ইউরোপীয়ানের চোখে অঙ্কটা প্রায় পচিশ হাজার পাউণ্ড । বিজয়নগর এক অবিশ্বাস্ত রাজ্য । তার হাতিশালে হাজার হাজার হাতি, ঘোড়াশালে লক্ষ ঘোড়া । কৃষ্ণদেব রায় যখন রাইচুর অভিযানে যাত্রা করেন তখন র্তার বাহিনীতে ছিল নাকি সাত লক্ষ তিন হাজার পদাতিক, বত্ৰিশ হাজার ছয় শ’ অশ্বারোহী। এই বিরাট বাহিনীর সঙ্গে প্রমোদ-কন্যাই নাকি ছিল কুড়ি হাজার । কিন্তু এক ব্যাপারে কৃষ্ণদেব রায় রীতিমত সদাচারী ছিলেন বলা চলে । তার অন্দরে রানীদের বারে হাজার দাসী এবং সহচরী থাকলেও বিজয়নগর অধিপতির পত্নী ছিল মাত্র বারোজন। বলা অনাবশ্যক, তার পূর্বসূরীরা সবাই কিন্তু এমন সদাচারী নরপতি ছিলেন না ।
**পায়েস-এর প্রায় একশ’ বছর আগে (১৪২০) নিকোলো কোনটি নামে এক ইতালীয়ান এসেছিলেন বিজয়নগরে। তিনি লিখে গেছেন— এদেশের নরপতি ভারতের সব রাজরাজড়ার ওপরে। সাকুল্যে বারো হাজার স্ত্রী আছে তার ! শিবঠাকুরের তিন কন্যা’র একটির মত এদের চার হাজারের কাজ রান্নাবান্না । তারা সব সময় পায়ে হেঁটে রাজার সঙ্গে সঙ্গে চলেন । অন্য চার হাজার চলাফেরা করে টগবগিয়ে ঘোড়ার পিঠে । বাদবাকি রানীরা ভ্রমণ করেন দোলায় । মনে হয়, কৃষ্ণদেব রায়ের অন্যতম বিলাস ছিল, রানী নয়—নর্তকী। তার দ্বাদশ ঘরণীর একজন ছিলেন নর্তকী । তরুণ কৃষ্ণদেব ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ একদিন ধরা পড়েছিলেন একটি বিশেষ গোলাপে । মেয়েটিকে তিনি ভালবেসেছিলেন । রাজপুত্রের ভালবাসা ! কিন্তু তবুও, কৃষ্ণদেব অন্য ধরনের কুমার। হাতে হাত রেখে তিনি কথা দিয়েছিলেন—যদি কোনদিন সিংহাসনে বসতে পারি তবে রানী করব তোমাকে । রাজা কৃষ্ণদেব তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন । র্তার এই প্রিয় রানীর নামে তিনি একটি নতুন নগর পর্যন্ত পত্তন করেছিলেন । পরবর্তী বিজয়নগররাজ অচ্যুত রায়ের আমলেও রাজধানীর মন্দিরে, প্রাসাদে নর্তকীর বিরামহীন নূপুর-নিক্কণ।
* ফারনো মুনিজ ( ১৫৩৫-৩৭) বিবরণ , দেবদাসীর গল্পে মুনিজ-এর একটি ছত্রই যথেষ্ট : এক সময় হাজার রূপসী নাচতে নাচতে চলে গেল রাজার সামনে দিয়ে ! শুধু বিজয়নগরে নয়, দেবদাসী সেদিন দিকে দিকে, সর্বত্র । যেখানে জনপদ, সেখানেই মন্দির ; আর যেখানে মন্দির সেখানেই দেবদাসী। বিজয়নগরের মন্দির-নর্তকীদের কেউ দেবদাসী’ বলে উল্লেখ করেননি । কিন্তু তারা যে জীবনে-আচারে দেবতাদের দাসী ছিল সে বিষয়েও কোন সমসাময়িক বিবরণ সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ রাখেনি। নামে কিছু আসে যায় না ।
**কৃষ্ণদেব রায়ের বহু আগে একাদশ শতকের দক্ষিণ ভারতে অন্যতম বিখ্যাত নরপতি চোল বংশের রাজারাজ । তার এক তাম্রশাসনের বক্তব্য -- রাজারাজ তাঞ্জোরের মন্দিরে সুশিক্ষিতা চারশ’ তেলিচ্চেরি পেণ্ডুগাল’ বা মন্দির-কন্যা দান করেছেন। তাদের জন্য মন্দিরের চারপাশে উত্তম বাসগৃহ নির্দিষ্ট হয়েছে। এজন্য তাদের কোন কর দিতে হয় না।...ইত্যাদি । এটা খ্ৰীষ্টীয় ১০০৪ সনের ঘটনা ।
**এখানেই মনিয়ের উইলিয়ামসকে প্রায় সাড়ে আটশ' বছর পরে নাচ দেখিয়েছিল দশটি নর্তকী।
**সমসাময়িক কালের আরও একটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে খাদেশের ভাগলি নামক একটি জায়গায় । তার তারিখ ৯৯১ শক, বা ১০৬৯ খ্ৰীষ্টাব্দ । সেটি থেকে জানা যায়, রাজা গোবিন্দ দেব মন্দিরের নর্তকীদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন। তাদের তিনি ভূসম্পত্তি দান করেছেন ।
**তিরিশ বছর পরে ১০৯০ সনে সম্পাদিত চমন রাজা জোজলা দেবের খোদিত নির্দেশ—উৎসব দিনে নর্তকীদের মনোহর বেশে নৃত্যগীতে যোগ দিতে হবে । রাজা বলেছেন—যদি কেউ কখনও এই প্রস্তাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করে তবে তাকে সমুচিত শাস্তি দেওয়া হবে।
**ইত্তাগিতে প্রাপ্ত এক শিলালিপি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, শুধু রাজন্তবর্গ নয়, সেকালের বিত্তবানদের অন্যতম ধৰ্মকৃত্য তথা বড়মানুষি ছিল দেব-মন্দিরে নর্তকী অর্ঘ । এই লিপিটি ১১১২ সনে সম্পাদিত । এতে লেখা আছে—মহাদেব নামে এক ব্রাহ্মণ মন্দিরের নর্তকীদের জন্য গৃহ দান করছেন !
*দেবদাসীর নিবেদিত দেহের অপূর্ব নৃত্যভঙ্গী, তার মণিমুক্তা-খচিত গহনা, তার বর্ণাঢ্য পোশাক—সেই অন্ধকার থেকে এখনও ঝিলিক দিয়ে যায়। মধ্যযুগীয় লৌকিক বিবরণ থেকে জানা যায়—গুজরাটের চার হাজার মন্দিরে দেবদাসী ছিল—কুড়ি হাজার । দিনে তারা মন্দিরে মন্দিরে ছ’বার নাচত । একবার ভোগের সময়, আর একবার আরতির সময় ।
দেবদাসীর নাচ কার্যত নিত্য-পুজোয় অন্যতম উপচার। তার নূপুরঝঙ্কার কানে না এলে দেবতার ঘুম ভাঙে না, তার হাস্যলাস্ত চোখের সামনে না থাকলে তিনি ভোগ গ্রহণে উৎসাহ পান না । মন্দিরে দেবদাসীর উপস্থিতি, অতএব পুরোহিতের মতই জরুরী।
**সপ্তম শতকে মুলতানের সূর্যমন্দিরে হিউয়েন সাঙ ওদের দেখা পেয়েছিলেন ।
**ভারতবর্ষে ইসলাম আসার পূর্বে নিম্নবর্ণের হিন্দু মেয়েরা বিয়ের আগে মন্দিরে সেবাদাসী হিসেবে কাজ করতে হতো। মন্দির ধোয়া মোছা থেকে শুরু করে মন্দিরের ব্রাক্ষন পুরাহিতদের শয্যাসঙ্গী হওয়া এরকম প্রায় সব কাজই তাদের করতে হত।ব্রাক্ষণ পুরাহিতরা এই নিম্নবর্ণের হিন্দু মেয়েদের সাথে প্রতিদিন উপুর্যপুরী FREE SEX করতো।মেয়েরা কিন্তু ব্রাক্ষনদের কেনা দাসী ছিল না তারা শুধু তাদের বিয়ের আগের সময়টা এই মন্দিরে কাজ করতো। বিয়ের পর নিম্ন বর্ণের হিন্দু মেয়েরা আর মন্দিরে যেত না।
**একাদশ শতকে মাহমুদ সোমনাথ মন্দির লুঠ করতে গিয়ে এ কী ঐশ্বর্য হাতে পেলেন ! সোমনাথে সেদিন (১০২৬) নৃত্যগীতপটিয়সী পাচ শ’ তরুণী । বিরামহীন নৃত্যসভা। ওরা পালা করে অষ্টপ্রহর নাচে, গায়। সুলতান মাহমুদ এ প্রথা বন্ধ করার জন্য অনেক চেষ্ট করছে ।
**চতুর্দশ শতকে সুলতান আলাউদ্দীন বাহমনী কর্ণাট প্রদেশ আক্রমণের পর যখন রাজধানীতে ফিরেছিলেন তখন তারও সঙ্গে ছিল একদল মন্দির-নর্তকী ।
শুধু সোমনাথ নয়, শুধু পশ্চিম বা দক্ষিণ ভারতে নয়, দেবদাসী ভারতের অতীতের সর্বত্র তারার মত ছিটানো । গ্রীক লেখকরা হয়তো সত্যিই ওদের দেখা পাননি। কিন্তু একালের গবেষকরা বলেন —জাতক’-এর কালে ওরা ছিল। অনেক রঙ্গিনী প্রাচীন বৌদ্ধসাহিত্যে । অনেক নর্তকী । তাদের মধ্যে কে ‘দেবদাসী, কে নয়— তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন নেই। স্বয়ং সিদ্ধার্থ নাকি সব ত্যাগ করে বিবাগী হয়েছিলেন অদেখা স্বৰ্গীয় সুন্দরীদের প্রেরণায় । ওরা তার চারপাশ ঘিরে গান গাইত—বৈরাগ্যের গান। পণ্ডিতদের ধারণা—খ্ৰীষ্টীয় তৃতীয় শতক থেকে দেবদাসী নিয়মিত মন্দির-ললনা । মালবিকা-অগ্নিমিত্র কাহিনীর মৃত্যপটিয়সী নায়িকা মালবিকা দেবদাসী ছিলেন না হয়তো, কিন্তু কালিদাসের কালে যে তারা অজ্ঞাত ছিল না তার প্রমাণ—মেঘদূত। মনোযোগী পাঠক তার পাতায় দেবদাসীর হিল্লোলিত অঙ্গের কল্লোল যেন এখনও কানে শুনতে পান ; উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে নাচছিল মেয়েটি। কিছু কিছু পুরাণেও (পদ্ম পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ) নাকি দেবদাসীর উল্লেখ আছে দেবতার মন্দিরে দেয় অর্থের তালিকায়। ভবিষ্য পুরাণের পরামর্শ ; যদি, সূর্যলোকের মন জয় করতে চাও, তবে কোন সূর্যমন্দিরে একদল নর্তকী উপহার দিয়ে যাও ! অধিকাংশ পুরাণই নাকি খ্ৰীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের, অথবা কাছাকাছি সময়ের ।
**সপ্তম শতকে হিউয়েন সাঙ-এর তীর্থযাত্রা । অষ্টম শতকে রাজতরঙ্গিনী সাক্ষ্য—কাশ্মীরে দেবদাসী ছিল ! এই নর্তকীরা তখন একটি বিশেষ জায়গায় নাচত । সেখানে কোন মন্দির নেই। ওরা বলে–নাই বা থাকুক, এককালে ছিল । আমরা নর্তকীর বংশ । আমাদের বংশের মেয়েরা চিরকাল এখানেই নেচে গেছে—আমরাও তাই নাচি । যুগের পর যুগ নেচে চলেছিল ওরা। ক্লান্তিহীন, বিরামহীন । কোন একটি বিশেষ মন্দিরে নয়, কম-বেশি ভারতময়।
**আলবেরুনি পশ্চিম ভারতে ওদের দেখা পেয়েছিলেন ; আলতেকার লিখেছেন— কুট্টিনিমাতম বিশ্বাস করলে মানতে হবে একসময় বারাণসীর বিশ্বনাথের মন্দিরেও ওরা নাচত । টাভারনিয়ার গোলকুণ্ডায় ওদের পল্লী দেখেছিলেন, বারনিয়ার পুরীর মন্দিরে স্বয়ং দেবদাসীকেই । সেদিক থেকে মনে হয়, নামে বেনামে দেবদাসী এই সনাতন দেশে যেন চিরকালীন । সে অনন্তযৌবনা, চির আয়ুষ্মতি ।
>> প্রথার উচ্ছেদঃ
**আলবেরুনি লিখেছেন —হিন্দুদের একাংশ এই মন্দির-নর্তকীদের উচ্ছেদের জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল। কিন্তু সফল হতে পারেননি। কারণ, দেশের রাজন্তবর্গ এবং রাজপুরুষেরা এদের পিছনে ওঁরা যদি এই ব্যবস্থা বহাল রাখেন তবে নৃত্যসভার উচ্ছেদ করে সাধ্য কার? রাজপুতানায় প্রাপ্ত দশম শতকের একটি লিপি আলবেরুনি উল্লেখিত এই প্রতিরোধ আন্দোলনকে সমর্থন করে কেননা লিপিটির বক্তব্য : আমি মন্দিরে মন্দিরে যে নর্তকীদের দান করেছি, তাদের কর্তব্যে যেন কেউ অসুবিধার সৃষ্টি না করতে পারে । সন্ন্যাসী অথবা ব্রাহ্মণের সে চেষ্টা করলে তৎক্ষণাৎ তাদের প্রতিহত করতে হবে । এই ঘোষণা জনৈক রাজপুত দলপতির। তার নির্দেশের লক্ষ্য—আপন অনুচরগণ । আইনের আঙ্গিনায়ও দেবদাসী রীতিমত পুরানো বিষয়।
১৯০৬-৭ সনে ভারত সরকারকে পতিত-মেয়ে সম্পর্কিত একটি আন্তর্জাতিক সনদে সই করতে হয় । স্বভাবতই এ দেশের মেয়েদের অবস্থা সম্পর্কে কথা উঠল । ক্রমে দেবদাসীও আলোচনায় এল । সে ১৯১২ সনের কথা । পুরানো দিনের ইম্পিরিয়াল কাউন্সিলে হঠাৎ নতুন ধরনের বিল উত্থাপিত হলো । একখানা নয়, পর পর তিনখানা । তিনটিরই বক্তব্য—দেবদাসী প্রথার উচ্ছেদ চাই । ভারত সরকার নেটিভদের ধর্মবিষয়ে তৎকালে অতি সতর্ক । তারা জবাব দিলেন—এ প্রথার সঙ্গে দক্ষিণ ভারত বিশেষভাবে জড়িত । কোন আইন প্রণয়নের আগে সেখানকার অভিমত জানা প্রয়োজন । স্থানীয় সরকারগুলোর মতামত সংগ্রহ করতে কিছু সময় নষ্ট হলো । তারপর তাদের পাঠানো মতামতের ভিত্তিতে নিযুক্ত হলো এক কেন্দ্রীয় সিলেক্ট কমিটি । সিলেক্ট কমিটি গঠিত হয়েছিল ১৯১৩ সনে । র্তাদের রিপোর্ট পাওয়া গেল পরের বছর মার্চ মাসে । সেপ্টেম্বরে উত্থাপিত হলো সরকারী বিল। হয়তো সেদিনও দেবদাসী ভাবনায় গালে হাত রেখেছিল। কিন্তু ভাগ্য তার পক্ষে । ‘বিল’ ভাল করে জানাজানি হতে না হতে প্রথম মহাযুদ্ধ। মন্দিরের অঙ্গনের চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র সরকারের পক্ষে অনেক জরুরী। দাসীকে তার নাচের আসরে ছেড়ে তারা লড়াইয়ে মনোযোগ দিলেন । ক’বছর পরে আবার সেই দেবদাসী । ডাঃ হরিসিং গৌর মাদ্রাজ বিধানসভায় ১৯২২ সনে ওদের সম্পর্কে আইন দাবি করে প্রস্তাব উত্থাপন করলেন । ১৯২৭ সনে কেন্দ্রীয় পরিষদে একই প্রস্তাব পেশ করলেন রামদাস পানতুলু। দু’জনের প্রস্তাবই গৃহীত হলো । কিন্তু আইন পাস হলো না কোথাও । সরকার পক্ষ কখনও সংশোধিত পেনেল কোড দেখালেন, কখনও সারদা আইনের ( ১৯২৭) দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন।
সেকালে পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য এই প্রথার বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন—কেউ কি আমাকে দেখাতে পারেন হিন্দুর ধর্মশাস্ত্রে দেবদাসীর বিধান আছে ? কোন শাস্ত্রজ্ঞ তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি। একালে একই প্রশ্ন তুলেছেন গান্ধীজী । দক্ষিণ ভ্রমণে এসে তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে গেছেন ।
মাদার ইনডিয়া’র লেখিকার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের অন্যতম উপলক্ষ— দেবদাসী । মন্দির-প্রাঙ্গণে সুলক্ষণা, সুসজ্জিতা, সর্ববিদ্যায় পারদর্শিনী এই তরুণী মেয়েটির আবির্ভাব-দিন থেকেই তাকে নিয়ে দিকে দিকে ভ্ৰকুটি।
দেবদাসী প্রথার চর্চা ভারতে বেশি ছিল, যেখানে গ্রাম থেকে ছোট মেয়েদের ধরে এনে ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী বিয়ে দেয়া হত দেবতার সাথে বা মন্দিরের সাথে এবং তাকে সেখানেই থাকতে হত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অভিযোগ করে যে এভাবে উচ্চস্তরের হিন্দুরা দেবদাসীদের সাথে যৌন কর্ম করত জোর করে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার আইন করে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করেছে। এসব আইনের মধ্যে বোম্বে দেবদাসী আইন ১৯৩৪, দেবদাসী মাদ্রাজ আইন ১৯৪৭, কর্ণাটক দেবদাসী আইন ১৯৮২, অন্ধ্রপ্রদেশ দেবদাসী আইন ১৯৮৮ অন্যতম।
[সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, ব্লগ, পত্রিকা , শ্রি-পান্থের-- দেবদাসী , প্রাচীন ভারতের ইতিহাস-- অতুল চন্দ্র রায়]
বিষয়: বিবিধ
২৮১৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন