বারমাসি কাব্য ও বাংলা সাহিত্য

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ০৭ নভেম্বর, ২০১৫, ০৩:১৫:০৩ দুপুর

বারমাসি কাব্য ও বাংলা সাহিত্য

----------------------------

>>বারমাসি কবিতা কি?

বাংলা বারমাসি বা ক্যালেন্ডার কবিতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ ও কলাবিভাগের ডীন ডক্টর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন বলেন : “মনে হয় বারমাসি বা ক্যালেন্ডার কবিতা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল । করুণ বিষয় অবলম্বনে দীর্ঘ বর্ণনামূলক কবিতা রচনাকালে এর অবতারণা কবিদের মধ্যে একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। যে করুণ চিন্তার অভিব্যক্তি এই জাতীয় রচনায় দেখা যায় তা দুঃখ, ভোগ ও সহিষ্ণুতার জন্য রসোত্তীর্ণ হয়েছে। অতীতের সৈনিক জীবনের কার্যাবলি স্মরণ করে কোন ক্লান্ত যোদ্ধার খেদোক্তি বা বিষণ্ণ-ভাবের রূপায়ণ না বরং ইহা এমন এক জনসাধারণেরই করুণ চিন্তার অভিব্যক্তি যে, জনসাধারণ এক অলঙ্ঘ্য ও অ-প্রতিরোধীয় শক্তির বিরুদ্ধে নিজেরকে নিতান্তই অসহায় বলে মনে করে। এই জন্য বারমাসি কবিতা সমাজ-বিজ্ঞানের এক প্রয়োজনীয় দলিল । এই জাতীয় কবিতা কবিত্বের দিক হতে যেমন অতুলনীয় তেমনি আবার সমসাময়িক সমাজ-ব্যবস্থার এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী রেকর্ড । প্রাচীন সাহিত্যে প্রচুর পরিমাণে এই কবিতা সৃষ্ট হয় এবং আপাতদৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় সমাজ-প্রথার খুঁটিনাটি বর্ণনার ব্যাপারে যথার্থতা রক্ষিত হয়েছে, ফলে, অতীতের পুনরুজ্জীবনে এই সমস্ত কবিতা সহায়ক হয়েছে একথা বলা চলে।”

ইংরেজ কবি স্পেনসার মেষ-পালকদের জীবন অবলম্বনে "শেপার্ডস ক্যালেন্ডার” অর্থাৎ মেষ-পালকদের বারমাসি নামক কবিতা আমাদের সামনে আসে।

আমাদের প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেও ক্যালেন্ডার বা ‘বারমাসি জাতীয় কবিতার নিদর্শন দেখা যায় । প্রাচীন বাংলা সাহিত্য অসংখ্য বারমাসি’ কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়।

আর উধহরন হিসেবে সামনে আনা যায় --

>কামার আলীর --রাধার বারমাস,

>মোহাম্মদ আলীর --মুর্শিদের বারোমাস,

>হাশেমের-- রাধিকার বারোমাস,

>শেখ জালালের --সর্থীর বারোমাস,

>হরি পণ্ডিতের --জয়গুণের বারোমাস,

>জনৈক অজ্ঞাতনামা লেখকের --নিমাইর বারোমাস,

>কাজী দৌলত --‘সতী ময়না’

>রহিমুন্নেছা--ভ্রাতৃ-বিলাপ

>সৈয়দ মুলতানের--নবী-বংশ

তিমিম গোলালু জেবল মুলুক, শামারেখ , প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

*ডঃ এনামুল হক চট্টগ্রাম হতে “ভ্রাতৃবিলাপ" নামক একটি নূতন ধরনের বারমাসি আবিষ্কার করেছেন। এই বারমাসি কবিতার রচয়িত্রী মহিলা কবি রহিমুন্নেছা । তিনি অষ্টাদশ শতকে জীবিত ছিলেন এবং উক্ত কবিতা তিনি তার এক সহোদর ভ্রাতার মৃত্যু শোকে রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।

* সতী ময়না কাব্যের রচয়িতা কবি কাজী দৌলত সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে জীবিত ছিলেন এবং রোসাঙ্গ রাজা শ্রী সুধমার বা থিরি থু ধর্মার (১৬২২-৩৮ খ্রীঃ) রাজত্বকালে তাহার লস্কর উজির অর্থাৎ ‘সমর সচিব আশরাফ খানের আদেশে কাব্য রচনায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন । কিন্তু রচনার পরিসমাপ্তির পূর্বে তিনি অকালে পরলোক গমন করেন। তার মৃত্যুর প্রায় বাইশ বৎসর পরে ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মহাকবি আলাওল রোসাঙ্গ রাজা শ্রী চন্দ্র সুধৰ্মার অর্থাৎ থিরি থান্দ থু ধর্মার (১৬৫-৮৪ খ্রীঃ) প্রধান উজির সোলেমানের আদেশে উক্ত অসমাপ্ত কাব্যখানি সমাপ্ত করেছিলেন । কবি কাজী দৌলত তার কাব্যের বিরহিণী নায়িকা

ময়না ও দূতী মালিনীর উত্তর-প্রত্যুত্তর-স্থলে ব্রজবুলি ভাষা প্রয়োগ করে এক অনবদ্য বারমাসি কবিতা রচনা করেছিলেন।

প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের এই জাতীয় বারমাসিতে সাধারণত: নায়িকার দুর্বল ও চঞ্চল মনের পরিচয় পাওয়া যায় । অধিকন্তু, নায়িকাকে দেখা যায় কাম-পীড়ায় জর্জরিত যাহার ফলে বর্ণনায় অশ্লীলতা প্রধান্য লাভ করেছে। কিন্তু কাজী দৌলতের প্রকাশভঙ্গী যেমন ফুটে উঠেছে স্বাভাবিকভাবে তেমনি তার নায়িকা ময়নাকে দেখতে পাই মানসিক চাঞ্চল্য ও দেীর্বল্যের ঊর্ধ্বে অদ্ভুত প্রলোভন বিজয়িনী ও অসাধারণ ধৈর্য্যশালিনীরূপে।

নিচে মালিনী কর্তৃক শ্রাবণ মাসের বিরহ বর্ণনা ও তদুত্তরে ময়নাবতীর উক্তি :–

>>মালিনীর উক্তি

----------------------

শ্রাবণ মাসেতে ময়না বড় সুখ

লাগয় ।

রিমিঝিমি বরিস-এ মনোভাব

লাগয় ।।

ধরতী বহএ ধার। রাতি আধিয়ারী

ধাসায়ী ।।

শ্যামল অম্বর শ্যামল ক্ষেতি ।

শ্যামল দশ দিশ দিবসক জুতি।।

খেলায় বিজুলী মেহ ধামরের

সঙ্গে ।

জনম দুখিনী তুই রাজার দুহিতা ।

বিফল ছে নাম ধর লোরের

বণিত ।।

সুজন পিরির্তী জান নিত্য নব

মালা

লস্কর নায়ক মনি জগ উজিমালা ।।

>>ময়নাবতীর উক্তি

------------------------

মালিনী কি কহব বেদন ওর

লোর বিনু বাসহি বিহি ভেল

মদন অসিক জানি বিজুরির

রেহা।

থরকএ রজনী কম্পএ ছব দেহা ।।

ন বোল ন বোল ধাঞি অনুচিত

বোল ।

আন পুরুখ নহে লোর ছমতুল ।৷

লাখ পুরুক নহে লোরক ছত্রুপ ।

কোথা এ গোময় কীট কোথাএ

মহুপ।।

গরল ছদুস পর পুরুথক ছঙ্গ ।

ডংসিআ পলাএ জেন কাল ভূজঙ্গ।।

তাহা ছনে পালএ জে প্রেমের

অঙ্কুর ।

থির ন রহে জাতি পিরীতি

দুহু কুল ।।

তেঞি রিতু মানি এ আবএ লোর ।

নতু জীবনে জে মরন ছম মোর ।।

তছু পাএ ছাজএ ছাত্তন রছ আজ।

অবিরত কান্তান ছোরে কান্ত

পাছ ।।

বিরহে পীয়ারি ধনি জপ ইতি

নাহা ।।

আশরাফ নায়ক ছব গুণ গাহা।।

এই বারমাসী কবিতা এককালে আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয় ছিল। বারমাসী না হইলে কোন পুথি পাঠের আসরই জমিত না । ইহা এমন এক সাহিত্যিক রেওয়াজে পরিগণিত হয়েছিল যে, সুযোগ পাইলেই কবিরা এর ব্যবহার করিতে ছাড়তেন না ।

উদাহরণ স্বরূপ, ষোড়শ শতকের কবি সৈয়দ মুলতানের নবী বংশ কাব্যে বর্নিত হযরত আদমে(আHappy সহিত বিবি হাওয়ার (রাঃ আঃ) বিচ্ছেদ এর অংশ উল্লেখ করা যেতে পারে। এখানে কবি অন্যান্য বিষয়াদির সাথে বারমাসিরও আমদানি করেছেন । প্রাচীন সাহিত্যিক রেওয়াজ অনুসারে সুফি-সাধক সৈয়দ সুলতান ধর্মীয় বিষয় অবলম্বনে কাব্য রচনা করলেও কিছুতেই উক্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে পারেন নি। না করলেই হয়তো পাঠক সম্প্রদায়ের কাছে হয়ত জনপ্রিয়তা লাভে ব্যর্থ হতেন ।

বিষয়: বিবিধ

১৭৭২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

348821
০৭ নভেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:১০
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : বারমাস্যা চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে এখনও প্রচলিত অনেক বৃদ্ধার কাছে। রহিমুন্নিসার বারমাস্যা রচনা করেই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃত এর স্বিকৃতি পেয়েছেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File