মধুমালতি

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ০৬ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:৪২:২৮ রাত



*বই: মধুমালতী

*লেখক: মনঝন

*সম্পাদনা: সৈয়দ আলী আহসান

*প্রকাশক: বই ঘর চট্টগ্রাম/১৩৮০ বাংলা



কবি মনঝন সেলিম শাহের রাজত্বকালে মধুমালতী রচনা আরম্ভ করেন , সেলিম শাহ শের শাহ শূরের পুত্র । ৯৫২ হিজরি অর্থাৎ ইংরেজি ১৫৪৫ সালে শের শাহের দেশান্তরের পর সেলিম শাহ শাসক হন। সে বছরই মনঝন মধুমালতী রচনা আরম্ভ করেন। সেলিম শাহের গুণকীর্তন করতে যেয়ে মনঝন বলেছেন যে, সেলিম শাহের ব্যক্তিত্ব এত অসাধারণ ছিল যে, উত্তরে হেমগিরি থেকে দক্ষিণে সেতুবন্ধ পর্যন্ত তার রাজত্ব বিস্তৃত ছিল । এটা অবশ্য অত্যুক্তি ।

শেখ মুহম্মদ গোস মনঝনের গুরু ছিলেন। মনঝন তাঁকে 'বড়ে শেখ বলে উল্লেখ করেছেন। শেখ গোস একজন সাধু-মাত্র ছিলেন না । তার যুগের একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিও ছিলেন। সম্রাট বাবরও তাকে শ্রদ্ধা করতেন। তিনি অনেকদিন পর্যন্ত অজ্ঞাতবাসে ছিলেন এবং শের শাহের দেহাবসানের পর ৯৫২ হিজরিতে তিনি অজ্ঞাতবাস ত্যাগ করেন। ৯৭০ হিজরিতে শেখ মুহম্মদের মৃত্যু হয়। মধুমালতীর এ পর্যন্ত কেবল চারটি পুথি পাওয়া গেছে। প্রথম পুথিটি রামপুরের নবাবের পুস্তকালয়ের। পুথিটি সুরক্ষিত, কিন্তু প্রারম্ভের একটি পত্র নেই। দ্বিতীয় পুথিটি ভারত কলাভবন, বারানসির। পুথিটির আদি মধ্য এবং অন্তে খণ্ডিত। এই দুটো পুথি ফার্সি হরফে লেখা । তৃতীয় পুথিটিও ভারত কলাভবনের। লিপিকর মাধোদাস এবং লিপি দেবনাগরী । চতুর্থ পুথিটি একডল জিলা ফতে-পুরের, বর্তমানে ভারত কলাভবনে রক্ষিত। ১৯৬১ সালে এই চারটি পুথি সম্পূর্ণ পরীক্ষা করে ডক্টর মাতা-প্রসাদ গুপ্ত একটি সুসম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশ করেন । আর সেই কপি হতেই বাংলায় মধুমালতি সম্পাদনা করা হয়।

মনঝন তার রচনার প্রারম্ভে আল্লার গুণগান, রসূল ও চার খলীফার প্রশংসা, সেলিম শাহ এবং পীর ও আশ্রয়দাতার গুণগান করে বচনের প্রশংসা করেছেন, বাংলায় আমরা যাকে বলি বাণী-বন্ধন ।

>>কাহিনী সংক্ষেপ:

কনৈগিরি গড় নামে একটি প্রাচীন নগরের রাজা ছিলেন সূর্যভান । তার কোন সন্তান ছিল না। একদিন এক তপস্বী এলেন রাজদরবারে। রাজা বার বছর পর্যন্ত তার সেবা করলেন । সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে তপস্বী রাজাকে এক পিণ্ড তৈরি করে দিলেন পাটরাণীর আহারের জন্য। রাণীর গর্ভ হলো এবং দশমাস পর তিনি এক রাজকুমারের জন্ম দিলেন। পণ্ডিত এবং জ্যোতিষীগণ রাজকুমারের গ্রহ-নক্ষত্র বিচার করে তার নাম রাখলেন মনোহর। তারা আরও বললেন যে, চৌদ্দ বছর এগারো মাস যখন এর বয়স হবে, তখন সে আপন প্রেমিকাকে দেখবে এবং তার বিরহে বিরাগী হয়ে ঘুরতে থাকবে নানা অঞ্চলে এক বছর পর্যন্ত। যাই হোক, ক্রমান্বয়ে রাজকুমার বড় হলও, পঞ্চম-বর্ষে তার বিদ্যারম্ভ হলও, বার বছরের মধ্যে সমস্ত বিদ্যায় সে পটু হলও। রাজা বৃদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বার বছর বয়সে কুমারকে রাজতিলক দিলেন। যখন রাজকুমারের বয়স হলও চৌদ্দ বছর এগারে মাস, তখন এক রাত্রে রাজকুমার একটি নৃত্যগীতের উৎসবে উপস্থিত ছিলেন। অর্ধ-রাত্রির পর তাপন কক্ষে এসে গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হলেন সেই মুহূর্তে কয়েকজন অপসরা শূন্যপথে যাচ্ছিল। তার রাজকুমারের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলো এবং স্থির করলো যে, তার উপযুক্ত কোনো কন্যা তারা খুঁজে বার করবে। তখন তাদের মনে পড়লো মহারস নগরের বিক্রমরাজ-কন্যা মধুমালতীর কথা। তখন তারা উভয়ের রূপের তুলনা করবার জন্য পালঙ্কসহ রাজকুমারকে নিয়ে উপস্থিত করলে মধুমালতীর নিভৃত কক্ষে। মধুমালতীর নিভৃত কক্ষে মনোহর নিদ্রা থেকে জাগলো এবং ঘুমন্ত মধুমালতীকে দেখলে । সুন্দরীকে দেখে তার হৃদয়ে পূর্ব জন্মের প্রীতি উদিত হলে । রাজকুমার মধুমালতীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শোভা নিরীক্ষণ করতে আপন মনে ভাবলো, সেই ব্যক্তির জন্য ধন্য হবে, যাকে এই সুন্দরী প্রেম করবে। সুন্দরী তখন জেগে উঠলে নিদ্রা থেকে। শয্যার পাশে অপরিচিত রাজকুমারকে দেখে তার মনে ভয়ের সঞ্চার হলো । কিন্তু ধৈর্য ধারণ করে রাজকুমারের পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। কুমার আপন পরিচয় দিলে৷ এবং কন্যার পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। কুমারীও আপন পরিচয় দিলো । কুমার তখন প্রেমে অভিভূত হয়ে কুমারীর চরণ ধারণ করলো। কুমারী তখন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলে যে, রাজকুমারের এভাবে অভিভূত হওয়ার কারণ কি ? প্রশ্নের উত্তরে কুমার বললে যে, যেদিন বিধাতা তাকে সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই সে রাজকুমারীর প্রেমিক এবং সেদিন থেকেই সে বিরহ ভার বহন করছে। তার হৃদয়ে বেদন ছিল, কেননা সে ছিল প্রীতি-মুগ্ধ। তারা দুজন ছিল অভিন্ন | কুমার ছিলে শরীর এবং কুমারী ছিল তার প্রাণ। এতদিন পর্যন্ত সে প্রাণ-বিহীন জীবন যাপন করছিলো, কিন্তু অদ্য রাত্রের এই সাক্ষাৎকারের পর তার শরীরে প্রাণ প্রবেশ করেছে। একথা শুনে কুমারীর মনেও পূর্ব জন্মের কথা স্মরণ এলো | কুমারী স্বীকার করলে যে, এখন আর কেউ তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ আনতে পারবে না। কুমারীর এই প্রেম-বার্তা শুনে কুমারের দেহে কামনার চাঞ্চল্য জাগলে। কুমার কামিনীর

কুমার কামিনীর বক্ষ স্পর্শ করবার জন্য হাত বাড়ালে ; কিন্তু কুমারী তাকে বাধা দিলো এবং বললে যে, দেহ স্পর্শ করবার পূর্বে রুদ্র, ব্ৰহ্মা এবং হরিকে সাক্ষী রেখে এ শপথ করতে হবে যে, জন্মজন্মান্তরে সে তার প্রেমিক থাকবে। কুমার বললে যে, যখন শরীর এবং প্রাণের আলোক পরস্পর অভিন্ন তখন শপথের প্রয়োজন কোথায় ? কিন্তু অবশেষে শপথ গ্রহণ করে তার অঙ্গুরি বিনিময় করলে এবং মিলনের তন্ময়তায় মগ্ন হল । তারা শয্যা পরিবর্তন করলো। নিদ্রাভিভূত হবার পর অপ্সরীগণ রাজকুমারকে নতুন শয্যার সঙ্গে তুলে নিয়ে তার নিজের কক্ষে রেখে এলো । সকালে সখীরা রাজকুমারীকে জাগালে । রাজকুমারী ব্যাকুল-বিহ্বল নয়নে চারদিকে দৃষ্টিপাত করলো ! সখীরা আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলে তার এ অবস্থার কারণ কি ? রাজকুমারী বললে সে স্বপ্নে এক রাজকুমারের সাক্ষাৎ পেয়েছিলো, যে তার হৃদয়ে প্রীতি জাগিয়ে চলে গেছে এবং তার কারণেই রাজকুমারী বিরহে পীড়িত হল। সথিরা তখন রাজকুমারীকে প্রবোধ দিলো । অন্যত্র কুমার যখন জাগল, সে মধুমালতীকে না পেয়ে বিকল হল । তার এ দশা দেখে তার ধাত্রী সহজ এ অবস্থার কারণ জিজ্ঞেস করলো, রাজকুমার সবকথা বলল। অধিকন্তু সে প্রতিজ্ঞার কথা ব্যক্ত করলে যে, সে মধুমালতীকে পাবার জন্য প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। রাজা এবং রানী রাজকুমারের এ দশ শুনে বৈদ্য ডাকলেন। কিন্তু বৈদ্য কুমারের শরীরে কোন ব্যাধি পেলে না। রাজার এক মহামাত্য কুমারের এ দশা দেখে ধারণা করলেন যে, কুমার নিশ্চয়ই কারো বিরহে ব্যথিত । তার অনুরোধে রাজকুমার মধুমালতীর ঘটনা বললে । মহামাত্য তাকে উপদেশ দিলেন যে, কোনও নারীর মোহে জীবনকে মই করা উচিত নয়।

তার উপদেশের প্রভাব কুমারের উপর পড়লে না। রাজ রানী এ সংবাদ শুনে ব্যথিত হলেন এবং ক্ৰন্দন করতে লাগলেন। কুমার তখন অনুমতি চাইলো যে, সে মহারস নগরে গিয়ে মধুমালতীর সন্ধান করবে। রাজ-রানী অনেক বললেন যে তার বৃদ্ধ হয়েছেন। এ অবস্থায় কুমারের দেশে থাক। কর্তব্য। কিন্তু কুমার কারো কথা না শুনে যোগীর বেশ ধারণ করে যাত্রা করলে দূরের পথে।

রাজকুমার সঙ্গী-সাথী নিয়ে পথ চললে। চলতে চলতে তারা এলো সমুদ্রতটে । চারমাস জলযান করে সমুদ্র-পথে তার চলল । তারপর একদিন হঠাৎ তাদের জলযান ভেঙে গেলে । কুমার ব্যতিরেকে সকলেই সমুদ্র-পথে প্রাণ হারালে । কুমার কোনও প্রকারে সমুদ্রতটে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে রইলো। সেখান থেকে কুমার নিকটবর্তী এক ঘন বনের মধ্যে প্রবেশ করলে । চলতে চলতে দ্বিতীয় দিন কুমার একস্থানে এসে উপস্থিত হলও, যেখানে একটি চৌখণ্ডী ছিলে । চৌখণ্ডীর ভিতর প্রবেশ করে সে দেখলে একটি শুভ্র কোমল শয্যায় এক ঘুমন্ত রাজকুমারীকে। এই নির্জন স্থানে রাজকুমারীকে দেখে কুমার আশ্চর্য হল। রাজকুমারী জেগে উঠে কুমারের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে। আরো জিজ্ঞেস করলে৷ সে কি করে এই নির্জন বনে এলো ? কুমারও তাকে একই প্রকার প্রশ্ন করলো। কুমারী বললে যে, সে চিত্ত-বিশ্রাম নগরের রাজা চিত্র-সেনের কন্যা এবং তার নাম পেমা । একদিন সাথিদের সঙ্গে সে যখন আম্রকাননে ক্রীড়া কৌতুকে মত্ত ছিল, সে সময় মধুকরের উৎপাতে তারা অত্যন্ত বিব্রত হল । সাথিরা সকলে পালিয়ে গেলো। এ সময় একটি রাক্ষস এসে তাকে নিয়ে এক বনখণ্ডের মধ্যে বন্দী করলো। কুমার তার দুঃখে দুঃখিত হল । কুমারী জানালে যে রাক্ষসের ফিরে আসতে বিলম্ব আছে। এই অবসরে কুমার তার কাহিনী বলতে পারে। কুমার জানালে যে, সে তার প্রেমিক মধুমালতীর সন্ধানে চলেছে। আপন পরিচয় দিয়ে দিয়ে কুমার সেই রাত্রির ঘটনা জানালো, যে রাত্রে সে মধুমালতীর উপর অনুরক্ত হয়। পেম জানালে যে মধুমালতী তার বাল্যসখা । মধুমালতী যখন শিশু তখন তার মাত এবং পেমার মাতা পরস্পর বন্ধুত্ব-সূত্রে আবদ্ধ হন এবং মধুমালতীর মাতা সঙ্গীত্বের নিদর্শন স্বরূপ প্রতিজ্ঞ করেন যে, প্রত্যেক মাসের দ্বিতীয়ায় কন্যাকে নিয়ে তিনি সখী-গৃহে আসবেন। প্রেম বললে

যে, যদি কুমার পেমার মাতৃ-গৃহে যায় এবং সেখানে যেয়ে আত্মপরিচয় দেয়, তবে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে। কুমার এ কথায় প্রফুল্লিত হল , কিন্তু বললে যে, সে পেমাকে এ অবস্থায় ফেলে যেতে পারে না। এখন থেকে পেম। তার ভগ্নী। পেমা তাকে অহেতুক বিপদের সম্মুখীন হতে নিষেধ করলো। কিন্তু কুমার বললে যে, রাক্ষসকে হত্যা করেই সে স্থান ত্যাগ করবে, তার পূর্বে নয়। যখন রাক্ষসের ফিরবার সময় এলো তখন কুমার ভাবলে যে, তার কাছে তো অস্ত্র নেই, সে কি দিয়ে রাক্ষসকে হত্যা করবে ? পেম। তাকে অস্ত্র দিলো | রাক্ষস এসে পৌঁছল। কুমারকে দেখে প্রশ্ন করলে যে, সে কে এবং সে কেন প্রাণ দিতে এসেছে ? কুমার বললে যে, সে তাকে হত্যা করে পেমাকে নিয়ে যাবে। যুদ্ধ আরম্ভ হল । কুমারের তরবারির আঘাতে রাক্ষসের এক মস্তক এবং দুই ভুজ বিচ্ছিন্ন হলে । রাক্ষস তার মস্তক এবং দুই ভুজ উঠিয়ে নিয়ে চলে গেলো এবং আবার সে ফিরে এলো পূর্বের রূপে। এ যুদ্ধে করো জয় হলে না, কারো পরাজয়ও ঘটলে না । ইতিমধ্যে রাত্রি হল এবং রাক্ষস তার প্রয়োজনীয় কর্মে বাইরে গেলে । পেমা তখন কুমারকে রাক্ষসের পুনরুজ্জীবনের রহস্য বললে। দক্ষিণ দিকে একটি উদ্যানের মধ্যে অমৃত বৃক্ষ আছে। সেই অমৃত বৃক্ষ উৎপাটন করলে রাক্ষিসের মৃত্যু ঘটবে। একথা শুনে কুমার পেমাকে সঙ্গে নিয়ে অমৃত-বৃক্ষ উৎপাটন করলো, সকালে আবার রাক্ষস এলে যুদ্ধের জন্য। রাক্ষস আহত হয়ে অমৃত-বৃক্ষের সন্ধানে গেলো, কিন্তু উৎপাটিত বৃক্ষ দেখে নিরাশ হয়ে প্রাণত্যাগ করলে।এরপর তারা এলে চিত্তবিশ্রাম নগরে। চিত্ৰসেন সংবাদ পেয়ে উল্লাসের সঙ্গে তাদের গ্রহণ করলেন। পেমার উদ্ধারের সংবাদ শুনে চিত্ৰসেন কুমারকে অনেক সন্মান করলেন। চারদিন পর কুমার যখন মধুমালতীর সন্ধানে যেতে চাইলে, তখন পেমা বললে যে, পরের দিন দ্বিতীয়া । মধুমালতীকে নিয়ে আগামী দিন নিশ্চয়ই তার মাতা আসবেন, মনোহরকে সে চিত্রসারীতে বিশ্রাম নিতে বললে এবং জানালে যে সেখানেই মধুমালতীর সঙ্গে তার মিলন ঘটবে। দ্বিতীয়ার দিন মধুমালতী এলো এবং পেমার কাছে তার উদ্ধারের কাহিনী শুনলে । প্রসঙ্গক্রমে পেম রাজকুমার মনোহরের কথা বললে । মধুমালতী স্বীকার করলে যে রাজকুমার তার প্রেমিক। পেমা তখন তাকে

নিয়ে চিত্রসারীতে মনোহরের কাছে পৌঁছে দিলে এক সখী যেয়ে প্রথমে জানালো যে, মধুমালতী এসেছে। মধুমালতীর নাম শুনে মনোহরের শরীরে সাত্ত্বিকভাব জাগল। কম্প হল এবং মুখে বচন এলো না, চিত্ত অচৈতন্য হলে এবং নেত্র মুদিত হল ।

সাক্ষাতের পর মনোহর মধুমালতীর কাছে আপন বিরহের কথা বললে, মধুমালতীও তাকে আপন বিরহ-বেদনার কথা শুনল । মনোহর তখন মধুমালতীর অধরামৃত পান করতে চাইলে । মধুমালতী বললে যে যতদিন পর্যন্ত না। তাদের ধর্ম-বিবাহ হয়, ততদিন পর্যন্ত তারা সুরত-সুখে বিরত থাকবে। মনোহর স্বীকৃত হল এবং উভয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে শুয়ে রইলো |

মধুমালতীর অত্যধিক বিলম্ব দেখে তার মাতা রূপমঞ্জরী চিন্তিত হলেন। তিনি তার সন্ধানে কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে ঘুরতে লাগলেন। অবশেষে চিত্রসারীতে উভয়কে আলিঙ্গনাবদ্ধ দেখে ক্রুদ্ধ হলেন এবং পেমাকে তিনি কটুক্তি করলেন। পেমা মধুমালতীর পূর্বরাগের কথা বললো এবং এবং জানালে যে, এদের উভয়ের প্রেম নিঃষকলুষ। রূপমঞ্জরী পেমার কাছে মনোহরের পরিচয় পেলেন। রপমঞ্জরী দুজনকে একে অন্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করলেন এবং সুষুপ্তা মনোহরকে কনৈগিরি পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন এবং সুষুপ্তা মধুমালতীকে নিয়ে এলেন আপন গৃহে ।

কুমার জেগে উঠে মধুমালতীকে না পেয়ে শিরে করাঘাত করে রোদন করতে লাগলো এবং পুনরায় মধুমালতীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লো। অন্যদিকে মধুমালতীও জেগে উঠে বিরহে ব্যথিত হয়ে রোদন করতে লাগলে । রূপমঞ্জরী তাকে অনেক প্রকার প্রবোধ দেবার চেষ্টা করলেন এবং বললেন যে, এভাবে কুলের কলঙ্ক করা তার উচিত নয়। কিন্তু কিছুতেই মধুমালতী শান্ত হলে না। তখন রূপমঞ্জরী মধুমালতীর দেহে মন্ত্রপত পানি ছিটিয়ে দিলে । মন্ত্রের প্রভাবে মধুমালতী পাখি হয়ে উড়ে গেলো। রাণী তখন নিজের অন্যায়ের কথা বুঝতে পারলেন এবং হাহাকার করলেন ।

পাখী হয়ে মধুমালতী উড়ে চললে মনোহরের সন্ধানে। কিছু দূর যেয়ে মনোহরের মতো অন্য এক রাজকুমারকে দেখল, যে ছিলো পোনের গড়ের রাজপুত্র। নাম তারাচাঁদ। পক্ষীরূপী মধুমালতী তারাচাদের প্রাসাদ-শীর্ষে এসে বসলে । কুমার তারাচাঁদ জাল বিছিয়ে পক্ষীকে ধরল ।

তারাচাঁদ মধুমালতীকে রাখলে সোনার খাঁচায় এবং তার সামনে রাখলে নানা প্রকার আহার্য। কিন্তু তিনদিন গেলে মধুমালতী কিছুই খেলে না । কারণ জিজ্ঞেস করার পর মধুমালতী আপন দুঃখের কথা বললে । মধুমালতীর কাহিনী শুনে তারাচাদ প্রতিজ্ঞ করলে যে মহারস নগরে যেয়ে মধুমালতীকে তার মনুষ্য-রূপ ফিরিয়ে দেবে এবং তারপর মনোহরের সঙ্গে তার মিলন ঘটাবার জন্য যত্ন করবে। অতঃপর কুমার তারাচাঁদ পক্ষীরূপী মধুমালতীকে সঙ্গে নিয়ে মহারস নগরের দিকে যাত্রা করলে |

তারা মহারস নগরে এলে । রাজা এবং রাণী সমাচার পেয়ে দৌড়ে

এলেন। রাণী মন্ত্র পড়ে মধুমালতীকে আবার নারী-রূপ দিলেন। তিনি উদ্ধারকর্তা তারাচাদের হাতে মধুমালতীকে সমর্পণ করতে চাইলেন, কুমার তারাচাঁদ বললে যে, মধুমালতীর মিলন একমাত্র মনোহরের সঙ্গে হতে পারে ।

রাজরানী একথা শুনে পেমার কাছে পত্র লিখলেন। সন্দেশ-বাহককে বললেন যে, যদি মনোহরের সঙ্গে সাক্ষাত হয় তবে তাকে যেন সঙ্গে নিয়ে আসে। পত্রবাহক যখন পেমার কাছে উপস্থিত হয়ে রূপমঞ্জরীর সংবাদ ব্যক্ত করছে, সে সময় পেমার এক সখী দৌড়ে এসে সংবাদ দিলে যে, রাজকুমার মনোহর যোগীর বেশ ধারণ করে সেইস্থানে উপস্থিত হয়েছে। পেম। তখন রাজকুমারকে আপ্যায়ন করে নিলো এবং তাকে মধুমালতীর সমাচার শুনালো । রূপমঞ্জরীর পত্রের উত্তরে পেমা লিখলে যে যদি সত্যই মনোহরের সঙ্গে মধুমালতীর বিবাহের ব্যবস্থা তারা করতে চান, তবে তারা যেন পেমার পিতৃগৃহে উপস্থিত হন। মধুমালতীর কাছেও সে পত্র দিলে। কুমার মনোহরও এক গুপ্ত পত্র প্রেরণ করলে । গে পত্রে কুমার তার অনন্য প্রেম এবং বিরহের কথা জানালো ।

মনোহরের কুশল সমাচার পেয়ে রাজরানী প্রসন্ন হলেন এবং দিন স্থির করে তারা যাত্রা করলেন। দশদিন পথ চলে তারা সামিয়ানা টাঙ্গালো নদীর ধারে । এখান থেকে সংবাদ পাঠালেন চিত্রসেন এবং পেমার কাছে | চিত্ৰসেন এবং পেমা সেখানে এলো । বিবাহের তিথি নির্ধারিত হল এবং সে তিথি অনুসারে মনোহর এবং মধুমালতীর বিবাহ হলে । বিবাহের পর তারা সুরত শয্যায় মিলিত হল । বিক্রমরাজ বিবাহ প্রসঙ্গে অনেক উপঢৌকন দিলেন ।

দ্বিতীয় দিন মনোহর তারাচাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলে এবং ইচ্ছা প্রকাশ করলে যে তার দুজনে বন্ধুর মতো এক সঙ্গে থাকব। বিক্রমরাজ এই ইচ্ছা সমৰ্থন করলেন। মিত্রতা-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তারা সঙ্গে সঙ্গে থাকতে লাগলো। একদিন তারাচাঁদ মৃগয়ার অভিলাষ করলো, মৃগয়ান্তর জলস্রোতে স্নানের জন্য নামলে । স্নান সমর্পণ করে তারাচাঁদ যখন প্রত্যাবর্তনের পথে, তখন সে চিত্রসারীর নিকটে ঝুল-খেলায় রত একটি রমণী দেখল ঝুলন্ত অবস্থায় তার অঞ্চল উড়ছিল । তারাচাদ তার দেহ সৌষ্ঠব দেখে মূর্ছিত হয়ে পড়লো। মধুমালতী এবং মনোহর সংবাদ শুনে সেখানে এলো এবং তারাচাদকে সুস্থির করে রাজমন্দিরে নিয়ে এলে । বৈদ্যগণ তাকে পরীক্ষা করে বলল যে তার শরীরে কোনো বেদন নেই | সম্ভবত: এর চিত্ত অন্য কোথাও ন্যাস্ত , তাই যে বস্তু দেখে তার চিত্তবিভ্রম হয়েছে, তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার ঘটলেই এ সম্পূর্ণ ভাবে সচেতন হবে। মধুমালতী তারাচাদের নিকট এসে জিজ্ঞেস করলে যে, কে সে, কাকে দেখে তার দেহ চেতনাশূন্য হয়েছে ? তারাচাঁদ বললে যে তার নাম সে জানে না ; সে তাকে এক মুহূর্তের জন্য দেখেছে ঝুলন্ত অবস্থায় । তারাচাঁদ তখন সে রমণীর অঙ্গ সৌষ্ঠব বর্ণনা করলে । মধুমালতী বললে যে সম্ভবত: এ রমণী পেমা ।

মনোহরের সঙ্গে মধুমালতী আলোচনা করলে এবং বললে যে তারাচাদের সঙ্গে পেমার বিবাহ স্থির করতে হবে । মনোহর পেমার পিতা চিত্রসেনের কাছে বিবাহের প্রস্তাব আনলে । প্রস্তাব স্বীকৃত হল এবং শুভ-লগ্নে তারাচাদের সঙ্গে পেমার বিবাহ হলে । রাত্রিতে দুজনে সুখশয্যায় মিলিত হলে এবং প্রথম সমাগমের আনন্দ অনুভব করলো । সমস্ত বর্ষা দুই রাজকুমার একসঙ্গে রইলো। তারপর উভয়ে চিত্রসেনের কাছে প্রস্তাব করলে যে তারা আপন আপন দেশে প্রস্থান করবে। চিত্ৰসেন বিক্রমরাজার কাছে এলেন এবং কুমারদের প্রস্তাব শুনলেন। বিক্রমরাজ স্বীকৃত হলে। দুই রাজকুমারীর মাতা কন্যাদের উপদেশ

দিলেন। দুই রাজকুমার আপন তাপন প্রিয়তমাকে নিয়ে পথযাত্রা করলো। চার ক্রোশ পর্যন্ত একসঙ্গে চলে তারা একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিলে। মধুমালতী তারাচাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিদায় নিলো , এভাবে পেমাও মনোহরের নিকট বিদায় নিলো। কুমারীরাও একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিলো ।

তারাচাদ মানগড়ের পথে এবং মনোহর কনৈগিরির পথে যাত্রা করলো। দুবছর পর মনোহর পৌছলে কনৈগিরি। যখন দেশে কুমারের আগমন সংবাদ পৌঁছলও, সমগ্র দেশ আনন্দে উৎফুল্ল হল | রাজকুমার রাজকুমারীকে সঙ্গে নিয়ে পিতামাতার চরণ স্পর্শ করলে ।

কাহিনী এখানেই সমাপ্ত হল---

রাজা রাণী পুত্রবধূ লইয়া হরিষে

সুখেতে রাজত্ব করে আপনার দেশে।

বিষয়: বিবিধ

১৩২৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

348673
০৬ নভেম্বর ২০১৫ সকাল ১১:২৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
সে সময় এর কমন কাব্য। তবে এই ধরনের রুপকথা কাব্যেও আলাওল ও সৈয়দ সুলতান ব্যাতিক্রম। তারা দেবতার চেয়ে মানব নিয়েই কাব্য রচনা করেছেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File