সহমরণ/সতীদাহ

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ০৩ নভেম্বর, ২০১৫, ০৫:৪৫:৩৬ বিকাল

সহমরণ/সতীদাহ

---------------

সতীদাহ প্রথা স্বামীর শব দাহের সঙ্গে বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত দাহ করার পূর্বেকার হিন্দুধর্মীয় প্রথা। সংস্কৃত ‘সতী‘ শব্দটি আক্ষরিক অর্থে এমন সতীসাধ্বী রমণীকে বোঝায় যিনি তার স্বামীর প্রতি চূড়ান্ত সততা প্রদর্শন করেন এবং তার আত্মীয়-স্বজনদের প্রতিও থাকেন সত্যনিষ্ঠ। কিন্তু একটি আচার হিসেবে সতীদাহের অর্থ হলো মৃত স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর সহমরণের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা এবং ওই অনুষ্ঠানে তূরীবাদক জনতার মাঝে স্বামীর শেষকৃত্যের চিতায় আরোহণ করা।

কবে এবং কিভাবে এ ধরনের আচার ধর্মীয় প্রথারূপে গড়ে উঠেছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কিন্তু এই আত্মহত্যার নেশা শুরু হয়েছিল কবে কেউ জানে না। কেউ বলে ঋগ্বেদের কালে, কেউ বলে—তারও আগে। কেউ বলেন—এ অনার্য ভারতের আদিম অভ্যাস। কেউ বলেন এর আদি স্কাইথিয়া, কারও কারও মতে স্ক্যাণ্ডিনেভিয়া। ইউরোপ, আফ্রিকা, সেকালের আমেরিকা, একালের এশিয়া— কমবেশি পৃথিবীর সর্বত্র সহমরণের কাহিনী আছে।অতীতে বিশ্বের বহু সমাজে মানুষের আত্মাহুতি প্রথার অস্তিত্ব ছিল বলে নৃবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকরা মোটামুটি একমত।মহাভারতে পাণ্ডুর স্ত্রী মাদ্রি সহমরণে যান (কিন্তু কুন্তী যাননি,অর্থাৎ মাদ্রি স্বেছায় যান এ কাহিনিও ফাঁদা হয়েছে)। রাজপুতানায় "জহর ব্রত" প্রচলিত হয়েছিল যাতে কোনো শহর দখল হওয়ার পূর্বেই পুরনারীরা আত্মসম্মান রক্ষার্থে আগুনে ঝাঁপ (জহর বা বিষ) দিয়ে স্বেছায় মৃত্যুবরণ করতেন,যা সতীদাহের অনুরূপ বলে অনেকে দাবি তোলেন। বলেন সতীদাহ প্রথা রাজপুতরাই চালু করেছিল। পরে এই বিষ নাকি পুরো অখণ্ড এবং বৃহৎ ভারতে ছাড়িয়ে পড়েছিল। কালক্রমে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে হিন্দু স্ত্রীকে সহমরণে বাধ্য করা হত। বিশেষ করে কোনো ধনী লোকের মৃত্যুর সম্পত্তি অধিকার করার লোভে তার আত্মীয়রা তার সদ্যবিধবা স্ত্রীকে ধরে বেঁধে,ঢাক-ঢোলের শব্দ দ্বারা তার কান্নার আওয়াজকে চাপা দিয়ে তার স্বামীর সাথে চিতায় শুইয়ে পুড়িয়ে মারত। আর এ ঘটনা ঘটানোর ইন্ধন জোগাত “বর্ণশ্রেষ্ঠ”ব্রাহ্মণরাই।

*গ্রিক লেখক ডিওডোরাস (আনু. ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এক সতীদাহের ঘটনার বর্ণনা দেন। এই বর্ণনার সঙ্গে আঠারো শতকের প্রচলিত সতীদাহ ব্যবস্থার প্রায় অবিকল মিল রয়েছে।

*গুপ্ত সাম্রাজ্যের আগে থেকেই এ প্রথার প্রচলন সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায়।

* ইংরেজরা এদেশে এসে দেখলেন, রৌদ্রকরোজ্জ্বল হিন্দুস্তান চিতার ধোঁয়ায় এক অন্ধকার দেশ। ১৭৭৮ সন। উইলিয়াম জোন্স-এর চিঠিতে সে কাহিনী প্রথম পৌঁছাল বিলেতে। শুরু হল অনুসন্ধান। অবশ্য বেসরকারিভাবে।

* দেখা গেল—মহাভারতে পাণ্ডুর স্ত্রী সতী হওয়ার জন্য কাড়াকড়ি করছেন এবং শ্রীকৃষ্ণের চারজন স্ত্রী তার সহগামী হয়েছেন।

* এ দিকে শ্লোকের সন্ধান পাওয়া গেল--

(১) অথর্ববেদ : “আমরা মৃতের বধু হওয়ার জন্য জীবিত নারীকে নীত হতে দেখেছি।” (১৮/৩/১,৩)।

(২)পরাশর সংহিতা : “মানুষের শরীরে সাড়ে তিন কোটি লোম থাকে, যে নারী মৃত্যুতেও তার স্বামীকে অনুগমন করে, সে স্বামীর সঙ্গে ৩৩ বৎসরই স্বর্গবাস করে।” (৪:২৮)

(৩) দক্ষ সংহিতা : “যে সতী নারী স্বামীর মৃত্যুর পর অগ্নিতে প্রবেশ করে সে স্বর্গে পূজা পায়”।(৪:১৮-১৯)।

(৪) দক্ষ সংহিতা : “যে নারী স্বামীর চিতায় আত্মোৎসর্গ করে সে তার পিতৃকুল, স্বামীকুল উভয়কেই পবিত্র করে।”(৫:১৬০)। যেমন করে সাপুড়ে সাপকে তার গর্ত থেকে টেনে বার করে তেমনভাবে সতী তার স্বামীকে নরক থেকে আকর্ষণ করে এবং সুখে থাকে।

(৫) ব্রহ্মপুরাণ : “যদি স্বামীর প্রবাসে মৃত্যু হয়ে থাকে তবে স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর পাদুকা বুকে ধরে অগ্নিপ্রবেশ করা।”

(৬) মহাভারতের মৌষল পর্বে, কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর চার স্ত্রী রুক্ষিণী, রোহিণী, ভদ্রা এবং মদিরা তাঁর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন। এমন কি বসুদেবের আট পত্নীও তাঁর মৃত্যুর পরে সহমরণে গিয়েছিলেন।

পাণ্ডু দেহত্যাগ করলে তার দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী তাঁর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন।

(৭) ব্যাসস্মৃতি বলছে, চিতায় বিধবা নারী তার স্বামীর মৃতদেহে আলিঙ্গন করবেন অথবা তার মস্তকমুণ্ডন করবেন। (২:৫৫)।

(৮) ষষ্ঠশতকের বরাহমিহির তার বৃহৎসংহিতায় বলেন, “অহো নারীর প্রেম কি সুদৃঢ়, তারা স্বামীর দেহক্রোড়ে নিয়ে অগ্নিতে প্রবেশ করে।” (৭৪:২৩)।

(৯) রামায়ণেও আমরা দেখি,রাবণের কাছে বন্দি থাকাকালে সীতার “সতীত্ব” ঠিক ছিল কী-না সেটা জানার জন্য অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। সেটা ভগবান রামও অনুমোদন করে দেন! অথচ,রামের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অধিকার কারও ছিল না!

*এদিকে বিদেশী সূত্রেও খবর মিলল কিছু কিছু। গ্রীক ঐতিহাসিকেরা জানালেন— গ্রিক দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের সাথে ভারতে এসেছিলেন ক্যাসান্ড্রিয়ার ঐতিহাসিক অ্যারিস্টোবুলুস। তিনি( পাঞ্জাবে ) তক্ষশীলা শহরে সতীদাহ প্রথার ঘটনা তার লিখনিতে সংরক্ষণ করেছিলেন। গ্রিক জেনারেল ইউমেনেসের এক ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যুতে তার দুই স্ত্রীই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সহমরণে যান;এ ঘটনা ঘটে ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ।

*সেণ্টজেরোম, মার্কোপোলোও একই কথা বললেন। তারাও এখানে ওখানে এ ঘটনা দেখেছেন। দেখেছি মানে, জনৈক পর্তুগীজ জানালেন—বিজয়নগরে এক রাজার সঙ্গে তিনি এগার হাজার মেয়েকে মরতে দেখেছেন।

*অবশ্য ঐতিহাসিকেরা বলেন— একটা অতিশয়োক্তি। তবে ১৬১১ সন থেকে ১৬২০ সনের মাঝামাঝি এমন ঘটনা দক্ষিণ ভারতে কিছু কিছু ঘটেছে যেখানে এক আগুনে দু'হাজার তিন হাজার মেয়ে ছাই হয়ে গেছে। দক্ষিণ ভারত সতীর আসল ক্ষেত্র নয়, তাদের মহাশ্মশান উত্তর আর উত্তরপশ্চিম ভারত। যশলমীর যখন পুড়েছে (১২৯৫) তখন তার সঙ্গে চব্বিশ হাজার মেয়ে স্বেচ্ছায় পুড়ে মরেছিল। তারা ‘সতী নয়, জওহর ব্রতী’।

*১৭৮০ সনে যোধপুরের রাজা অজিত সিং যখন মারা যান তখন তার সঙ্গে চিতায় উঠেছিল ষাট জন রানি। বুদীর রাজা বুধ সিং যখন মারা গেলেন তখন সহগামিনী হলেন—আশিজন! সেই মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে চিতোরে এবং রাজস্থানের পথে প্রাস্তরে আজও দাড়িয়ে আছে—একের পর এক মহাসতী’। সতীদের নামে উৎসগীকৃত স্মৃতিস্তম্ভ সেগুলো |

*মধ্য এবং উত্তর ভারতের স্তম্ভগুলো সে তুলনায় অনুচ্চ। তাদের নাম—‘বীর কল’। বীরের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে তার গায়ে খোদাই করা হয় তার দুটি পা কিংবা একটি হাত। নীচে অন্য সারিতে থাকে তার জন্যে যে মেয়েরা আত্মাহুতি দিয়েছে তাদের মূর্তি। তবে মধ্যভারতে এ ধরনের মূর্তির চেয়ে জনপ্রিয় চিহ্ন সতীর হাতের ছাপ। শ্মশানযাত্রার আগে সতীর হাতে সিদুর মাখিয়ে বাড়ির দেওয়ালে একটা ছাপ রাখা হল। মেয়েটি পুড়ে মরার পর সেই ছাপ ধরে ধরে খোদাই করা হল তার হাতখানা। সিঁদুর রঞ্জিত সেই হাতের নিশানায় অতঃপর সেই বাড়ি আশেপাশের তীর্থ। বিকানীরের রাজবাড়ির দেওয়ালে জেনারেল হার্ভে পর পর এমনি সাঁইত্রিশখানা হাত গুণেছিলেন!

বাংলাদেশে এসব প্রথা নেই। এখানে ওখানে ছড়ানো কিছু কিছু সতী-ভিটে, নয়তো সতী-পুকুর ছাড়া এখানে সতীর পরম্পরাগত স্মৃতি বিশেষ কিছু নেই। তবে প্রত্যক্ষদশীদের কলমে লেখা স্বাক্ষর রয়েছে বিস্তর। শুধু বিস্মৃত, চমকিত বিদেশী ভ্রমণকারীদের বিবরণই নয়, উনবিংশ শতকের প্রথম দিককার কলকাতা এবং আশেপাশের খবরের কাগজগুলোর পাতা ওল্টালেই চোখে পড়ে তা। যথা : সহগমন!—শুনা গেল যে, বংশবাটিনিবাসি পঞ্চানন বসু নামক এক বর্ধিষ্ণু তৎসহগামিনী হইয়াছেন। (সমাচার দর্পণ, ১০ এপ্রিল, ১৮২৪) একটি নয়, দুটি নয়—পাতায় পাতায় এমনি সমাচার। ১৮০৩ সনে শ্রীরামপুর থেকে কেরী সাহেব কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। কলকাতাকে কেন্দ্র করে চারদিকে তিরিশ মাইল এলাকা ছিল তার অনুসন্ধান ক্ষেত্র। খবর নিয়ে দেখা গেল, এখানে আগের বছর সহমৃতা হয়েছে এমন মেয়ে সংখ্যায়—চারশ’ আটত্রিশ জন! পরের বছর দশজন নির্ভরযোগ্য লোককে আবার কাজে নামানো হল। এবার ঠিক হল, ছ’ মাসের পাকা হিসেব জোগাড় করতে হবে। তাতে দেখা গেল— সংখ্যাটি তিনশোয় দাঁড়িয়েছে। ক’ বছর পরে দেখা গেল—এ সংখ্যা ক্রমেই যেন আরও বাড়তির দিকে। ১৮১৩ সনে কড়াকড়ি করে আইন চালু হয়েছিল। ১৮১৪ সনটা এ আইনের ফল দেখা হয়নি। ১৮১৫ সনে বাংলাদেশে ‘আগুন-খেকী’ মেয়ের সংখ্যা ছিল—৩৭৮ জন, “১৮১৬ সাণ—৪৪২ জন, ’ ১৮১৭ সনে—৭০৭ জন, "১৮১৮ সনে—৮৩৯ জন, ১৮১৯ সনে—৫৬০ জন, ১৮২০ সনে—৫৯৮ জন, ১৮২১ সনে—৬৫৩ জন, ১৮২২ সনে— ৫৮৩ জন,১৮ ২৩ সনে—৫৭৬ জন, ১৮২৪ সনে—৫৭২ জন, ১৮২৫ সনে—৬৩৯ জন,

১৮২৬ সনে—৫১৮ জন এবং নিষিদ্ধ হওয়ার আগের বছর অর্থাৎ১৮ ২৮ সনে—৪৬৩ জন |

এর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশই যে খাস কলকাতার চিতায় আত্মাহুতি দিয়েছে সে কথা বলাই বাহুল্য। প্রথম চার বছরের হিসেব নিয়ে দেখা গেছে মোট ২৩৬৬ জন সতীর মধ্যে কলকাতাবাসিনী ১৪৮৫ জন!

বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির পুলিস সুপার মিঃ ডব্লিউ ইউয়ার-এর মতে তার পরিমাণ দশজনের মধ্যে মাত্র একজন। স্ত্রীম্যান সাহেব নিজে লিখেছেন ১৮২৬ সনে তিনি নিজে একজন সতীর সতীত্ব পরখ করে দেখেছেন। মেয়েটিকে সাহেব অনেক বোঝালেন। কিন্তু তাতে কিছুতেই সঙ্কল্পচু্যত করা গেল না। সে বলল—“আমাকে বুঝিয়ে কি লাভ সাহেব, আমি আমার স্বামীর সঙ্গেই মরে রয়েছি। এই দেখ, আমার নাড়ি পর্যন্ত চলছে না।’ স্ত্রীম্যান-এর সঙ্গীরা পরখ করলেন। দেখা গেল, মেয়েটির কথা সত্য। সত্যিই নাকি ওর রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে! সাহেব বললেন—একদিন ওকে পাহারায় আটকে রাখ। দেখ, মতিগতি পাল্টায় কিনা।—কিন্তু হায়, এ চেষ্টাও বিফল হল। স্ত্রীম্যানের চোখের সামনেই পরের দিন ও মেয়ে সতী হয়ে গেল। ১৮২৮ সনের ‘ক্যালকাটা রিভিউ-এ এমনি আরও একটা ঘটনার খবর আছে। সেটা ঘটেছিল হাওড়ার সালকিয়ায়। ১৮২১ সনের ১৮ই আগস্ট তারিখের ‘সমাচার দর্পণেও এমনি সংবাদ পাবেন পাঠকেরা। ২২ সনের ২৭শে এপ্রিলের কাগজের সংবাদটি আরও লোমহর্ষক। গয়ার এক বাঙালি-গিনী সহমরণে উদ্যতা হয়েছেন শুনে “গয়ার জজ শ্ৰীযুত মেং কিরিষ্টফর স্মিথ সাহেব গিয়া তাহাকে অনেক নিষেধ করিলেন। তাহাতে সে ব্রাহ্মণী আপন আঙ্গুলি অগ্নিতে দগ্ধ করিয়া পরীক্ষা দেখাইল তাহা দেখিয়া জজ সাহেব আজ্ঞা দিলেন তোমার যে ইচ্ছা তাহা করহ।”

সে মেয়ে মারা গেল। যদি কেউ ভাবেন, স্বামীহীনা মেয়েদের মৃত্যু ছাড়া সামনে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা ছিল না বলেই তারা এভাবে আত্মহত্যা করেছে, তবে ইতিহাস বলবে সে কথা সব সময় সত্য নয়। সত্য বটে, মৃতার তালিকায় ভবিষ্যৎহীন বৃদ্ধা এবং প্রৌঢ়ারা একটা উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায় ছিলেন, কিন্তু সাধারণত যে বয়সে মানুষের কাছে জীবনটা নেশার মতোই লোভের বস্তু বলে মনে হয়, সে বয়সের মেয়েরাও সে দলে একেবারে কম ছিলেন না। ১৮১৫ থেকে ২০ সনের মধ্যে এই কলকাতার যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাদের মধ্যে কুড়িজনের বয়স ছিল—ষোল। চব্বিশজনের বয়স ছিল তারও কম। তিনজন আট বছরের শিশু। ১৮১৮ সনে যারা সতী হন, তাদের মধ্যে উনপঞ্চাশ জনই ছিলেন কুড়ির নীচে এবং একশ’ পচিশ জনের বয়স ছিল কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে। ১৮২৩ সনের শান্তিপুরের একজন অষ্টাদশ বৎসর বয়স্ক পরমাসুন্দরী স্ত্রীর খবর শুনুন। “শান্তিপুরের থানাদার নানা লোক সমেত মানা করিতে সে স্থানে পহুছিল এবং ঐ স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিল যে, তুমি কেন এই মৃত ব্যক্তির সহিত দগ্ধা হইতে বাসনা করিতেছ। কি দরিদ্রতার ভয়ে কিংবা পরিবারের বিদ্রুপের ভয়ে এই কর্মে প্রবৃত্তা হইয়াছ। এ যুক্তি ব্যর্থ হল। এবং অনেক কথোপকথনের পর ঐ স্ত্রীর দুই ক্ষুদ্র বালককে তাহার সম্মুকে আনাইল, কিন্তু ঐ বালকদিগকে দেখিয়াও ঐ স্ত্রীর হৃদয়ে মাতৃস্নেহ জন্মিল না। ...ইহাতে ঐ থানাদার কহিলেক যে আমি নাচার হইলাম তোমার ইচ্ছা।” (সমাচার দর্পণ, ১৬ই আগস্ট, ১৮২৩) । এমনকি দেখা গেছে জোর করেও সব সময় এসব মেয়েকে চিতার মুখ থেকে ফেরানো যায় না। ক্লাইভ আর নবকৃষ্ণ একবার একটিকে কেড়ে রেখেছিলেন, কিন্তু বাচাতে পারেননি। না খেয়ে না খেয়ে সে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল। সতীদাহ উচ্ছেদ হওয়ার পরও কলকাতার খবরের কাগজে এ ধরনের খবর পাওয়া গেছে। মরতে যে চায় আইন তাকে বাচাবে কি করে? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—কেন এভাবে মরতে চায় ওরা ? ইতিহাস বলে—সে কারণ বহুবিধ। তার মধ্যে হিন্দুর সনাতন ধর্মবিশ্বাস একটি।

তারা বলেন—ভারতবর্ষ সতীর জন্যে খ্যাত বটে, কিন্তু মনে রাখতে হবে ভারতের বিপুল নারী সমাজের একটা ভগ্নাংশই মাত্র সতী হয়েছে এখানে। এবং খবর নিলে দেখা যাবে, যারা সতী হয়েছেন, তারা অধিকাংশই বড়ঘরের মেয়ে, কিংবা এমন সম্প্রদায়ের যারা সমাজের অন্যান্য শাখা থেকে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে ভাবেন। রাজপুত রাজাদের প্রাসাদে, বিজয়নগররাজের অন্দরে তাই সতী বেশি। রাজবাড়িতে সতী বেশি কারণ রাজাদের লোভ বেশি, সম্মানবোধ বেশি। একজন বৃদ্ধ নরপতি মৃত্যুশয্যায় যখন ভাবেন, তার এই প্রাসাদ-বোঝাই রানিরা অতঃপর যথেচ্ছাচারিণী হবেন—তখন মনে মনে তিনি শাত্তি পান না। তাই কারণও যে কিছু কিছু না থাকে এর পিছনে তা নয়। অনেকেই পুরুষ দাসদেরও মৃত্যুর নির্দেশ দিয়ে যেতেন। প্রাসাদের পরামাণিকও বাদ পড়ত না। ১৮১৮ সনের নিয়েছিলেন—একটি পরামাণিকও। আর একজন নির্দেশ দিয়ে গেলেন–রাজ অন্তঃপুরে যে বৃদ্ধা ব্রাহ্মণী পানীয় জল সরবরাহ করে, তাকেও যেন বাদ না দেওয়া হয় চিতার আগুন থেকে!

সুতরাং, ভারতবর্ষ যেদিন মুখে মুখে গর্ব করে বলল—“মরবে বধূ উড়বে ছাই, তবে তার বালাই গাই সেদিন সে সত্যই বর্বরের দেশ ছিল কিনা সে কথা তর্কসাপেক্ষ। সে তর্ক আজ অবাস্তর। এমনকি ইংরেজরাও তা কোনোদিন তোলেননি। আল বুকার্ক তার রাজ্য থেকে সতীদাহ উচ্ছেদ করেছিলেন—১৫২০ সনে। তৃতীয় শিখ গুরু অমর দাস (১৫৫২-৭৪) উচ্ছেদ করেননি, কিন্তু তিনি এই প্রথাকে নিন্দা করেছিলেন। আকবর আরও একটু এগিয়েছিলেন। রাজধানী থেকে প্রবলবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন—যোধপুর রাজের পুত্রবধূকে চিতার আগুন থেকে বাচাতে। এই একটি মেয়েকে তিনি বাঁচিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু তার কালে অগণিত মেয়ে সতী হয়েছিলেন। কারণ, স্বেচ্ছায় কেউ তা হতে চাইলে বাদশার তাতে অমত ছিল না। ইংরেজরাও মোটামুটি গ্রেট মোগল-এর সেই পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন। ১৮০৮ সনেও তাই হুগলির কালেক্টর সাহেব তার এলাকার সতীর বিবরণ পাঠিয়ে for-Coss-“I have the pleasure to forward the prescribed annual report of Suttee' etc. In to 3G, of GGE of কিংবা আত্মহত্যার বিবরণের ভূমিকা এটি! এই ভূমিকাসহই এই দেশের ইংরেজ সরকার চললেন অনেককাল। ’১৭ সনে কানুন হল। ১৮ সনে তার প্রবর্তক নিবর্তক সম্বাদ নিয়ে এগিয়ে এলেন নেটিভ রামমোহন। তার প্রায় দশ বছর পরে ১৮২৭ সনে গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন লর্ড বেণ্টিঙ্ক। সতীদাহ আইন পাশ হল তারও দু' বছর পরে, ২৯ সনে।

বিষয়: বিবিধ

১৪৩৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

348350
০৩ নভেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৩৪
শেখের পোলা লিখেছেন : বিধবাদের ওরা মানুষ বলেই গন্য করেনা৷ কোন মজলিশ বা উৎসবে সে অচ্ছুত,খাবার দাবার পোষাক, চলা ফেরা সবেই রয়েছে তার জন্য যন্ত্রনা৷ এ কথা ভেবেও অনেকে বেঁচে মরে থাকার চেয়ে আগুনে অ্প সময়ের কষ্টে মরাকেই বেছে নিত৷ ধন্যবাদ৷
348355
০৩ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০৮:৫০
হতভাগা লিখেছেন : উফ !কি বর্বর প্রথা ছিল সেটা !

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File