উইলিয়াম কেরী জীবন ও সাধনা

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২৮ অক্টোবর, ২০১৫, ০৯:৫০:৩০ সকাল

বইঃউইলিয়াম কেরী জীবন ও সাধনা

লেখকঃ সুশান্ত সরকার

প্রকাশকঃ জাতীয় কমিটি উইলিয়াম কেরীর দ্বিশত বর্ষপূর্তি উদযাপন- বাংলাদেশ ৩৩ সেনপাড়া পর্বতা,ঢাকা-১২১৬, ১১ই নভেম্বর ১৯৯৩ ।

মূল্যঃ ২০০টাকা( কিনেছি ৩০ টাকা)

>>শুরুর কথাঃ

বাংলা ভাষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি,শিক্ষা, সমাজে অষ্টাদশ শতকের শেষ ও উনবিংশ শতকের শুরুতে- সূচিত হয় নব জীবন চেতনা। এই নব জীবন জাগরণ তথা আধুনিকতা পাশ্চাত্যের সংস্কারমুক্ত ইংরেজী সভ্যতার সাহচর্যের ফল। আধুনিক সভ্যতার প্রতিভূ ইংরেজরা, মূলত এ দেশে এসেছিল আপাত দুটি উদ্দেশ্য চরিতার্থতায়।

প্রথমত: এ দেশ শাসন ও অবাধ সম্পদ লুণ্ঠন।

দ্বিতীয়ত: খ্ৰীষ্টধর্ম প্রচার। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের প্রত্যাশায় উইলিয়াম কেরী এদেশে আসেন অষ্টাদশ শতকের একেবারে শেষ প্রান্তে । মুখ্যত মিশনারী হিসেবে এদেশে এলেও তিনি ধারণ করে এনেছিলেন পাশ্চাত্য মানবতাবাদের নবতর চেতনা, আঁধার সুপ্তি ভাঙ্গার জাগরণী বাণী । ফলে উইলিয়াম কেরী একজন ধর্মযাজক হিসেবে কতটা চরিতার্থ হতে পেরেছিলেন সে বিষয়টি খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জকভাবে উল্লেখ্য নয়, তবে বাংলা ভাষা,সাহিত্য, শিক্ষা, সমাজে বহুযুগ সঞ্চিত, অশিক্ষার অন্ধকারজনিত শৃঙ্খল মুক্তির, জীবন সচেতনতার অন্যতম পথিকৃৎরূপে তার কর্মপ্রচেষ্টা, কৃতিত্ব নি:সন্দেহে ছিল অসামান্য। যে ঋণ প্রতিটি বাঙ্গালীকে সংবেদনে অথবা অবচেতনে স্বীকার করতেই হবে ।

মহাত্মা উইলিয়াম কেরী অষ্টাদশ শতকের শেষে বঙ্গদেশে এসে দীর্ঘ চল্লিশ বছর বাস করে যে বিশাল কর্মকাণ্ড গড়ে তুলেছিলেন- আজ তা ভাবলে অবাক হতে হয় । ড. কেরী সূচীত সেই সব বহুমুখী কার্যক্রমের কল্যাণকর প্রভাব আজও এদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ বিবর্তনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়। যদিও জাতীয় স্তরে বিশ্বের উন্নত দেশের মত ড. কেরীর সেই সব সৃজনশীল, সুদূর প্রসারী চিন্তা ও কর্মপ্রয়াস এদেশে বাস্তবে এখনো রূপলাভ করেনি। ড. কেরীর কর্মকাণ্ডের আলোচনা, গবেষণা ও মূল্যায়ন দুই শতাব্দী ধরে নানাভাবে, নানা প্রয়োজনে, বিভিন্ন ধারায় কমবেশী হয়ে আসছে। কিন্তু সেই সব আলোচনা ও মূল্যায়নের মধ্যে অসম্পূর্ণতা ও নিরপেক্ষতার অভাব লক্ষণীয়। কারণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ড. কেরী বঙ্গদেশে এসেছিলেন একজন খ্ৰীষ্টান মিশনারী হয়ে, খ্ৰীষ্টধর্ম প্রচার করাই ছিল তার মুখ্য উদ্দেশ্য। ফলে মিশনারী কেরীকে তার সমকালীন বাঙ্গালী সমাজ সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি, তার যুগান্তকারী কাজগুলোকেও তারা নিন্দা করেছেন। কেরী তার যুগকে অতিক্রম করে, অনেক অগ্রবর্তী ছিলেন, তাই তাকে মূল্যায়ন করা, তৎকালীন বাঙ্গালী সমাজের পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না। ইউরোপীয় নব জাগরণের চেতনা সমৃদ্ধ, কেরী যখন এদেশে এসেছিলেন, তখনও সেই নবজাগরণের ঢেউ বঙ্গদেশের উপকূলে এসে পৌছায়নি। বুদ্ধিজীবী বাঙ্গালী সমাজ সে সময় খ্ৰীষ্টান মিশনারীদের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন ছিলেন, মিশনারীদের কোন ভাল কাজকে গ্রহণ করার মত কোন উদার মানসিকতা, এমন বিরোধিতা-পূর্ণ পরিবেশে সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে সমাজ সংস্কার ও খ্ৰীষ্টধর্মে দীক্ষিত করার কারণেই এই বিরোধের সূত্রপাত হয়। না কেন – এদেশের তদানীন্তন বাঙ্গালী সমাজের কাছে এবং পরবর্তীকালেও উইলিয়াম কেরী ততখানিগ্রহণীয় ছিলেন না। ড. কেরী ও তার সহকর্মীদের চেষ্টায় এদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে, একথা জেনেও বাঙ্গালীর সংস্কার, তাদের যথার্থমূল্যায়নে বাধা স্বরূপ ছিল। কিন্তু আজ মনে হয় সে কুষ্ঠা অনেকাংশে কেটে গেছে, উপেক্ষার শেষ হয়েছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে চিন্তা চেতনার, সংস্কারের পরিবর্তন ঘটেছে ।

উইলিয়াম কেরী নিজ দেশে কখনো ফিরে যাননি। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে নিজেকে বাঙ্গালী বলে মনে করতেন। তার লেখা এবং জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে একথার সত্যতা নিরূপণ করা যায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের রসের ধারায় তিনি সিঞ্চিত ছিলেন বলেই মিয়মাণ বঙ্গীয় সমাজকে মুক্তির স্বাদ দিতে পেরেছিলেন। একটা কথা এখানে বিচার্য, উইলিয়াম কেরীকে খ্ৰীষ্টান সমাজ চেয়েছে কেবল মিশনারী রূপে চিত্রিত করতে; এবং তার অন্যান্য সমস্ত কাজকে দেখেছে মিশনার কাজের পরিপূরক রূপে। পক্ষান্তরে বাঙ্গালী সমাজ দীর্ঘকাল তাকে উপেক্ষা করেছে বিদেশী বলে এবং মনুষ্যতের চেয়ে জাত্যাভিমানকে বড় মনে করে। এই দুই মানসিকতার ফলে, দুই শতাব্দী ধরে কেরীর মূল্যায়ন যথাযথ ভাবে সম্ভব হয়নি। আজ সেই সব বাধা ও মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে, তাই কেরী ও তার। সহকর্মীদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে নতুন করে আলোচনা, গবেষণা ও মূল্যায়ন করা হচ্ছে। অধ্যাপক সুশান্ত সরকার তার উইলিয়াম কেরী: জীবন ও সাধনা গ্রন্থটিতে পূর্বের সমস্ত কুষ্ঠা ও উপেক্ষাকে অতিক্রম করে, উদার নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে এগারটি অধ্যায়ে উইলিয়াম কেরীর জীবন ও কর্ম সাধনাকে বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। এ প্রচেষ্টা গতানুগতিক নয়, একেবারেই ভিন্নধর্মী। তিনি একজন গবেষক, তার গবেষকের দৃষ্টি দিয়ে, মুক্ত মননে প্রতিটি বিষয় নিরীক্ষণ করেছেন, তুল্য মূল্য বিচার করেছেন নির্মোহভাবে ।

>>লেখক সুশান্ত সরকারঃ

সুশান্ত সরকার এর জন্ম ১৯৪৫ খ্ৰীষ্টাব্দে বৃহত্তর খুলনা জেলার বাগেরহাটের বিষ্ণুপুর গ্রামে। পিতৃদত্ত নাম সুশান্ত কুমার সরকার। গ্রামের স্কুল ও বাগেরহাট পি.সি. কলেজের পাঠ শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ খ্ৰীষ্টাব্দে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ. পাশ করেন। তারপর থেকে অধ্যাপনা জীবন শুরু, ১৯৭০ থেকে খুলনা সুন্দরবন আদর্শ মহাবিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে কর্মরত। ছাত্রজীবনেই সাহিত্য চর্চার সূত্রপাত। সে সময় থেকে সৃজনধর্মী সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি পেলেও, ১৯৮২ খ্ৰীষ্টাব্দে প্রকাশিত অধ্যাপক সরকারের ‘পালি প্রাকৃত সংস্কৃত ভাষাতত্ত্ব সমীক্ষা গবেষণা ধর্মগ্রন্থটি দেশ এবংবিদেশের বহুবিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সমাদৃত হয়েছে। ছোট গল্পকার হিসেবে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। তার 'পুঁজ পাচড়ার পাচালী’ (১৯৮৭) গল্পগ্রন্থের নাম গল্পটি একাধিক ভাষায় অনুদিত, নাটকাকারে মঞ্চায়িত ও পুরস্কৃত হয়েছে। দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ফলবতী মৃত্তিকা’ (১৯৯২)।

বাংলা সাহিত্যে নীতি কবিতা সদ্ভাবশতকের অমর কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারকে প্রায় বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে তুলে ধরেছেন লোকচক্ষুর সমীপে, তার শ্রমের ও ঘামের ফসল কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার গ্রন্থে (১৯৮৯), সাহিত্যের বিচিত্র অঙ্গণে সুশান্ত সরকারের সমান পদচারণা। ছোটগল্প, মঞ্চ-বেতার নাটক, রম্য রচনা, গান, কবিতা রচনায় তিনি সিদ্ধ হলেও সুশান্ত সরকার মূলত একজন গবেষক। উইলিয়াম কেরী: জীবন ও সাধনা তার একটি ভিন্ন মাত্রিক গবেষণা কর্ম। উইলিয়াম কেরীকে বিভিন্ন কৌণিক অবস্থান থেকে পুনরাবৃত্তি করে অবলোকন করতে চেয়েছেন- একেবারেই মুক্ত মননে, ঠুমরী গানের ঢং এ। এখানে তিনি প্রথাবদ্ধ নন- ভিন্নধর্মী।

সম্প্রতি আবহমান লোকজ সংস্কৃতির বিচিত্র আঙ্গিকের রূপ ও স্বরূপ অন্বেষায় তিনি নিমগ্ন। যাত্রা নামক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করছেন নিয়মিতভাবে-লোকজ সাহিত্য-সংস্কৃতির তথা ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহে, আকর্ষণে এবং বোধকরি সচেতন সমাজ মনস্কতায় ।

বিষয়: বিবিধ

১০০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File