১৯৫--পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধি (পর্ব এক)
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ৩০ এপ্রিল, ২০১৫, ০৪:২৪:০০ বিকাল
১৯৫--পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধি (পর্ব এক)
প্রথমেই বলে নিই এই লিখার তথ্য ***পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধি-১৯১ জন** ডা এম এ হাসান এর বই থেকে নেয়া।
**১৯৫ জন বন্দি যুদ্ধাপরাধি সৈনিকদের ছেড়ে দেয়ার কারন ...
১৯৭১ এর ২৫সে মার্চ কালোরাতে ক্রেকডাউন এর পর পর দখলদার পাকিস্তানি জান্তা East Bengal regiment সহ সকল বাহিনীর বাঙ্গালি সদস্যদের নিরস্ত্র করার হুকুম দেয়া হয়। পুর্বাঞ্চলে বেশিরভাগ বাঙ্গালি সদস্য পাক বাহিনীকে পরাস্ত করে অস্ত্র সহ আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। কিন্তু পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সহ সকল বাহিনী থেকে হাজার হাজার বাঙ্গালি সদস্য দের প্রথমে নিরস্ত্র পরে চাকুরিচুত ও গৃহবন্দি করা হয়। পরবর্তিতে ডিসেম্বরের সুরুতে তাদের গ্রেফতার করে ক্যাম্পে আটক রাখা হয়। পুলিশ ও আধাসামরিক মিলিশিয়া বাহিনীর বাঙ্গালি সদস্যদেরও গ্রেফতার করা হয়।
অনুরুপ ভাবে ডিসেম্বরের প্রথমদিকে যুদ্ধের সুরুতেই সরকারি ও বেসরকারি পদে কর্মরত বাঙ্গালি দের কে চাকুরিচুত ও নজরবন্দি করা হয়। মুক্ত চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। অনেককেই মিথ্যা পালানোর অভিযোগে গ্রেফতার বা হত্যা হয়।
১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্ত হয় এবং ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্নসমর্পন করে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী উভয় দেশের বেসামরিক নাগরিক দের বিনা negotiation এ ছেড়ে দেওয়ার কথা, সে অনুযায়ি বাংলাদেশ অবিলম্বেই বেসামরিক নাগরিক (সামরিকদের পরিবার পরিজন সহ) ছেড়ে দেয়।
পরবর্তিতে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন অফিসার-সৈনিক বাদে বাকি ৮৯ হাজার ৮ শত সৈন্য ছেড়ে দেয়া হয়।কিন্তু বর্বর পাকিস্তানিরা তাদের ১৯৫ জন অভিযুক্ত সৈন্য ফেরত না আসা পর্যন্ত কোন বাঙ্গালিকে ছাড়া হবেনা বলে হুংকার দেয়। কিন্তু আবার এদিকে পশ্চীম ফ্রন্ট এ আটক ভারতীয় সৈন্য এবং বিধ্বস্ত বিমান পাইলট সহ সকল ভারতীয় দের দ্রুতই ছেড়ে দেওয়া হয়।পাকিস্তানে চাকুরিরত বাংগালী ২০ হাজার সেনাসদস্য, নৌ ও বিমান বাহিনী, আধাসামরিক রেঞ্জার্স শিমান্তরক্ষী এবং পুলিশ সদস্য। এছাড়া সরকারি-আধাসরকারি সংস্থায় চাকুরিরিত ১৫-২০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারি, ছাত্র। দোকান, কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অগনিত বাঙ্গালি সহ মোট তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বাঙ্গালি পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছিল। এদের অনেকেই দির্ঘদিন স্থায়ীভাবে বসবাস করছিল।
এই চার লাখ হতভাগ্য বাঙ্গালিদের ৭১ সাল থেকে ৭৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে প্রায় তিন বছর যাবত যুদ্ধবন্দির মত জিম্মি করে রাখা হয়েছিল এই ১৯৫ জন পাকি যুদ্ধাপরাধির বিপরিতে।
U N H R, R ed cross. সহ অনেকের চেষ্টা সত্তেও চার লাখ আটক বাঙ্গালি দের ছাড়িয়ে আনা সম্ভব হয় নাই। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও এত বিশালসঙ্খক বেসামরিক নাগরিক দের এতো দির্ঘ সময় আটকে রাখার কোন উদাহারন দেখা যায় না। আটক চার লাখ বাঙ্গালির প্রায় সবাই মুসলমান হলেও আরব মুসলিমজাহান ও সাম্রাজ্যবাদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট এই ব্যপারে পাকিস্তান কে সমর্থন দেয়। ইতিমদ্ধে আটক নাগরিক দের অবস্থা দিনে দিনে আরো খারাপ হতে থাকে। তাদের পলায়ন ঠেকাতে শিবিরে-জেলে স্থানান্তর সুরু করে পাকিস্তানিরা। পলাতক বাঙ্গালি ধরতে হাজার রুপি পর্যন্ত পুরষ্কার ঘোষনা করা হয়েছিল।
এদিকে ১৯৭৩ রের পর O IC সম্মেলনের পুর্বে বংগবন্ধু বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে তীব্র চাপের সম্মুখিন হয়। বাংলাদেশকে ইসলামি দেশগুলোর সংস্থা O IC সদস্যভুক্ত করা হয়। আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, সৌদি রাজা ফয়সাল এবং জর্ডানের কিং হোসেন এর উদ্যোগে সাতটি মুসলিম দেশের প্রতিনিধি ঢাকা সফর করেন। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের উদ্যোগ থেকে সরে আসার জন্য বংগবন্ধুকে রাজী করাতে। মুজিব তা প্রত্যাখ্যান করেন .. কিন্তু তাদের চাপ অব্যাহত ছিল।এমতাবস্থায় দির্ঘদিন আটক বিপুলসংখক পনবন্দি বাঙ্গালিদের অসহায় অবস্থা বিবেচনা করে নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধপরাধি বিচার করা থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। যদিও যুদ্ধাপরাধ আইন ১৯৭৩ তৈরি করা ও ট্রাইবুনাল প্রস্তুতি নিয়ে বিচার শুরুর প্রকৃয়া চলছিল।
১৯৭৩ এর শেষ দিকে ও ১৯৭৪ এর প্রথম দিকে সিমলা তৃ-দেশীয় চুক্তির খসড়া তৈরি হয়। এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ১৯৫ জন সামরিক যুদ্ধপরাধি বন্দিদের সর্ত সাপেক্ষে ছেড়ে দিতে সম্মত হয়।
তবে পাকিস্তানি পক্ষকে কয়েকটা শর্ত চুক্তিপত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য করে। যার একটি ছিল -
"এই ১৯৫ জন অপরাধি কে ছাড়া হবেনা। যুদ্ধপরাধের বিচার পাকিস্তানেই করা হবে" কিন্তু পরে পাকিস্তান তা করেনি।
জিম্মি বাঙ্গালিদের ছেড়ে দেয়া সুরু হয় ১৯৭৪ এর দিকে। কিছু হাই অফিসিয়াল চামচাদের কিছু আগেই ছেড়ে দেয়া হয়।আন্তর্জাতিক রেডক্রস এবং U N H C R এর ভাড়াকরা কয়েকটি বিমান পালাক্রমে এদের নিয়ে আসে, বেশকিছু বাঙ্গালি রাশিয়ান জাহাজেও আনা হয় দেশে ফিরে আসার সময় তাদের সম্পুর্ন খালিহাতে আসতে হয়।এমন কি তাদের কোন টাকা পয়সাও আনতে দেয়া হয়নি। অনেকের গহনাগাটি কেড়ে রাখা হয়েছিল। বকেয়া বেতন এবং ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, সঞ্চয়পত্র, ইন্সুরেন্স পলিসি, ঘর-বাড়ী, দোকান, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আগেই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল।
এবার দেখে নিই সেই ১৯৫ যুদ্ধাপরাধী দের নাম এবং তাদের অপরাধ ও সংঘটনের স্থান ও সাক্ষীদের নাম। আর সুবিধার জন্য বাংলাদেশের ৬টি বিভাগে ভাগ করে দেখানো হয়েছে। আজ ঢাকা বিভাগ।
ঢাকা
**আসামীঃ(১-১৪) লে. জেনারেল টিক্কা খান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব, ব্রিগেডিয়ার বশির, ব্রিগেডিয়ার রাজা, ব্রিগেডিয়ার আসলাম, ব্রিগেডিয়ার শরীফ, ব্রিগেডিয়ার শফি, কর্নেল তাজ, মেজর আসলাম,ক্যাপ্টেন সাঈদ, ক্যাপ্টেন তারেক, সুবেদার শের শাহ্ খান, আকবর (র্যা ঙ্ক অজানা)
>>অপরাধের ধরনঃ গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নসিংযোগ ।
>>সাক্ষীঃ অরুন কুমার দে, রেনুবালা দে, ফরিদা খানম, আবদুল খালেক, হাসিনা বেগম, রাম রাজীয়া পার্শ্বী, মনোরঞ্জন দাস,গাঙ্গুলী বাবু, পাগলনাথ সুর, শহীদ জননী সালেমা বেগম, জিল্লুর রহমান,
নুরুদ্দীনমিয়া, আওয়াল খান, ফকির সফির উদ্দীন আহমেদ, এ্যালাইয়া, কমলা, মারি, অধ্য¶ ব্রাদার জন।
>>ঘটনাকালঃ একাত্তরের পঁচিশে মার্চের রাত থেকে ডিসেম্বর।
>>ঘটনাস্থলঃ ঢাকা
**আসামী: (১৫-১৬) মেজর আইয়ুব, সুবেদার মুশতাক।
>>অপরাধের ধরন: গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নসিংযোগ।
>>সাক্ষীঃ বিল্লাল হোসেন, মোহাম্মদ আসগর আলী, যতীন্দ্র চন্দ্র দাস, নিলু বালা শীল, শ্রীনিবাস ভৌমিক, সিস্টার সিসিলিয়া,সুশান্ত টমাস রিবারু , রবি রিবেরু, যোসেফ বিভাষ গোমেজ,
>>ঘটনাকাল: একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে ডিসেম্বর
>>ঘটনাস্থল: গাজীপুর
**আসামীঃ (১৭-১৯)ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ , ক্যাপ্টেন ইয়াসিন, সুবেদার মোশতাক।
>>অপরাধের ধরনঃ গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নসিংযোগ।
>>সাক্ষীঃ আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম (যুদ্ধকালীন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রশাসক), মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক, প্রভাষক বজলুর রশিদ খান, সাধনচন্দ্র ভট্টাচার্য,গোপালচন্দ্র বণিক, হরিপদ সাহা, গোপাল চন্দ্র বৈষ্ণব, ভানু বেগম, নুরজাহান বেগম,শবজান এবং আরও অনেকে।
>>ঘটনাকালঃ একাত্তরের এপ্রিল থেকে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময় ।
>>ঘটনাস্থলঃ টাঙ্গাইল, মির্জাপুর, মধুপুর, ভুয়াপুর, ছাব্বিশা, কালামাঝি ও জেলার অন্যান্য স্থান
**আসামীঃ(২০-৩১) ব্রিগেডিয়ার আব্দুল কাদের, মেজর আইয়ুব, মেজর সিদ্দিক, মেজর সুলতান, মেজর রিয়াজ, ক্যাপ্টেন খালেক,ক্যাপ্টেন আব্দুর রহিম, ক্যাপ্টেন আঞ্জু, হাবিলদার আলাউদ্দিন, হাবিলদার সুফি, রমজান ও সাদেক (র্যা ঙ্ক অজ্ঞাত)।
>>অপরাধের ধরনঃ গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নসিংযোগ।
>>সাক্ষীঃ মোঃ হায়দার রহমান তালুকদার, আব্দুল হাই তালুকদার, রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার, মোঃ আব্দুল করিম, মানিক চন্দ্র
দাস, আতিকুল ইসলাম, শেখ আহমেদ, আব্দুল রশিদ, মোসাম্মৎ রমিসা, বিমল পাল, অধ্য¶ আমীর আহমেদ চৌধুরী।
>>ঘটনাকালঃ একাত্তরের এপ্রিল মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যš—।
>>ঘটনাস্থলঃ ময়মনসিংহ জেলা।
**আসামীঃ (৩২)মেজর ইফতেখার
>>অপরাধের ধরনঃ গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নসিংযোগ।
>>সাক্ষীঃ আব্দুর রাজ্জাক, শরীফা খাতুন, আব্দুর রহিম, জামাল উদ্দীন।
>>ঘটনাকালঃ একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যš—।
>>ঘটনাস্থলঃ কিশোরগঞ্জ জেলা
**আসামীঃ (৩৩-৩৬) মেজর আনসারী, মেজর আকরাম কোরেশী, সেপাই রাশিদ খান (বেলুচ)।
>>অপরাধের ধরনঃ গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নসিংযোগ।
>>সাক্ষীঃ মোঃ মোসলেম শরীফ, মো মনু মিয়া, মঙ্গল চন্দ্র শীল, খন্দকার জাকির হোসেন নিলু, সুফিয়া বেগম, সোহরাব ফকির, সুফিয়া বেগম, হাফিজুর রহমান চানুমিয়া, মোঃ আবুল ফয়েজ, এ কে এম আবু ইউসুফ সিদ্দিক।
>>ঘটনাকালঃ সতেরোই এপ্রিল থেকে আট ডিসেম্বর ।
>>ঘটনাস্থ’লঃ ফরিদপুর।
**আসামীঃ (৩৭)মেজর চীমা খান
>>অপরাধের ধরনঃ গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নসিংযোগ।
>>ঘটনাকালঃ একাত্তরের সতেরোই এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ।
>>ঘটনাস্থলঃ রাজবাড়ি।
**আসামীঃ (৩৮-৪০) মেজর সেলিম, মেজর খটক, মেজর মঞ্জু।
>>অপরাধের ধরনঃ গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নসিংযোগ।
>>সাক্ষীঃ আবদুর রব হাওলাদার, চৌধুরী বাবু নুর আলম, আলহাজ্ব আনোয়ার ফরাজী।
>>ঘটনাকালঃ একাত্তরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ।
>>ঘটনাস্থলঃ মাদারীপুর।
**আসামীঃ (৪১-৪২)ক্যাপ্টেন ফয়েজ, ক্যাপ্টেন সেলিম।
>>অপরাধের ধরনঃ গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নসিংযোগ।
>>সাক্ষীঃ মোঃ বদরদ্দোজা বদর।
>>ঘটনাকালঃ একাত্তরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ।
>>ঘটনাস্থলঃ গোপালগঞ্জ
চলমান---
বিষয়: বিবিধ
১২১৩ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
টাঙ্গাইল এ মেজর আইয়ুব যুদ্ধের সময়ই নিহত হয়েছিলেন।
ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন