পান্তা ভাত
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ০৮ এপ্রিল, ২০১৫, ১১:৪০:২৯ সকাল
পান্তা ভাত
অবাক করার মত একটা বিষয়। আমরা আমাদের জাতীয় দিবস, ভাষা দিবস, সহ অন্যান্য যে কোন দিবস গুলি খুব ঘটা করে পালন করি। এই সব দিবসে আমরা যখন যা প্রয়োজন তা সাজতে বা ভাঁড়ামি করতে একেবারে ওস্তাদ। যেমন ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতার গুন গান স্তুতি আর মুক্তিযোদ্ধা দের গুন গান গেয়ে , টকশো বা অনুষ্ঠান এ মুখে ফেনা তোলার মত অবস্থা হয় আমাদের। ভাষা দিবসে ভাষা সৈনিক দের গুন গান গেয়ে অস্থির। কপালে গায়ে মুখে চোখে বর্ণ মালা এঁকে শহীদ বেদীতে সকাল বেলা ফুল দিতে যাওয়া সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাতৃভাষার গুন গান গাওয়ার ভাঁড়ামি বেশ ভালয় চালায় আমরা। সে রকম ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বিজয়ের গান, ফাকিস্তানি হানাদার, রাজাকার, আলবদর সহ বিভিন্ন দেশ বিদ্রোহীদের তুলা ধুনা সহ দেশ প্রেমের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে আমাদের মত আর কারও জুড়ি নেই। এই আসছে সামনে পহেলা বৈশাখে বাঙ্গালি সাজার কি নিদারুণ চেষ্টায় আমরা কত কিছুই না করব।
বিশেষ করে শহুরে বাঙ্গালিরা এইদিন নিজেদের খাটি বাঙ্গালি সাজার জন্য পান্তা ইলিশ খাবে, ধুতি পাঞ্জাবি পরবে, গায়ে রং মেখে সঙ সাজবে, শভা জাত্রায় অংশ নেবে--- ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে শহুরে বাঙালী বাংলা নববর্ষকে ঘটা করে উদযাপন শুরু করে। এই দিন বাঙালিয়ানার প্রতীক হিসেবে ভাজা ইলিশ মাছ সহযোগে পান্তা ভাত খাওয়া রেওয়াজে পরিণত হয়। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে পান্তা উৎসবের মাধ্যমে অনেকেই নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার সংস্কৃতি চালু ও পরিব্যাপ্ত হয়েছে।এ নিয়ে এখন শহুরে নব্যধনিক ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মাতামাতির শেষ নেই। ফলে পহেলা বৈশাখের দিন এখন শহরের অলিগলি, রাজপথ, পার্ক, রেস্তোরাঁ—সর্বত্রই বিক্রি হয় পান্তা-ইলিশ। এমনকি এখন অভিজাত হোটেলগুলোতেও শুরু হয়েছে পান্তা-ইলিশ বিক্রি এবং এই পান্তা-ইলিশ খাওয়া এখন একশ্রেণীর মানুষের বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু আবহমানকাল থেকেই পহেলা বৈশাখের সঙ্গে এই পান্তা-ইলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা শহুরে নব্য বাঙালিদের আবিষ্কার। পহেলা বৈশাখের উত্সবে গ্রামের অবস্থাপন্ন এবং ধনী পরিবারে খাবারের আয়োজনের মধ্যে থাকতচিড়া, মুড়ি, সাধারণ খই, বিন্নি ধানের খই, দই, খেজুরের গুড়, খিচুড়ি, বড় কই মাছ, বড় রুই মাছ ইত্যাদি। সকালবেলা নাশতার আয়োজনে থাকত চিড়া, মুড়ি, খই, দই, খেজুর গুড় ইত্যাদি। আর দুপুরবেলা থাকত খিচুড়ি এবং বড় কই ভাজা, বড় রুই মাছের পেটি ভাজা, বড় পুঁটি মাছ ভাজা এবং বিভিন্ন ধরনের ভাজি। রাতেও এসব খাবার খাওয়া হত।
তা যাই হোক যে যাই করুক যে যাই নিয়ে নাচা নাচি করুক তা তে আমার কি?
সামনে আসছে পহেলা বৈশাখ আর এই দিনে শহুরে বাঙ্গালিরা পান্তা ইলিশ খাবেন, নিষেধ করলেও শুনবেন না। তাই তাদের জন্য নিয়ে এলাম খাটি গ্রামের পান্তা ভাতের রেসিপি।
পান্তা ভাতের রেসিপিঃ
নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতকে পানিতে প্রায় এক রাত ডুবিয়ে রাখলেই তা পান্তায় পরিণত হয়। ভাত মূলত পুরোটাই শর্করা (Carbohydrate)। তামিল ভাষায় পান্তা ভাতকে বলা হয়“ পাঝিয়া সাধাম”(অর্থাৎ বাসি ভাত)। তেলেগু ভাষায় পান্তা ভাতকে বলা হয়“সাধী আন্নামু” অথবা “সাধেন্নামু” (অর্থাৎ ঠান্ডা ভাত)। ভাতে পানি দিয়ে রাখলে বিভিন্ন গাজনকারি ( Fermenation) ব্যাক্টেরিয়া (Bacteria) বা ইস্ট (Yeast) শর্করা ভেঙ্গে ইথানল (C2H6O )ও ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে। এই ইথানলই পান্তাভাতের ভিন্ন রকম স্বাদের জন্য দায়ী। মূলত পান্তা ভাত রাতভোর ভাত সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি। ভাত বেশিক্ষণ রেখে দিলে তা পচে খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কিন্তু পানি দিয়ে রাখলে গাজনকারি ব্যাক্টেরিয়া সেখানে ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে যার ফলে পান্তা ভাতের অম্লত্ব বেড়ে যায় (pH কমে)। তখন পচনকারি ও অনান্য ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ভাত নষ্ট করতে পারে না।
তবে আমাদের গ্রাম গুলিতে মহিলারা যে পদ্ধতিতে পান্তা তৈরি করেন তা একটু ভিন্ন। আসুন দেখে নিই সেই পদ্ধতি।
>সময়ঃ পান্তা রাধার ভাল সময় অবশ্যয় রাতে।
>উপকরণঃ
পান্তায় স্বাদ পেটে হলে ভাল চালের বিকল্প নেই। আর ভাল চাল বলতে আমি ঢেঁকি চাঁটা চালকে বুঝি।ঢেঁকি চাঁটা চালেই কেবল পাবেন প্রকৃত গ্রামীণ পান্তার স্বাদ। জনগণ( পরিবারের সদস্য অনুসারে) অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল নিন।
>তৈরির প্রক্রিয়াঃ
চালকে উত্তম রুপে ধুয়ে নিন। এবার পাতিলে করে করে ভাত যে ভাবে রান্না করতে হয় ঠিক সেই ভাবে উনুনে তুলে দিন। তবে পানির পরিমাণ একটু বেশি দিবেন( ভাত রাধার চেয়ে পানি বেশি দিবেন)। এবার ভাত হয়ে গেলে উনুন হতে নামিয়ে ফেলুন। আর ভাতের মাড়/ফেন সহ ঢেকে রেখে দিন।
(পান্তা নরম খেতে চাইলে ভাত একটু বেশি সেদ্ধ করে নিন। শক্ত খেতে চাইলে একটু কম সেদ্ধ করে নিন।)
সকালে নরম তুলতুলে সুন্দর ও স্বাদ যুক্ত পান্তা খাবার জন্য পরিবেষণ করুন। এই পান্তা বেশি সময় পর্যন্ত রাখা যায় না, কারন টক হয়ে যায়। তায় ১০-১১ টার মধ্যে খেয়ে ফেলুন।
@@পহেলা বৈশাখে যে সব পান্তা বিক্রি হয় সব ভাতের ফেন ফেলে দিয়ে পরে পানি যোগ করা। তাই ঐগুলির স্বাদ কম। এটি করা হয় পান্তাকে বেশি সময় রাখার জন্য।
রেসিপি তো দিলাম, এবার এই পান্তা ভাতের গুনাগুন দেখেনিই এক পলক।
>>>একজন আমেরিকান পুষ্টিবিদ যিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের খাদ্যাভাস নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি মন্তব্য করেছেন আগের দিন রান্না করা ভাত রাতভর পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকালে খায় তা সর্ব্বোত্তম।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, আগের দিন রান্না করা রাতভর পানিতে ভিজিয়ে রাখা ভাতের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন বি-৬ এবং ভিটামিন বি-১২। এ ভাতের মধ্যে রয়েছে অনেক উপকারি ব্যাকটেরিয়া যা খাদ্য হজম করতে সহায়তা করে এবং বহু রোগ প্রতিরোধ করে। এ ভাতে রয়েছে হাড় ও পেশি শক্তি বৃদ্ধির উপাদান এবং বার্ধক্য প্রতিরোধ ক্ষমতা। আমেরিকান পুষ্টিবিদ পান্তা ভাতের আরো অনেক গুণাগুনের বিবরন দিয়েছেন যেমন:
১. পান্তা ভাত খেলে শরীর হালকা লাগে এবং কাজে বেশি শক্তি পাওয়া যায়।
২. মানব দেহের জন্য উপকারি বহু ব্যাকটেরিয়া পান্তা ভাতের মধ্যে বেড়ে উঠে।
৩. পেটের পীড়া ভাল হয় এবং শরীরে তাপের ভারসাম্য বজায় থাকে।
৪. কোষ্ঠবদ্ধতা দূর হয় এবং শরীরে সজিবতা বিরাজ করে।
৫. রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে।
৬. অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সবল হয় এবং মেজাজ ভাল থাকে।
৭. এলার্জি জনিত সমস্যা প্রশমিত হয় এবং ত্বক ভাল থাকে।
৮. সব রকম আলসার দূরীভূত হয়।
৯. শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
১০. মন মেজাজ ভাল থাকে।
এখনও যারা মাঠে কৃষি কাজ করেন, সকালে পান্তা ভাত খেয়ে মাঠে যান এবং ৮-১০ ঘন্টা কাজ করেন। তাদের রোগ বালাই কম হয়।
তথ্যসুত্র: https// groups google.com/d/m sg/adarsha/TAb, previous day's cooked rice soaked in plain water overnight
বিষয়: বিবিধ
১৬৮৫ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গ্রামের কৃষকদের খেয়ে শুয়ে থাকার সুযোগ নেই তাই তারা পান্তা খেলেও অলসা তাদের সাথে ঘেষতে পারে না।
যাই হোক, আমি ছোট বেলা থেকে পান্তা খাওয়ার অভ্যাস, তাহলেতো আপনার বর্ণনা মতে অনেক উপকার পেয়ে গেছি!
আর প্রকৃত গ্রামবাংলায় ১লা বৈশাখ মানুষ জন পান্তা ইলিশ নয় বরং পিঠা বা খিচুরি খায়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন