ঘুঁট/ঘুঁটে/ঘুষি/নোন্দা

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৯:২৯:৪৩ রাত

ঘুঁট/ঘুঁটে/ঘুষি/নোন্দা



প্রবাদে আছে—“ঘুঁটে পুড়লে গোবর হাসে”

অন্ত-নিহিত অর্থ: অন্যের বিপদে আনন্দ করা কিন্তু সে বিপদ নিজের হতে পারে সে বিষয়ে ভুলে থাকা।


এই ঘুঁট গ্রামীণ সমাজে একপ্রকার জ্বালানি। অঞ্চল ভেদে নানা নামে পরিচিত। সাহিত্যে এটি ঘুঁটে নামেই পরিচিত। তবে গ্রামের মানুষের কাছে ঘুঁট/ঘুষি/নোন্দা/ব্রে/মুইট্টা/ঘাটে ইত্যাদি। (রাজশাহীতে থাকাকালিন দেখেছি-- মেসগুলির বেশির ভাগ রান্না করার প্রধান জ্বালানি এই ঘুঁট/ঘুষি/নোন্দা। পরে এর জায়গা দখল করেছে ধানের তুষের তৈরি চারকোল )

গ্রামীণ মহিলাদের কাছে জনপ্রিয় জ্বালানি। যা গোবর দিয়ে তৈরি হয়।গ্রামের মহিলারা নিজেদের জ্বালানি চাহিদা মিটানর জন্য প্রাকৃতিক ও জৈব জ্বালানি হিসেবে এটি ব্যবহার করে থাকে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে শুকনো জ্বালানি পাওয়া কষ্টকর তখন গ্রামের বধূরা জ্বালানি হিসেবে গ্রীষ্ম কালে তৈরি ও সংগ্রহে রাখা এই ঘুঁটে ব্যবহার করে থাকে।

প্রকার: ঘুঁট আকৃতি গত ভাবে দুই রকম দেখা যায়।

এক- গোলাকার( বৃত্তকার)



দুই- লম্বা (লাঠির মত বেলনাকার)



গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড রোদে এটি তৈরির ভাল সময়।এ সময়ে গ্রামের বধূরা নিজেদের বা অন্যের গরুর গোবর সংগ্রহ করে। এর পর সেই গোবর প্ল্যাস্টিক শিটের উপর রাখা হয়। এর পর পরিমাণ মত খড়( বিচুলি) কুচি কুচি করে কেটে গোবরের উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

এবার মহিলারা সেই গোবর ও খড়ের মিশ্রণ কে ভাল ভাবে মিশ্রিত করে গোবর মণ্ড প্রস্তুত করে । আর তা করতে তারা তাদের হাত ব্যবহার করে।আর অনেকে হাতে ডাক্তারদের ব্যবহারিত পুরাতন হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করে(তবে তা শতে একজন)।

>>>গোলাকার ঘুঁট/ঘুষি তৈরির প্রক্রিয়াঃ এর পর সেই গোবর মণ্ড বাড়ির দেয়ালে বা ফাঁকা উঠানে যেখানে অন্তত আধা বেলা রৌদ্র পড়ে এমন জায়গায় মোটা করে রুটির মত চাকা চাকা গোলাকার ভাবে দেওয়ালে লাগিয়ে দেওয়া হয়/মাটিতে হাতদিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয় শুকানোর জন্য। তবে বেশি মোটা করে দিলে ভিতরে শুকাতে দেরি হয়। তাই কিছুটা পাতলা করে দেওয়া উচিত। এরপর ৭-৮ দিন পর সেগুলিকে উল্টিয়ে দেওয়া হয় অপর পিঠ শুকানোর জন্য। ১২-১৮ দিনের মধ্যে সেটি শুকনো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।

>> লম্বা ঘুঁট/ঘুষি তৈরির প্রক্রিয়াঃএ জন্য প্রয়োজন পাট কাঠি বা শুকনো গাছের ডাল বা শুকনো বাঁশের কঞ্চি। তবে বেশিরভাগ মহিলারা পাটকাঠি ব্যবহার করে।

তিন চারাটা পাটকাঠি কে একত্রে লম্বা করে ধরে তার গায়ে গোবরের মণ্ড মোটা করে লাগিয়ে দেওয়া হয়। পাটকাঠিএগুলি কিছুটা দেখতে তখন লাটাই এর মত মনে হয়। মাঝখানে সুতার বদলে গোবরের মণ্ড আর দুইপাশে হাত রাখার হাতল বা কিছুটা করে ফাঁকা পাটকাঠি। এর পর সেগুলি কে হেলিয়ে দেয়ালের গায়ে/ বা মাঠে ফুটবলের গোলবারের মত কম উচ্চতার বার তৈরি করে দাড় করিয়ে দেওয়া হয় শুকানোর জন্য। ১২-১৮ দিনের মধ্যে এগুলিকে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রোদে শুকিয়ে নিতে হয় ।সেটি শুকলে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।

>>বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদনঃ

অনেক এলাকায় ঘুঁটে বানিজ্যিক ভাবে উৎপাদন হয়ে থাকে।গরুর গোবরের ঘুটে বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন গ্রামের ছিন্নমূল নারীরা এর প্রমান অনেক যায়গায় মেলে।অনেক এলাকায় দুস্থ ও ছিন্নমূল নারীরা গরুর গোবর কুড়িয়ে ঘুঁটে তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে দিনের পর দিন। গ্রামের বিধবা থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী, যুবতী এমনকি কিশোরী মেয়েরা গরুর গোবর কুড়িয়ে এনে রৌদ্রে শুকিয়ে ঘুঁটে তৈরি করে । সবাই এদের ঘুটে কুড়ানি হিসেবেই চেনে। দু’পয়সা রোজগারের অবলম্বন হিসেবে ছিন্নমূল নারীরা বেছে নিয়েছে এই কাজ। সারাদিন মাঠে ঘাটে, গ্রামের বিভিন্ন সড়ক পথ ও আনাচে কানাচে হতে গরুর গোবর সংগ্রহ করে দুপুরে বাড়ি ফেরে এসব দুস্থ ও ছিন্নমূল মহিলারা। প্রতিদিন জনপ্রতি প্রায় ১০ থেকে ১৫ কেজি গোবর সংগ্রহ করে তারা। সংগৃহীত গোবর বাড়ির উঠানে অথবা সড়কের কোন ফাঁকা স্থানে হাত দিয়ে ঘুঁটে বানিয়ে রৌদ্রে শুকিয়ে নেয় এবং পরে চটের বস্তায় ভরে বাড়ির এক কোণে স্তূপাকারে রাখে।অনেকে আবার পাঠকাঠি দিয়ে লম্বা ঘুঁটে বানিয়েও বিক্রি করে থাকেন।

বাড়ি থেকেই জ্বালানি হিসেবে প্রতি বস্তা গোল ঘুটে ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করা হয়।আর পাটকাঠির ঘুঁটে প্রতি বোঝা/বান্ডিল (২০/৩০ টাই এক বোঝা) ১০০-১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতিদিন ১০ কেজি হিসেবে সপ্তাহে ৭০ থেকে ৮০ কেজি কাঁচা গোবর শুকিয়ে ঘুটে তৈরি করা হয়। প্রতি মণ ৮০ থেকে ৯০ টাকা দরে বিক্রি করে তারা। এ হিসেবে প্রতিমাসে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা রোজগার করে থাকে সহায় সম্বলহীন ঘুটে কুড়ানীরা।

অনেকের মধ্যে দু এক জনের জাদের নিজস্ব গাভী বা গরু আছে তারা নিজেদের পালিত এসব গাভী থেকেই সারাদিন ৭ থেকে ৮ কেজি গোবর সংগ্রহ করে। এদের ঘুটে কুড়ানি বললে এরা নিজেদের ছোট মনে করে না। এরাও ঘুটে বিক্রি করে দুই পয়সা রোজগার করে, সংসারের টুকিটাকি খরচ ও নুন মরিচের পয়সা যোগায়।



>>উপকারতাঃ ঘুঁট/ঘুষি/নোন্দার জ্বালানি একটি প্রাকৃতিক ও জৈব জ্বালানি হিসেবে খুব সমাদৃত।একে পোড়ালে ধোয়া খুব কম হয়,ফলে পরিবেশের দূষণ কম হয়। এটির ব্যবহার গাছের জ্বালানির উপর চাপ কমায়। এর ছাই গুলি আবার জৈবসার হিসেবে জমিতে পুনঃব্যবহার করা যায়।

বিষয়: বিবিধ

১২৭৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

304442
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০৩:৪৮
ভোলার পোলা লিখেছেন : Khub mone pore amar basay o hoto
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ০১:২৭
246619
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File