কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার >>>>জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১৪ অক্টোবর, ২০১৪, ০১:২৩:১০ দুপুর
জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি
জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি অঞ্চল ভেদে যে যাহায় বলে থাকি না কেন এটি আমাদের দেশের গ্রামীণ মহিলাদের কাছে খুব প্রয়োজনীয় একটি গৃহস্থলি উপকরণ। যা এই কিছু কাল আগেও মহিলাদের কাছে সংসারের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়ে আসা উপকরণ। কিন্তু সময়ের কাছে এবং আধুনিক যন্ত্রের কাছে মার খেয়ে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা ছুরি, কাঁচি,সুপারি কাটা জাঁতি প্রভৃতি
নানা রকম জিনিস ব্যবহার করে থাকি। ঐসব জিনিস প্রত্যেকটিই একেকটি সরলযন্ত্র। জাঁতা সম্পর্কে জানার আগে আসুন জেনে নিই সরল যন্ত্র কি?
সরল যন্ত্র
পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় সরল যন্ত্র (simple machine) এমন একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা যা বলের দিক অথবা পরিমাণ (magnitude) পরিবর্তন করে। সাধারণভাবে বলা যায় সবচেয়ে সরল উপায়ে যান্ত্রিক সুবিধা ব্যবহার করে বলবৃদ্ধি করার ব্যবস্থাকে সরল যন্ত্র বলে।
সরল যন্ত্র একটিমাত্র বলের ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি কাজ করে। উক্ত যন্ত্রের উপর বল প্রযুক্ত হলে তা কাজ সম্পাদন করে এবং এর ফলে নির্দিষ্ট দূরত্ব আতিক্রান্ত হয়। সম্পাদিত কাজ অতিক্রান্ত দূরত্ব ও প্রযুক্ত বলের গুণফলের সমান। কোন একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজের পরিমাণ ধ্রুবক। অবশ্য প্রয়োজনীয় বলের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত অধিক দূরত্বের উপর কম বল প্রয়োগ করে কমানো যেতে পারে। দুইটি বলের পরিমাণের অনুপাতকে যান্ত্রিক সুবিধা বলা হয়ে থাকে।
প্রথাগতভাবে সরল যন্ত্র বলতে রেনেসাঁ যুগের বিজ্ঞানীদের সংজ্ঞায়িত নিম্নোক্ত ৬টি যন্ত্রকে বোঝায়ঃ:
আনত তল (N)
চাকা-অক্ষদন্ড (O)
লিভার (T)
কপিকল (U)
গোঁজ (V [single wedge]; X [double wedge])
স্ক্রু (Y)
আসলে এই ছয় প্রকারের সরল যন্ত্রই হচ্ছে আধুনিককালের সব জটিল যন্ত্রের মূল। এদেরকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে জটিল ও উন্নত যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে।
লিভারযন্ত্র
লিভারযন্ত্র হচ্ছে এমন এক যন্ত্র, যার সাহায্যে বড় বড় ভারি জিনিস বা বাধাকে অল্প বল প্রয়োগে তোলা যায় লিভার যন্ত্র সাধারণত তিন শ্রেণীর হয়, যথা-
ক্লাস ১ বা প্রথম শ্রেণীর লিভার,
ক্লাস ২ বা দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভার এবং
ক্লাস ৩ বা তৃতীয় শ্রেণীর লিভার।
প্রত্যেক শ্রেণীর লিভারে থাকে তিনটি বিন্দু। যে বিন্দুর চারদিকে লিভারটি সহজেই ঘুরতে বা দুলতে থাকে, তার নাম ফালক্রাম। দ্বিতীয় বিন্দুটি হলো বল প্রয়োগ বিন্দু; অর্থাৎ যে স্থানে বল প্রয়োগ করা হয়। আর তৃতীয় বিন্দুটি হলো ভারবিন্দু। ঐ বিন্দুতে ওজন বা বাধা ক্রিয়া করে। ফালক্রাম ভার বিন্দুর মধ্যকার দূরত্বকে বলে ভারবাহু। তেমনি ফালক্রাম ও বল প্রয়োগ বিন্দুর মধ্যকার দূরত্বকে বলে বল বাহু।
>>জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি প্রাচীন কাল হতে মানুষ সমাজের ব্যবহার হয়ে আসা তেমনি একটি সরল যন্ত্র। এটি লিভার শ্রেণীর একটি সরল যন্ত্র। যা মানুষ গম ও যব কে আটায়/ময়দায় রূপান্তর করার জন্য আবিষ্কার করেছে এবং ব্যবহার করে আসছে। কবে ,কখন বা কারা এটির আবিষ্কারক তা যানা না গেলেও ধারনা করা হয় প্রাচীন মেসপোটিমিয়া সভ্যতায় এর দেখা মেলে।
কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার >>>>জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি
আধুনিক যন্ত্র নির্ভরর সভ্যতায় যন্ত্রপাতির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তেমনি পুরাতন সব যন্ত্রের জায়গা দখল করে নিচ্ছে আধুনিক সব যন্ত্র। এতে যেমন সময় ও শ্রমের অপচয় হ্রাস হয়েছে তেমনি মানব জীবনে এসেছে গতিশীলতা। আজ হতে ১৫-২০ বছর আগে আমাদের দেশে গ্রাম গুলিতে এমন সব জিনিস বা উপকরণ ব্যবহার করা হত যা আজ কল্পনা করা যায় না। আধুনিক যন্ত্রের কাছে সেই সব জিনিস টিকতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন হতে। তেমনি একটি যন্ত্র জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি । গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ীতে দেখা যেত যাতা। বিয়ের সময় অনেকে বাবার বাড়ি হতে (নব বধূ) উপহার হিসেবে পেত এই জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি।
কি কি করা হতঃ
এই জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি দিয়ে গ্রামীণ বধূরা এই কিছুদিন আগেও চাল/গম/জব হতে আটা/ময়দা করতে ব্যবহার করত( যদিও ঢেঁকির সাহায্যে তা করা হত, তবে অল্প পরিমাণে আটা করতে জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি ব্যবহার হত)। এ ছাড়া যাতা দিয়ে ভাঙ্গানো হতো মশারী, খেসারী, মাশ কলাইসহ প্রভৃতি রকমের ডাউল।
কি দিয়ে তৈরিঃ
জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি তৈরির মূল উপাদান পাথর। মসৃণ দুই খণ্ড পাথরকে কেটে গোল করে জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি তৈরি করা হত। সেই খণ্ড দুটির ভেতরের ভাগ(যে দিক বা পাশ ভিতরের দিকে থাকবে) কে লোহার তৈরি বিশেষ বাটাল বা যন্ত্র দিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চটলা বা খাল করে এর ধার বাড়ানো হয় এবং উপরে এবং নিচের পাটের মাঝে গোল একটি ছিদ্র করা হয়। যা দিয়ে বিশেষ ভাবে কাঠের বা বাশ দিয়ে তৈরি হাতল লাগানো হয় যা দুই পাটকে এক জায়গায় থাকতে সাহায্য করে। দুই ছিদ্রের মাঝে বিশেষ খাজ কাটা দণ্ড থাকে যার সাহায্যে পাট দুটির মাঝে কতটুকু ফাঁক থাকবে তা নির্ধারণ করা হয়—অর্থাৎ আপনি কেমন আটা বা ডালের টুকরা চান তার উপর নির্ভর করে পাট দুটির মাঝে ফাঁক রাখা হয় ঐ ডন্ডের মাধ্যমে। শুধু উপরের পাটে আর একটি ফুটো করা হয় যা দিয়ে শস্য কে ভিতরে পাঠানো হয় পিষার জন্য।
যে ভাবে পিষা হয়ঃ
গৃহবধূরা মাঝের ফুটো হাতল ধরে আরেকটি ফুটো দিয়ে শস্য ভিতরে দিয়ে হাতল ধরে জোরে ঘুরাতে থাকে । এতে শুধু উপরের পাট নিচের পাটের উপর ঘুরতে থাকে এবং দুই পাটের ঘর্ষণের ফলে উপর হতে দেওয়া শস্য ভেঙ্গে গুড়া হয়ে দুই পাটের চার সাইড ফাক দিয়ে দ্রুত গতিতে বের হয়ে আসে। অনেক সময় দেখা যায় ভাল করে গুড়া হয় না। ফলে আবার সেগুলিকে ভিতরে দিয়ে আবার জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি ঘুরিয়ে ভাল করে গুড়া করা হয়। দুই পাটের মাঝে থাকা খাজ কাটা ডন্ডের মাধ্যমে দু পাটের ফাঁক কম বেশি করে সশ্যের আটা বা ডালের টুকরা কেমন হবে তা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
শেষ কথাঃ
পাথরের তৈরী যাতা দিয়ে যখন কাজ করা হয় তখন একটি মিষ্টি ধরনের শব্দ হয়। এখন আর চোখে পড়ে না সচারাচার যাতার ব্যবহার। উন্নত ধরনের মেশিন তৈরী হওয়ার কারনে সুখ প্রিয় বাঙ্গালী পরিবার আর কষ্ট করে জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি চালাতে চায় না। তারপরও গ্রামাঞ্চলের অনেক পরিবার যাতেকে ঐতিহ্য হিসাবে ধরে রেখেছেন। আমাদের বাড়িতে এখনো আছে পাথরের জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি। হয়ত আর কিছু দিন পর এ যাতা কালের আবর্তে হারিয়ে যাবে।
বিষয়: বিবিধ
২৭৭৫ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ঢেঁকি যাঁতার কাজে জীবনের অনেক দীর্ঘ সময় গেছে- কর্মজীবনের আগ পর্যন্ত, স্মরণ করে আপ্লূত হই
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
ঢেঁকি যাঁতার কাজে জীবনের অনেক দীর্ঘ সময় গেছে- কর্মজীবনের আগ পর্যন্ত, স্মরণ করে আপ্লূত হই
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
তবে আপনার পোস্টের দৌলতে আরেকবার দেখলাম । ভালো লেগেছে
মন্তব্য করতে লগইন করুন