কালায় রুটি
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১২ আগস্ট, ২০১৪, ০৪:১৩:২৭ বিকাল
কালায় রুটি
আমাদের গ্রাম দেশে মানুষ ২ প্রকার। যথা---
১। বরিন্দা
২। দিয়াড়া
@বরিন্দা(বরিন্দা-অধিবাসী,যারা আগে হতেই ছিল) মানে আমরা যারা আগে থেকেই এই এলাকায় বসবাস করে আসছি বা আসছে। কিছুটা অলস ও আরামপ্রিয়।
@ যারা চাঁপাই নবাবগঞ্জের অধিবাসী, যারা ঐ সব এলাকা ছেড়ে আমাদের এলাকায় বসবাস করতে এসেছে। এরা খুব পরিশ্রমী ও কাজপ্রিয়। এদের ভাষা চাঁপাই এর আদি ছ-শ,উ টান বিদ্যমান। আর এর দলবদ্ধ ভাবে বসবাস করে। এদের মাঝে আমাদের মত কাজ্জা নাই।
এদের নিয়ে এত কথা বলার একটিই কারণ এদের খাদ্য তালিকার একটি খাদ্য। আমারা বরিন্দারা ভাত আর গমের রুটি খেতে অভ্যস্ত। তবে পার্বণে মাঝে মাঝে আটার রুটি খেয়ে থাকি। আর দিয়াড়ারা কি সকাল, কি রাত, কি দুপুর এদের খাদ্য তালিকায় সবচেয়ে প্রিয় একটি খাদ্য কালাই রুটি।
>>বৃহত্তর চাঁপাই নবাবগঞ্জের জনপ্রিয় একটি খাদ্য এটি।
আমারা ঈদে বা ছুটির সময় বাড়ি গেলে এই কালাই রুটি বেশ খাওয়া হয় আমাদের আইধার (দিয়াড়া) কর্তৃক। আমাদের ১০-১৫ বিঘের মত জমি এই দিয়াড়া আইধার চাষ করে। তাকে ফোন দিয়ে বললেই হয় আংকেল রুটি খেতে ইচ্ছে করছে। তিনি পরের দিন সেই সাতসকালে সাইকেল চালিয়ে পোঁটলা বেঁধে কালাই রুটি নিয়ে হাজির বাড়িতে। আহ গরম গরম কালাই রুটি আর কাঁচামরিচ ও পিঁয়াজের ভর্তা বা পোড়া বেগুনের ভর্তা দিয়ে খেতে এমন টেস্ট কি বলব মাইরি।
আর রাজশাহীতে থাকতে এই রুটি প্রচুর খেয়েছি। রাজশাহীতে বিভিন্ন যায়গায় কালাই রুটির দোকান চোখে পড়বে। কিছু মহিলা বা পুরুষ দোকানদার দেধারচে বানিয়ে বানিয়ে বিক্রি করছে এই রুটি। আর পাশের টুলে বসে মরিচ ভর্তা/বেগুন ভর্তা(ফ্রি) দিয়ে খেয়ে নিচ্ছে আমজনতা। তবে সমস্যা একটাই এদের রুটিতে পাওয়া যায়না আসল মজা। কারণটা হল এদের বেশির ভাগ কারিগর বেশি লাভের আশায় কালায় আটার সঙ্গে অন্য আটা বেশি পরিমাণ মিশিয়ে দেয়।
এবার আসুন দেখে নিই এই কালায়/কালাই রুটি তৈরির রেসিপি:
এই রুটির প্রধান ২ উপাদান।
১।মাষকলাই/কালাই
২।আতপ চাল/চিকন ধানের চাল
প্রথমে জাতাতে
মাষকলাই ও আতপ চালকে কে পিষে আটা বানিয়ে নিতে হবে। তবে এই কাজ মেশিনেও করা যায়। তবে ভাল কলাই এর রুটি খেতে চাইলে মেশিনে ভাঙা নয়, জাতাতে পিষা কলাই আর আতপ চাল (আমাদের এখানে আলো চাল বলে) এর আটা ভাল। যদি মেশিনে ভাঙতে হয় তবে, আটাটা একটু মোটা করে ভাঙতে হবে। বেশি চিকন হলে রুটি খেতে মজা লাগবে না।
প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র:
আটা প্রস্তুত হয়ে গেলে যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হল কুমারদের তৈরি এক খানা মাটির খোলা বা পাতিল বা তাওয়া বা কড়ায়। তবে একেবারে নতুন খোলায় রুটি ভাল হবে না। তাই কিছুদিন
খোলাটাকে পুড়িয়ে নিলে ভাল হয়। আর চুলার কথা তো বলায় লাগে না। সঙ্গে রুটি উল্টা উল্টি করার জন্য কাঠের বা লোহার বা ষ্টীলের ছুন্নি।আর ছোট একটা বাটিতে প্রয়োজন মত পানি।
খমীর প্রস্তুতি:
উপকরণ: চাউলের আটা ১০০গ্রাম , কলাই আটা ২৫০ গ্রাম |প্রয়োজন মত ও স্বাদের জন্য এই পরিমাণ বাড়িয়ে বা কমিয়ে নেওয়া যায়।
রুটি বানানোর নিয়ম: প্রয়োজনীয় পরিমাণ আটা নিয়ে সাইজ মত গামলায় প্রয়োজন মত লবণ দিয়ে পানি মিশিয়ে খমীর বানাতে হবে। ঠিক গমের রুটির আটার
মতো পানি দিয়ে আটা তৈরি করতে হবে | তৈরি আটা একটা টেনিস বলের সমান নিয়ে একটা বল বানাতে হবে ।টেনিস বলের মত করে মোথা আটাকে গোল করে চ্যাপ্টা করতে হবে। এক হাতের তালু বাটির পানিতে ভিজিয়ে ঐ তালুতে চ্যাপ্টা আটাকে নিয়ে আসতে হবে, পরে অন্য তালুটা ভিজিয়ে নিতে হবে। এতে সুবিধা হয় যে আটা যেন হাতের তালুতে আটকে না যায়।যখন আটা হাতের তালুতে লাগার মত হবে, তখন সেই তালু আবার ভিজিয়ে নিতে হবে। চাকতির মত আটাকে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এই তালু থেকে অন্য
তালুতে বারবার নিয়ে আটাকে যতটুকু সম্ভব পাতলা করে নিতে হবে।দুই হাতের তালুতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চ্যাপটা করে রুটি বানাতে হবে।
তারপর সেটা খোলায় দিতে হবে। কিছুক্ষণ গরম হবার পর রুটিটিকে আবার উল্টিয়ে অন্যপাশ দিতে হবে। অন্যপাশ না হওয়া পর্যন্ত এটা ঐভাবে খোলাতে রাখতে হবে।যখন দেখা যাবে রুটি ফুলে মচমচে হয়েছে , তখন রুটি খাওয়া যাবে। আর ততক্ষণে আপনি আরেকটি রুটি হাতে পাকাতে শুরু করবেন।
খাওয়ার জন্য: এত এত কসরত করে রুটি তো বানিয়ে ফেললেন। এবার খাবার পালা। তবে যা তা দিয়ে খেলে তো আর স্বাদ লাগবে না, তাই এই বিশেষ রুটি খেতেও হবে বিশেষ কিছু তরকারি বা ভর্তা সহযোগে।যেমন পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা বাটা, আগুনে পোড়ানো বেগুন-ভর্তা দিয়েই বেশিরভাগ মানুষ কলাই রুটি খেয়ে থাকে।
১। চুলায় পুড়ানো বেগুন ভর্তা + টক আচার ।
কালায় রুটি সবচেয়ে মজা পোড়া বেগুনের ভর্তা দিয়ে। তাই যেনে নিই বেগুন ভর্তা করার একটা সুন্দর রেসিপি।
উপকরণ: বেগুন ১টি (বড় সাইজ), সরিষা বাটা ১ চা চামচ, পোস্ত-দানা ১ চা চামচ, নারকেল মিহি বাটা ২ চা চামচ, টমেটো কুচি ১ কাপ, পেঁয়াজ কুচি আধা কাপ, মেথি আধা কাপ, সরিষার তেল ২ টেবিল চামচ, কাঁচামরিচ কুচি ২ টেবিল চামচ, লবণ স্বাদমতো।
প্রণালি: বেগুনের গায়ে তেল মাখিয়ে পুড়িয়ে নিতে হবে। এবার পানিতে রেখে খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে একটু ছেনে নিতে হবে। কড়াইয়ে তেল দিয়ে মেথি ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে একটু নরম হলে টমেটো দিয়ে নাড়াচাড়া করে টমেটো নরম হলে সরিষা, পোস্ত, নারকেল, কাঁচামরিচ ও লবণ দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে বেগুন দিয়ে কষাতে হবে। কড়াইয়ের তলা ছেড়ে এলে এবং একটু আঠালো হলে নামিয়ে নিতে হবে। চিতই পিঠার সঙ্গে এই ভর্তা খাওয়া যায়। নাজমা হুদা সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো।
২। পিঁয়াজ,রসুন ও কাচা মরিচ ভর্তা + টক আচার।
৩। কাচা মরিচ ও ধনিয়া পাতা ভর্তা।
৪। শুকনা মরিচ ও লবণ চাটনি।
৫। আলু ভর্তা
এগুলি গেল নিজে নিজে বানানোর হেপা। এবার দেখি বাণিজ্যিক ভাবে যারা এগুলি বানান তাদের লাভ ক্ষতির হিসেব নিকেশ।
দর দামঃ পথে ঘাটে বা রাজশাহী বা চাঁপাই এর বিশেষ বিশেষ কালাই রুটির হোটেল ভেদে এই এক একটি কলাই রুটির মূল্য নেন ১৫-২০ টাকা। স্পেশাল ২৫-৩০ টাকা। এর সঙ্গে মশলা হিসেবে খাওয়ার জন্য পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা বাটা, আগুনে পোড়ানো বেগুনভর্তাসহ আরও লাগে পাঁচ টাকা। সব মিলিয়ে রুটি প্রতি দাম ২৫-৩০ টাকা করে। তবে রাস্তার পাশের দোকান হতে ১০- ১৫ টাকায় পাবেন এই রুটি সঙ্গে মশলা ফ্রি।
ব্যয় : মাষকলাইয়ের আটা ও চালের আটার মিশ্রণে তৈরি হয় কলাই রুটি। প্রতি কেজি মাষকলাইয়ের আটার মূল্য ৭০ টাকা। একমন কলাইয়ের আটার দাম হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ টাকা। আবার প্রতি কেজি চালের আটার দাম ৩৮ টাকা। সে হিসাবে প্রতিমন আটার দাম ১ হাজার ৫২০ টাকা হয়। প্রতি কেজি চাল ও কলাইয়ের আটার সংমিশ্রণে রুটি হয় ৮টি। এক কেজি আটা থেকে আয় হয় (৮ x ২০) ১৬০ টাকা। সেই হিসাবে একমন আটা থেকে মোট রুটির মূল্য আসে ৬ হাজার ৪০০ টাকা।
কলাই রুটির পুষ্টিগুণ:
গবেষক ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে মাষকলাইয়ে থাকে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেল (জিঙ্ক, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম) ও অল্প পরিমাণে ফ্যাট আর চালে কার্বোহাইড্রেট, সামান্য প্রোটিন ও ফ্যাট। তবে কলাইয়ের চেয়ে চালে ফ্যাটের পরিমাণ বেশি। কলাই রুটিতে যে পরিমাণ মিনারেল থাকে তা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেট শরীরের গঠন মজবুত ও অতিরিক্ত শক্তি যোগায়। মিনারেলগুলো শরীরের বিপাকক্রিয়া সম্পন্ন করে। এছাড়া কলাই রুটিতে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকায় তা শরীরের গঠন মজবুত করে। বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগ মারাত্মকভাবে দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন, ডায়াবেটিস রোগীদের ভাতের চেয়ে রুটি খাওয়াই বেশি ভালো। সেক্ষেত্রে কলাই রুটি তাদের জন্য অধিক উপকারী বলেও অভিমত দেন অনেক গবেষক ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ।
বিষয়: বিবিধ
৩১১০ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আলহামদুল্লিলাহ ! অনেক মজা হয়েছে ।
আপনাকে ধন্যবাদ ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন