দাই মা বা ধাই মা বা ধাত্রি মা

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২৭ জুলাই, ২০১৪, ০১:২৮:২১ রাত



সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। সূর্য ডোবার সাথে সাথে হাসনুহানার গাছের ডালের ফাঁক ফোকর দিয়ে চাঁদের আলো জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে। ঘরটি বেশ আলোকিত। তারপর হারিকেনের মৃদ আলো জ্বলছে। গামলায় গরম পান । নাড়িকাটার জন্য নতুন চকচকে ব্লেড । সাবান, স্যাভলন আর কিছু পুরোনো কাপড় তার পাশে প্রসব বেদনায় ছটফট করছে আলেয়া বানু । প্রচন্ড ঘাম শরীর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে । আলেয়ার মা মুখ, হাত, গা মুছে তাকে কিছুটা হালকা করেতে চাইছে । আলেয়া দাঁত কামড়ে ধরেছে । তার মনে হচ্ছে কলিজাটা বের হয়ে আসছে । দাইমা তাপ দিচ্ছে আর বলছে আর একটু চেষ্টা কর । আর সেই চেষ্টায় পৃথিবীতে জন্ম নিল নতুন এক শিশু।

দাই মা চিৎকার করে বললো- ছেলে/মেয়ে হয়েছে ।

বাইরে বাচ্চার নানা-মামারা খুসিতে আত্মহারা। নানা তৎক্ষণাৎ ছোট ছেলেকে গঞ্জে পাঠালেন মিষ্টি নিতে।

বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগের বেশী নারী গ্রামে গঞ্জে দাইমাদের সহায়তায় সন্তান প্রসব ও তার পূব ও পরবর্তী সেবা নেয়। এই দাই মায়েরা মানব সেবায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।



পৃথিবীর প্রাচীনতম একটি পেশা দাই মা বা ধাই মা বা ধাত্রি মা। মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি এই পেশা যা আজও আমাদের সমাজে টিকে আছে। বিশেষকরে গ্রামের মেয়েদের বাচ্চা জন্মের সময় এই মা দের প্রয়োজনীয়তা আর তাদের উপস্থিতি সেই প্রাচীন কাল হতে আজও অব্দি পৃথিবীতে আসা নতুন অতিথিদের নিরাপদ করত ও করে চলেছে।

এদের প্রধান কাজ ছিল বাচ্চা প্রসব করানো। কোন বাড়ির মেয়ে গর্ভবতী হলে, শ্বশুর বাড়ী ছেড়ে নিজ ( বাবার) বাড়িতে সন্তান(প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে বেশী প্রযোজ্য) প্রসব করানো রেওয়াজ ছিলও সমাজে, যা আজও দেখা যায়।গর্ভবতী মেয়ে মায়ে বাড়ীতে আসলে, গ্রামের বা পাশের গ্রামের দাই মা'কে খবর দিয়ে রাখা হতো। সে গর্ভবতী নারীর লক্ষণ দেখেই বলতে পারতো, সম্ভাব্য প্রসবের তারিখ। সম্ভাব্য তারিখের কাছাকাছি সময়ে নিয়মিত আসতো মেয়ের বাড়িতে। আর প্রসবের দিন সারাদিনই ওই বাড়িতে থাকতো। সন্তান প্রসবের পর নগদ টাকা, চাল-ডাল এবং ক্ষেত্র বিশেষে উপহার সামগ্রী দেওয়া হতো তাকে। কখনো শাড়ী, চাদর, বেশী ধনীর বাড়ী এবং মনমতো(ছেলে সন্তান বা মেয়ে সন্তান যার যেটা কাম্য) সন্তান হলে গয়না পাওয়াও অস্বাভাবিক ছিলোনা। প্রতিবছর মে মাসের ৫ তারিখ আন্তর্জাতিক ধাত্রী দিবস। আন্তর্জাতিকভাবে ধাত্রীরা সন্তান প্রসবে মায়েদের যেভাবে যুগ যুগ ধরে সেবা দিয়ে আসছেন সেই কাজের স্বীকৃতির জন্য ১৯৮০ এর দশক থেকে তাঁরা দাবী করে আসছেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালে ৫ মে তারিখটি আন্তর্জাতিক ধাত্রী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। প্রতিবছর এই দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে ধাত্রীরা মনে করিয়ে দিতে চান ধাত্রীবিদ্যা এবং পেশা হিশেবে ধাত্রীর কাজের গুরুত্ব কতখানি। এই দিনে তাঁরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করেন, এবং অন্যদের সাথেও সম্পর্ক তৈরী করে তাঁরা তাঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।

বাংলাদেশে ১৫টি জেলায় দাইঘর পরামর্শ কেন্দ্র উবিনীগ স্থাপন করেছে, সেখানে পরামর্শ সেবা ও সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের পাঠানোর কাজ শুরু করে ২০১২ সালে। এই কাজের অংশ হিসেবে ২০টি দাইঘরের প্রতিনিধিদের নিয়ে এই সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনে দাইমাদের দক্ষতা, ঝুঁকি চিনে সরকারী হাসপাতালে পাঠানো এবং পুষ্টি সেবার বিষয়ে আলোচনা হয়।



নিরাপদ জন্মদানে আমাদের বাংলাদেশে অবস্থাঃ

দেশে প্রতিবছর ২২ লাখ মা গর্ভধারণ করেন।জন্মদানের জটিলতায় এখনো বাংলাদেশে প্রতি লাখে ১৯৪ জন মা মারা যান। তাঁদের ৫৪ শতাংশ প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর (চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য সহকারী, দাই) কাছে প্রসব-পূর্ব সেবা পান। ২৭ শতাংশ মা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা পান। আর প্রসব-পরবর্তী সেবা পান ২৩ শতাংশ মা।

>>নিরাপদ মা ও শিশুর জন্যে-২৮ মে প্রতিবছর বাংলাদেশে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হয়।বাংলাদেশে ১৯৯৭ সাল থেকে ‘২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হয়ে আসছে’। তবে উপরে উল্লিখিত হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যেও গত দুই দশকে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু বা শিশুমৃত্যু রোধে এগিয়েছে অনেক। ২০০১ সালেও বাংলাদেশে সন্তান জন্ম দানের সময় প্রতি লাখে মারা যেত ৩২২ জন মা। ২০০১ সালে বাংলাদেশে মাত্র ৯ শতাংশ গর্ভবতী মা সন্তান জন্ম দিতে পারতেন প্রশিক্ষিত দাই বা পাস করা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে। অবশ্য ২০১৬ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ গর্ভবতী সন্তান জন্ম দিতে পারবেন প্রশিক্ষিত বা পাস করা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে বলে সরকারি কর্মকর্তারা মনে করছেন। এখনো গ্রামের অনেক মা সরকারি হাসপাতালে বা অন্য



সেবা কেন্দ্রগুলোতে জন্মদানের জন্য যেতে চাননা এটাও সত্য।

প্রতি বছর সারা বিশ্বে ২১ কোটি নারী গর্ভবতী হন এবং দুই কোটিরও বেশি নারী স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। তাদের মধ্যে ৮০ লাখেরও বেশি জীবনাশঙ্কা দেখা দেয় এবং প্রতিদিন ৮০০ নারী এ সংক্রান্ত জটিলতায় মারা যান বলে ইউএনএফপি সূত্রে জানা গেছে। চিকিৎসকেরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন, সন্তান জন্ম দিয়ে যেসব মা মারা যান তাদের সন্তানও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জন্মের দুই বছরের মধ্যেই মারা যায়।

ইউএনএফপিএ সূত্রে জানা গেছে, সন্তান জন্মদানে যেসব মা মারা যান তাদের ৯০ শতাংশই এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতে। বেশির ভাগ মহিলা রক্তপাত, রক্তশূন্যতা, জীবাণু সংক্রমণ এবং অনিরাপদ গর্ভপাতের সময় মারা যান। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুকে ৭৫ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও এ সময়ের মধ্যে বেশির ভাগ দেশ সে লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হবে। বাংলাদেশ ২০১০ সাল পর্যন্ত ৬০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

>>>জন্ম যেন হয় নিরাপদ—সুস্থ থাকুক মা ও শিশু ,এই আশাবাদ ব্যক্ত করি আমরা সকলে।

বিষয়: বিবিধ

২৮৯৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

248597
২৭ জুলাই ২০১৪ রাত ০৩:০৮
এবেলা ওবেলা লিখেছেন : জন্ম যেন হয় নিরাপদ—সুস্থ থাকুক মা ও শিশু ,এই আশাবাদ ব্যক্ত করি আমরা সকলে। Thumbs Up Thumbs Up Thumbs Up Thumbs Up
248660
২৭ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৯:২৯
egypt12 লিখেছেন : ভাই ধাত্রী দিয়ে বাচ্চা প্রসবই ভালো...শিক্ষিত ডাক্তারেরা সিজার ছাড়া কিছু বোঝে না...ভালো মাত্রার ধান্দাবাজী আর কি!
248661
২৭ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৯:৩৩
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : জনকল্যান মূলক পোস্টের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
248987
২৮ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৮:৩২
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ ভাই সকল

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File