বনরুই---- গ্রাম হতে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ এক অদ্ভুদ স্তন্যপায়ী প্রাণী।

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১২ জুলাই, ২০১৪, ০১:৫৯:০৪ রাত

বনরুই---- গ্রাম হতে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ এক অদ্ভুদ স্তন্যপায়ী প্রাণী।





এই তো সেদিন কার কথা------ বাড়ির পাশে ঝোপে বাসা বেঁধে থাকত যে প্রাণীটা তা আজ আর দেখায় যায় না। আমার দাদি, বাবার মুখে শোনা এই কথা গুলি। গ্রাম বাংলার প্রকৃতি হতে হারিয়ে যাওয়া খুব চেনা একটা প্রাণী বনরুই।



পানির সঙ্গে তেমন একটা সম্পর্ক না থাকলেও এদের দেহ মাছের মতোই পুরো দেহ আঁশে ঢাকা থাকে--বরং মানুষের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী এরা ।বনরুই (Pangolin) ফোলিডোটা বর্গের আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। মুখে দাঁত না থাকায় পূর্বে দাঁতহীন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। কিন্তু কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বর্তমানে এদের আলাদা একটি দল ফোলিডোটার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার একমাত্র সদস্য বনরুই।পিঁপড়া ও পিঁপড়াজাতীয় প্রাণী খায় বলে আঁশযুক্ত পিঁপড়াভুক নামেও পরিচিত।



বিশ্বের স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্তিত্ব-হুমকিতে রয়েছে এই বনরুই। বাংলাদেশেও এটি আজঅস্তিত্ব-হুমকিতে।

বনরুই বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস

জগৎ/রাজ্য: Animalia

পর্ব: Chordata

শ্রেণী: Mammalia

Infraclass: Eutheria

মহাবর্গ: Laurasiatheria

বর্গ: Pholidota

পরিবার: Manidae

গণ: Manis

বৈজ্ঞানিক নাম: (Manis )ম্যানিস পেন্টাডাক্টিলা



যেখানে দেখা যায়ঃ

বনরুই আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। দেশি বনরুই বাংলাদেশে মহাবিপন্ন ও বিশ্বে কম শঙ্কাগ্রস্ত বলে বিবেচিত। ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণি আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত। পৃথিবীতে ৭ প্রজাতির বনরুই রয়েছে, তন্মধ্যে এশিয়ায় আছে তিন প্রজাতির আর এই তিনটিই বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এশীয় বনরুইদের এই তিনটি প্রজাতি হলও

ক. দেশি বনরুই, Indian Pangolin, Manis crassicaudata,

খ. মালয়ী বনরুই, Malayan Pangolin, Manis javanica, ও

গ. চায়না বনরুই, Chinese Pangolin, Manis pentadactyla.



বাসস্থানঃ

এরা প্রধানত চিরসবুজ ও আধা চিরসবুজ বনে বাস করে। দেশি ছাড়া অন্য দুটি প্রজাতি সব জায়গায় দেখা যায় না। চীনা প্রজাতিটি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট এবং মালয় বনরুই শুধু সিলেটের বনজঙ্গলে বাস করে। অত্যন্ত লাজুক ও নিশাচর বলে এ দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যায় থাকা সত্ত্বেও প্রকৃতিতে বনরুইয়ের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

বর্ণনাঃ

বাংলাদেশের স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মধ্যে দেশি বনরুই দীর্ঘ ও সরু দেহের একটি প্রাণি। বনরুই ওজনে ২ থেকে ৯ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তিন প্রজাতির বনরুইয়ের মধ্যে আকারে দেশিগুলোই বড়। লেজ বাদে প্রায় ৬৬ সেন্টিমিটার লম্বা হয়; লেজটি হয় প্রায় ২০ সেন্টিমিটার। চীনা ও মালয়গুলো অপেক্ষাকৃত ছোট ও ছিপছিপে গড়নের হয়। ওজনে দেশি প্রজাতিটি ১০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। নাক ও দেহের নিচের দিক ছাড়া বাকি অংশ ১১-১৩ সারি শক্ত আঁশে আবৃত থাকে। আঁশের ফাঁকে ফাঁকে থাকে শক্ত লোম। লোমের পরিমাণ চীনাগুলোতে বেশি থাকে। দেশি বনরুইয়ের শরীরের রং হালকা বাদামি; আর চীনা ও মালয়গুলোর রং গাঢ় বাদামি। এ ছাড়া মালয়গুলোর আঁশের রং কিছুটা সাদাটে হয়ে থাকে। তবে নাক ও আঁশবিহীন অংশের রং কাঁচা মাংসের মতো লালচে হয়। ঘন আঁশের কারণে মালয় ছাড়া অন্য দুই প্রজাতির বনরুইয়ের কান দেখা যায় না।

এরা অত্যন্ত অদ্ভুত প্রাণী। মাটিতে বাস করলেও গাছে চড়তে ওস্তাদ, বিশেষ করে চীনা ও মালয়গুলো। বনরুই যখন কুঁজো হয়ে দুলতে দুলতে চলে, তখন মনে হয় কোনো জীবাশ্ম বা ফসিল বুঝি জীবিত হয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। এদের দেহ, বিশেষ করে লেজ, অত্যন্ত নড়নক্ষম। লম্বা এই লেজটি কোনো গাছের ডালে জড়িয়ে দিব্যি ঝুলে থাকতে পারে।

>>আবার কোনো বিপদ দেখলে সামনের দুই পায়ের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে লেজ দিয়ে পুরো দেহ ঢেকে বলের মতো করে ফেলে। এ



অবস্থায় গায়ের আঁশগুলো খাড়া হয়ে যায়। এভাবে দেহ একবার কুণ্ডলী পাকাতে ও সামনের পা দিয়ে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে পারলে শক্তিশালী প্রাণীও সহজে এদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আর এভাবেই এই নিরীহ প্রাণীটি শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করে থাকে।

খাদ্যঃ

বনরুই অত্যন্ত অলস ও ধীরগতিসম্পন্ন প্রাণী। সারা দিন গর্তে ঘুমিয়ে কাটায় ও রাতে খাবারের খোঁজে বের হয়। খাবারের জন্য এরা মাটি শুঁকতে শুঁকতে এগোতে থাকে। পিঁপড়ার বাসা বা উইপোকার ঢিবির খোঁজ পেলেই শক্তিশালী থাবার নখের মাধ্যমে সেগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলে। এদের থাবায় পাঁচটি করে ধারালো নখ থাকে। বাসা বা ঢিবি ভাঙার পর প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা আঠালো জিহ্বার সাহায্যে পিঁপড়া, উইপোকা, তাদের ডিম ও বাচ্চা খেতে থাকে। একটি পূর্ণবয়স্ক বনরুই এক রাতের শিকারে গড়ে পাঁচটি পিঁপড়ার বাসা বা উইপোকার ঢিবি সাবাড় করতে পারে।

>>এ ছাড়া এরা মজার একটা কাণ্ড ঘটায়---- নখ দিয়ে পিপীলিকার বাসা ভেঙে তার গায়ের আঁশগুলো ছড়িয়ে দেয়। পিঁপড়াগুলো তার আঁশের ভেতর ঢুকে পড়লে সে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পিঁপড়াগুলো পানি থেকে বাঁচতে ছোট গোলাকৃতি বা দানাদার হয়ে যখন পানিতে ভাসতে থাকে, তখন বনরুই তার সরু লম্বা জিভ দিয়ে সেগুলো মুখের ভেতর শুষে নেয়। সে জন্য প্রাণীটির নামকরণ হয়েছে পিপীলিকাভুক।



বাসা তৈরি ও জীবনচক্রঃ

এরা মাটির নিচে গর্ত করে বাসা বাঁধে। গর্ত ছয় মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এরা সাধারণত জোড় বেঁধে চলে ও বসন্তকালে বাচ্চা দেয়। এশিয়া অঞ্চলের বনরুই এক থেকে তিনটি বাচ্চা দেয়। তবে আফ্রিকা অঞ্চলের বনরুই একটির বেশি বাচ্চা প্রসব করে না। জন্মকালে বাচ্চার ওজন ৮০ থেকে ৪৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। দুই বছরে পরিপক্ব হয়ে ওঠে এরা। তখন দেহের আঁশগুলোও শক্ত হয়ে যায়। এরা প্রায় দুই দশক পর্যন্ত বেঁচে থাকে।’

বাচ্চা নিয়ে ঘোরাফেরার সময় মা লেজটিকে উঁচু করে তাতে বাচ্চাকে বসিয়ে নেয়। সময় বিপদ দেখলে বাচ্চাসহ এমনভাবে কুণ্ডলী পাকায় যে বাচ্চা আঁশের ফাঁকে ঢাকা পড়ে যায়।



বিলুপ্তির কারনঃ

শান্ত-নিরিহ এই বনরুই আমাদের ক্ষতি না করলেও আমরা মানুষেরা তাদের বাসস্থান বন জঙ্গল কেটে ও ধ্বংস করে তাদের করেছি আশ্রয়হীন।এ ছাড়া মানুষ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে প্রাণীটি নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে। লোকজ ওষুধ তৈরি বা টোটকার দোহাই দিয়ে হাটবাজারে হামেশাই



পসরা সাজিয়ে বসে থাকা ভণ্ড কবিরাজ ও গণক আর ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অনেকে নিরীহ প্রাণীটির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে হারবাল ওষুধ তৈরির কিছু হাতুড়ে কম্পানিরও। এদের দেহ-আবরণ বা আঁশ ক্যারোটিন থেকে তৈরি। মানুষের চুল ও নখ এই উপাদান দিয়ে তৈরি। ঔষধিগুণ থাকায় কালোবাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে কিছু ভণ্ড কবিরাজ বনরুই মেরে দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে তথাকথিত ওষুধ তৈরি করে এদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। অনেকেই হয়ত দেখে থাকবেন হাট-বাজারে কবিরাজ তার ঔষধের পশরা সাজিয়ে বসেছে। মাছের মত বড় বড় আঁশযুক্ত দু-এক খণ্ড চামড়া আছে হয়ত সেখানে। সেটিই বর্ম ধারী বনরুই এর করুণ পরিণতি! আবার গণকরাও মানুষকে প্রতারণার জন্য এই প্রাণীটিকে ব্যবহার করে। এ ছাড়া কোনো কোনো আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে এদের মাংস অত্যন্ত প্রিয়। এ ছাড়া আমাদের দেশ থেকে এই বিলুপ্তপ্রায় বনরুই মিয়ানমারসহ পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।



আমাদের করনীয়ঃ

প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনরুইয়ের দেহ দিয়ে তৈরি করা এসব ওষুধের বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই। এগুলো আসলে অপচিকিৎসা এবং অসচেতন মানুষকে বিভ্রান্ত করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার একটি কৌশল। কাজেই বিলুপ্তির হাত থেকে এদের রক্ষা করার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

যদিও ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী আইনে এটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও এদের শিকার করা বন্ধ হয়ে জায় নি। অস্তিত্ব সংকটের উদ্ভূত



পরিস্থিতিতে বনরুইকে বাঁচাতে হলে গণসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। পাশাপাশি দরকার সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর দ্রুত বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

সূত্র- নেট, ব্লগ।

বিষয়: বিবিধ

২৭৭১ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

243958
১২ জুলাই ২০১৪ রাত ০৩:১০
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার পোষ্টটির জন্য ধন্যবাদ। টাঙ্গাইল এর মধুপুর জঙ্গলে একবার বুনো পরিবেশে এই প্রানি টি দেখার সেীভাগ্য হয়েছিল।
243961
১২ জুলাই ২০১৪ রাত ০৩:২৬
আব্দুল গাফফার লিখেছেন : বাহ! দেখতে ভয়ংকর মনে হলেও নিরহ জেনে ভাল লাগলো । এই প্রজাতি ছাড়াও অসংখ্য প্রজাতি বিলুপ্তের পথে । সরকারী বেসরকারি ব্যক্তিগত সবাই এগিয়ে আসলেই এদের রক্ষা করা সম্ভব । শেয়ার করায় অনেক ধন্যবাদ
243970
১২ জুলাই ২০১৪ রাত ০৩:৪৯
মাটিরলাঠি লিখেছেন :
চমৎকার শেয়ার ও অসাধারণ। Rose Rose
244002
১২ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৮:১৩
সন্ধাতারা লিখেছেন : Wonderful post!! Jajakalla khairan.
244043
১২ জুলাই ২০১৪ দুপুর ১২:১২
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ সবাইকে। এগিয়ে আসতে হবে এই প্রানিটি কে বাচিয়ে রাখতে
244074
১২ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০২:০৮
আহমদ মুসা লিখেছেন : চমৎকার পোস্ট, ভাল লাগলো।
245049
১৬ জুলাই ২০১৪ রাত ০১:১০
egypt12 লিখেছেন : অনেক কিছু জানা হলো ভাই Happy

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File