ঘোল গ্রামীণ সমাজের এক হারিয়ে যাওয়া পানীয়

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২৫ মে, ২০১৪, ০১:২৫:৪২ দুপুর

ঘোল গ্রামীণ সমাজের এক হারিয়ে যাওয়া পানীয়



‘ঘোল লাগবি ঘোল,

খাঁটি দুধের ঘোল।’


কাঁধে বাঁশের বাহুকে দুইপাশে ঝোলান দড়ির শিকার বাকে দু’টো মাটির পাঁতিলে একটিতে ঘোল আর অন্যটিতে পানি নিয়ে গ্রাম ময় ঘোষজীর সেই ডাক আর শোনা যায় না।

তবে এই ঘোল, যার অপর নাম মাঠা। অতি সুস্বাদু পানীয় হলেও বাংলা ভাষায় ঘোল শব্দটি অকারনে নেতিবাচক ব্যাবহারের দোষে দুষ্ট। সাহিত্যে ------

ঘোল খাওয়া---- বিপদে পড়ে বিব্রত হওয়া।

ঘোল খাওয়ানো ---- নাকাল করা।

মাথায় ঘোল ঢালা ------ অপমানিত বা জব্দ করা।


ধরনের বাক্যের ব্যবহার উপদেয় এই পানীয়টির উপর যথেষ্ট অবিচার করেছে বলে আমার ধারনা।

এমন হাজারো বিশেষণে ভূষিত ঘোল এক সময় গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় কোমল পানীয়। আধুনিক কালের (এখন হলো কোমল পানীয়র যুগ। ঠকিয়ে ঘোল খাওয়ানোর যুগ)কোমল পানীয়ের কাছে টিকতে না পেরে এটি বর্তমানে গ্রামীণ সমাজ হতে আজ বিদায় নিয়েছে। তবে কিছু কিছু এলাকায় আজও এটি এর স্বকীয়তা বজায় রেখে মহা সমারোহে চলছে। তার উজ্জ্বল উদাহরণ মাঠা নামে বোতল-জাত করে বাজারে ছাড়া হয়েছে একে। এ যেন সেই প্রবাদকে মনে করিয়ে দেয়----

এ যে, নতুন বোতলে সেই পুরানো সুধা।

তাই তো পুরানো স্মৃতি ধরে রাখতে প্রতি বছর সিরাজগঞ্জে উল্লাপাড়ায় আয়োজন করা হয় ঘোল উৎসব।



ঘোল শুধু বাঙালির রসনা তৃপ্তির অংশই নয়, এক সময় ঔষধি হিসেবেও খাঁটি দুধের ঘোলের ব্যাপক চাহিদা ছিল। গ্রীষ্মে পেটের পীড়াসহ নানান রোগব্যাধি শুরু হলে ঘোলের কদর বেড়ে যেতো। ধান কাটার মৌসুম এলেই ঘোল সহ গোয়ালাদের হাঁকডাক শোনা যেতো। গৃহিণীরা ধানের বদলে ঘোল নিত।

ঘোলঃ

ঘোল [ Ghōla ] জলের সঙ্গে মিশিয়ে পাতলা করা বা মাখন-তোলা দই। [ √ঘূণ্ (< ঘূর্ণ) + অ-- প্রাকৃ. ঘোল]। ঘোল বা ছানার পানি বিভিন্ন দেশে একটি উপাদেয় পানীয় হিসেবে পরিচিত। দুধ হতে ছানা অপরাসরণের পর অবশিষ্ঠাংশই ঘোল নামে পরিচিত। এতে দুধের কেজিন প্রোটিন (Casein) ছাড়া আর সকল উপাদানই বিদ্যমান। এটি মূলত পনির উৎপাদনের একটি প্রধান উপজাত।



উৎপাদনঃ

দুধে খাদ্য উপযোগী অম্ল জাতীয় পদার্থ যেমন লেবুর রস প্রভৃতি যোগ করলেই দুধের কেজিন প্রোটিন জমাট বেঁধে যায়। জমাট বাঁধা অংশটুকুই ছানা হিসেবে পনির তৈরির জন্য অপরাসারণ করা হয়। অবশিষ্ট তরল পদার্থই ঘোল। প্রাকৃতিক ভাবে দুধ রেখে দিলে এতে ল্যাকটিক এসিড



উৎপাদনকারী ব্যাক্টেরিয়া সংখ্যা বৃদ্ধি করে। এই জাতীয় ব্যাক্টেরিয়া দুধের শর্করা ব্যবহার করে ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে যা দুধের অম্লত বাড়িয়ে দেয় (pH কমায়)দেয়। অম্লীয় মাধ্যমে দুধের কেজিন প্রোটিন জমাট বাধে। রয়ে যাওয়া তরল অংশই ঘোল।

পুষ্টিগুণঃ

পনির উৎপাদনের একটি উপজাত হলেও ঘোলে দুধের কেজিন ভিন্ন আর সকল উপাদানই বিদ্যমান। বিধায় এর পুষ্টিগুন অপরিসীম। তাছাড়া এটি পনিরের তুলনায় সস্তা। এছাড়াও শরীরের মেদ কমাতেও এটি সাহায্য করে । প্রতিদিন ঘোল(মাঠা) পানে শরীরের অতিরিক্ত মেদ হ্রাস পায়। এতে দুধের প্রোটিন থাকে না বলে যাদের দুধ



পানে সমস্যা হয় তারা ঘোল পানে দুধের অন্যান্য প্রয়োজনিয় উপাদান পেতে পারেন। ঘোলে প্রোটিন ছাড়াও ভিটামিন, মিনারেলস, কার্বোহাইড্রেটসহ এনার্জি বিদ্যমান। এছাড়াও---- ঘোল



১. ক্ষত শুকানোয় সহায়তা করে ।

২. ওজন নিয়ন্ত্রণ করে ।

৩. শারীরিক কর্মক্ষমতা বাড়ায় ।

৪. ঘোলের প্রোটিন টাইপ-টু ডায়াবেটিকস রোগীদের জন্য বেশ উপকারী ।

৫. বয়স্কদের ওজন হ্রাস ও হাড় ক্ষয় রোধে এটি বৃদ্ধদের জন্য এটি অতি দরকারি পানীয়।

৬. ঘোলের প্রোটিনের বিভিন্ন ধরনের উপাদান শিশুদের পুষ্টির জন্য প্রয়োজন।

৭. ঘোলে থাকে ভিটামিন বি-১২ এবং এই ভিটামিনের অভাবে স্মৃতিশক্তি ভয়াবহভাবে হ্রাস পায়। ঘোলে থাকা ভিটামিন বি-১২ বয়সজনিত স্মৃতিশক্তি হ্রাস রোধ করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় মস্তিষ্কের সংকোচন কমিয়ে দেয়।

অন্যান্য ব্যবহারঃ

শুধু খাদ্য ছাড়াও ঘোলের আরো ভিন্ন ব্যবহার রয়েছে। ঘোলে দুধের শর্করা থাকে ফলে এটি ভিনেগার উৎপাদনের কাচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।



কি ভাবে তৈরি করবেনঃ

আধুনিক পদ্ধতিঃ

ঘোল তৈরি: উপকরণ: দুধ ৩ লিটার।

প্রণালি: দুধ জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করে নিয়ে ডাল ঘুঁটনি দিয়ে ভালো করে ঘুঁটে ওপর থেকে ক্রিম উঠিয়ে নিতে হবে। সব ক্রিম বা ননি ওঠানো হয়ে গেলে যে দুধ থাকবে, ওটাই ঘোল। এই ঘোল দিয়ে মাঠা তৈরি করা হয়।

মাঠা তৈরি: উপকরণ: ঘোল ৪ গ্লাস, লবণ সামান্য, চিনি ৪ টেবিল-চামচ, বরফ ১ কাপ।

প্রণালি: সব একসঙ্গে ব্লেন্ডারে দিয়ে খুব ভালো করে ব্লেন্ড করতে হবে। ওপরে ফেনা উঠবে, এই অবস্থায় ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশন।

গ্রামীণ পদ্ধতিঃ

দুধ ঘন করে জ্বালিয়ে বীজ দিয়ে দই বসিয়ে রাখতে হয়। পরদিন দই হলে, সেই দই পানি মিশিয়ে বাঁশের মোহন (ঘাঁটুনি) দিয়ে আচ্ছা মতো ঘঁটতে হয়। এসময় দইয়ের ননি (মাখন) উঠিয়ে নিতে হয়। সেই মাখন বা ননি দিয়ে পরে ঘি বানানো হয়। আর যে পাতলা দই থাকলো ওটাই হলো ঘোল।



পুরানো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মাঠা বা ঘোল

পুরানো ঢাকায় গিয়েছেন অথচ মাঠা খাননি এমন ভোজন রসিক খুজে পাওয়া যাবে না। মাঠা- পুরানো ঢাকার একটি বিশেষ ঐতিহ্যবাহী খাবার। স্বাদ ও গুণের জন্য মাঠার জনপ্রিয়তা এত কালেও কমেনি এক বিন্দু, বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঢাকা শহরের অনেক যায়গাতেই মাঠা পাওয়া যায়। কিন্তু খাঁটি মাঠা ও ঐতিহ্যের স্বাদ একসাথে পেতে পুরানো ঢাকায় যাওয়ার বিকল্প নেই।

প্রায় ১০০ বছর আগের ঢাকায় প্রতিদিন সকালে মাঠা বিক্রি হতো। বিশেষত শীতে এর কদর বেড়ে যেতো। একটি বিরাট হাঁড়ি মাথায় নিয়ে গোয়ালারা হাঁক দিতেন ‘মাঠা-মাখন’ বলে। গোয়ালারা দুটি কাঁচের গ্লাস এবং মাঠা তোলার জন্য টিনের হাতলওয়ালা একটি ছোট মগ আনতেন। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির বাসিন্দাই মাঠা খেতেন এসব গোয়ালাদের কাছ থেকে। এক গ্লাস মাঠার মধ্যে এক টুকরো মাখন এবং অল্প লবন ছিটিয়ে পরিবেশন করা হতো। প্রাচীন ঢাকার মাঠা ছিলো ঘন, ক্রীমি এবং অত্যন্ত সুস্বাদু।

কোথায় পাবেন- মাঠা খেতে হলে সকাল সকাল পুরনো ঢাকার শাখারী বাজারে চলে যেতে পারেন। সাধারণত সকাল ৯টা ১০ টার মধ্যেই মাঠা বিক্রি শেষ হয়ে যায়। এখানের অলি-গলিতে খুঁজলে আপনি পেয়ে যাবেন সুস্বাদু মাঠা। এছাড়াও চকবাজার, নাজিমুদ্দিন রোড, লালবাগ, আমলিগোলা, লক্ষ্মীবাজার, নবাবপুর, উর্দ্দু রোড, ওয়ারী, নারিন্দা, নাজিরাবাজার, ইসলামপুর ইত্যাদি যায়গায় মাঠার খোজ করতে পারেন।

সতর্কতাঃ বর্তমানে বেশ কিছু বোতলজাত মাঠা পাওয়া যায়। যেমন— --- মাঠা.. ---- মাঠা......।। এগুলোর বেশিভাগই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভেজাল দুধ দিয়ে বানানো। তাই এখনো খাঁটি মাঠা খেতে হলে ঘরে তৈরির কোনো বিকল্প নেই।



দরদামঃ মাঠা গ্লাস প্রতি ১০ টাকা হয়ে থাকে। তবে লিটার হিসেবে নিলে এর দর দাম অঞ্চল ভেদে ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন—ঢাকায় সর্বমিম্ন উন্নত মানের ঘোল ১২০ টাকা লিটার এবং একটু পাতলা ঘোল বিক্রি হয় ৯০ টাকা লিটার। প্রতি গ্লাস ১০ টাকা ও ১৫ টাকা।



রাজশাহীতে সর্বমিম্ন উন্নত মানের ঘোল ৭০ টাকা লিটার এবং একটু পাতলা ঘোল বিক্রি হয় ৫০ টাকা লিটার। প্রতি গ্লাস ৫ টাকা, ১০ টাকা ও ১৫ টাকা।

উল্লাপাড়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘোল উৎসব



ব্রিটিশ শাসনামল থেকে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ঘোল উৎপাদন ও বিক্রি হতো। এই ঘোল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি হতো। কালের পরিক্রমায় ঐতিহ্যবাহী এ ঘোল ও ঘোল উৎপাদক পরিবারগুলো বিলুপ্তপ্রায়।

এ ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ২০০৮ সাল থেকে সিরাজগঞ্জের প্রভাতি সংঘ ঘোল উৎসবের আয়োজন শুরু করে। প্রতিবছর এপ্রিলের দ্বিতীয় শুক্রবারে অনুষ্ঠিত এ উৎসবে জেলার বিভিন্ন উপজেলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে।



এরই ধারাবাহিকতায় ৬ষ্ঠ বছরে (১১/০৪/১৪)এ ঘোল উৎসবের আয়োজন করা হয়।

চীনে বিষাক্ত ঘোল খেয়ে ১৯ শিশু অসুস্থ

বিষয়: বিবিধ

১৬২৭ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

225942
২৫ মে ২০১৪ দুপুর ০১:৩০
পরিচিত লিখেছেন : ঐতিহ্য এবং বর্ণনামূলক পোষ্ট টির জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি--
২৫ মে ২০১৪ দুপুর ০২:০৬
172938
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
225946
২৫ মে ২০১৪ দুপুর ০১:৩৩
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : প্রিয়তে নিলাম; পরে পড়ে নেবো।
২৫ মে ২০১৪ দুপুর ০২:০৬
172937
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
225954
২৫ মে ২০১৪ দুপুর ০১:৫৮
বিন হারুন লিখেছেন : পিলাচ পিলাচ
২৫ মে ২০১৪ দুপুর ০২:০৬
172936
গোলাম মাওলা লিখেছেন : মাইনাস মাইনাস
২৫ মে ২০১৪ দুপুর ০২:০৯
172940
বিন হারুন লিখেছেন : Crying Crying
225992
২৫ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:০৯
আমীর আজম লিখেছেন : মাথায় ঘোল লেগে গেল।
২৫ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৬
173020
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ঘোল খাওয়া---- বিপদে পড়ে বিব্রত হওয়া।

ঘোল খাওয়ানো ---- নাকাল করা।

মাথায় ঘোল ঢালা ------ অপমানিত বা জব্দ করা।
226160
২৫ মে ২০১৪ রাত ০৮:১৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ঘোল বা মাঠা দারুন গরমে অত্যন্ত শিতল ও সাস্থপযোগি পানিয়। বর্তমানে ঘোলের ঝাল শরবত বা বোরহানি বোতল জাত অবস্থায় পাওয়অ যায়। তবে মাঠার মিষ্টি শরবত অনেক বেশি উপাদেয়। এখনও চট্টগ্রামে কয়েকজায়গায় ভাল মাঠা পাওয়া যায়। যদিও দাম বেশি। মাঝে মাঝে সেখান থেকে এনে নিজে বানিয়ে খাই।
সুন্দর পোষ্টটির জন্য ধন্যবাদ।
২৫ মে ২০১৪ রাত ১১:২৯
173197
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ঘোল খাওয়ানো ---- নাকাল করা।;Winking
226367
২৬ মে ২০১৪ দুপুর ১২:৫৪
egypt12 লিখেছেন : জেনে প্রীত হলাম Rose
২৬ মে ২০১৪ দুপুর ০২:১৫
173352
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File