ভোঁদড় বা উদবিড়াল বাংলাদেশের প্রণী জগতের এক অদ্ভুত স্তন্যপায়ী প্রাণী
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১৯ মে, ২০১৪, ০২:০০:৫১ দুপুর
ভোঁদড় বা উদবিড়াল বাংলাদেশের প্রণী জগতের এক অদ্ভুত স্তন্যপায়ী প্রাণী
"আয় রে আয় টিয়ে নায়ে ভরা দিয়ে
না' নিয়ে গেল বোয়াল মাছে
তাই না দেখে ভোঁদড় নাচে
ওরে ভোঁদড় ফিরে চা
খোকার নাচন দেখে যা "...
ছোটবেলার এই ছড়ার মাধ্যমেই মূলত: ভোঁদড় সবার চেনা প্রাণী। কিন্তু ভোঁদড়ের ছবি আমি দেখেছি বা চিনেছি অনেক অনেক পরে। যদিও অনেক ছোটতে গ্রামের বড় দিঘিতে একে দেখেছি দুএকবার, তখন নাম জানতাম উদবিড়াল বা মাছ খেকো বিড়াল বলে। কিন্তু এই সেই কবিতার ভোঁদড় তা জেনেছি অনেক পরে।
ভোঁদড় বা উদবিড়ালঃ
জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে ভোঁদড় এক ধরনের বিশেষ প্রাণী। ভোঁদড় কয়েক ধরণের আধা জলচর (এবং একটি ক্ষেত্রে জলচর) প্রধাণত মৎস্যভূক স্তন্যপায়ী প্রাণী। ভোঁদড় বলতে মুস্টিলিডি (Mustelidae) গোত্রের লুট্রিনি (Lutrinae) উপগোত্রের প্রাণীগুলোকে বোঝায়, যার মধ্যে আরও আছে উদবিড়াল, নেউল বা বেজি, ব্যাজার ইত্যাদি। বাংলাদেশে ভোঁদড়ের তিনটি প্রজাতি এবং ব্যাজারের একটি প্রজাতি দেখা যায়।
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ/রাজ্য: Animalia
পর্ব: Chordata
শ্রেণী: Mammalia
বর্গ: Carnivora
পরিবার: Mustelidae
উপপরিবার:Lutrinae
শ্রেণীবিভাগঃ
ভোঁদড় দু'রকমের হতে পারে:
১. নখরযুক্ত ভোঁদড় বা সাধারণ ভাষায় ভোঁদড়
শরীর কালচে বাদামী পানি প্রতিরোধক ঘন লোমে ঢাকা। মাথা ও শরীরের মাপ ৬৫-৭৫ সেমি। গলার দিকে সাদা । লেজ ৪০-৪৫ সেমি. চ্যাপ্টা ফলে সাতারে বেশ সুবিধা হয় । কান ছোট । পায়ের পাতা হাঁসের পায়ের মত চ্যাপ্টা । ভোঁদড় বা উদ-বিড়াল ওজনে ৭-১১ কেজি হয় ।
২. নখহীন ভোঁদড়
নখহীন ভোঁদড়কে (Clawless otter) (বৈজ্ঞানিক নাম Amblonyx cinereus) "নখহীন" ডাকা হলেও এদের আসলে নখ রয়েছে, তবে বাইরের দিকে একটু কম বেরিয়ে থাকে। এদের দেহের রং কালচে বাদামি, দেহের নিচের অংশ ময়লা হলদে। ঠোঁট ও গলার দিককার রং প্রায় সাদা। নখহীন ভোঁদড়ের ওজন হয় ৩ থেকে ৫ কেজি।
বাংলাদেশে ভোঁদড়ঃ
ছোট বেলার সেই ছড়া আবৃতির সাথে সাথে খোকনদের দেখানোর মত ভোঁদড় বা উদ-বিড়াল (Smooth-Coated Indian Otter) আগের-মত বাংলাদেশে আর নেই ।দেশের বিভিন্ন স্থানে এরা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত যেমন- ধেড়ে, ঊদ, উদবিলাই, উদবিড়াল ও মাছনেউল ইত্যাদি।আমাদের দেশে তিন প্রজাতির ভোঁদড় আছে।
উদ-বিড়াল বসবাসের জন্য নদী , লেক , হাওড় – বিল গ্রামের পুকুর বা দিঘির পারে থাকা ঝোপঝাড় পছন্দ করে । উদ-বিড়াল কৌতূহলী প্রাণী । কোন কিছু আঁচ করতে পারলে পিছনের দুপা ও লেজের উপর ভর করে দারিয়ে এদিক অদিক দেখে নেয় ।উদ-বিড়াল পরিবার ভিত্তিক দলে থাকে ও শিকার করে । এরা পানিতে ঢুপ দিয়ে মাছ ধরতে খুব পটু ।ফলে মানুষ এদের পোষ মানিয়ে মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করে আসছে বহু কাল থেকে । মাছ উদ-বিড়ালেরে প্রধান খাবার ।
আগে বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামের পুকুর বা দিঘির পারে থাকা ঝোপঝাড়ে উদ-বিড়াল বাস করত । পুকুর বা দিঘির পারে উদ-বিড়ালের খাওয়া মাছের কাটা পড়ে থাকতে দেখা যেত । গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত এই প্রাণীটির বিপন্ন কাহিনী হয়েছে অনেক আগেই ।
বাংলাদেশে যে সব ভোঁদড় দেখা যেত এক সময় গ্রামে গ্রামে তাদের শরীর কালচে বাদামী পানি প্রতিরোধক ঘন লোমে ঢাকা। মাথা ও শরীরের মাপ ৬৫-৭৫ সেমি। গলার দিকে সাদা । লেজ ৪০-৪৫ সেমি. চ্যাপ্টা ফলে সাতারে বেশ সুবিধা হয় । কান ছোট । পায়ের পাতা হাঁসের পায়ের মত চ্যাপ্টা । ভোঁদড় বা উদ-বিড়াল ওজনে ৭-১১ কেজি হয় ।ভোঁদড় পানিতে বাস করার কারণে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিবর্তন ঘটেছে। লম্বা শরীর, তেলতেলে চামড়া, মাংসল লেজ, হাঁসের পায়ের মতো পায়ের পাতা, ছোট কান, চওড়া মাথা সবই পানিতে বিচরণের উপযোগী। এরা খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে এবং এক ডুব দিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার যেতে পারে। ধারাল দাঁত দিয়ে মাছ শিকার করতে এদের জুড়ি নেই।
দিন দিন দিঘির পারের ঝোপঝাড় পরিষ্কারের ফলে আশ্রয়হীন হয়ে পড়লো গ্রামীণ বনের উদ-বিড়ালেরা । কেউ হয়ত মারা পড়লো উৎসাহী গ্রামবাসীর লাঠির আঘাতে নয়ত-বা গৃহস্থের কুকুরের কামরে ।কেউ হয়ত পারি-জমাল কাছে থাকা কোন হাওর বা বিলে। কিন্তু তারাও বেশী দিন নিরাপদে থাকতে পারলনা । মানুষের লভাতুল দৃষ্টি পড়লো অদের চকচকে সুন্দর চামড়ায় । অবাধে নিধন হল উদ-বিড়াল। তারপরেও যারা লুকিয়ে বেঁচেছিল তারা সিকার হোল ইজারাদারদের মাছচাষ প্রকল্পের কবলে । জলজ পরিবেশ ধ্বংসের সাথে সাথে বিলুপ্তির দার প্রান্তে উদ-বিড়াল । বাংলাদেশের গ্রামের বড় বড় পুকুর ও দিঘিত, বিল হাওড়ে এদের অবাধ বিচরণ আর তেমন দেখা যায়না । তবে সুন্দরবনে উদ বিড়াল এখনো ভালো ভাবে টিকে আছে।
বৈশিষ্ট্যঃ
ভোঁদড় সাধারণত লিপ্তপদী, মানে হাঁসের পায়ের মতো আঙ্গুলগুলো পাতলা পর্দা দিয়ে জোড়া লাগানো থাকে।এদের লেজ মোটা আকারের এবং শরীর লম্বাটে গড়নের। বেশিরভাগেরই পায়ে ধারালো নখযুক্ত থাবা আছে। সাঁতার কাটার সময়ে ভোঁদড়ের নাক ও কানের ফুটো বন্ধ থাকে। এদের নাকের ডগায় লম্বা গোঁফের মতো খাড়া লোম থাকে। এই গোঁফ সংবেদনশীল বলে পানির নীচে শিকার ধরতে ভোঁদড়কে সহায়তা করে। এদের গোঁফ যেহেতু খাড়া, তাই জলে ভিজে গায়ে লেপ্টে যায় না, ঘোলা জলে এই স্পর্শকাতর গোঁফ শিকারের উপস্থিতি জানান দেয়। নোখহীন ভোঁদড়ের হাত-পায়ের পাতাও খুব স্পর্শকাতর। ফলে কাদায় লুকানো ঝিনুক, শামুক, চিংড়ি, কাঁকড়া এদের হাত থেকে রক্ষা পায় না। এদের শক্তিশালী ছুঁচালো দাঁত আর মাড়ি পিচ্ছিল শিকার ধরতে বা মাছের মুড়ো চিবোতে অত্যন্ত কার্যকর।
ভোঁদড়ের দেহে দুই স্তর লোম রয়েছে। প্রথম স্তর আকারে ছোট, কোমল এবং তাপরোধী। এই অন্তঃলোম বাতাস ধরে রেখে পানির নীচে এদের দেহ উষ্ণ ও শুকনো রাখে। এই লোমগুলো পানিরোধী। দ্বিতীয় স্তরের লোম লম্বা। এই লোমই আমাদের চোখে পড়ে, এগুলো জলে ভিজে ওঠে। এদের লেজ চ্যাপ্টা, ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি (মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চি) লম্বা। নৌকার দাঁড়ের মতো হাত-পা (পা হাতের চেয়ে বড়), শক্ত খাড়া গোঁফ জলে শিকার করার অত্যন্ত উপযোগী। ভোঁদড় লিপ্তপদী বলে পানির নিচে খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে এবং পানির উপরে মাথা না তুলে একবারে প্রায় আধা কিলোমিটার যেতে পারে।
ভোঁদড় বা উদবড়ালের গন্ধ বিকট একপ্রকার গন্ধ রয়েছে; অভিজ্ঞজনেরাও এ গন্ধকে বাঘের গন্ধ বলে ভুল করতে পারেন। ভোঁদড়েরা দলবেঁধে থাকলে প্রচন্ড চেঁচায়। অধিকাংশ সময় এরা বাচ্চা সাথে নিয়ে শিকার খোঁজে। ভোঁদড়-গোত্রের অন্যান্য প্রাণীরা নিশাচর হলেও ভোঁদড় সব সময়ই কর্মতৎপর।
উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের সামুদ্রিক ভোঁদড় পাথরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এরা সামনের পা দিয়ে পাথর টেনে তুলে তার সহায়তায় শামুক, ঝিনুক ইত্যাদির খোল ভেঙ্গে থাকে। এরা ভাসমান অবস্থায় বুকের উপরে পাথর রেখে তাকে কামারের নেহাইয়ের মতো ব্যবহার করে।
খাদ্য ও আবাসঃ
অনেক ভোঁদড় শীতল পানিতে বসবাস করে এবং শরীর উষ্ণ রাখার জন্য এদেরকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। দিনে ইউরেশিয়ান ভোঁদড়কে তাদের দেহের ওজনের ১৫ শতাংশ আর সামুদ্রিক ভোঁদড়কে তাপমাত্রাভেদে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।
যদিও ভোঁদড়ের মূল খাদ্য মাছ, তবে এরা অন্যান্য জলজ অমেরুদন্ডী প্রাণী, যেমন: কাঁকড়া, পানির ব্যাঙ ইত্যাদিও দলবেঁধে শিকার করে থাকে। কিছু ভোঁদড় শেলফিশ খুলতে দক্ষ, আর অন্যরা ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী বা পাখি শিকার করে। নির্দিষ্ট শিকারের উপরে নির্ভরশীল বলে ভোঁদড় শিকারশূণ্যতার ঝুঁকিপূর্ণ।
অন্যান্য ভোঁদড়ের যেমন প্রথম পছন্দ মাছ, নোখহীন ভোঁদড়ের সবচেয়ে পছন্দের শিকার চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক ইত্যাদি শক্ত খোলসের প্রাণী।
ভোঁদড় সমাজবদ্ধ জীব। এরা বেশ ক্রীড়াপ্রবণও। বুদ্ধিমান এই প্রাণীগুলো বেশ বন্ধুবৎসল এবং সহজেই পোষ মানে। অনেক স্থানে, বিশেষত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও সুন্দরবন এলাকায় পোষা ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করতেও দেখা যায়।
বেশিরভাগ ভোঁদড় জলাশয়ের কিনারে, গর্তে বাস করে। শিকার করা বা ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছাড়া এরা পানিতে নামে না, ডাঙাতেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। তবে সামুদ্রিক ভোঁদড়রা সমুদ্রে, জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করে।
ভোঁদড়, জোয়ারপ্রবণ এলাকায় বাসা তৈরি করে জোয়ার-সীমানার উঁচুতে কোনো বড় গাছের তলায় গর্ত করে। গর্তের কয়েকটি মুখ থাকে। গর্তে ঢুকতে হয় জলের তলা দিয়ে। কিন্তু বাচ্চা প্রসবের জায়গাটি থাকে শুকনো এলাকায়। মায়ের সঙ্গে দুই-তিনটির বেশি বাচ্চা দেখা যায় না। সামুদ্রিক ভোঁদড় ছাড়া অন্য কোনো ভোঁদড় নোখহীন ভোঁদড়ের মতো লবণ সহ্য করতে পারে না। নোখহীন ভোঁদড়ের শত্রু হলো বাঘ, কুমির, হাঙর, মেছোবিড়াল ও মানুষ।ভোঁদড় মাংসাশী প্রাণী। প্রধান খাদ্য নানা প্রজাতির মাছ। তবে এরা কাঁকড়া, কেঁচো, পোকামাকড়, পাখি প্রভৃতি খেয়ে থাকে। ভোঁদর মূলত নিশাচর প্রাণী। তবে এদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় শিকার করতে দেখা যায়। সুন্দরবনের একটু ভেতরের খালগুলোতে দলে দলে শিকাররত ভোঁদড় দেখা যায়। ভাটার সময় খালের কাদায় কাঁকড়া ও মাছ ধরায় এরা খুব পটু। এদের সারিবদ্ধভাবে কাদায় গড়াগড়ি খাওয়া ও সোজা দুপায়ে দাঁড়িয়ে কিচিরমিচির শব্দ করে উঁকিঝুঁকি দিয়ে শত্র“র উপস্থিতি পর্যবেক্ষণের দৃশ্য সত্যি উপভোগ্য। ভোঁদড় প্রাকৃতিক পরিবেশে জলাশয়ের ধারে গর্ত করে ২ থেকে ৩টি বাচ্চা দেয়। গর্ভধারণ কাল প্রায় ২ মাস। জন্মের পর বাচ্চার চোখ বন্ধ থাকে। ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ পর চোখ ফোটে। প্রায় ৬ মাস বয়স পর্যন্ত বাচ্চা মা-বাবার সাথেই থাকে।
এ সময় মা-বাবা বাচ্চাদের দেখাশোনা, খাবার খাওয়ানো ও ধীরে ধীরে শিকার করতে শেখায়। ভোঁদড় বুদ্ধিমান, অনুসন্ধিৎসু এবং সহজেই পোষমানা প্রাণী।
বিস্তৃতিঃ
সাতটি বর্গে প্রায় তেরোটি প্রজাতির ভোঁদড় অস্ট্রেলিয়া ছাড়া মোটামুটি গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় ভোঁদড়কে "ধাইরা" এবং "বাদার ধাইরা" (নখহীন ভোঁদড়) নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশের খাল-বিলে চরা ভোঁদড়ের বৈজ্ঞানিক নাম Lutra perspicillata, যেগুলোর ওজন হয় ৭ থেকে ৯ কেজি।
ভোঁদড় দিয়ে যত কাজ কারবারঃ
১। চিত্রশিল্পী ভোঁদড়ঃ ভোঁদড়ের মধ্যেও যে শিল্পীর প্রতিভা লুকিয়ে থাকতে পারে তা অনেকেরই অজানা। সম্প্রতি এমনই একটি তথ্য জানা গেছে ভোঁদড় সম্পর্কে।
ঘটনাটি হলো দুবাই একুয়ারিয়াম এবং আন্ডারওয়াটার চিড়িয়াখানার দুইটি ভোঁদড়কে ছবি আঁকা শেখানোর পরিকল্পনা করে কর্তৃপক্ষ। একসময় তারা সফলও হয়। দর্শকের সামনে ছবি এঁকে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেয় ভোঁদড় দুটি।
দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীতে বসবাস করা অসংখ্য প্রাণী রয়েছে যারা মানুষের বুদ্ধিমত্ত্বার কাছাকাছি না যেতে পারলেও ঠিকঠাক প্রশিক্ষণ দিতে পারলে কখনো কখনো শিখে নিতে পারে কাজটি। ভোঁদড়দের করা কীর্তি তা-ই প্রমাণ করে। তবে প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা যাচাই করা এবং তাদের কোন না কোন বিশেষ কাজে অভিজ্ঞ করে তোলা অনেক কঠিন কাজ। প্রতিনিয়ত অনুশীলন করানোর মাধ্যমেই কোন প্রাণী বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারে।
২। মাছ শিকারঃ
ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার মানুষের বহু প্রাচীন একটা পদ্ধতি। বাংলাদেশে এখনো দক্ষিণাঞ্চলের (সুন্দরবন অঞ্চলের) আশেপাশে যেসব জেলেদের বাস, তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে অদ্ভুত এক কায়দায় মাছ ধরতে অভ্যস্ত। আর তা হলো ভোঁদড়ের সাহায্যে মাছ ধরা।
প্রথম পদ্ধতি---- এ সব ভোঁদড়দের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যে এরা পানিতে ডূব দিয়ে মাছ কে তাড়িয়ে ডাঙার কাছে বা মাছ ধরার জালের অদূরে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। আর তার ফলে বিপুল সংখ্যক মাছ ধরা পড়ে জালে।
সুন্দরবনে গাছের গুড়ির আশেপাশে প্রচুর মাছ থাকে। ভোঁদড়গুলো ওই মাছগুলোকে ধাওয়া করে। ফলে মাছগুলো পালানোর সময় জালে আটকা পড়ে। এই মাছ ধরার কাজটা সাধারণত করা হয় রাতে। কোনো কোনো দিন রাতে । এই ভোঁদড়দের সাহায্যেই জেলেরা ১২-১৫ কেজি ওজনের মাছ যেমন ধরেন তেমনি গলদা চিংড়ি এবং কাকড়াও ধরে অনেকে।
দ্বিতীয় পদ্ধতিঃ এই পদ্ধতি ভোঁদড়দের এমন ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যেন এরা পানিতে ডূব দিয়ে মাছ ধরে জেলের নিকট নিয়ে আসে। তাই প্রশিক্ষিত ভোঁদড়দের হাতে ধরা বাঁশে বা নৌকার গলূয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে পানিতে নামিয়ে দেওয়া হয় বা জেলের
ইশারা পেলেই পানিতে লাফিয়ে পড়ে ভোঁদড়। কিছুক্ষণ পরেই মুখে মাছ নিয়ে পানি থেকে উঠে আসে এক একটি ভোঁদড়।
গবেষকদের ধারণাঃ
>গত ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশের ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন মোস্তফা ফিরোজ। তিনি জানান, এই ২৫ বছরে জেলে পরিবারের সংখ্যা ৫০০ থেকে কমে ১৫০ এ নেমে এসেছে। ৫০ বছর আগে থেকে লক্ষ্য করলে হয়ত দেখা যাবে যে, এই জীবিকা কমেছে ৯০ ভাগ। তাই তার আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে আগামী দুই দশকে মাছ ধরার জীবিকাটাই আর থাকবে না।
>ওয়াল্ডলাইফ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই ভোঁদড়রাও এখন হুমকির মুখে। ছোট লোমের এই ভোঁদড়গুলো ক্রমেই যে বিলুপ্ত হতে চলেছে!
>যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা জানিয়েছেন, ভোঁদড় কেবল নাচানাচি করেই দিন কাটায় না, আলাস্কার সামুদ্রিক ভোঁদড় খিদে পেলে সমুদ্রের পানিতে ডুব দিয়ে ওই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সামুদ্রিক শজারু শিকার করে। ভোঁদড়ের এ শিকারের কারণেই সেখানকার সমুদ্রের পরিবেশ ভালো থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা সম্প্রতি জানিয়েছেন, আলাস্কার সামুদ্রিক ভোঁদড় ওখানকার সমুদ্রে ক্ষতিকর অম্লীয় কার্বন ডাই-অক্সাইড জমতে বাধা দেয়। এক খবরে এ তথ্য জানিয়েছে রয়টার্স।
সমুদ্রের তলদেশে জন্মানো সামুদ্রিক গুল্ম পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। সমুদ্রের পরিবেশ ঠিক রাখতে সমুদ্রতলে এ ধরনের লতাগুল্ম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লতাগুল্ম খেকো সামুদ্রিক শজারু সেখানকার পরিবেশের জন্য হুমকি তৈরি করে। শজারু শিকার করে লতাগুল্ম বেড়ে উঠতে সাহায্য করে ভোঁদড়।
‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন ইকোলজি অ্যান্ড দ্য ইনভায়রনমেন্ট’ সাময়িকীর সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত গবেষণাপত্রে গবেষকেরা জানিয়েছেন, সি-বেড বা সমুদ্রতলের গুল্ম আলোক সংশ্লেষণ-প্রক্রিয়ায় কার্বন শোষণ করে এবং পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। সমুদ্রের পানিতে এসিডের মাত্রা বেড়ে যায়। সমুদ্রের নিচের উদ্ভিদগুলো এই এসিড শোষণ করে। সমুদ্রের নিচের গুল্ম খেকো ক্ষতিকর প্রাণী শিকার করে সমুদ্র পরিষ্কার রাখে ভোঁদড়ের দল।
গবেষকেরা হিসাব করে দেখেছেন, গুল্ম খেকো প্রাণী শিকার করে ভোঁদড় যে পরিমাণ গুল্ম বাঁচায়, আর তাতে যে কার্বন শোষিত হয়, সে পরিমাণ কার্বন পরিশোধন করতে ২০-৪০ কোটি ডলার খরচ করতে হতো। গবেষকেরা কলম্বিয়া, কানাডা ও আলাস্কার ভোঁদড়সংক্রান্ত ৪০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ ফল পেয়েছেন।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোঁদড় বিশেষজ্ঞ ও গবেষক জিম ইসটেস জানিয়েছেন, এ গবেষণার ফলে মানুষ সামুদ্রিক ভোঁদড়ের গুরুত্ব বুঝতে পারবে এবং ভোঁদড়ের উপকারের কথা জানতে পারবে।
গবেষক জিম ইসটেস আরও জানান, অনেকেই ভোঁদড়কে শান্তশিষ্ট প্রাণী হিসেবে পছন্দ করেন। আবার অনেকেই ভোঁদড় মোটেও পছন্দ করেন না। অনেক জেলে, মাছশিকারী নিষ্ঠুরভাবে ভোঁদড় মেরে ফেলেন। কিন্তু প্রকারান্তরে, জেলে ও মাছশিকারীদের জন্য যথেষ্ট উপকারী বন্ধু ভোঁদড়। সমুদ্রের লতাগুল্ম বাঁচিয়ে রেখে মাছের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে ভোঁদড়।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত শিকারের কারণে আলাস্কার উপকারী ভোঁদড় প্রায় বিলুপ্তির পথে। ২০০৫ সালে পশ্চিম আলাস্কা অঞ্চলের ভোঁদড়কে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণীর তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
বিষয়: বিবিধ
৩৩১৮ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন