“বায়স্কোপ” বিলুপ্ত গ্রামীণ বিনোদন মাধ্যম

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১২ মে, ২০১৪, ০৩:২৩:৫৭ দুপুর

“বায়স্কোপ” বিলুপ্ত গ্রামীণ বিনোদন মাধ্যম



এক সময় গ্রাম-বাংলার এমনকি শহরের শিশু-কিশোরদের বিনোদনের মাধ্যম ছিল বায়স্কোপ। কারণ তখন রেডিও, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের এত প্রসার ছিল না। তাই গ্রামের হাট-বাজার বা মেলায় এই বায়স্কোপ দেখা যেত। আবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরেও এই বায়স্কোপ দেখানো হতো কিছু পয়সা কিংবা চাল, ডাল, ফল, শস্য বা শাকসবজির বিনিময়ে। কিন্তু এখন এই বায়স্কোপ বিলুপ্ত। নতুন আবিষ্কার ও হাতের কাছে ডিজিটাল সিনেমা দেখার জন্য সহজ লভ্য মোবাইল ফোন, টিভি, ডিভিডি,ল্যাপটপ ইত্যাদির মাঝে “বায়স্কোপ” যে বড় বে মানান। হঠাৎ এটি দেখা যায় শহর থেকে দূরে নির্জন কোনো পল্লীতে।

টিকেটের দামঃ গ্রামে একটাকা বা চাল-ধান এর বিনিময়ে বাচ্চারা টিকেট কেটে( বলতে টাকা নিয়ে একটা মুখে বসিয়ে দেওয়া) একটা মুখে বসিয়ে দিত “বায়স্কোপ” ওয়ালা।

তাই তো ----



আয়রে আয় পোলাপান

কাইন্দা কাইন্দা পয়সা আন

বায়স্কোপ তোরা দেখবি আয়

চইলা গেল ফুরাইয়া যায়- - -

এমনিতর ডাকে ছুটে যেত ছোট পোলাপানরা বায়স্কোপওয়ালার কাছে।বায়স্কোপওয়ালা কখনো ঝুমঝুমি, আবার কখনো কাঠ-করতাল বাজাত। আর সুরে সুরে ডাকত। সে সুর মুহূর্তেই পৌঁছে যেত পিচ্চিদের কানে।

কখনো সুর শুনে, কখনো অন্যদের থেকে শুনে শুনে ছুটে আসত ছেলে মেয়েরা।আর বায়স্কোপওয়ালাকে ঘিরে ভীড় করে দাঁড়ানো ছেলে মেয়েরা অধীর আগ্রহে থাকত কখন শো শুরু হবে। এদের সঙ্গে যোগ দিত বড়রাও। যেন বায়স্কোপওয়ালাকে ঘিরে ছেলে-বুড়োর মেলা বসে যেত। পয়সা দিলেই বায়স্কোপওয়ালা ছবি দেখাতে শুরু করত। সুর করে ঘটনার বিবরণ দিত। আবার ঘটনার মাঝে মাঝে গানও গাইত।

নানা লোককাহিনী ভিত্তিক ছবি দেখাত বায়স্কোপওয়ালা। সেই সঙ্গে সুরে সুরে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরত। লোককাহিনী ছাড়াও ঐতিহাসিক ঘটনা, স্থান, ব্যক্তি, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ছবি ও গান পরিবেশ করত। সাম্প্রতিক ঘটনা, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানও বায়স্কোপের বিষয় হয়ে উঠত।



সুরে সুরে যে বিবরণ দিয়ে বায়স্কোপ দেখানো শুরু করতেন তার নমুনা-

কী চমৎকার দেখা গেল কী চমৎকার দেখা গেল

কী চমৎকার দেখা যায় ভাই

এই বাকসোর খোপে চক্ষু রাইখ্যা দেখো সবাই নয়ন মেইল্যা

মনোহর শোভা দেখো ভাই,

এই বায়স্কোপের ছবির লাহান আইস্যা পড়ে তামাম জাহান

যত রঙ্গ আছে বইল্যা যাই।।

বায়স্কোপ চলাকালে নানা বিবরণের মধ্যে এই অংশটি ঘুরে ফিরে আসত। বায়স্কোপে গল্প, গান ও বর্ণনার মাধ্যমে লোককাহিনী, ঐতিহাসিক ঘটনা ও স্থানের বিবরণ, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঢাকার বিবরণ উপস্থাপন হত প্রচলিত লোককাহিনীর আঙ্গিকে।

আরে ঘোড়ার পিঠে সোয়ার হইয়া তলোয়ারডা যায় ঘুরাইয়া

বাপের বেটি বিবি সোনাভান

এই বিবি সোনাভানের ডরে কতো বীরে লম্ফ মারে

পড়ে উববুত হইয়া পরে থান।। ]

এর পর কারবালার করুন কাহিনী নিয়ে সুর করে ---------

এই বারেতে নবীর প্রিয় নাতি তীর বিদ্ধ ঘোড়া এল

এজিদ বাহিনীর হাতে তার মস্তক তবে ছিন্ন হল

দু জাহানের সবায় তখন কেদে কেদে ভেসে গেল।।

এর পর হয়তো বাদশাহ শাহজাহানের অমর প্রেমের কাহিনী আলোকে, মমতাজের প্রেমের নমুনা হিসেবে যমুনার তীরে নির্মিত তাজমহল ইতিহাসের এই তথ্য উঠে আসে এভাবে-

আরে শাহানশাহ শাজাহান ছিলো মমতাজ প্রেমে কাতর হইলো

বিবির শেকে বাদশা টলমল

আরে যমুনার তীরে বানাইলো বাদশার খাযেশ পুরা হইলো

এইবার আইলো ঐ তাজমহল।।



দিল্লীর সুউচ্চ কুতুব মিনারের ছবির রসালো বিবরণ তুরে ধরে ---- -

আরে দিল্লীর বুকে আছে খাড়া তালগাছরে কয় বেডা দাঁড়া

আমার লাহান উচার নাই কিনার

আরে এইবার দ্যাখো আইয়া গেলো খাম্বার মতো লাম্বা রইলো

আরশী-পড়শী কুতুব মিনার।।

এরপর বায়স্কোপের মধ্যবিরতি। এই ফাকে দর্শদের থেকে বাকি পয়সা আদায় করে নেয়ার পালা। এর পর ঢিমে তালে চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা-

আপনেরা এ্যকটু এইবার সবুর করেন

বাকী পয়সা যার যা আছে উসুল করেন,

চান্দির আওয়াজ শুইন্যা ছবির কইলজায় আসবো পানি

চাইয়া রইছে হরেক মানুষ চীনা-জাপানী;

আরে ইংরাজ আর হিটলার যঙ্গেতে মাতিলো

ঝাঁকে ঝাঁকে উড়াজাহাজ আইয়া যে গেলো;

রেঙ্গুনেতে বোমা মারলো জাপানী বিমান

ইংরাজ বলে ইয়া নাফ্সী বাঁচাও নিজের জান।



এরপরে হয়তো বাংলা সিনেমার নায়ক নায়িকাদের বর্ণনা দিয়ে শুরু হয়...............

কি চমৎকার দেখা গেলো !!!!!!!!!

আইরে তেলেসমাতি নিভল বাতি হইল অন্ধকার

আসেন জিনিস দেখাই একখান চমৎকার

কি চমৎকার দেখা গেলো

সবার প্রিয় শাবানা মেডাম আইসা গেল....

এরপরেতে কে আইলো????

এরপরেতে নায়ক রাজ্জাক আইসা গেল

ভিলেনগোরে ঠুসা মারল

কি চমৎকার দেখা গেলো ......

এরপরেতে ববিতা মেডাম হাজির হল

নাইচ্চা নাইচ্চা কোমর দুলাইলো

এরপরেতে কে আইলো???????

এরপরেতে সবার প্রিয় আলমগির আসলো

প্রেমেরও গান গেয়ে গেল

কি চমৎকার দেখা গেলো.

এরকম নানা বিষয় নিয়ে সুর করে বর্ণনা দিয়ে ছবি দেখিয়ে বাচ্চাদের আনন্দ দেবার প্রচেস্থা থাকত বায়স্কোপ চালকের।

সবশেষে বায়স্কোপওয়ালা নিজের পরিচয় দিয়ে দর্শকদের কাছে দোয়া চেয়ে ছোট বড় সকলের শুভাকামনা করে শেষ হয় শো--------------

বায়স্কোপোর বাকসো লইয়া শহর গ্রামে শার্গিদ লইয়া

ছবি দ্যাখাই আমি ----------

আরে কি চমৎকার দ্যাখা গেলো চিও সুখে ভইরা গেলো।

দোয়া রাইখ্যেন সকল ভাইজান

দোয়া রাইখ্যেন সকল ভাইজান

ভালো থাইক্যেন সকল ভাইজান

ভালো থাইক্যো গুড়াগাড়া জান।।



গঠন প্রণালিঃ

বায়স্কোপের প্রধান কাঠামো কাঠ ও টিনের তৈরি একটি বাক্স। এই বাক্সের সামনের দিকে থাকে অনেকগুলো মুখ। এই মুখে কাঁচ বসানো থাকে। মুখগুলো ঢাকনা দিয়ে ঢাকা থাকে। বায়স্কোপের কাহিনী শুরু করার আগে ঢাকনাগুলো খুলে দেওয়া হয়। এখানে চোখ রেখে দর্শকরা বায়স্কোপ দেখে।

বাক্সটির দুই পাশে ওপর থেকে নিচ বরাবর দুটি শলাকা আছে। এই শলাকা দুটির একটিতে বায়স্কোপের ছবিগুলো পেঁচানো থাকে। ছবিগুলো আঁটা থাকে মোটা শক্ত কাগজ বা কাপড়ের ওপর। এটি বায়স্কোপের পর্দা। এই পর্দার দুই প্রান্ত দুটি শলাকাতে আটকানো হয়। যে শলাকাতে পুরো পর্দাটি পেঁচানো থাকে তার অপর পাশের শলাকা ঘুরালে পর্দা চলতে থাকে। তখন পর্দায় আটানো ছবিও একের পর এক আসতে থাকে।



পর্দার ওপর ছবিগুলো বিভিন্নভাবে বসানো হয়। আঁকা ছবি, ফটোগ্রাফ, পেপার কাটিং পর্দার ওপর এঁটে দেওয়া হয়। ছবিগুলো বায়স্কোপওলারা বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করতেন। কিন্তু এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিবরণভিত্তিক গানগুলো নিজেরাই রচনা করতেন এবং নিজের সুরে গাইতেন। বিভিন্ন সময়ে বিবরণ ও গানগুলোর কথা ও সুরে কিছুটা পরিবর্তন ঘটত। সর্বোপরি, কাঠের বাক্সটিকে নানা রঙে সাজানো হয়। বায়স্কোপ দেখানোর সময় বাক্সটিকে একটি স্ট্যান্ডের ওপর বসানো হয়। বাক্সের পিছনের দিকে দাঁড়িয়ে বায়স্কোপওয়ালা ছবি দেখান।



শেষ কথাঃ অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়েই আমাদের জীবন। অতিতের বর্ণীল সুখ স্মৃতি মনের কোঠরে হয়তো মাঝে মাঝে ঝিলিক মারে, তখন সেই অতীতে নিজের অজান্তে চলে যায় মানুষ। এমন হাজারো বর্ণিল অতীত নিয়ে আমরা সকলে চলছি আগামির পথে। সবশেষে ------

তোমার বাড়ির রঙ্গের মেলায়

দেখেছিলাম বায়স্কোপ

বায়স্কোপের নেশায় আমায় ছাড়েনা ।

ব্যান্ড : দলছুট



বিঃদ্রঃ অতীতে এই“বায়স্কোপ” কে আমরা আমাদের দেশের মানুষের মাঝে নতুন কিছু জানাতে এবং দেখাতে এবং শিক্ষার ও বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছি নিজেদের অজান্তে। বর্তমানে শিক্ষার ও সচেতনতার মাধ্যমা হিসেবে আমরা লাইব্রেরী কে সামনে আনতে চাই। গড়তে চাই পাঠাগার। যা হবে নতুন কে জানার এবং অতীত হতে শিক্ষা নেবার একটি মাধ্যম। তাই আসুন গড়ে তুলি গ্রাম পাঠাগার।

বিষয়: বিবিধ

২৩৯৮ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

220599
১২ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৩৩
হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে লিখেছেন : পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন। ভালো লাগলো। আগে আমরা চাল দিয়ে এসব দেখতাম। এখন অবশ্য আর দেখা যায় না এসব।
১৪ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৯
168910
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ, যায় মাঝে মাঝে
220607
১২ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৮
মেঘ ভাঙা রোদ লিখেছেন : Sad Sad Sad হায়রে কোথায় হারিয়ে গেলো সেইসব সোনালী দিনগুলি
১৪ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৯
168909
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ, হা তাই
220622
১২ মে ২০১৪ বিকাল ০৪:১৬
মুজিব সেনা লিখেছেন : সেই কবে দেখছিলাম............। এখনো পহেলা বৈশাখে দেশ-গেরামে গেলে মনে পড়ে।
১৪ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৯
168908
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
220646
১২ মে ২০১৪ বিকাল ০৫:২৩
নীল জোছনা লিখেছেন : ছোটবেলায় দেখতাম। এখন আর এসব লোকজন নাই। তথ্য প্রযুক্তি এসে এদের পেটের ভাত মেরেছে।
২১ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৮
171449
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
220693
১২ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:১৮
অনেক পথ বাকি লিখেছেন : সেই কবে দেখছিলাম............এখনো দেশ-গেরামে গেলে মনে পড়ে।
১৪ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৮
168907
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
220714
১২ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪১
শেখের পোলা লিখেছেন : হায়রে মজা লাইগ্যা গেল,
রূপবানেরই বিয়ে হল,
কি চমেৎকার দেখা গেল৷
১৪ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৮
168906
গোলাম মাওলা লিখেছেন : হা হা হা ্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌ ধন্যবাদ
220902
১৩ মে ২০১৪ সকাল ০৮:০২
কাঁচের বালি লিখেছেন : খুব সুন্দর একটা পোস্ট , আমি কোনোদিন দেখিনি । তবে পোস্ট ভালো লেগেছে ।
১৪ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৮
168905
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
220914
১৩ মে ২০১৪ সকাল ০৯:০০
egypt12 লিখেছেন : দিনে দিনে সবই বদলায় একদিন এই যুবক আমিও বৃদ্ধ হয়ে যাব এটাই দুনিয়ার নিয়ম Rose
১৪ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৮
168904
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
221194
১৩ মে ২০১৪ রাত ১১:৩০
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : ভালো লাগলো। তবে লেখক সাড়া না দেয়ায় আমি অবাক
১৫ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:২৩
169243
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
১০
224505
২২ মে ২০১৪ সকাল ০৯:১১
egypt12 লিখেছেন : ভালো লাগলো Love Struck
২২ মে ২০১৪ রাত ১১:২৪
172084
গোলাম মাওলা লিখেছেন : Love Struck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File