কৃষকের পরম বন্ধু--------ফিঙে
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ৩০ এপ্রিল, ২০১৪, ০১:১৯:৫১ দুপুর
ফিঙে
ফিঙে তেল চিকচিকে কালো রঙের লম্বা লেজঝোলা সুন্দর পাখি। কালো ফিঙে, (Dicrurus macrocercus) রাজকীয় কাক হিসেবেও পরিচিত।, ইংরেজি নাম ‘ব্ল্যাক ড্রোঙ্গো’। পাখিটি এশিয়ায় বাস করা ড্রঙ্গো পরিবারভুক্ত একটি ছোট্ট গানের পাখি। এটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা, একে দক্ষিণ-পশ্চিম ইরান থেকে শুরু করে ভারত এবং শ্রীলংকা হয়ে দক্ষিণ চীন ও ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। ফিঙেকে বলা হয় কৃষিবান্ধব। ফিঙে লম্বায় লেজসহ ২৮-৩১ সেন্টিমিটার। মাথা থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত কালো পালকে আবৃত। কালোর ওপরে নীলাভ আভা বের
হওয়াতে পালিশ করা চকচকে দেখায়। এদের ঠোঁট ধাতব কালো, গোড়ায় সাদা ফোঁটা থাকে। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের পেটের ওপর থাকে সাদা রেখা। যা দূর থেকে আঁশটে দেখায়। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। ফিঙের মাজা কালো রঙ আর দু'ভাগ করা লেজ দিয়ে একে সহজেই চেনা যায়।এদের লম্বা লেজের আগা ‘ভি’ আকৃতির।
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ/রাজ্য: Animalia
পর্ব: Chordata
শ্রেণী: Aves
বর্গ: Passeriformes
পরিবার: Dicruridae
গণ: Dicrurus
প্রজাতি: D. macrocercus
দ্বিপদী: Dicrurus macrocercus
পাখির রাজাঃ ফিঙেকে ‘পাখির রাজা’ বলা হয় তার সাহসিকতার কারণে। এরা পাখিদের ডিম বাচ্চাখেকো শিকারী অন্য সব পাখি আর বন্যপ্রাণীদের তাড়া করে শুধু নিজের ডিম বাচ্চাকেই রক্ষা করে না নিরীহ পাখিদের ডিম বাচ্চাও রক্ষা করে। এরা যেখানে বাসা বানায় তার আশপাশে কোন
শিকারী পাখি প্রাণী আসতে পারে না। এরা তারস্বরে ডাকাডাকি করে, তীব্র বেগে উড়ে এসে ডাইভ দিয়ে ঠুকরিয়ে ওদের তাড়িয়ে দেয়। সে জন্য নির্ভয়ে ফিঙে পাখির এলাকায় অন্য পাখিরা বাসা বানায়।
খাদ্যঃ সব রকমের ছোট কীটপতঙ্গ পোকামাকড় এদের প্রধান খাদ্য। সে কারণে এদের ফসলী জমি, বড় বড় ঘাস আর ঝোপঝাড়ের পাশে খোলা জায়গায় বাঁশের কন্চে, গাছের ডাল বা খুঁটির আগায়, টেলিফোনের তারে এমনকি মাঠে চড়ে বেড়ানো গরুমহিষ ছাগলের পিঠে বসেও খাবারের সন্ধানে থাকতে দেখা যায়। এদের চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষè, অনেক দূর থেকেও ছোট পোকামাকড়ও নজর এড়ায় না। দ্রুত উড়ে ঠোঁট দিয়ে ধরে গিলে খায় পোকা। সে জন্য ইদানীং জমিতে ছোট ছোট খুঁটি পুঁতে রাখে কৃষকরা জমির ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিধনে ফিঙে পাখিদের বসার সুযোগ করে দিচ্ছে। আর ফিঙে খুঁটিতে বসে পোকা খেয়ে ফসল রক্ষায় কৃষকদের সহায়তা করে।
বাংলাদেশে যে কয় রকম ফিঙে দেখা যায়----------
ফিঙে পাখির যে সমস্ত প্রজাতি আমাদের দেশে দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো হলো ছোট ফিঙে কেশরাজ, ধূসর ফিঙে, কালো ফিঙে, ভীমরাজ, ভৃঙ্গরাজ।
ছোট ফিঙে ॥ ফিঙের মধ্যে এই প্রজাপতির পাখিটির মাথা ঠোঁট দেখতে অন্য প্রজাতির চেয়ে অনেক সুন্দর। পিঠ ও মাথার পালকের রং উজ্জ্বল কালো। এদের ছোট ভুজঙ্গ পাখি নামেও ডাকা হয় কোন কোন এলাকায়। প্রধান খাদ্য পোকামাকড় হলেও এদের ফুলের মধু খেতেও দেখা গেছে। ছোট ফিঙে লম্বায় ২৪ সে.মি. এর বেশি হয় না।
কেশরাজ ॥ স্থানীয় প্রজাতির এই কেশরাজ নামের ফিঙের বিচরণ এদেশে বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। ফিঙের মধ্যে এরাই সবচেয়ে বেশি লম্বা প্রায় ৩২ সে.মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। সুন্দর বাটির মতো বাসা বানায় গাছের অনেক উঁচু ডালে। এদের লেজ লম্বা এবং এরা শিমুলসহ বড় বড় ফুলের মধু খেতেই পছন্দ করে বেশি।
ধূসর ফিঙে ॥ এরা শীতকালীন পরিযায়ী প্রজাতির পাখি। সর্বত্র এদের দেখতে পাওয়া যায় না। এদের গায়ের ও লেজের পালকের রং কুচকুচে কালো নয় ধূসর। আর চোখ লাল টকটকে। খাদ্য অন্যদের মতোই। গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতেই এদের পছন্দ বেশি।
কালো ফিঙে এদের দেখতে পাওয়া যায় সর্বত্র। বিশেষ করে ফসলের ক্ষেতে, বাঁশ, গাছের ডালে বসে পোকামাকড় ধরে খায় সারাক্ষণ ঠাঁয় বসে থেকে। উড়ন্ত পোকামাড়ককেও তাড়া করে ধরে। ফুলের মধু, খেজুর তালগাছের রস খেতেও এরা অত্যন্ত দক্ষ। টিকটিকি, ফড়িং, তেলেপোকা শিকারেও এরা দক্ষ। কালো ফিঙে লম্বায় ৩০ সে.মি. এর বেশি হয় না। গা, মাথা, লেজের নীলাভ এবং তেল চকচকে কালচে। এদের কালিপেঁচা, ফেচকিলা ও ধেইচ্চা নামেও ডাকা হয় কোন কোন এলাকায়।
ভীমরাজ ॥ এরা বেশ বাহারি লেজের পাখি। ভীমরাজ সাইজে ছোট হলেও লেজটা বেশ লম্বা-প্রায় ১৫ সে.মি. লম্বা হয়ে থাকে। এদের ঠোঁট লম্বা এবং ঠোঁটের উপর থেকেই মাথায় রয়েছে কালো রঙের পালকের ঝুঁটি। ‘ভি’ আকৃতির লম্বা লেজের দু’পাশে আরও লম্বা দুটো চিকন, দুটো ডাটার আগায় পতাকার চওড়া দুটো পালক থাকে। যখন এরা ওড়ে, তখন লেজের আগার ওই লম্বা ওই পালক দুটো দৃষ্টিনন্দনভাবে পত্ পত্ করে উড়তে থাকে। বিশেষ এই বাহারি লেজ ভীমরাজ ফিঙেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে। এদের খাদ্য অন্যদের মতো হলেও ফুলের মধু বেশি প্রিয়।
ভৃঙ্গরাজ এরা বিরল প্রজাতির ফিঙে পাখি। এদেরও ভীমরাজের মতো বাহারি লম্বা লেজ। তবে মূল লেজের আগা ‘ভি’ আকৃতির নয় অন্য পাখিদের মতো চ্যাপ্টা। লেজের দু’কোনা থেকে লম্বা ডাটা বেরিয়ে গেছে ভীমরাজের মতো। তবে এদের চ্যাপ্টা মাথায় ঝুঁটি নেই। পালক এদের কুচকুচে কালো।
যে ভাবে বাসা বাঁধেঃ এদের প্রজনন মাস মার্চ থেকে জুন। সাধারণত গাছের ‘ডি’ আকৃতির / ত্রিডালের ডালের ফাঁকে গাছের শক্ত আঁশ, নারকেল, সুপারি গাছের শুকনো পাতার শলা, ঘাস, মাকড়সার জাল দিয়ে পরিপাটি বাটির মতো বাসা বানায়। তাতে সাদা গোলাকার ডিম পাড়ে ৩ থেকে ৫টি আর ১৬ থেকে ১৮ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা জন্মে।
------ কৃষকের পরম বন্ধু--------
একটি ফিঙে গড়ে প্রতিদিন ২৫-২৮টি মাজরা পোকা খেয়ে থাকে। একটি স্ত্রী মাজরা ২৫০-৩০০ মাজরার মথ জন্ম দেয়। ফিঙে অন্তত একটি স্ত্রী মাজরা পোকা খেলে ৩০০টি পোকা দমন হয়।
এ পর্যন্ত ধানের ১৭৫টি প্রজাতির অনিষ্টকারী পোকা শনাক্ত করেছে। এদের মধ্যে ২০-৩৩টি প্রজাতিকে প্রধান ক্ষতিকর পোকা হিসেবে গণ্য করা হয়। এদের আক্রমণে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফিঙে পাখি বিভিন্ন ধরনের পোকা খেয়ে দ্রুত এদের সংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে।
জানা যায়, ফিঙে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫৪ শতাংশ ঘাসফড়িং, ৪৭ শতাংশ হলুদ মাজরা পোকা, ৩৭ শতাংশ সবুজ পাতাফড়িং, ৩৫ শতাংশ বাদামি গাছফড়িং ও ৯ শতাংশ পামরি পোকা খেয়ে ফেলতে পারে। এতে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি কীটনাশকের অতিরিক্ত খরচ থেকে রেহাই পাচ্ছে কৃষক।
‘ফিঙে পাখি কৃষি ও কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু। কৃষক ‘পার্চিং’ (ফিঙে বসার জন্য তারা ক্ষেতে গাছের ডাল পুতে দেওয়া)
পদ্ধতিতে ফিঙে পাখির মাধ্যমে পোকা দমন করেন।
বিষয়: বিবিধ
১১৭১ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন