কাকতাড়ুয়া

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২৪ এপ্রিল, ২০১৪, ০১:৫১:৩০ রাত

কাকতাড়ুয়া



কৃষি প্রধান আমাদের বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রকার ফসল পাখিদের কবল থেকে রক্ষা করতে সর্বাধিক ব্যবহৃত সনাতন পদ্ধতি কাকতাড়ুয়া। এর ইংরেজি: Scarecrow । কাকতাড়ুয়া হচ্ছে কাক কিংবা অন্যান্য পশু-পাখিকে ভয় দেখানোর জন্যে জমিতে রক্ষিত মানুষের প্রতিকৃতি বিশেষ।বাংলাদেশের সর্বত্রই রয়েছে এর ব্যাপক ব্যবহার। শীতকালীন সবজি বা রবিশস্য চাষের সময় বীজ বপন বা চারা রোপনের বেশ কয়েকদিন পরেও বীজ বা চারার দানা মাটির সাথে মিশতে পারে না। মূলত এই সময়টাই চারাগাছগুলোর সংকটকাল। এসময় কাক, চড়ুই, শালিক, ঘুঘু ইত্যাদি বিভিন্ন পাখি এসে চারাগাছ উপড়িয়ে ফেলে। পাখিদের এই আক্রমন থেকে ফসলকে রক্ষা করতে জমিতে বীজ বপনের সাথে সাথে জমির মাঝ বরাবর কাকতাড়ুয়া দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়।শস্য রক্ষায় কৃষকের এই বিশ্বস্ত অবলম্বন কাকতাড়ুয়া শস্যক্ষেত থেকে শুধু বীজ নষ্টকারী পাখিদেরই দূরে রাখে না, বাড়ন্ত শস্য ক্ষেতের দিকে পথচারীর লোভাতুর দৃষ্টিকেও মায়াজালে বন্দি করে এমনই বিশ্বাস সারাদেশের কৃষককুলের। অনেক সময় কাকদের ভয় দেখার জন্য অন্য একটি কাক মেরে উঁচুতে ঝুলিয়েও রাখা হয়। সাধারণত ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে কাকতাড়ুয়া তৈরি করা হয়।

আর তাইতো ছোট বাচ্চাদের মুখে শোনা যায়-------



হাত দুটো বাড়িয়ে

কাকতাড়ুয়া থাকে শুধু দাঁড়িয়ে।

ক্ষেতে কোনো পাখি এলে

দেয় সে তাড়িয়ে।



তৈরির প্রক্রিয়াঃ এটি মানুষের দেহের গঠনের সঙ্গে মিল রেখে পুরনো পরিত্যক্ত শার্ট, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি ও প্যান্ট দিয়ে কিম্ভূতকিমাকার বা সঙের মতো সাজানো হয়। এক্ষেত্রে একটি সোজা দণ্ডের ওপরের দিকে এক তৃতীয়াংশ বরাবর তুলনামূলক ছোট আরেকটি সোজা দণ্ড-



আড়াআড়িভাবে বেঁধে দেয়া হয়। তারপর দণ্ড-গুলোতে পুরনো পোশাক যথাস্থানে পরিয়ে দেয়া হয়। মাথা হিসেবে খুঁটির ওপরের অংশে দইয়ের হাঁড়ি বা মাটির সানকি আটকিয়ে দেয়া হয় এবং মানুষের মুখের



সঙ্গে মিল রেখে হাঁড়ির তলায় চোখ, মুখ, নাক ইত্যাদি এঁকে দেয়া হয়। অনেকে হাঁড়ির বদলে পলিথিনে খড়কুটো ঢুকিয়ে দিয়ে মাথার মতো গোল করে বানিয়ে নেন।



প্রয়োগঃ সাধারণত ফাঁদ হিসেবে ও ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে কাকতাড়ুয়া তৈরী করা হয়। এটি মানুষের দেহের গড়নের সাথে মিল রেখে কিম্ভুতকিমাকার বা সঙের ন্যায় সাজানো হয়



ফলে এটি দেখতে অনেকটা মানুষের মত মনে হয় বলে কৃষক কর্তৃক জমির মাঝামাঝি স্থানে গর্ত খুঁড়ে খুঁটি হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এর মাধ্যমে বাতাসের দোলায় কাপড় হাল্কা দুলতে থাকে ফলে বীজ ও সবজী খেকো পাখিরা ভয় পায় এবং ফসলের মাঠে ঘেঁষে না যা কাক অথবা চড়ুইজাতীয় পাখির উৎপাত ও সাম্প্রতিক সময়ে বীজ বপনের ফলে তাদের খাদ্য সংগ্রহ করা থেকে বিরত রাখার একটা প্রয়াস মাত্র ।



বিকল্প ব্যবহারঃ বসন্তকালে বাগানে বা মাঠে বীজ খেকো পাখির উৎপাতজনিত সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। আধুনিক কাকতাড়ুয়া হিসেবে সচরাচর ফাঁদ মানবাকৃতির প্রতিকৃতির বিকল্প হিসেবে নানা রকম আকৃতি ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেকে সূর্যের আলোয় প্রতিফলিত হয় এমন ধরনের ফিতা বা নষ্ট ক্যসেট প্লেয়ারের



ফিতা মাঠের আড়াআড়ি খুঁটিতে বেধে ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রোপেন গ্যাসের সাহায্যে সৃষ্ট বন্দুকের বিকট আওয়াজও করার মাধ্যমেও কাকতাড়ুয়ার অন্যতম বিকল্প উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে অনেক দেশে।



বাংলাদেশে কাকতাড়ুয়াঃ বাংলাদেশে কাকতাড়ুয়ার সহজ যে চেহারা দেখা যায়, তা হলো: একটা খাড়া লম্বাকৃতির দন্ডের উপরের এক-তৃতীয়াংশে ভূমি সমান্তরালে আড়াআড়ি করে আরেকটি দন্ড বেঁধে দুপাশে হাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো মানুষের আকৃতি তৈরি করা হয়, তারপর এই আকৃতির গায়ে জড়িয়ে দেয়া হয়, পুরোন পাঞ্জাবি, কিংবা শার্ট-লুঙ্গি। লম্বাকৃতি দন্ডের উপরের মাথায় রেখে দেয়া হয় দইয়ের পাতলা সানকির মতো মাটির পাতিল— এতে পাতিলের তলা বাইরের দিকে বেরিয়ে থাকে আর একটা মানুষের গোলগাল মুখের মতো দেখায়। কেউ কেউ সেই পাতিলের



তলাকে আরো বেশি বাস্তবসম্মত করতে সেখানে চোখ-মুখ এঁকে মানুষের আদল স্পষ্ট করেন।

তবে অনেক স্থানে ধর্মীয় কিংবা স্থানীয় আজন্ম লালিত বিশ্বাসের প্রেক্ষিতে পাতিলের তলায় বিভিন্ন শুভ-নকশা আঁকা দেখা যায়— কখনও গোল গোল বুটি, কখনও চারকোনো ছক ইত্যাদি এঁকে মাটির সানকি দিয়ে ফসলের সু-উৎপাদন কামনা করা হয়।



উপস্থাপনাঃ বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার দিনেও পিছিয়ে পড়েনি কাকতাড়ুয়া। তার একনিষ্ঠতা আর চির গ্রহণযোগ্যতা এখনো কৃষকদের আস্থা অর্জন করে চলেছে। আর কাকতাড়ুয়া বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন জনপ্রিয় মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা গ্রামীণ জীবনের মূর্ত প্রতীকরূপে উপস্থাপিত হলেও, অনেক ভৌতিক



চলচ্চিত্রে কাকতাড়ুয়াকেই নির্জন কৃষিজমিতে দাঁড়ানো ভূত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রদর্শিত সিসিমপুর অনুষ্ঠান ছাড়াও বাংলাদেশের বহু গ্রামীণ নাটক-চলচ্চিত্রে কাকতাড়ুয়ার উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।আবহমান বাংলার চিরপরিচিত ও বহুল প্রচলিত এই কাকতাড়ুয়া মূলতঃ শস্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হলেও গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদি ক্ষেত্রে নির্জন এলাকায় ভয়ের পরিবেশ তৈরী করতে এর জুড়ি নেই। তাই বাংলার ঐতিহ্য ও গ্রামীণ জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিক সম্পর্ক এই কাকতাড়ুয়ার।



কৃষি ও কৃষকের অস্তিত্বের সাথে আবহমান কাল ধরে মিশে থাকা এই কাকতাড়ুয়া চিরকাল বেঁচে থাকুক কৃষি, শিল্পীর চিত্রকর্মে, বইয়ের প্রচ্ছদে, গল্প, উপন্যাস, নাটক কিংবা সিনেমা ইত্যাদির হাত ধরে – এই চাওয়া সারা বাংলার সৌন্দর্য্য ও সংস্কৃতিপ্রেমীদের।

বিষয়: বিবিধ

৩১৪৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

212574
২৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ১২:৪৪
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
২৫ মে ২০১৪ সকাল ০৮:৩৫
172844
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
225422
২৪ মে ২০১৪ দুপুর ০১:৪২
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : ভালো লাগলো কিন্তু সবাই কৃপণ মন্তব্য করতেও
২৫ মে ২০১৪ সকাল ০৮:৩৫
172843
গোলাম মাওলা লিখেছেন : হা হা হা .।.।.। ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File