গ্রামীণ-দেশজ খেলা যা আর খেলা হয়না তেমন—পরিচয় করিয়ে দিই আপনাদের সঙ্গে পর্ব: ০২

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২১ এপ্রিল, ২০১৪, ০১:২৮:০৬ দুপুর

গ্রামীণ-দেশজ খেলা যা আর খেলা হয়না তেমন—পরিচয় করিয়ে দিই আপনাদের সঙ্গে পর্ব: ০২



প্রথম পর্ব



দাড়িয়াবান্ধা



দাড়িয়াবান্ধা বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলার মধ্যে একটি পরিচিত খেলা। বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হাডুডুর মতোই সব অঞ্চলের আরেকটি জনপ্রিয় খেলা দাড়িয়াবান্ধা। কেবল অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরাই নয় এতে অংশ নিতে পারে বড়রাও। এ দেশের সর্বত্র স্থানীয় নিয়ম কানুন অনুযায়ী এ খেলা হয়ে থাকে। জাতীয় রিক্রিয়েশন এ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের জন্য এ খেলার গ্রহণ যোগ্য আইন কানুন প্রণয়ন করেছে। প্রায় সব এলাকার শিশুরাই এ খেলাটি খেলতে পছন্দ করে। ছেলে, মেয়ে, এমনকি বড়দেরও এ খেলায় অংশ নিতে দেখা যায়।

মাঠ



এ খেলার মাঠটি ৫০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট প্রস্থে, মাঝখানে সমান্তরাল ৫০ ফুট লম্বা ও ১ ফুট চওড়া একটি লাইন থাকবে। ১ ফুট অন্তর আড়াআড়ি ৪টি লাইনে সমগ্র কোর্টটি ১০ইঞ্চি/১০টি খোপে ভাগ করা থাকবে। আড়াআড়ি ৬টি লাইন ১ ফুট চওড়া হবে।

নিয়ম-কানুন



প্রত্যেক দলে ৬ জন করে খেলোয়াড় থাকে। টস করে আক্রমণকারী ও প্রতিরক্ষাকারী স্থির করা হয়। ২৫ মিনিট খেলা, ৫ মিনিট বিশ্রাম, পুনরায় ২৫ মিনিট খেলা-এই নিয়মে খেলা চলে। খেলার সময় একজন মারা পড়লে অন্যদলের অর্ধাংশ আক্রমণ করার সুযোগ পাবে। খেলায় একজন রেফারী ৬ বা ১২ জন দাড়িয়া জজ ও ২ জন স্কোরার থাকে। খেলার ফলাফল অমীমাংসিত থাকলে ১০-১-১০ মিনিট পুনরায় খেলে খেলার ফলাফল নির্ধারিত করা যায়।

সাধারন নিয়মাবলী

প্রথমে মাটিতে দাগ কেটে ঘর তৈরি করা হয়। ঘর দেখতে অনেকটা ব্যাডমিন্টনের কোর্টের মতো। দুই দলে চার-পাঁচজন করে খেলোয়াড় হলে জমে। কম হলেও দুজন করে খেলোয়াড় লাগবেই। সমতলভূমিতে কোদাল দিয়ে দাগ কেটে ঘর কাটা যায়। বর্গাকার একটি ঘরে সামনে-পেছনে সমান দূরত্বে দুটি করে দাগ কাটতে হয়। এ দুই দাগের মাঝে এক হাত পরিমাণ জায়গা রাখতে হয়।

খেলায় ঘরের সীমানার বাধ্যবাধকতা থাকায়, দ্রুত দৌড়ের চেয়ে কৌশল ও প্যাঁচের কসরত জানতে হয় বেশি। এক নম্বর ঘরকে কোনো কোনো অঞ্চলে বদন ঘর, ফুল ঘর বা গদি ঘর বলে। ২ নম্বর ঘরটি লবণ ঘর বা পাকা ঘর নামে বা নুন কোট পরিচিত বা এগুলোকে বলে আড়া কোর্ট। দুটি আড়া কোর্ট জোড়া দিয়ে মাঝখানে একটি কোর্ট তৈরি করা হয়। মাঝখানের এই কোর্টকে বলে 'খাড়া কোর্ট'। খেলোয়াড় যত বেশি হবে, কোর্টের সংখ্যাও তত বাড়বে। প্রতিটি আড়া কোর্টে একজন করে খেলোয়াড় দাঁড়ায়। এখানেই দাঁড়িয়ে অন্য দলের খেলোয়াড়দের ঘরের ভেতর



ঢুকতে বাধা দেয়। কোর্টের ওপর বা ঘরের ভেতর অন্য দলের খেলোয়াড়কে ছুঁতে পারলে সে মারা পড়ে। সামনের খেলোয়াড় তার পেছনের খাড়া কোর্ট ব্যবহার করতে পারে। যে দল খেলার সুযোগ পায়, তারা সামনের ঘর দিয়ে ঢুকে পেছনের ঘর দিয়ে বেরোতে থাকে। সব ঘর পেরোনোর পর আবার পেছনের ঘর থেকে সামনে আসে। কোর্টে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য দলের খেলোয়াড়দের ছোঁয়া বাঁচিয়ে সবাই ফিরে আসতে পারলে গেম হয়। যারা কোর্টে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের খেলোয়াড়দের কারো পা যদি দাগে পড়ে তবে তারা ঘর ছেড়ে দেয়। অন্য দল ঘরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। এভাবে অনেক সময় ধরে খেলাটি খেলা যায়। দাড়িয়াবান্ধার কোর্টের সঠিক কোনো মাপ নেই। একজন খেলোয়াড় দৌড়ে কতটুকু ঘর সামলাতে পারবে, তার ওপর ভিত্তি করে ঘর কাটা হয়। তবে সব ঘরের গঠন একই থাকে।

শেষকথা



এই খেলায় কোন খরচ লাগে না এবং বেগ, তেজ প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের দরুণ এটি দেশের ছোট-বড় সবার জনপ্রিয় খেলা।

কুতকুত /এক্কাদোক্কা :



এক্কাদোক্কা আমাদের দেশের মেয়েদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় একটি খেলা। ছোট ছেলেরাও এই খেলা হতে বাদ যায় না। মেয়েদের সঙ্গে ছোট ছেলেরাও আও খেলায় সমান অংশগ্রহণ করে থাকে।



যা প্রয়োজনঃ এই খেলার জন্য প্রথমে ভাঙা মাটির হাঁড়ি বা কলসির টুকরা দিয়ে চাড়া বা ঘুটি বানিয়ে নিতে হয়।

এর পর বাড়ির উঠানে কিংবা খোলা জায়গায় আয়তাকার দাগ কেটে খেলা হয় এক্কাদোক্কা। ঘরের মধ্যে আড়াআড়ি দাগ টেনে তৈরি করা হয় আরও ছয়টি খোপ।



প্রথমেই সাথি বা পার্টনার নিয়ে দুই জন দুই জন করে বা একা একা দুইজন মিলে এই খেলা খেলা যায়।

এই জন্য প্রথমেই বাটাবাটি বা দল গঠন করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে দল ঠিক কড়া হয়। কথাও ---ওবু দশ , বিশ , ত্রিশ চল্লিশ , পঞ্ছাশ , ষাট , শত্তুর , আশি , নব্বই এবং একশ করে বা কথাও দুইজন দলনেতা ঠিক করে অন্য দুজন একটু দূরে গিয়ে একটা জিনিস ঠিক করে আশে বলবে মাছ নিবে না গরু। মাছ একজন ডেকে নিবে অন্য জন পাবে গরু।

খেলার নিয়ম : প্রথমেই একের ঘরে চাড়া ফালতে হবে তারপর ধাক্কা দিতে দিতে সেই চারা কে এক এর ঘর থেক দুইয়ে , দুই থেকে তিনে তিন থেকে চারে এমন করে জোরে ধাক্কা দিয়া সাতে নিতে হবে বা এক এক করে প্রতিটি ঘরে চাড়া ছুড়ে এবং এক পায়ে লাফ দিয়ে দাগ পার হয়ে ওই চাড়া পায়ের আঙুলের টোকায় ঘরের বাইরে আনতে হয়। আঙুলের টোকায় চাড়াটি কোনো দাগের ওপর পড়লে কিম্বা দুই পাশের রেখা পার হয়ে গেলে খেলোয়াড় দান হারায়। তখন দান পায় দ্বিতীয় জন। এভাবে যে সব ঘর পার হয়ে আসতে পারে সে-ই এক্কাদোক্কায় জিতে যায়।



খেয়াল রাখতে হবে যে ৫ ও ৬ ঘরে দুই পা দুই দিকে ফালে লাফ দিয়ে নেক্সট ৭ এর ঘরে দুই পা একসাথেই ফেলতে হবে ।

তবে সাবধান : মনে রাখতে হবে এই খেলায় বানানো কুতকুত খেলার ঘরটা যেই দাগ কাটা থাকবে সেই দাগে যেন কখনই পা না পড়ে ।আর চারাটা ও যেনো দাগে না পড়ে এবং দাগের বাইরে না যায় ।

এ ছাড়া দমের ব্যপারে খেয়াল রাখতে হবে। দম বলতে বলে রাখি নিঃশ্বাস না ছেড়ে একটা ছড়া যেমন আপনি এক দমে শেষ করতে পারনে ঠিক তেমনি করে প্রতিটি ঘরে এক পা এক পা করে রেখে যেতে হবে। গ্রামে মেয়েরা এই রকম ছড়া বলে-----

কুত কুত কুত কুতকুত কুত কুত – কুথাহ/ কিত কিত কিত কিত কিথা।

এই ভাবে একে একে ছয়টি ঘর খেলতে হবে । মনে রাখতে হবে তিনটি বিশেষ জিনিস -

১/ চাড়াটা ঠিক ঠিক ঘরে ফেলতে হবে, বাইরে অথবা দাগের উপর পড়লে বাদ ।

২/ দম না ছেড়া যাবেনা , যতক্ষন না লক্ষ্যের ঘরে পৌঁছে যায় ।

৩/ লাফ দিয়ে এক পা দিয়ে যাবার বেলায় খেয়াল রাখতে হাবে অথবা যেই পা উঁচু তা যেন মাটিতে অথবা এক পাটি যেটা মাটিতে আছে সেটা দাগে না পরে ।

একে একে খেলার পর এবার " চু "খেলতে হবে । এই ক্ষেত্রে সাথির সাথে ডিসাইড করে নিতে হবে কয় চু দেব। কেউ কেউ ২ চু অথবা ৩ চু দেয়

এই ক্ষেত্রে নিম্নের কথাটি বলতে হবে - চু উ উ উ উ উ উ উ উ উ- আ



চু এর পর কাজ শেষ হইলে আপনার কাজ হবে আছি দেওয়া ( আছি মানে = দুই চোখ বন্ধ করে আসমানের দিকে মাথা উচু করে হেটে যাওয়া) । এই ক্ষেত্রে অন্ধের মত এক এক করে ঘরগুলো পেরিয়ে যেতে হবে এবং সর্ব শেষ ঘরে (৭নাম্বার) গিয়ে চোখ খুলতে হবে । এর মধ্যে যদি পা ঘরের লাইনে পড়ে তবে দান বাতিল। তবে আছি দেবের সময় সাথিকে বলতে হবে ঠিক আছে কিনা মানে সঠিক ঘরে পা পড়েছে কি না । তার সিগ্যনাল সবুজ হইলেই সে বলবে আছো , তারপর নেক্সট ঘরে পা বাড়াতে হব/

ঘর কেনার নিয়ম :৭টি ঘর একে একে খেলার পর এইবার লাস্ট ১ স্টেপ বাকি থাকবে। এখন হাপ দিবেন । হাপ মানে = মুখের ভিতর এক হাত রেখে বা শুধু মুখ বন্ধ করে প্রতিটা ঘর চারা ছাড়াই ডিঙ্গিয়ে যাওয়া।

সাবধানতা : হাপ দেওয়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন দাঁত না দেখে যায়। অন্য দলের সাথি দাঁত দেখে ফেললে ঐ দান কচ্চা (বাদ)।

হাপ দিয়ে শেষ উপরের ঘরে গিয়ে পিছন ফিরে মাথার উপর দিয়া চারাটা ঘর লক্ষ করে ফেলতে হবে । এই বার যেই ঘরে চারটা পড়বে সেই ঘরটা কিনা হয়ে যাবে। তবে ঘরের দাগে প্রলে দান বাদ। ঘর কিনা হলে ঐ ঘর ক্রস একে নিজের বানিয়ে নিতে হবে । পুনুরায় খেলার সময় সেই ঘরে রেস্ট নিতে পারবে, তবে অন্য দলের সাথিরা ঐ ঘরে পা দিতে পারবে না। তবে অনুমতি নিলে পারবে।

এই ভাবে একে একে সব ঘর কিনে ফেলার পর সর্বশেষ ৭ নাম্বার ঘর কেনার পালা । ওইটা কেনার পরই খেলা শেষ ।

তবে অঞ্চলভেদে এক্কাদোক্কার নিয়মে কিছু কিছু ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন মুখ উপরের দিকে তুলে চাড়াটি কপালে রেখে ঘর অতিক্রম করা, দাগে পা পড়লে দান বাদ হওয়া ইত্যাদি। কোথাও আবার শেষ ঘরটি পার হওয়ার সময় না ঘুরে চাড়াটি ছুড়ে মারা হয়।

খেলাটি এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। গ্রামাঞ্চলে ও মফস্বল এলাকায় এখনো মেয়েদের এক্কাদোক্কা খেলতে দেখা যায়।







বিষয়: বিবিধ

২৬৮৬ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

211168
২১ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০১:৫১
সূর্যের পাশে হারিকেন লিখেছেন : মজার একটা সিরিজ চালু করছেন। মনে মনে হাঁসি পড়ার সময়। কারন মেয়েদের সাথে কত্তবার খেলছি এক্কাদোক্কা Big Grin Love Struck Big Grin এখন ওরা ৩, ৪ বাচ্চার মা Day Dreaming আর আমি এখনও Broken Heart Broken Heart
২১ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:১২
159558
গোলাম মাওলা লিখেছেন : মেয়েদের সঙ্গে বদন বা দাড়িয়াবান্ধা খেলেছি
211172
২১ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:০৩
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : হাডুডু, বউছি, গোল্লাছুট, সাতচারা, পাঁচগুটি, দাঁড়িয়াবান্ধা ব্যাপক খেলেছি।
২১ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:১২
159559
গোলাম মাওলা লিখেছেন : হুম আমিও
211573
২২ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ০৬:৫৯
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : খেলা গুলোর কথা মনে হলে শৈশবে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় Day Dreamingভালো লাগলো Good Luck Rose
225425
২৪ মে ২০১৪ দুপুর ০১:৪৪
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : ভালো লাগলো
২৫ মে ২০১৪ সকাল ০৮:৩১
172837
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ভালো লাগলো বাদশা ভাই, আপনি আমার পোস্ট গুলি পড়ছেন । ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File