গ্রামীণ-দেশজ খেলা যা আর খেলা হয়না তেমন—পরিচয় করিয়ে দিই আপনাদের সঙ্গে পর্ব: ০১
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১৮ এপ্রিল, ২০১৪, ০১:৫৭:০৫ দুপুর
গ্রামীণ-দেশজ খেলা যা আর খেলা হয়না তেমন—পরিচয় করিয়ে দিই আপনাদের সঙ্গে পর্ব: ০১
মানুষ সেই প্রাচীনকাল হতে তাদের মানসিক বিনোদন ও আনন্দের জন্য যা শুরু করেছিল তা খেলা। আর তার ভিন্নতা বা জনপ্রিয়তা দেশ ও মানুষ ভেদে বিভিন্ন রকম। একেক দেশে একেক খেলা মানুষ নিজেদের আনন্দের জন্য নিজেরা আবিষ্কার করেছে। আমাদের দেশ তথা বাঙালি সমাজে এমন অনেক খেলা প্রচলিত আছে বা হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে নতুন নতুন খেলার ভিড়ে। এই সব খেলা আগে গ্রামীণ সমাজে যেমন খেলা হত তেমনি শহুরে পরিবেশেও খেলা হত হরদম।
দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ এমন খেলাধুলা নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত ঘটানো ও মানুষের মাঝে পারষ্পারিক ভ্রাতৃত্ব-বোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে সারাদেশের বিলুপ্তপ্রায় নানা রকমের খেলার আয়োজন হয়ে থাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে। দেখুন দেখি কে কোন খেলাটা অন্তত একবার হলেও খেলেছেন।
১।হা-ডু-ডু (কাবাডি) খেলা:
প্রতিটি দেশের একটি জাতীয় খেলা থাকে। ইংরেজদের জাতীয় খেলা ক্রিকেট, আমেরিকানদের জাতীয় খেলা বেস বল। আমাদের জাতীয় খেলা হাডুডু বা কাবাডি। কিন্তু কালক্রমে এই খেলার কদর হারিয়ে যেতে বসেছে। দশ বছর আগেও স্কুল ভিত্তিক আন্তঃজেলা বা থানা কাবাডি প্রতিযোগিতার আয়োজন চোখে পড়ত। বর্তমানে সেটাও চোখে পরে না। অনেকেই হাডুডু খেলার নিয়ম পর্যন্ত জানে না! । চলুন জেনে নিই এই খেলা সম্পর্কে। খেলার নাম :হাডুডু বা কাবাডির উৎপত্তিস্থল ফরিদপুর, আবার কেউ কেউ বলেন বরিশাল। তবে বাংলাদেশের সর্বত্র এই খেলার প্রচলন আছে। মাঠের সাইজ :৪২ ফুট লম্বা ও ২৭ ফুট চওড়া। মাঠকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিটি ভাগকে কোট বলা হয়। মোট সময় :৪৫ মিনিট (২০ মিনিট + ৫মিনিট + ২০ মিনিট) মাঝের ৫ মিনিট বিরতি। হাডুডু খেলার শুরুতে খেলোয়াড়দের দুটি দলে ভাগ করে নিতে হয়। প্রতিটি দল তাদের দলনেতা নির্বাচন করে। নেতার অধীনে দু'দলে সমান সংখ্যক খেলোয়াড় থাকে। সাধারণত খেলোয়াড় থাকে ১২ জন। তবে প্রতিবার সাত জনের দল নিয়ে খেলতে হয়। দু'পক্ষের দু'দল মুখোমুখি অর্ধ বৃত্তাকারে দাঁড়ায়। খেলা শুরু হলে একপক্ষ দম রেখে হাডুডু বা কাবাডি বলতে বলতে ডাক দিতে থাকে এবং মধ্যরেখা পার হয়ে বিপক্ষের কাউকে ছুঁয়ে দম থাকা অবস্থায় দ্রুত পালিয়ে আসতে চেষ্টা করে।
যদি কাউকে ছুঁয়ে আসতে পারে তবে সে ‘মরা' বলে গণ্য হয়। আবার আক্রমণকারী যদি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের হাতে ধরা পড়ে তবে সেও মরা বলে গণ্য হয়। একজন মরা আর খেলতে পারবে না, তাকে কোটের বাহিরে অপেক্ষা করতে হবে। যদি মরা দলের কেউ প্রতিপক্ষের
কাউকে ছুঁয়ে আসতে পারে তবে মরা পুনরায় বেঁচে যাবে। আক্রমণে পরাজিত হওয়াকে মরা এবং বিজয়ী হওয়াকে বাঁচা বলে। এই খেলার মজার একটা নিয়ম আছে। সেটা হল ৮০ কেজি বেশি ওজনের কাউকে এই খেলায় নেওয়া হয় না। এই খেলা পরিচালনা ও বিচারকার্য করে থাকেন একজন রেফারি, দুইজন আম্পায়ার, একজন স্কোরার।
২।লাঠি খেলা
লাঠি খেলা ভিডিও
লাঠি খেলা একটি ঐতিহ্যগত মার্শাল আর্ট যেটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কিছু জায়গায় চর্চা করা হয়।লাঠি খেলা' অনুশীলন কারীকে 'লাঠিয়াল' বলা হয়।লাঠি খেলা লাঠি দিয়ে আত্মরক্ষা শেখায়। ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত বাংলার জমিদাররা (পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বঙ্গ) নিরাপত্তার জন্য লাঠিয়ালদের নিযুক্ত করত। চঞ্চলে জমি দখলের জন্য মানুষ এখনও লাঠি দিয়ে মারামারি করে। মহরম ও পূজাসহ
বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানে এই খেলাটি তাদের পরাক্রম ও সাহস প্রদর্শনের জন্য খেলা হয়ে থাকে। এই খেলার জন্য ব্যবহৃত লাঠি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা, এবং প্রায়ই তৈলাক্ত হয়। অত্যাশ্চর্য কৌশলের সঙ্গে প্রত্যেক খেলোয়াড় তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শন করে। শুধুমাত্র বলিষ্ঠ যুবকেরাই এই খেলায় অংশ নিতে পারে।কিন্তু বর্তমানে শিশু থেকে শুরু করে যুবক, বৃদ্ধ সব বয়সের পুরুষেরাই লাঠিখেলায় অংশ নিয়ে থাকেন। উত্তরবঙ্গে, ঈদের সময়ে চাঁদি নামক একটি অনুরূপ খেলা খেলা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশে পূজাসহ বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানের সময় "লাঠি খেলা" এর প্রদর্শনী এখনও আছে।
লাঠি খেলা এদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ভ্রাম্যমাণ পরিবেশনা শিল্প। গ্রামের সাধারণ মানুষেরা তাদের নৈমিত্তিক জীবনের উৎসব-বাংলা বর্ষ বরণ, বিবাহ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে লাঠি খেলার আয়োজন করে থাকেন। এক্ষেত্রে সাধারণত কোনও লাঠিয়াল দলকে ভাড়া করে আনা হয়। লাঠিয়াল বাহিনী সড়কি খেলা, ফড়ে খেলা, ডাকাত খেলা, বানুটি খেলা, বাওই জাঁক (গ্রুপ যুদ্ধ), নরি বারী (লাঠি দিয়ে উপহাস যুদ্ধ) খেলা এবং দাও
খেলা (ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপহাস যুদ্ধ) খেলা দেখায়। এর মধ্যে ডাকাত খেলার উপস্থাপনা ঈদে জনপ্রিয় খেলা হিসেবে প্রসিদ্ধ। লাঠিখেলার আসরে লাঠির পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঢোলক, কর্নেট, ঝুমঝুমি, কাড়া ইত্যাদি ব্যবহৃত হয় এবং সঙ্গীতের সাথে চুড়ি নৃত্য দেখানো হয়।
৩।গোল্লাছুট, চি বুড়ি (গোশত-গোশত গোল্লাছুট):
গ্রামবাংলার কিশোর-কিশোরীদের এই খেলার সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। আমার মনে হয় সারা বাংলার সব গ্রামের কিশোর-কিশোরীরাই এ খেলার সঙ্গে পরিচিত এবং এটি তাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা। গ্রামের বিস্তৃত স্কুল মাঠ, খোলা জায়গা, নদীর পাড়ে সাধারণত কিশোর-কিশোরীরা গোল্লাছুট খেলায় মেতে উঠে। এ খেলার জন্য ছোটাছুটি ও দৌড়াদৌড়ির জন্য বেশ জায়গা লাগে। গোল্লাছুট খেলায় দু’টি দল থাকে। বৃত্ত তৈরি করে ঘুরতে হয় বলে একে “গোল্লা” এবং আঞ্চলিক ভাষায় ছুট হলও দৌড়ানো। এভাবেই খেলার নাম হয়েছে গোল্লাছুট গোল্লাছুট খেলায় দুটি দল থাকে। মাটিতে এক জায়গায় গর্ত করে একটি লাঠি পুতে তাকে কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয়, এই লাঠিকে কেন্দ্র করে বৃত্ত তৈরি করে ২৫/৩০ ফুট দূরের কোন একটি বস্তুকে (বৃত্তের বাইরে আর একটি কেন্দ্র) স্পর্শ করতে হয়।
যেমন : খেলার শুরুতে প্রথম দুজন দলপতি নির্ধারণ করা হয়। দলপতিদের বলা হয় “গোদা”। তার পর খেলোয়াড় বাছায়। কোনও জুটি একটু দূরে গিয়ে তাদের নাম ঠিক করল চাঁদ ও তারা। দলনেতাদের সামনে গিয়ে তারা বলে_ আমরা চাঁদ ও তারা। তোমরা কে কাকে চাও। একজন চাঁদ চাইলে অন্যজনের ভাগে পড়ে তারা। ভাগ হয়ে দুজন দুদলে চলে যায়। এভাবেই দুই দলে সবাই ভাগ হয়।দুদলেই সমান সংখ্যক খেলোয়াড় থাকে (৫ অথবা ৭ জন)।
এরপর খেলা শুরু হয়। খেলা শুরুর আগে একটা ছোট্ট গর্তকে ঘিরে খেলা চলে। এই গর্তে একটি কাঠি বা কঞ্চি পুঁতে সেটির নাম দেয়া হয় গোল্লা। আর ৬০/৭০ গজ দূরে কোন গাছ বা খড়ের গাদাকে সীমানা ধরা হয়। ওই গোল্লা থেকে দৌড়ে সীমানাকে ছোঁয়াই খেলার প্রধান লক্ষ্য। গোল্লা থেকে ছুটে গিয়ে সীমানা ছোঁয়ার কারণেই এই খেলার নাম হয়েছে গোল্লাছুট।
এই খেলার দলনেতা গোল্লাকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর গোল্লার হাত ধরে দাঁড়ায় এক সদস্য। এরপর একে অপরের হাত ধরে লম্ব হয়ে ঘুরতে থাকে। আর অন্য পক্ষের খেলোয়াড়রা তাদের ঘিরে দূরে দাড়িয়ে থাকে। দলনেতাকে ধরে ঘুরতে থাকা খেলোয়াড়রা ফাঁক বুঝে দৌড় দিয়ে সীমানাকে ছুঁতে চেষ্টা করে। আর অপরপক্ষ ছুটে চলে দৌড় দেয়া খেলোয়াড়কে সীমানা ছোঁয়ার আগে ছুঁয়ে দিতে। যদি ছুঁয়ে দিতে পারে তাহলে ওই খেলোয়াড় খেলা থেকে বাদ পড়ে।
অন্যদিকে সীমানা ছুঁতে পারলে জয়ের দিকে একধাপ এগিয়ে যায় তারা। এভাবে চলতে চলতে গোল্লাকে ঘিরে ঘুরতে থাকা দলের সব সদস্য সীমানা ছুঁয়ে ফেললে তারা সকলে গোল্লায় এসে জোড় লাফ দিয়ে দিয়ে সীমানার দিকে যেতে থাকে। সবাই জোড় লাফে ঠিকমতো সীমানা ছুঁতে পারলে ওই দান (পর্ব) তারা জিতে। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ যদি কোন খেলোয়াড়কেই সীমানা ছুঁতে না দেয় তাহলে তারা দান পায়। পরে প্রতিপক্ষ দলনেতা গোল্লাকে ছুঁয়ে দাঁড়ায় আর অন্য সদস্যরা তাকে ছুঁয়ে আগের মতো ঘুরতে থাকে এবং চেষ্টায় থাকে কখন ছুটে গিয়ে সীমানা ছুবে। এভাবেই ঘুরে ফিরে খেলা চলতে থাকে।
৪। বউচি খেলা:
বউচি বাংলাদেশের সব অঞ্চলের শিশুদের প্রিয় খেলা। বউচি খেলায় দুটি দলের প্রয়োজন হয়। প্রতি দলে ৮ থেকে ১০ জন করে খেলোয়াড় হলে খেলা জমে। মাঠ অথবা বাড়ির উঠোন_যেখানে খুশি সেখানে খেলা যায়। খেলার আগে ১৫-২০ ফুট দূরত্বে মাটিতে দাগ কেটে দুটি ঘর তৈরি করতে হয়। দুই দলে যারা প্রথম খেলার সুযোগ পায় তাদের মধ্যে থেকে একজনকে বউ বা বুড়ি নির্বাচন করা হয়। দুটি ঘরের মধ্যে একটি ঘর হবে বড়, যেখানে এক পক্ষের সব খেলোয়াড় থাকবে। আর ছোট ঘরে দাঁড়াবে বউ। ছোট ঘরটিকে বউঘর বা বুড়িঘর বলে। বউয়ের বিচক্ষণতার ওপর খেলার হারজিত নির্ভর করে। খেলার মূল পর্বে বউঘর থেকে বউকে ছুটে আসতে হবে বড় ঘরটিতে। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা সব সময় পাহারায় থাকে বউ যেন ঘর থেকে বের হতে না পারে। বউ বাইরে এলে বিপক্ষ দলের কেউ তাকে ছুঁয়ে দিলে ওই পক্ষের খেলা শেষ হয়ে যায়। এরপর বিপক্ষ দল খেলার সুযোগ পায়। এদিকে বড় ঘরটিতে যারা থাকে তারা দম নিয়ে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের তাড়া করে। দম নিয়ে তাড়া করলে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা দিগ্বিদিক ছুটে পালায়। আবার খেয়াল রাখে বউ যেন যেতে না পারে। দম নিয়ে যাওয়া খেলোয়াড় কাউকে ছুঁয়ে দিলেই বিপক্ষ দলের সে খেলোয়াড় মারা পড়ে। মরা খেলোয়াড় চলতে থাকা খেলায় অংশ নিতে পারে না। এভাবে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় মেরে বউকে বড় ঘরে ফিরে আসতে সুযোগ করে দেওয়া হয়। বউ যদি বিনা ছোঁয়ায় বড় ঘরে চলে আসতে পারে তাহলে এক পয়েন্ট। খেলা আবার তারাই শুরু করবে। আর বউ মারা পড়লে অন্য দল খেলার সুযোগ পাবে। যতক্ষণ ইচ্ছা ততক্ষণ চালানো যায় খেলা।
৫। মোরগ লড়াই (বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলা)
বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে মোরগ লড়াই শিরোনামে শিশুদের মধ্যে হাঁটু লড়াইয়ের আয়োজন হয়ে থাকে। এ খেলায় এক পা ভাঁজ করে হাঁটু দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হয়।মোরগ লড়াই বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আয়োজন করা হয়ে থাকে।এটি সাধারণত ছেলেদের খেলা।গ্রামাঞ্চলের ছেলেদের কাছে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা।
নিয়মকানুন: মোরগ লড়াই খেলায় একদল ছেলে গোল হয়ে একপায়ে দাড়িয়ে থাকে। দুই হাত দিয়ে অপর পা পিছনে ভাজ করে রাখতে হয়। রেফারি যখন বাঁশিতে ফুঁ দেন তখনই খেলোয়াড়রা একে অপরকে ভাজ করা পা দিয়ে মারতে থাকে। কেউ পড়ে গেলে সে বাতিল বলে গণ্য হয়। এভাবে শেষ পর্যন্ত তিনজন থাকে। তাদের মধ্য থেকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় নির্ধারণ করা হয়।
৬।মার্বেল খেলা:
বাংলাদেশের গ্রামীণ কিশোর ছেলেদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় খেলা মার্বেল। কোন কোন অঞ্চলে মার্বেল খেলাকে বিঘত খেলাও বলে। এটা অভিভাবকদের কাছে এক ধরণের নিষিদ্ধ খেলা। অভিভাবকদের ধারণা এটা বস্তির পোলাপানের খেলা, কোন ভদ্র শিক্ষিত ঘরের ছেলে এটা খেলতে পারেনা। সম্ভবত অভিভাবকদের নিষেধাজ্ঞাই এই খেলার প্রতি কিশোরদের অদম্য আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এই খেলার নিষ্পত্তি হয় অন্যের মার্বেল খেলে জিতে নিজের করে নেবার মাধ্যমে।মার্বেল খেলার জন্য কমপক্ষে দুইজন খেলোয়াড় দরকার হয়। তিন, চার, পাঁচ, বা সাতজন মিলেও খেলা যায়। পরিষ্কার সমতল ভূমি এই খেলার জন্য উপযোগী।
মার্বেল খেলার অঞ্চল ভেদে নানা ভার্শন প্রচলিত আছে।তবে সারা দেশে জনপ্রিয় একটা হচ্ছে 'ডিপ' খেলা। 'ডিপ' খেলায় দুই থেকে শুরু করে ৮/১০ জন খেলতে পারে। একটা ছোট গর্ত খোঁড়া হতো যার নাম ডিপ। সবাই একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব হতে মার্বেল ছুঁড়তো। যার মার্বেল ডিপের সবচেয়ে কাছে পড়তো সে সবার আগে খেলার সুযোগ পেতো। প্রথমে ডিপ লক্ষ্য করে আঙ্গুলে মার্বেল ছুঁড়ো, ডিপে ফেলো, তারপর সুবিধা মত প্রতিপক্ষের যেকোন মার্বেল লক্ষ্য করে মার্বেল ছুঁড়ো। লাগলে সেই মার্বেল তোমার। অবশ্য প্রতিপক্ষ অন্য একটি মার্বেলও ইচ্ছা করলে দিতে পারে।
এই ডিপ পদ্ধতির আর একটা খেলা আছে এটি পয়েন্ট ভিত্তিক খেলা। সবাই একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব হতে মার্বেল ছুঁড়তো। যার মার্বেল ডিপের সবচেয়ে কাছে পড়তো সে সবার আগে খেলার সুযোগ পেতো। প্রথমে ডিপ লক্ষ্য করে আঙ্গুলে মার্বেল ছুঁড়ো, ডিপে ফেলো , তাহলে এক পয়েন্ট। তারপর সুবিধা মত প্রতিপক্ষের যেকোন মার্বেল লক্ষ্য করে মার্বেল ছুঁড়ো। লাগলে পয়েন্ট ২। এভাবে ২০ পয়েন্ট করতে পারলে সে বিজয়ী। সবার শেষে যে থাকে সে চোর। তাকে এবার চোর দিতে হবে বা আমরা বলি গাই খাটতে হবে। চোর এবার প্রথম লাইন হতে ডিপ লক্ষ করে মার্বেল ছুড়বে। যদি এক চান্সে ডিপে পড়ে ভাল তা না হলে একে একে সকলে তার মার্বেল লক্ষ করে মার্বেল ছুড়বে তাকে ডিপ হটে দূরে সরিয়ে দিতে।প্রথম জন চোরের মার্বেলে লাগাতে পারলে বলা হয়
১ এ গাই( গরুর স্ত্রী লিঙ্গ) ... ,
পরের জনের লাগলে ২ এ বিড়াল,
৩ এ ত্যাঁদড় ,
৪ এ চোর,
৫ এ পেঁচা ,
৬ এ ছোঁচা ,................................................ ১৯ এ হিয়া,
২০ এ বিয়া,
২১ এ বাসর রাত,
২২ এ বাচ্চার বাপ ।
এমন করে চলতে থাকে যতক্ষণ চোর ডিপে মার্বেল না ফেলতে পারে। অনেক সময় চোরকে মাফ করে দেওয়া হয়। আবার খেলা শুরু হয় নতুন করে। আবার হয়তো নতুন কেও চোর।
এর পর আসা যাক দান খেলা বা বাদ খেলাতে । এ জন্য প্রথমে দুইটি একটি রেখা টানতে হয়। প্রথম রেখা ( শুরুর রেখা বা দান রেখা)থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে দ্বিতীয় রেখার(আঞ্চলিক ভাষায় রেখাটিকে ‘জল্লা’/কোথাও ‘জই’ নামে পরিচিত) আশে পাশে একটি গর্ত(গর্তটিকে ‘কেপ’ বলে) করতে হয় যেন একটি মার্বেল সেই গর্তে বসতে পারে। জল্লার বাইরে হতে প্রথম রেখা ( শুরুর রেখা বা দান রেখা)থেকে পা রেখে প্রত্যেকে একটি করে মার্বেল কেপ এ ফেলার চেষ্টা করে। যার মার্বেল কেপ এ পড়ে বা সবচেয়ে কাছে যায় সে প্রথম দান পায়। প্রথম যে দান পায় তার হাতে ২/৩/৪টি করে মার্বেল জমা দেয়। দুই এর দান হলে ২ টি , তিন এর দান হলে ৩ টি।
সে মার্বেলগুলো প্রথম রেখা ( শুরুর রেখা বা দান রেখা)থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে দ্বিতীয় রেখার(আঞ্চলিক ভাষায় রেখাটিকে ‘জল্লা’/কোথাও ‘জই’ নামে পরিচিত) আশে পাশে ওই গর্তের(গর্তটিকে ‘কেপ’ বলে) আশপাশে আলতো করে ছড়িয়ে দেয়। এরপর অন্য খেলোয়াড়রা একটা নির্দিষ্ট মার্বেলকে বলে ‘বাদ’। অর্থাৎ ওই মার্বেল ছাড়া বাকি যে কোন একটি মার্বেলকে অন্য একটি মার্বেল ছেড়ে দিয়ে স্পর্শ করতে হবে। যদি এমনটা পারে তাহলে ওই দান সে জিতে যায়। আর না পারলে পরবর্তী জন একইভাবে খেলার সুযোগ পায়।
মার্বেল খেলায় দুটি নাম খুব প্রচলিত ছিলো - ডাগ্গি আর চুঁই। সবচেয়ে গোলাকার এবং সুবিধাজনক মার্বেল, যেটা দিয়ে খেলা সবচেয়ে সহজ তাকে বলা হতো ডাগ্গি। প্রতিটা খেলোয়াড় তার ডাগ্গি কোন ভাবেই হাতছাড়া করতো না, কারণ এটা দিয়েই সে খেলে। আর সবচেয়ে ছোট মার্বেলকে বলা হতো চুঁই। সুবিধা মত এ দুই ছুড়ে খেলা হয়।
তবে ‘বাদ’ দেয়া মার্বেল কিংবা অন্য একাধিক মার্বেলকে ছুড়ে দেয়া মার্বেল স্পর্শ করলে ওই খেলোয়াড়কে ফাইন দিতে হয়। এবং দান জেতার জন্য পরবর্তী খেলোয়াড় ফাইন হওয়া মার্বেলসহ সেগুলো ছড়িয়ে দিয়ে খেলতে থাকে।
যে কেউ দান জিতলে আবার পুনরায় খেলা শুরু হয়। এভাবেই চলতে থাকে যতক্ষণ না প্রতিপক্ষ আত্মসমর্পণ করে কিংবা তার কাছের মার্বেল শেষ না হয়ে যায়।
এ ছাড়া আরও দুটি খেলা প্রচলিত একটা বলে বাটা খেলা আর একটা হল ঘর খেলা। বাটা খেলা দান খেলার মতই তবে এটি খেলা হয় দেয়ালের পিছে ছোট ঘর করে।পদ্ধতি টা একটু আলাদা। আর ঘর খেলা হয় চার কোন ষোল গুটির মত ছক ঘর করে মার্বেল ঘরের ছকে ছকে বসানো থাকে। নির্দিষ্ট দূর হটে ঘর লক্ষ করে মার্বেল ছোড়া হয় বা ঘরের আশে পাশে যাবার চেষ্টা করা হয়। আর পর সবচেয়ে কাছে যে সে প্রথমে মারার চান্স পায়। সে একে একে তার ডাগ্গি দিয়ে ঘরের মার্বেল কে লক্ষ করে মারে , মার্বেল ঘর হতে অন্য মার্বেলকে স্পর্শ না করে বাইরে এলে সে মার্বেল তার। এভাবে একে একে মার্বেল তুলে নিতে থাকে বা পারে না বা ডন করে। ডন হলে অন্য জন সুযোগ পায়। একটা মার্বেল তুলে নিতে ঘরের অন্য মার্বেল স্পর্শ করলে ডন হয়। এ জন্য ফাইন একটা মার্বেল ঘরে বসাতে হয় অথবা এক দান বসে থাকতে হয়। অন্যরা প্রথম হতে খেলা শুরু করে।
চলবে..................... পরের পর্বে দাড়িয়াবান্ধা (গাদন, বদন),
কানামাছি,সাতগুটিবাঘবন্দী,ষোলগুটি,ডাসাকড়ি বা কড়ি,ডাংগুলি
বিষয়: বিবিধ
৩২২১ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লাঠি খেলার আধুনিক রুপ হতে পারে ফেনসিং / মুষ্টিযুদ্ধ । কিন্তু এগুলো খুবই রিস্কি খেলা ।
বাকী খেলাগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পেশ করার জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে কাজ করতে হবে ।
অনেক ধন্যবাদ আপ্নাকে, এরকম একটা স্মৃতিবিজড়িত সিরিজ চালু করার জন্য।
দেশিয় খেলার মধ্যে কাবাডি টাই এখনও টিকে আছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন