তাল পাতার পাখা

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ২৯ মার্চ, ২০১৪, ০১:২৭:৫৬ দুপুর

তাল পাতার পাখা





তলঃ বাংলাদেশের সর্বত্র তালগাছ দেখা যায়। তালগাছ শাখা-প্রশাখা বিহীন একবীজপত্রী উদ্ভিদ। তালগাছ বাড়ির আনাচে-কানাচে, পুকুর পাড়ে, নদীর ধারে, পরিত্যক্ত স্থানে বেশি দেখা যায়। তবে দিনে দিনে বিলুপ্তির পথে তালগাছ । কিন্তু তাল ও তালগাছের হরেক রকম ব্যবহার রয়েছে। তালের অর্থনৈতিক গুরত্ব অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। তালের বহুমাত্রিক গুনের পরিচয় পাওয়া যায় যুগ যুগান্তর ধরে। আর এই তাল গাছের হরেক রকম ব্যবহারের মধ্যে আছে---

ক)তালের রস

খ)তালের কাঠ

গ)তালের শাস

ঘ)তালের আঁটি

ঙ)তালের পাতা



>>তালের পাতার পাখাঃ সেই প্রাচিন কাল হতে বর্তমান সময়ে গ্রামের বিদ্যুৎ বিহীন প্রতিটি বাড়িতে খুব পরিচিত ও গরম কালে সবার কাছে অতি পরিচিত একটি নাম তালের পাখা। যদিও বর্তমানে নানা রকম, নানা ধরনের, নানা ফ্যাশনের নানা উপাদানের তৈরি পাখার প্রচলন হয়েছে , তবুও তালের পাখার কদর কমেনি একটুও।তালের পাতা থেকে তৈরি পাখার বাতাস খেয়ে শরীর শীতল করেন নি, ক্লান্তি দূর করেন নি এমন লোক গ্রাম বাংলায় নেই।

রাজা বাদশাদের আমলে রাজার সিংহাসনের পিছনে দুইজন পাখা হাতে দাঁড়িয়ে থাকত। তাদের কাজ ছিল বিশাল সাইজের এই পাখা ধীরে ধীরে বাতাস করা।



হাত পাখা ছাড়াও আরেক ধরনের পাখা ছিল। এই পাখা কাপড়ের তৈরি। মাথার উপর সিলিংয়ে ঝুলানো থাকত মোটা কাপড়। এর চারদিকে মোড়ানো থাকত লালসালু। এর সঙ্গে যুক্ত থাকত দড়ি। দূরে বসে একজন দড়ি ধরে টানত। দড়ির টানে লালসালু যুক্ত মোটা কাপড় এদিক-ওদিক নড়াচড়া করতো। এতে সারা ঘরময় বাতাস খেলে যেত।

এক সময় অফিস-আদালতে মাথার উপর সিলিংয়ে ঝুলানো এ ধরনের পাখা টেনে বাতাস করার রেওয়াজ ছিল। বেশি দিন আগের কথা নয়। এই ইংরেজ আমলে এমন কি ইংরেজ আমলের পরেও এ উপমহাদেশে জজ-ম্যাজিষ্ট্রেটের আদালতে এ ধরনের পাখা টেনে বাতাস করার ব্যবস্থা ছিল। তখন এ কাজের জন্য সরকারি কর্মচারীও নিযুক্ত ছিল।

এখন এই ধরনের পাখা না দেখা গেলেও হাত পাখার কদর এখনো কমে নি। কৃষক মাঠে কাজ করছে, আর তার বধু তার জন্য খাবার নিয়ে আসছে এবং সাথে একটি তালের হাত পাখা। কৃষক খাচ্ছে এবং গৃহবধু হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে।

তাইতো প্রচন্ড গরমে তালের পাখা হাতে অনেকের মুখে শোনা যায় গ্রাম বাংলার প্রাচীন লোকগাঁথা--- –

১। ‘তালের পাখা প্রাণের শখা,

শীত কালে দেয়না দেখা,

গরম কালে পরম পাখা’।

২।নামটি আমার তালের পাখা,

শীত কালেতে যায় না দেখা

গ্রীষ্মকালে প্রাণের সখা।

আমার পাখার এমনগুন,

বাতাস খেলে আসে ঘুম।’

৩।"তালের পাখা

প্রাণের সখা,

গরমকালে

দিয়ো দেখা।"



আধুনিক সময়ে নগর জীবনে প্রতিদিন বিদ্যুৎ বিভ্রাটে অতিষ্ঠ নগর জীবনে সঙ্গী করে নিতে হয় হাতপাখা। তাই তো আজকাল অভিজাত বুটিক বাড়ি কিংবা ফ্যাশনহাউজগুলোও নজর দিচ্ছেন বাহারি হাত পাখার উপর। এসব হাতের পাখা নানা ঢং আর রঙ-এ চলে আসছে অভিজাত ড্রইং রুমের সৌন্দর্য বৃদ্ধির উপকরণ হয়ে। তাই আজ আর হাত পাখা শুধু হাওয়া খাওয়ার জন্য নয়, আরও বেশি কিছুতে পরিণত হয়েছে। তালপাখা সম্পর্কে অভিজাত বুটিক সপগুলোর ডিজাইনাররা ভাবছেন নতুন করে। তাদের মধ্যে দেশীয় উপকরণ আর ঐতিহ্যের উপর আজ মানুষ ঘুরে ফিরে যাচ্ছে। এতে তাদের রুচি ও আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটে বলে তারা মনে করেন। তাই ড্রইং রুমে ক্রিস্টালের দামী সোপিস এর সাথে বাহারি হাতপাখা আর বেমানান নয়।বর্তমানে প্লাস্টিকের হাত পাখা প্রচলন হলেও তালের হাত পাখা বা খেজুর পাতা, কাপড়ের তৈরি পাখার মর্যাদা নিতে পারেনি।

এই হাত পাখা নিয়ে অনেক গান কবিতা আছে। একটি জনপ্রিয় গান এই রকম...

''তোমার হাত পাখার বাতাসে

প্রান জুড়িয়ে আসে,

কিছু সময় আরও তুমি

থাকো আমার পাশে।''

>>পাখা তৈরিঃ তালপাতা ভালো করে রোদে শুকিয়ে ঠান্ডায় নরম করে নেওয়ার পর বাঁকাকাঠি সুন্দর ডিজাইন করে তার ভিতর তালপাতা ডুকিয়ে গুনে (তার) দিয়ে বেঁধে সুতা দিয়ে সেলাই করা লাগে। তারপর রং করে শুকাতে হয়। ফাল্গুন থেকে ভাদ্র-আশ্বিন মাস পর্যন্ত পাখা বানানোর কাজ চলে।

পাখার উপর---



‘তালের পাখা প্রানের সখা,

গরম আসলি করে দেখা’,

এ কথাও কেও কেও রং দিয়ে লিখে দেন।

তালের প্রধানত ২ রকম পাখা বানানো হয়।

১। পকেট পাখা



২। ডাটি পাখা।

একটা গাছের ১৫ থেকে ২০ টা ড্যাগ থাকে। তাতে ১‘শ ৫০ থেকে ২‘শ টা পাখা হয়। ১‘শ টি ডাটি পাখা বানাতে এখন খরচ হয় ৪-৫ ‘শ টাকা।

আর ১ হাজার টাকার তালপাতায় পকেট পাখা হয় ৩ .৫ হাজার টার মত । খরচ পড়ে ৩ থেকে ৩.৫ হাজার টাকা। সময় লাগে ২০-২৫ দিন।



>>নানান নামঃ পাখা যে শুধু দেখতে বাহারি তা কিন্তু নয়, পাখার রয়েছে নামেরও নানান বাহার ।অঞ্চল ভেদে কিছু পাখাকে

i)ভালবাসা,

ii) শঙ্খলতা,

iii) মানবিলাসী,

iv) বাঘাবন্দী,

vi) হাতফুল মানবাহার,

vii) পালং পোষ,

viii) কাঞ্চন মালা,

ix) মন সুন্দরী লেখা ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।

>> হাত পাখা টাঙ্গাইলে বিছুন আবার ময়মনসিংহ তে বিচুইন নামে পরিচিত।

>পাখা গ্রামঃ বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলের গ্রাম গুলি পাখা গ্রাম নামে পরিচিত পেয়েছে। এই সব গ্রামের মানুষ পাখা তৈরি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। গরম কালে তাদের একমাত্র কাজ নানা ধরনের পাখা তৈরি।পাখা তৈরির জন্য কিশোরগঞ্জ, কৈতরকান্দি, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল করটিয়া, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর বরিশাল প্রসিদ্ধ। তাছাড়া, নওগাঁ, নোয়াখালি ও ঢাকার কিছু কিছু অঞ্চলে পাখা তৈরী হয়।

>দরদামঃ তালের এক একটা পাখা ১০ টাকা হতে শুরু করে নকশা করা একটা পাখা ৪০-৫০ টাকা পর্যন্ত দাম দিয়ে কিনতে হয়।

>> বর্তমান অবস্থাঃ পাখা তৈরির প্রধান উপকরণ তালের পাতার তীব্র সঙ্কট , রঙসহ অন্যান্য উপকরণের দাম আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় অনেকে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। পাখা তৈরির উপকরণ সামগ্রীর দাম বাড়লেও বাড়েনি পাখার দাম। তাই এ তাল পাখা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা কারিগরদের একান্ত দরকার।



বিষয়: বিবিধ

৩০৫৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

199662
২৯ মার্চ ২০১৪ দুপুর ০১:৩৯
বিন হারুন লিখেছেন : Rose Thumbs Up
199713
২৯ মার্চ ২০১৪ দুপুর ০২:৫০
নিউজ ওয়াচ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
199729
২৯ মার্চ ২০১৪ দুপুর ০৩:১৫
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
199756
২৯ মার্চ ২০১৪ বিকাল ০৪:০৪
শিশির ভেজা ভোর লিখেছেন : জ্ঞানগর্ভ লেখা। অনেক মেহনত করে লিখেছেন বলে ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File