মোরগ লড়াই/ককফাইট
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১৯ মার্চ, ২০১৪, ১২:২৬:৪৭ দুপুর
মোরগ লড়াই/ককফাইট
ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ব্যাডমিন্টনের মতো অতি পরিচিত একটি খেলা ককফাইট বা মোরগ লড়াই। মোরগের লড়াই /মুর্গার লড়াই / মুরগীর লড়াই (ইংরেজি: Cockfight) এক ধরনের রক্তাক্ত ক্রীড়া যাতে দুই বা ততোধিক মোরগজাতীয় প্রাণী বৃত্তাকার যায়গায় অংশগ্রহণ করে।আর চারপাশে জড়ো হয়ে হাততালি দিচ্ছে হাজারো মানুষ। তাদের তৈরি বৃত্তে প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে দুটি মোরগ। সে লক্ষ্যে এজাতীয় মুরগী লালন-পালন, পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে ক্রীড়া উপযোগী করে তোলা হয়। গ্রামবাংলার সচরাচর এই চিত্র সময়ের বিবর্তনে এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না। ঐতিহ্যবাহী খেলা হিসেবে মোরগ লড়াইয়ের সুখ্যাতি থাকলেও লড়াইয়ের মোরগ এবং খেলার ঐতিহ্য- দুই-ই হারিয়ে যেতে বসেছে।বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল, ঢাকা ও অন্যন্য এলাকায় এখনো মোরগ লড়াইয়ের ঐতিহ্য টিকে আছে।
>>সাধারণতঃ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোরগ নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে একে-অপরের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত লড়াইয়ের ন্যায় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। শক্ত ঠোঁট ও নখের সাহায্যে এ লড়াই চলে। যে-কোন একটি মোরগের মৃত্যুবরণ কিংবা লড়াইয়ে অপারগতা প্রকাশ করার মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় সমাপ্তি ঘটে। এ লড়াইয়ে বাজী ধরা অন্যতম ক্রীড়া অনুসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
>>ইতিহাসঃ খুব সম্ভবত ভারতীয় লাল বনমোরগ ব্যবহারের মাধ্যমে এ খেলার ব্যুৎপত্তি ঘটে যা পরবর্তীকালে সকল ধরনের গৃহপালিত মোরগকে এ লড়াইয়ে জড়িত করা হয়। ধারনা করা হয় যে, ভারত, প্রাচীন পারস্য, চীনসহ অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় দেশে এ খেলা ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর খ্রীষ্ট-পূর্ব ৫২৪-৪৬০ সালে গ্রীসে প্রবেশ করে। এরপর তা এশিয়া মাইনর ও সিসিলির মাধ্যমে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। রোমেও গ্রীসে প্রচলিত মোরগের লড়াইয়ের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রোম থেকে তা উত্তরাঞ্চলের দিকে প্রচলিত হয়। খ্রীষ্টীয় ধর্মগুরুগণ এ উন্মত্ত লড়াইয়ের বিরোধিতা করলেও ইতালি, জার্মানি, স্পেন ও এদেশগুলোর উপনিবেশসমূহে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ডেও একই দৃশ্য প্রবাহিত হয়। মাঝেমধ্যেই কর্তৃপক্ষ মোরগের লড়াইকে উচ্ছেদের প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। ইংল্যান্ডে ষোড়শ শতকের শুরু থেকে উনবিংশ শতক পর্যন্ত রাজন্যবর্গ ও উচ্চ পদবীধারী ব্যক্তিদের কাছে এ প্রতিযোগিতা বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
>>বাংলাদেশে ইতিহাসঃ ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, একসময় ভারত থেকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইলের দেওয়ান বংশ এই আসিল মোরগ নিয়ে আসেন। আগেরকার দিনের রাজা-বাদশার এটিকে পুষতেন বলে একে রাজকীয় মোরগও বলা হয়। শোনা যায়, টিপু সুলতান, সম্রাট আকবরসহ অনেক রাজা এই মোরগগুলো শখ করে পুষতেন। এদের লড়াই দেখাটাকে বিনোদনের অংশ হিসেবে নিতেন।ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, এখন থেকে প্রায় ৪০-৪৫(১৯৬০-৭০) বছর আগে পুরান ঢাকার ইউসুফ পালোয়ান, তাহের মিস্ত্রি ও নায়ক জাবেদ ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি ক্লাব করে এই খেলার অস্তিত্ব ধরে রাখেন। তবে, ধীরে ধীরে এখন অনেক ক্লাব গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ শৌখিন আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা, আরসিডি মোরগ উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ রয়েল আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মোরগ উন্নয়ন সংস্থাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ক্লাব রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার সব ক্লাবগুলোকে এক করে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ঢাকা ইউনাইটেড আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থা’। ক্লাবটির বর্তমান সভাপতি নাসির বিন জামাল।
>>দেশে দেশেঃ মোরগে মোরগে লড়াই বাংলাদেশসহ মেক্সিকো -স্পেনে বেশ জনপ্রিয় একটি খেলা। মেক্সিকোতে এ নিয়ে রীতিমতো জুয়া খেলা জমে যায়। বাজি ধরে খেলাটিকে করা হয় কোটি টাকার বিনিময়ের খেলা। স্পেনেও বাজি ধরা হয় মোরগ লড়াইয়ে। এ খেলায় দু'পক্ষের দুটি মোরগ মারামারিতে লিপ্ত হয়। যে পক্ষের মোরগ প্রতিপক্ষ মোরগকে ঘায়েল করতে পারে সে পক্ষই বিজয়ী ঘোষিত। মেক্সিকোও স্পেনে পশু চিকিৎসকরাও খেলার আয়োজন কমিটির সঙ্গে থাকেন। তাই পশু চিকিৎসকদের রায় মেনে নিয়ে খেলার মধ্যেও ফলাফল ঘোষণার রীতি চালু হয়েছে। তুরস্ক, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় মোরগ লড়াই প্রায় জাতীয় পর্যায়ের খেলার অন্তর্ভুক্ত।
>>মানুষের খেলাঃ বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে মোরগ লড়াই শিরোনামে শিশুদের মধ্যে হাঁটু লড়াইয়ের আয়োজন হয়ে থাকে। এ খেলায় এক পা ভাঁজ করে হাঁটু দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হয়।মোরগ লড়াই বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় আয়োজন করা হয়ে থাকে।এটি সাধারনত ছেলেদের খেলা।গ্রামাঞ্চলের ছেলেদের কাছে এটি অতন্ত্য জনপ্রিয় একটি খেলা।
>>নিয়মকানুনঃ মোরগ লড়াই খেলায় একদল ছেলে গোল হয়ে একপায়ে দাড়িয়ে থাকে। দুই হাত দিয়ে অপর পা পিছনে ভাজ করে রাখতে হয়। রেফারি যখন বাশিঁতে ফুঁ দেন তখনই খেলোয়াড়রা একে অপরকে ভাজ করা পা দিয়ে মারতে থাকে। কেউ পড়ে গেলে সে বাতিল বলে গণ্য হয়। এভাবে শেষ পর্যন্ত তিনজন থাকে। তাদের মধ্য থেকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় নির্ধারন করা
>>বাংলাদেশের মোরগঃ লম্বা পা, ইগলের মতো চোখ, কম পালকের দুর্লভ প্রজাতির হাসলি/'আছিল/আসিল' মোরগ বাংলাদেশে লড়াইয়ের জন্য সেরা। এটি চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে বুনো মোরগ , যার নাম হাসলি/'আছিল/আসিল'। অসম্ভব তেজি ও যোদ্ধা-প্রকৃতির মোরগ, দারুণ উড়তে পারে এরা।এদের উচ্চতাও সাধারণ মোরগের চেয়ে বেশি। সাধারণ মোরগ থেকে আসিল মোরগের পা, গলা, মাথা, বুক ও উচ্চতাসহ শারীরিক গঠন অনেক শক্তিশালী, যা লড়াই করার জন্য উপযুক্ত। এদের পেছনের আঙুলটি এক ইঞ্চির বেশি লম্বা, দেখতে সূচালো পেরেকের মতো কাটা থাকে। তবে, খেলার নিয়ম অনুযায়ী এই কাটা আধা ইঞ্চির উপরে থাকতে পারবে না। তাই খেলার আগে এ গুলি হেসকো বেল্ড দিয়ে অতিরিক্ত অংশটুকু কেটে ফেলা হয়। বক্সাররা যেমন হাতে গ্লাভস পরে তেমনি এসব মোরগের লড়াইয়ের সময় এদের পেছনের আঙুলটি (এক ইঞ্চির বেশি লম্বা, দেখতে সূচালো পেরেকের মতো কাটা থাকে) আগে তুলা দিয়ে ঢেকে দেয়া হলেও এখন গ্লাভস পরানো হয়। এসব গ্লাভস ভারত থেকে আনা হয়। আসিল মোরগ দেখতে হিংস্র হলেও এরা মারাত্মক প্রভুভক্ত। মালিকের আদর বোঝে, দেখলে ডাকতে থাকে, সামনে দিয়ে ঘুরাঘুরি করে। আদর করে কেও কেও এদের নামও রাখে। যেমন সুরমাইয়া, দাড়িওয়ালা লাখা, ঝাওয়া ইত্যাদি। মালিকের সম্মান রাখার জন্য খেলার মাঠে নিজের জীবন দিয়ে দেবে, কিন্তু হার মানতে নারাজ এই মোরগগুলো।
>> খাদ্যঃ একজন কুস্তিগীর তার শরীরকে ঠিক রাখার জন্য যেমন পুষ্টিকর খাবার খান, তেমনি এই প্রজাতির মোরগের খাবারেরও তালিকা আছে। সাধারণ মোরগগুলো ধান, গম খেলেও লড়াই মোরগের খাদ্য হলো বাদাম, ঘি, মাখন, গরুর মাংস, ডিম, দুধ, ভিটামিন সিরাপ, ট্যাবলেট প্রভৃতি। সেই সঙ্গে লড়াইয়ের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ব্যায়াম, প্রাকটিস ও খাওয়া-দাওয়ার মাধ্যমে একজন খেলোয়াড়ের মতো মোরগগুলোর ফিটনেস ধরে রাখতে কাজ করতে হয় মালিককে।
>> দরদামঃ দুইমাস বয়সী এসব মোরগের একটি বাচ্চার দাম এক হাজার টাকা, মাঝারি বয়সের একটি মোরগের দাম ছয় থেকে সাত হাজার টাকা, আর লড়াইয়ে দক্ষ একটি মোরগের দাম ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার কম নয়।
>>খেলার নিয়মাবলীঃ আসিল মোরগ লড়াইয়ের জন্য রয়েছে প্রায় ৩০-৩৫টি নিয়ম। লড়াইয়ের জন্য ১২ ফুট বাই ১২ ফুট স্কয়ার জায়গা নির্ধারণ করা হয়। মাঝখানে থাকে গোল একটা বৃত্ত যেটাকে গোল পয়েন্ট বা মিডল পয়েন্ট বলা হয়। মাঠের মাঝখানে দু’জন মানুষ দু’টি মোরগ হাতে নিয়ে বসেন। খেলার আগে সাধারণত তিন সদস্য বিশিষ্ট একটা কমিটি থাকে। এই কমিটি খেলায় রেফারির কাজ করে। তাই কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আর মাঠে মালিকের পক্ষ থেকে যে মোরগগুলোকে খেলায় তাদের প্রতিনিধিত্ব করে এদের ‘খলিফা’ বলা হয়। কমিটির নির্দেশ পাওয়া মাত্র শুরু হয় খেলা। খেলার ফলাফল বের করতে অনেক সময় ৪ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৩ ঘণ্টা এবং সর্বনিম্ন ৫ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট খেলার রেকর্ড রয়েছে।
লড়াই করতে করতে অনেক সময় হাফিয়ে গেলে বা আহত হয়ে পড়লে তখন গরম পানি দিয়ে মোরগের শরীরটা মুছে দেওয়া হয়। আহত হয়ে শরীরে ক্ষত হলে ক্ষতস্থানটা ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করে সেখানে ব্যান্ডেজ দিয়ে বেধে দেওয়া হয়। লড়াই শুরু হলে দু’টি মোরগ একজন আরেকজনকে কুপোকাত করার জন্য ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে পা দিয়ে সজোরে আঘাত করে।(মোরগের নিজস্ব ফ্লাইং কিকের স্টাইলগুলোকে মানুষ বিভিন্ন নামে চিত্রিত করে। যেমন- 'নিম', 'কড়ি', 'বাড়ি', 'ফাক', 'ছুট', 'কর্নার'- এগুলো বিভিন্ন আঘাতের নাম। ) তখন দেখা যায় অনেক মোরগের ঘাড় ভেঙে গেছে। আবার অনেক সময় চোখ অন্ধ হয়ে যায়। কারণ মোরগটি যখন পা দিয়ে লাথি মারে তখন তার পায়ের নখ শত্রু পক্ষের চোখে লাগলে চোখটা পড়ে যায়। সাধারণত যেসব মোরগ লড়াইয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না, তখন সে দৌঁড়ে পালায়। এভাবে তিনবার দৌঁড়ে সীমানা বাইরে চলে গেলে সে মোরগ পরাজিত হয়। অনেক সময় মোরগটা খুব জেদি থাকে, সে লড়াইও করে না, আবার পালিয়েও যায় না। মাঠেই মোরগটি বসে থাকে। নিয়মানুযায়ী কোনো মোরগ হাঁটু গেড়ে বসলে এবং সেই বসার সময় ১ মিনিট অতিক্রম করলে সেই মোরগটি পরাজিত
বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। আবার কখনো দেখা যায়, মোরগটি দৌঁড় দিচ্ছে না, বসেও পড়ছে না, এবং লড়াইও করছে না। সেক্ষেত্রে লড়াই না করা মোরগটিকে প্রতিদ্বন্দ্বী মোরগটি একের পর এক আক্রমণ করে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলে। এতে এক সময় তার মাথার নলটি নুয়ে পড়ে মাটির সঙ্গে লেগে থাকে। নিয়মানুযায়ী কোনো মোরগের মাথার নল যদি ১০ সেকেন্ডের বেশি নুয়ে থাকে, তাহলে সে পরাজিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এভাবে তিনবার হলে অন্য মোরগটিকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হয়।
>>পুরষ্কারঃ বিজয়ী মোরগের মালিকের জন্য রয়েছে নানা ধরনের পুরস্কার। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ খেলায় চ্যাম্পিয়ন মোরগের মালিককে ৬০-৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। রানার্সআপ পায় ৩০-৪০ হাজার টাকা।
বিষয়: বিবিধ
২৯০৮ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমনেরে আমার পালা মোরগটারে উপহার দিলাম। আমনের এই লেখায় আমার পেশাটারে শ্রদ্ধা জানাইল। আমি নিজেও মুরগী পালন করি, মুরগী চড়াই খাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন