হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১৪ মার্চ, ২০১৪, ১১:৫১:২৬ সকাল
হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প
সেই প্রাচীন কাল হতে মানুষ তাদের খাদ্য খেতে বা অন্যকোন গৃহ কাজে ব্যবহারের জন্য সর্ব প্রথম মাটির তৈজস পত্রের ব্যবহার শিখেছে ( যদিও ইতিহাস বলে প্রথম মানব হযরত আদম (আঃ) ও প্রথম মানবী হযরত হাওয়া (আঃ) কে আল্লাহ আগুন জ্বালানোর কৌশল, ভূমি আবাদ, কৃষিকাজ ও গৃহ শিল্প সংক্রান্ত বিষয় শিখিয়েছিলেন)। প্রথমে মানুষ রৌদ্রে শুকিয়ে পরে তা আরও টেকসই করার জন্য আগুনে পুড়িয়ে নানা রকমের নিত্যপ্রয়োজনীয় মাটির জিনিস ব্যবহার করত।
তাই আজও প্রাচীন স্থাপনা বা ঐতিহাসিক স্থান গুলিতে গেলে এখনো দেখা যায় নকশা করা ইট বা নানারকম নকশা আঁকা দেয়াল। যা সবই পোড়া মাটির কাজ।
কাল ক্রমে আজ এই আধুনিক যুগে এসেও মাটির বিভিন্ন জিনিস পত্রের প্রচলন ও ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়। আজকাল ড্রয়িংরুম ও বারান্দা সাজাতে নানারকম নকশা ওয়ালা টব , ফুলদানি বা অন্যান্য বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার হয়ে থাকে।অনেকে আবার মাটির সানকি ( প্লেট) এ ভাত খান। গ্রামে অনেক গৃহবধূ মাটির তৈরি পাতিলে ভাত রান্না করেন এবং অনেকে মাটির তৈরি পাতিলে গরমের দিন ভাত রাখেন, এতে রাত পর্যন্ত ভাত ভাল থাকে(অনেকটা ফ্রিজের কাজ করে) । আর গ্রামের আরেক ফ্রিজ নামে পরিচিত মাটির কলসের ব্যবহারের কথা তো সবারই জানা। গ্রামে গরমের দিন মাটির তৈরি কলস ও সরাই এ পানি রাখলে পানি ঠাণ্ডা থাকে( এর প্রধান কারণ মাটির তৈরি কলস বায়ুর আর্দ্রতা ধরে রাখে। আর এতে পানি ঠাণ্ডা থাকে)।
তবে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ সংকটের মুখে পড়েছে।
যদিও ঢাকা শহরে আমরা এই শিল্পের নানা রকম পসরা সাজিয়ে রাখতে দেখি তবুও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই পেশার সঙ্গে জড়িত অনেকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে শিল্পীরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
আমার জেলা শহর নওগাঁর বিভিন্ন থানায় এই শিল্পের ব্যাপক কারিগর আগে কাজ করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করত।আজও নওগাঁ জেলার
>পত্নীতলার-- নজিপুর পাল পাড়া, চকনিরখিন মোড়, পাটিচরা, পত্নীতলা বাজার।
>ধামইরহাট উপজেলার-- আড়ানগর, পলাশবাড়ী।
> মহাদেবপুর উপজেলার-- সুলতানপুর, শিবগঞ্জ, একডালা, দাউল, বারবাকপুর, খঞ্জনপুর, ক্ষুদ্র নারায়নপুর।
> সাপাহার উপজেলার-- সাপাহার, তিলনা।
> মান্দা উপজেলার--জোতবাজার, নবগ্রাম, প্রসাদপুর।
> বদলগাছী উপজেলার-- বালঘরা, আতায়কোলা।
> আত্রায় উপজেরার-- চাপড়া, পাচিপুর।
প্রভৃতি এলাকার মৃৎশিল্পীরা হাড়ি, পাতিল, কড়াই, মটকী, দইয়ের খাবলী, ফুলের টব, ডাবর, ঢাকনা, কাশা, খুঁটি, কলসি, মাটির ব্যাংক, হাতী, ঘোড়া, প্রদীপসহ বিভিন্ন ধরনের তৈরি নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র এবং খেলনা এমন কোন পরিবার ছিলনা যে তারা ব্যবহার করতো না। কালের আবর্তে আধুনিকতার ছেয়ায় মৃৎশিল্পীদের হাতে তৈরি ওইসব তৈজসপত্রের চাহিদা একেবারেই কমে গেছে।
>>> আর এই মৃৎশিল্পের সমস্যার প্রধান কারণ মাটি ও জ্বালানি সমস্যা মুখ্য। আগে মাঠে ঘাটে এমনিতেই ব্যাপক মাটি ও জ্বালানী পাওয়া যেত। এখন তা পাওয়া গেলেও চড়া দামে ক্রয় করতে হয়। এ কাজে পরিশ্রমও প্রচুর। শ্রমের তুলনায় ওইসব জিনিসপত্রের দাম পাওয়া যায় না। এছাড়া জিনিসপত্রের ব্যাপক প্রতিযোগিতা যেমন, প্লাস্টিক, সিলভার, এলুমিনিয়াম, কাঁসা ও ষ্টীলসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী মাটির তৈরি তৈজসপত্রের বিকল্প হিসাবে স্থান দখল করেছে। ফলে মৃৎশিল্পীদের হাতের তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদাও কম। তবে গুড় তৈরির পর রাখার জন্য মটকীর চাহিদা কিছুটা থাকলেও গত কয়েক বছর থেকে থান-গুড় তৈরিতে কৃষকেরা ঝুঁকে পড়ায় মটকীর চাহিদা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। তবে নিত্য ব্যবহার্য তৈজসপত্রের চাহিদা হ্রাস পেলেও দইয়ের খাবলী, ফুলের টবসহ নার্সারিতে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
>> মৃৎশিল্পীদের সমস্যা মিটানোর জন্য সরকারী ভাবে কোন ঋণ পাওয়া যায় না। জ্বালানী, মাটি সংকটসহ বিভিন্ন কারণে মৃৎ শিল্পের প্রসারতা দ্রুত হ্রাস পালদের পেশায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই পালরা এখন অনেকে দর্জি, সোনার কাজ, কেও বা রেডিওর মেকার, ঔষধ বিক্রেতা, বয়লার ব্যবসাসহ অনেকেই পছন্দমত পেশা নিয়ে নিজেদের নিয়োজিত করেছে।
>>> তাই আশা করি এই পেশার জন্য সরকারী ও বেসরকারি ভাবে নানা রকম উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশের তথা পৃথিবীর প্রাচীন এই পেশা ও শিল্পকে টিকে থাকতে সহায়তা করবেন।
বিষয়: বিবিধ
১৭৩৪ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এবার ঢাকা হতে বাবা মার জন্য ২ টি মাটির গ্লাস নিয়েছিলাম , তারা যে কই খুশি এতদিন পর মাটিরএকটা জিনিস পেয়ে
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পরে হাতের কাজ জমা দিতে এইসব মৃৎশিল্পও দেয়া হতো।
#একবার নানা বাড়ী বেড়াতে গিয়ে কি কান্ডটাই না ঘটিয়েছিলাম। পরে অবশ্য একটু খারাপও লেগেছিলো। আমার সমবয়সি একটা ভাগ্নে (আমার খালাত বোনের ছেলে)আছে। আমরা মামা-ভাগ্নেসহ আরো কয়েকজন মিলে খেলনা করতে গিয়ে কুমার বাড়ীর(যারা মৃৎশিল্পের কাজ করে)পাশে শুকাতে দেয়া অনেকগুলো জিনিস (খেলনা,কলসি,পাতিল)ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। পরে পালিয়ে আসলে নানাকে কুমারেরা আমাদের কথা বলে। অভিযোগ করার সাহস ছিলো না। কারণ আমার নানা বাড়ীর মানুষ প্রভাবশালী তালুকদার বংশ। যতোটুকু মনে পরে, নানা বাড়ী থেকে ওদের যা ক্ষতি হয়েছিলো তার চেয়ে একটু বেশীই অর্থ দিয়ে দিয়েছিলো। এইতো ৭-৮বছর আগেও দেখতাম ধান কাটার মৈাসুমে ওরা মাথায় করে মাটির তৈরী বিভিন্ন জিনিস নিয়ে আসত আর মহিলারা তাদের চিটা(ধান মারাই শেষে একটি অংশ থাকে, যাতে আরো কিছু ধান পাওয়া যায়) দিয়ে অনুমান করে মেপে একেকটা জিনিস রাখত।
আসলেই দুনিয়া যতোটা আধুনিতার স্পর্শ পাচ্ছে, প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে ঠিক তেতোটাই পরিবেশ বান্ধব জিনিসের বিলুপ্তি হচ্ছে।।।
ধন্যবাদ. . . . .আমার দেশের ঐতিহ্যের একটি দিক তুলে ধরার জন্য।
ধন্যবাদ তাদের ক্ষতিপূরণ দেবার জন্,
ভাল লাগল আপনার অতিত রমান্থন
ধন্যবাদ তাদের ক্ষতিপূরণ দেবার জন্,
ভাল লাগল আপনার অতিত রমান্থন
মন্তব্য করতে লগইন করুন