বিলুপ্তির পথে গরুর গাড়ি
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১১ নভেম্বর, ২০১৩, ১১:৫৭:৩৩ সকাল
বিলুপ্তির পথে গরুর গাড়ি
>>বিলুপ্তির পথে গরুর গাড়ি:
আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে
ধুত্তুর ধুত্তুর ধুত্তুর ধু সানাই বাজিয়ে
যাবো তোমায় শ্বশুর বাড়ি নিয়ে..................
জনপ্রিয় এ গানটি শোনা গেলেও গাড়ি আর গাড়ওয়ানদের চোখে আর পড়ে না।
তেমনি পল্লীগানের সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের গরুর গাড়িও চোখে পড়ে না।
পল্লী গানের সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া:
কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে .
যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়.................................
------------------------------------------
ওকি গাড়িয়াল ভাই
কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে
ওকি গাড়িয়াল ভাই…
হাঁকাও গাড়ি তুই চিল মারির বন্দর এ রে ।
সেই চিলমারী বন্দরের কদর এখন যেমন কমেলেও আব্বাস উদ্দিনের ওই গান গ্রামবাংলার মানুষের কাছে এখনও অত্যন্ত জনপ্রিয়, কিন্তু ওই গানের নায়ক গাড়িয়াল ভাই আর তার গরুর গাড়ি ডিজিটাল যুগে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই গান গ্রামবাংলার কিষাণ, রাখাল বালকদের কন্ঠে এখনও শোনা গেলেও গরুর গাড়ি তেমন একটা চোখে পড়ে না।
>>গরুর গাড়ি ও বাংলার গ্রামীণ সমাজঃ
@@পরিবহনঃ পায়ে হাঁটার যুগের অবসান হওয়ার পর মানুষ যখন পশুকে যোগাযোগের মাধ্যমে হিসাবে ব্যবহার করতে শিখলো তখন ঘোড়া এবং গরুর গাড়িই হয়ে উঠেছিল স্থল পথের যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যমে।এক সময় গরুর গাড়ীকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজনরা আভিজাত্য পরিবহন হিসেবে ব্যবহার করতো এবং গরুর গাড়িতে সাধারণ মানুষ এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতো।গরুর গাড়ি ব্যবহার হতো মালামাল পরিবহণ, ব্যবসা, ফসল ঘরে তোলা বা বাজারজাতকরণের জন্য।জমির ধান কাটার পর সেই ধান আনা হতো গরুর গাড়িতে।এক সময় গ্রামবাংলায় কৃষকের ঘরে ঘরে শোভা পেত নানা ডিজাইনের গরুর গাড়ি। তারা ভাড়ায় এসব গরুর গাড়ি অন্যদের মালামাল পরিবহণের জন্য ধার দিত।
@@ আমার কিছু স্মৃতিঃ গ্রামীণ সমাজে আধুনিক যন্ত্র কৌশলের পাওয়ার টিলার আসার আগে আগে আমাদের ছিল নাঙল দিয়ে চাষাবাদ। এই জন্য আমাদের ছিল ১২-১৫ টা নাঙল/ হাল। আর এই জন্য ছিল ১০-১৫ জোড়া গরু এবং ২ জোড়া মহিষ। এদের মারধ্যমে নাঙল ও গরু দিয়ে করতে হত চাষাবাদ। আর ধান কাটার পর জমি হতে ধান আনা নেওয়ার জন্য ২ টি মহিষের গাড়ি ও ১ টি গরুর গাড়ি। আর ধান বিক্রয় এর জন্য থানা শহরে ধান নিয়ে যেতে হত। কাদা ভেঙ্গে গাড়ি নিয়ে যেতে কই যে কষ্ট হত তা বলে বোঝানো যাবে না। আমার মনে আছে আমাদের অনেক বড় বড় ২ জোড়া মহিষ থাকত সবসময়।আর মাঝে মাঝে চোরের উৎপাত হত। একবার তো ১ জোড়া মহিষ মাটির গোয়ালঘরের দেয়ালে সিং কেটে( দেয়াল কেটে চুরি করাকে গ্রামে বলে সিং কাটা) নিয়েয় গেল। এর পর বাবা রাগে গোয়ালঘরের দেয়াল ইট দিয়ে ওয়াল দিয়ে দিলেন।
@@ বিয়েঃ আগে বিয়ে করতে যাওয়ার সময় গ্রামের বর পক্ষের জন্য গরুর গাড়ি ছিল একমাত্র ভরসা।বিয়েতে বর-কনে উভয় পক্ষই গরুর গলায় ঘন্টা লাগিয়ে ছই/টপর/টোপর উঠিয়ে নানা রঙে গরু ও গাড়ি সাজিয়ে গরুর গলায় ঘুগরা ও ফুলের মালা পরিয়ে বর-কনে আনা নেয়া করতো। গরুর গলার ঘুগরার বাজনা আর সারিবদ্ধ গরুরগাড়ি সে এক অপরূপ শোভা। তা দেখতে গ্রামের নারী-পুরুষরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতো রাস্তার ধারে। এমন দৃশ্যের কথা এখন ভাবাই যায় না।এখনও মাঝে মধ্যে কোন কোন জায়গায় পণ্য পরিবহনের জন্য গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হলেও বিবাহে বর-কনের পরিবহনের জন্য গরুর গাড়ির কথা চিন্তাই করা যায় না। অনেকের কাছেই এটি যেন অভদ্রতা এবং গেঁয়ো।
@@ আমার কিছু স্মৃতিঃ আমার মেজ বোনের বিয়ে। বর কলেজের প্রভাষক। ওরা ২০ টি গরু মহিষের গাড়ি নিয়ে ১০০+ জন বিয়ে করতে এসেছে। বরের বাড়ি আমাদের বাড়ি হতে ২০ কিলোমিটার দূরে। বিশাল বহর ওদের। বিয়ে করে কনে নিয়ে ওরা চলে গেল। পরের দিন আমরা কনে আনতে যাব বরের বাড়ি। আব্বা আমাদের গ্রাম ও আশে পাশের গ্রাম হতে ৩০ টা গরু ও মহিষের গাড়ি জোগাড় করে ৮০+ জনকে পাঠাল আমার বোনকে আনতে। তখন আমি ক্লাস ৩-৪ এ পড়ি। আমার মনে আছে আমাদের বড় মোষের গাড়ি ছিল সবার আগে। আমি ও আমার ২-৩ জন কাজিন ও এক আপা ছিলাম ঐ গাড়িতে। বিভিন্ন গ্রামের মধ্যে দিয়ে গাড়ির বহর যাচ্ছে আর ঐ গ্রামের সকলে রাস্তায় বের হয়ে দেখছে আমাদের। কেও কেও জিঙ্গেস করছে কোথায় আমরা যাচ্ছি।
@@ নায়েরঃ গ্রামের মহিলারা বাপের বাড়ি নায়ের/ বেড়াতে গেলে সে সময় একমাত্র বাহন ছিল টোপর ওলা গরুর গাড়ি। এ ছাড়া অন্য আত্মীয়দের বাড়ি বেড়াতে যেত গরুর গাড়ি সাজিয়ে নিয়ে। টোপরের সামনে পর্দা ফেলে বা দিয়ে গাড়ওয়ান হতে আলাদা হয়ে যেতেন মহিলারা, যেন বেগনা পুরুষ ওদের দেখে না ফেলে।
@@ আমার স্মৃতিঃ মা তাঁর বাপের বাড়ি( মানে আমার নানা বাড়ি, আমার নানা ১৫ বছর আগে মারা গেছেন, আল্লাহ তাকে শান্তি দিন) যেতেন মাঝে মাঝে । আর আমি ছোট বলে আমি মাস্ট যেতাম মার সাথে। তবে আমার স্কুল খোলা থাকলে যেতেন না। কারন আমার লিখা পড়ার ক্ষতি হবে। এজন্য গরমের ছুটি পড়লেই মাস্ট যেতাম নানা বাড়ি। মোষের গাড়ি নিয়ে আমাদের কাজের লোক আমাদের সকাল সকাল আমাদের নামিয়ে দিয়ে আসত। পৌছতে পৌছতে দুপুর। আমাদের রেখে দুপুরে খেয়ে আবার খালি গাড়ি নিয়ে গাড়োয়ান চলে যেত। আবার যেদিন আমরা যেতাম ঐদিন নানা গাড়ি দিয়ে আমাদের রেখে আসতেন।
@@ প্রতিযোগিতাঃ এক সময় গ্রাম বাংলায় নতুন ধান কাটার নবান্নের উৎসবের সময় গরুর গাড়ির প্রতিযোগিতার খেলা। গ্রামের মানুষের কাছে নির্মল আনন্দের উপকরণ এই খেলে। কার গাড়ি আগে যাবে এই প্রতিযোগিতা হত খোলা মাঠে। এই খেলাটিও হারিয়ে গেছে কালের আবর্তে।
>> শেষ কথাঃ মানুষ এক সময় যা কল্পনা করেনি তাই এখন পাচ্ছে হাতের কাছে। ইট-পাথরের মত মানুষও হয়ে পড়ছে যান্ত্রিক।মানুষ তার নিজস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। তারই ধারাবাহিকতায় এক সময়ের ব্যাপক জনপ্রিয় গ্রাম-বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য এবং যোগাযোগ ও মালামাল বহনের প্রধান বাহন গরুর গাড়ি কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাবার পথে। যান্ত্রিক আবিস্কার ও কৃষকদের মাঝে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগার কারণে গরুর গাড়ির স্থান দখল করে নিয়েছে ভ্যান, বাস, অটোরিকশা, নছিমন, করিমন, ভুটভুটি ইত্যাদি। কৃষকসহ সর্ব শ্রেণীর মানুষ এখন যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের জন্য এ সকল যান্ত্রিক পরিবহণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।এক সময় গ্রাম-বাংলায় কৃষকের ঘরে ঘরে শোভা পেত নানা ধরনের গরুর গাড়ি।এখন আর গ্রাম গঞ্জে আগের মতো গরুর গাড়ি চোখে পড়ে না।এ কারণে শহরের ছেলে- মেয়েরা দূরের কথা, বর্তমানে গ্রামের অনেক ছেলে- মেয়েরাও গরুর গাড়ির শব্দটির সাথে পরিচিত নয়। বেশির ভাগ রাস্তাঘাট পাকা হওয়ার কারণে গরুর গাড়ী আর চালানো সম্ভব হয়না। তবে মাঠ থেকে ধান আনার ক্ষেত্রে বা গ্রামের দূর্গম এলাকায় ও রাস্তা ঘাট ভালো না থাকায় গরুর গাড়ি ছাড়া ওখান থেকে জিনিসপত্র আনা নেওয়া করা সম্ভব হয়না। এ কারণে গরুর গাড়ির উপরই তাদের ভরসা। তবে রাস্তা ঘাটের উন্নয়ন হলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই গরু গাড়ী গুলো আগামী প্রজন্ম হয়তো আর দেখতে পাবে না। এমন এক সময় আসবে যখন বাংলাদেশে আর কোন গরুর গাড়ি অবশিষ্ট থাকবে না। গরুর গাড়ি হবে শুধুই ইতিহাস।
--------------------------------------------------------------
বিষয়: বিবিধ
৩৩৫৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন