রমজান মাসের কিছু আমল, যা আমাদের জীবনে অতিব প্রয়োজন
লিখেছেন লিখেছেন মনিরা ১৬ জুলাই, ২০১৩, ০৫:০৭:৪৭ বিকাল
প্রতি বছর রোযার মাস আসে আবার চলে যায়। আমরা অনেকে রোযা পালন করি, ঈদ উদযাপন করি, আবার পূর্বের জীবন যাত্রায় ফিরে আসি। রোযা ও রোযার মাস আমাদের জীবনে কোন পরিবর্তন আনে না। কোন প্রভাব ফেলে না। প্রকৃতপক্ষে আমরা নিজেরাই পরিবর্তন আনতে চাই না। আমরাই আমাদের জীবনের দীনী পরিবর্তনে অনিচ্ছুক। না হলে ভেবে দেখুন!
রোযার মাসে কিন্তু আপনার জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটেছিল কিন্তু সেই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা আমরা পরে রক্ষা করি না। আর বারংবার এ রকম হতে থাকলে আসলে রোযার মুখ্য উদ্দেশ্য নষ্ট হয়। রোযার প্রকৃত সওয়াব অর্জন হয় না। কারণ এই প্রকার লোকেরা যখন রোযার মাস আসে তখন শুরুতেই ভেবে নেয় যে, এটা রোযার সময় তাই একটু ভাল হয়ে থাকতে হবে, কিছুটা সংযত হতে হবে, রোযা শেষ হলে পূর্বে যেমন ছিলাম তেমনই থাকবো।
অতএব বুঝা গেল, তার সততায় সে আন্তরিক নয়, খাঁটি নয়। কারণ সে এই মাসের পর পুনরায় মন্দের দিকে ফিরে যাওয়ার গোপন ইচ্ছা রাখে। বলুন তো আল্লাহ কি আপনার এই গোপন নিয়তটির খবর জানেন না? অথচ আল্লাহ খাঁটি ভাবে কেবল তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই ইবাদত করতে আদেশ করেছেন। আল্লাহ বলেন: (তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে একনিষ্ঠ ভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং নামায কায়েম করতে ও যাকাত প্রদান করতে, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম।) [বাইয়্যিনাহ/৫]
নিম্নে এই মাসে কিছু চমৎকার সৎ আমল করার এবং অসৎ আমল বর্জন করার তালিকা দেয়া হয়েছে, যা পালন করলে মুসলিম ভাই যেমন অঢেল নেকী অর্জন করার পাশাপাশি এগুলোর মাধ্যমে তার জীবনে পরিবর্তনও আসতে পারে। আছেন কি কোন সত্যবাদী ও সাহসী ইসলাম প্রিয় ভাই যিনি আল্লাহর উদ্দেশ্যে এই রমযান মাসের রুটিন মেনে অনেক হারাম কাজ ছেড়ে সঠিক পথের পথিক হবেন। নিন্মোক্ত কর্মসূচীগুলো বাস্তবায়ন করে আল্লাহর রহমতে এই রামাযানেই জীবনকে বদলে দয়া সম্ভব:
১) কুরআন পড়তে শেখা: কত দুর্ভাগা সে, যে বাংলা, ইংরেজি সহ অনেক ভাষা জানে কিন্তু আল্লাহর বাণী কুরআন পড়তে জানে না। কুরআন পড়াতে পারে এই রকম এক ব্যক্তির নিকট চাইলে আপনি এক মাসে কুরআন পড়া শিখতে পারেন। বর্ণ পরিচয় ৭ টি ক্লাস + উচ্চারণ ও বানান প্রক্রিয়া ৭ টি ক্লাস + রিডিং ৭ টি ক্লাস + বিবিধ ৭ = ২৮ টি ক্লাস।
২) কুরআন খতম: প্রতি ওয়াক্তে আযানের সাথে সাথে মসজিদে আসলে সুন্নত পড়ার পরেও দশ মিনিট সময় পাওয়া যায়। এই ভাবে পাঁচ ওয়াক্তে ৫০ মিনিট। আর ৫০ মিনিটে সাধারণ ভাবে এক পারা তিলাওয়াত ভাল ভাবে সম্ভব। আর একটু সময় দিলে অর্থ সহ কুরআন খতমও হতে পারে।
৩) অতিরিক্ত ৩০টি রোযার সওয়াব: সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, রোযাদারকে ইফতার করালে একটি রোযার সওয়াব পাওয়া যায়; অথচ ইফতার কারীর কোন নেকী কম হয় না। মানুষ অতিরিক্ত আয়োজন ও খরচ ছাড়াই ইফতার করার সময় প্রতিদিন এক ব্যক্তিকে নিজ ইফতারীতে শরীক করে এই সওয়াবের অধিকারী হতে পারে।
৪) একটি হজ্জ ও উমরার নেকী: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি জামায়াতের সাথে ফজরের নামায আদায় করলো, অতঃপর সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর যিকির-আযকার করলো, তার পর দুই রাকাআত নামায আদায় করলো, সে একটি হজ্জ ও উমরার নেকী পেল।’’ [ তিরমিযী ] এই সুযোগটি গ্রহণ করা কতই না সুন্দর!
৫) নেশা পরিত্যাগ করা: বিড়ি, সিগারেট, গুল ও তামাক সেবন যেমন শরীয়তে হারাম, তেমন সমাজেও অপছন্দনীয়। এসবের আসক্ত লোকেরা রোযাবস্থায় এসব সেবন করে না। যে ব্যক্তি এ সব এক দিন ছেড়ে থাকতে পারে সে দুই দিন ও এক সপ্তাহও না সেবন করে থাকতে পারে। এসব নেশা ছাড়াতে রোযা হতে পারে একটি উত্তম মাধ্যম।
৬) গান-বাজনা পরিত্যাগ: গান-বাজনা শুনতে অভ্যস্ত লোকেরা রোযার মাসে কুরআন তিলাওয়াত তথা ওয়ায-নসীহতের ক্যাসেট ও সিডি শুনার মাধ্যমে এই হারাম অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারে।
৭) প্রকৃত নামাযী হওয়া: রামযান ছাড়া যারা অন্যান্য মাসে শুধু জুমুআর নামায পড়ে কিংবা পাঁচ ওয়াক্ত নামায ভালভাবে জামাতের সহিত পড়তে অলসতা করে কিংবা ফজরের নামাযে অলসতা করে, তারা রমযান মাসে সমস্ত নামায সঠিক সময়ে আদায় করার অভ্যাসের মাধ্যমে প্রকৃত নামাযী হতে পারেন।
৮) যাকাত প্রদান: যাকাত প্রদানে অলস বা বছরে কোন এক সময় নির্ধারণে অলস ব্যক্তি এই মাসটি নির্বাচন করতে পারেন। ফযীলতের মাস হিসাবে অধিক নেকীর ও আশা করা যায়।
৯) দানের অভ্যাস: যেহেতু রোযার মাসে সওয়াব বেশী তাই প্রতিদিন কিংবা জুমআর দিন কিংবা শেষ দশকে সাধ্যমত ফকীর-মিসকিন ও অভাবীদের মাঝে নিজ সম্পদের কিয়দংশ প্রদান করা কতই না সুন্দর অভ্যাস!
১০) পরিবারের খেয়াল: আমরা অনেকে সারা বছর কর্ম ব্যস্ততায় ছুটাছুটি করি। পরিবারকে সময় দিতে পারি না। আমরা এই মাসটি তাদের মাঝে থেকে যেমন সহজ ভাবে রোযা করতে পারি তেমন তাদের ভালবাসা ও তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারি।
প্রিয় ভাই! বরকত পূর্ণ রমযান মাসে এই রকম কিছু সৎ আমল করার দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে আমরা নিজের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারি, আল্লাহর পথে ফিরে যেতে পারি। নচেৎ প্রতি বছর রোযা আসবে আবার চলে যাবে, আর আমরা পূর্বের মতই থেকে যাবো! এটাই কি রোযার আসল উদ্দেশ্য? হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে:
‘‘যে ব্যক্তি ভাল কাজের জন্যে দৃঢ় সংকল্প করে কিন্তু তা করতে পারে না, তবুও আল্লাহ তার জন্যে পরিপূর্ণ নেকী লেখেন; আর দৃঢ় সংকল্পের পর সে যদি তা করে, তবে আল্লাহ নিজের কাছে তার জন্য দশ নেকী থেকে সাতশ’ পর্যন্ত বরং তার থেকেও বেশী নেকী লেখেন।’’ [বুখারী এবং মুসলিম]
মাহে রামাযান আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে একটি বরকতময় মাস। এ মাসকে আল্লাহ্ তা’আলা খুবই ভালবাসেন। এমাসের মর্যাদায় তিনি তাঁর রহমতের ভা-ার উন্মোচন করে দেন। করুণা ও নে‘য়ামতের আধার জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেন। শাস্তি ও গযবের আবাস জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেন। আর মানুষের চির শত্রু প্রকাশ্য দুশমন শয়তানকে শৃঙ্খলবদ্ধ করেন। যাতে করে মানুষ তাঁর রহমত, করুণা ও মাগফিরাত লাভে ধন্য হয়। জান্নাতের কর্ম করে জান্নাতের অধিবাসী হয় আর জাহান্নামকে ভয় করে ও শয়তান থেকে দূরে থাকে।
কিন্তু আফসোসের বিষয় হলেও সত্য কথা যে, বর্তমানে মানুষ মাহে রামাযানে ছিয়াম আদায় করে ঠিকই কিন্তু তাদের ছিয়াম তাদেরকে পরিশুদ্ধ করতে পারে না। এ মাসে তাদের অবস্থা দেখলে বুঝা যায়না যে, তারা কি সত্যই আল্লাহর আনুগত্য করছে না শয়তানের আনুগত্য করছে। রোজাদারের সংখ্যা অগণিত। কিন্তু তাদের মাঝে জান্নাতী কর্মের প্রবণতা খুবই কম। আল্লাহর জান্নাতের খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করার অনীহাই যেন বেশী। আর জাহান্নামের বন্ধ দরজাকে খোলার জন্য করাঘাত করতেই বেশী ব্যস্ত। শয়তানকে শৃঙ্খলবদ্ধ করা হয়েছে সত্য কিন্তু আজ মানুষই যে বড় শয়তান সেজে বসে আছে। শয়তানী কাজ-কর্ম করার জন্য শয়তানের প্ররোচনার দরকার নেই। তাই তো কিছু লোকের কার্যকলাপ দেখে শয়তানও তাদের থেকে লজ্জাবোধ করে।
রমাযান মাসে মানুষ সাধারণত: যে সমস্ত শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয় নিন্মে তার কিছু বিবরণ করা হল:
১) রাত জাগা ও নিদ্রায় দিন কাটানো: এ অভ্যাসের কারণে বান্দা বিভিন্ন ধরণের কল্যাণ থেকে মাহরূম হয়ে যায়। কখনো এর কারণে জামাতের সাথে সালাত ছুটে যায় বা সালাতের সময়ও পার হয়ে যায়।
২) রামাযানে খাদ্য-পানীয়তে বাড়াবাড়ি করা: অনেক মানুষের কাছে রামাযান যেন খানাপিনার ব্যাপারে প্রতিযোগিতার মওসুমে রূপান্তরিত হয়েছে। অথচ রামাযান গরীব-দুঃখীর অভাব ও দুঃখ অনটন অনুধাবন করার মওসুম।
৩) আগে ভাগে সাহুর খেয়ে ফেলা: অনেক মানুষ আগেভাগে সাহুর খেয়ে ফেলে। রাত বারোটা বা একটার দিকে সাহুর খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ফলে সে কয়েক ধরণের ত্রুটি করে। যেমন, সে সুন্নাত বিরোধী কাজ করে, শেষ রাতে সাহুর খাওয়ার বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। আর যদি তার ফজরের ফরয ছালাত ছুটে যায় তবে আরও বড় ধরণের অপরাধ সে করে বসল। রাসূলুল্লাহ বলেছেন”- তোমরা সাহুর খাও কারণ সাহুরে বরকত রয়েছে।” (বুখারী, মুসলিম) অন্য হাদীছে বলা হয়েছে: ‘‘আমাদের ও আহলুল কিতাব (ইহুদী-খ্রিষ্টানদের) ছিয়ামের মাঝে পার্থক্য হল সহুর খাওয়া।” অর্থাৎ তারা সাহুর না খেয়ে ছিয়াম পালন করে আর আমরা সাহুর খেয়ে ছিয়াম পালন করি। (মুসলিম হাদীছ নং ১০৯৬, তিরমিযী হাদীছ নং ৭০৮)।
৪) দেরী করে ইফতার করা: অনেক মানুষ সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও অধিক সতর্কতার যুক্তিতে দুতিন মিনিট দেরীতে ইফতার করে। এটা শয়তানের ওয়াসওয়াসার অনুসরণ ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘ততদিন যাবত আমার উম্মত কল্যাণের মাঝে থাকবে যতদিন আগেভাগে (সূর্য ডুবার সাথে সাথে) ইফতার করবে।” (সহীহ বুখারী)
হাদীছে কুদসীতে এসেছে:” আল্লাহ বলেছেন বান্দদের মধ্যে ঐ বান্দা আমার নিকট অধিক প্রিয় যে আগে ভাগে ইফতার করে।” (তিরমিযী)
৫) খারাপ চরিত্র ও অসৎ ব্যবহার করা: অনেক রোজাদার রোজা রেখেও দ্রুত রেগে যায়, অসৎ আচরণ করে, মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। মিথ্যা, গীবত ও চুগলখোরিতে লিপ্ত হয়। অথচ এরূপ করা ছিয়ামের উপকারিতা ও হিকমতের পরিপন্থী। এর মাধ্যমে ছিয়ামের ছওয়াব বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে ছিয়াম ব্যক্তিকে পবিত্র করে, তার চরিত্রকে সুন্দর করে, মুসলিম ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে ছবর-ধৈর্য, দয়া-অনুকম্পা ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: ‘‘যখন তোমাদের কারো ছিয়ামের দিন উপস্থিত হয় তখন সে যেন কোন অশ্লীল কথা ও কাজ না করে এবং অহেতুক উঁচু কণ্ঠে কথা না বলে অর্থাৎ ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা তার সহিত লড়াই-ঝগড়া করতে আসে তবে সে যেন তাকে বলে দেয়, আমি রোযা আছি।।” (বুখারী মুসলিম)
অন্য একটি হাদীছে এসেছেন “যে ব্যক্তি ছিয়ামরত অবস্থায় মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করে না, আল্লাহর কোনই দরকার নেই তার পানাহার ত্যাগ করাতে।” (বুখারী)
৬) রোযার ফযীলত ও তার বিধি-বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতা: রোযাদারদের অনেকেই রোযার ফযীলত, মাসআলা-মাসায়েল ও বিধি-বিধান সম্পর্কে কোনই জ্ঞান রাখে না। রোযা অবস্থায় কি করণীয় কি বর্জনীয়, কি করলে ছিয়াম হালকা হয়ে যায়, কিসে ছিয়াম নষ্ট হয়ে যায়, এ মাসে কোন ধরণের কাজ আল্লাহ্ পসন্দ করেন সে সম্পর্কে মোটেও জ্ঞান রাখে না বা জ্ঞান রাখার প্রয়োজন অনুভব করে না।
৭) রাতে স্বপ্নদোষ হলে গোসল করতে দেরী করা: অনেকে লজ্জা বশত: রাতে গোসল করে না। আর এভাবে ফজর ছালাত পরিত্যাগ করে বা সূর্যোদয়ের পর গোসল করে ফজর পড়ে। এটা নিতান্তই অজ্ঞতা ও গুনাহর কাজ। স্বপ্নদোষ হলে বা স্বামী-স্ত্রী মিলনের মাধ্যমে নাপাক হলে, নাপাকী অবস্থাতেই সাহুর খাওয়া যায় এবং রোযার নিয়ত করা যায়। তবে অবশ্যই ফযর ছালাতের আগে গোসল করতে হবে এবং ছালাত আদায় করতে হবে।
৮) মুখে উচ্চারণ করে রোযার নিয়ত পাঠ করাঃ ছিয়ামের জন্য নিয়ত বা সংকল্প করা জরুরী। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “যে ব্যক্তি (প্রথম) ফজরের পূর্বে নিয়ত করবেনা তার ছিয়াম হবে না।” (নাসাঈ) নিয়্যাহ-আরবী শব্দ, উহার শাব্দিক অর্থ ইচ্ছা, সংকল্প ও মনে মনে কিছুর আকাঙ্খা রাখা। উহা অন্তরের কাজ (মুখের নয়)। (দেখুন লিসানুল আরব, ১৮ খ- ৩৪৩ পৃঃ) শরীয়ত আমাদেরকে প্রতিটি ইবাদতের জন্য নিয়ত করতে বলেছে, কোথাও নিয়ত মুখে বলতে বলা হয় নি। অতএব নাওয়াইতু শব্দের মাধ্যমে নিয়ত বলা একটি অহেতুক কাজ। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে জঘন্যতম বিদআত। কেননা এই অহেতুক কাজটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), ছাহাবাহবর্গ, তাবেঈন, আত্বাউত তাবেঈন ও চার ইমামের কেউ-ই করেন নি। এ মর্মে কুরআন-সুন্নাতে কোন দলীলও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
৯) তারাবীহ ছালাত আদায় না করা: তারাবীহ ছালাত আদায় না করে কোন অনর্থক কাজে লিপ্ত থাকা উচিত নয়। বিশেষ করে তারাবীহ নামায না পড়ে ডিশ, ভিডিও, সিডি প্রভৃতির মাধ্যমে নাটক, সিনেমা ও অশ্লীল ছবি দেখে বা তাস, গুটি বোর্ড প্রভৃতি অনর্থক খেলা খেলে বা গল্প-গুজব করে সময় অতিবাহিত করা আরও বড় ধরণের অপরাধ ও পাপ।
১০) রামাযানের প্রথম দিকে ইবাদতে তৎপরতা প্রকাশ আর শেষের দিকে অলস হয়ে যাওয়া: যার ফলে দেখা যায় রামাযান শুরু হলে নামাযীর সংখ্যা বা তারাবীতে মুছল্লীর সংখ্যায় মসজিদ পরিপূর্ণ হয়ে যায়। দিন গড়াতে থাকলে ধীরে ধীরে এ সংখ্যায় হ্রাস পেতে থাকে। অথচ এরূপ করা সুন্নাতে রাসূলের বিপরীত কাজ। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের শেষ দশকের তুলনায় ইবাদত-বন্দেগীতে এত বেশী তৎতপরতা অন্য দিনে দেখাতেন না।
১১) রামাযান শেষ হলে মসজিদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা: কিছু রোজাদার আছে রামাযান এলে ছালাত-ছিয়ামে ভালই অগ্রসর হয়। কিন্তু রামাযান শেষ হয়ে গেলে তাদেরকে আর মসজিদে খুঁজে পাওয়া যায় না। দুনিয়াদারীতে তারা এতই ব্যস্ত যে, তাদেরকে মসজিদে খুব কমই দেখা যায়। অথচ মসজিদের সাথে সম্পর্ক রাখা ঈমানের বাহ্যিক পরিচয় ও মুনাফেক্বী থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্যতম উপায়। আল্লাহ্ সবাইকে হেদায়াত করুন।
১২) রোযা রেখে ছালাত আদায় না করা বা রামাযান চলে গেলে নামাযও ছেড়ে দেয়া: এটা আরও বড় অপরাধ; বরং এটা কুফরী। কেননা ঈমানের পর নামায ইসলামের সবচেয়ে বড় রোকন। নামায হচ্ছে ঈমান ও কুফরীর বাহ্যিক মানদ-। রোযার স্থান নামাযের অনেক পরে। কিয়ামত দিবসে সর্ব প্রথম নামায সম্পর্কেই প্রশ্ন করা হবে। যদি নামায গ্রহণীয় হয় তবে অন্যান্য আমল গ্রহণীয় হবে। আর নামায প্রত্যাখ্যাত হলে অন্যান্য আমলও প্রত্যাখ্যাত হবে।
১৩) রামাযানমাসের ব্যাপারে প্রচলিত কতিপয় জঈফ ও জাল হাদীছ :
১. “ছিয়ামকারীর নিদ্রা ইবাদত।”
২. “তোমরা রোযা রাখ সুস্থ থাকবে।”
৩. “যে ব্যক্তি বিনা ওজরে রামাযানের একটি রোযা পরিত্যাগ করবে, সারা বছরও যদি সে ছিয়াম রাখে তবু তার জন্য যথেষ্ট হবে না।”
৪. “রামাযানে প্রথম দশক রহমত, পরবর্তী দশক মাগফিরাত ও শেষ দশক জাহান্নাম থেকে মুক্তি।”
৫. “রামাযান মাসে একটি ফরয ইবাদত অন্য মাসের সত্তরটি ফরযের বরাবর। আর একটি নফল ইবাদত অন্য মাসের একটি ফরযের বরাবর।’’
৬. “মানুষ যদি জানতো রামাযানে কি পরিমাণ ছওয়াব রয়েছে, তবে আমার উম্মতের সবাই কামনা করতো সারা বছরই রামাযান থাক।”
৭. “প্রত্যেক বস্তুর যাকাত আছে, শরীরের যাকাত হচ্ছে ছিয়াম।”
৮. “নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা রামাযান মাসের প্রথম দিনের সাকাল বেলা সমস্ত মুসলমানকে ক্ষমা করে দেন।”
৯. “রোজাদারের প্রতিটি লোমকূপ তাসবীহ্ পাঠ করে। আর রোযা পালনকারী নারী পুরুষের জন্য কিয়ামত দিবসে আরশের নীচে স্বর্ণের দস্তরখানা বিছানো হবে।”
১০. “নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা রামাযান মাসের প্রত্যেক দিন ৬ লক্ষ এমন মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত ঘোষণা করেন যাদের জন্য জাহান্নাম আবশ্যক হয়ে গিয়েছিল।”
এছাড়া হাদীসের নামে আরও বিভিন্ন বানোয়াট ও দুর্বল কথা-বার্তা মানুষের মাঝে চালু আছে। সেই সাথে অনেক শরীয়ত বিরোধী কথা ও কাজে মানুষ এ পবিত্র মাসে লিপ্ত হয়। আল্লাহর কাছে আমরা দু‘আ করি তিনি যেন আমাদেরকে মাহে রামাযানে কুরআন-সুন্নাহ্ তথা শরীয়ত বর্জিত ও আল্লাহর অপসন্দনীয় গুনাহের বিষয়গুলো থেকে দূরে রাখেন। আর ফযীলতপূর্ণ আমল সমূহ বেশী করে আদায় করে দুনিয়াতে সৌভাগ্যশালী ও আখেরাতে মুক্তিপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে রাইয়্যান নামক দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করান।
রহমতের মাস, বরকতের মাস, কল্যাণের মাস, ক্ষমার মাস, কুরআনের মাস মাহে রামাযান আমাদের মাঝে উপস্থিত। এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা কি রামাযানের এই মহামূল্যবান সময়গুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছি? আসুন না একটি তালিকা তৈরি করি যেন এই মাসের প্রতিটি মুহূর্তে নেকী কুড়িয়ে আখেরাতের জন্য সঞ্চয় করে রাখতে পারি।
ফজর পূর্বে :
(১) আল্লাহর দরবারে তাওবা-ইস্তেগফার ও দুয়া: কারণ মহান আল্লাহ প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়াংশে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করে বলেন: “কে আছে আমার কাছে দু’আকারী, আমি তার দুআ কবুল করবো”। (মুসলিম)
(২) সাহরী ভক্ষণ : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : “সাহরী খাও। কারণ সাহরীতে বরকত আছে”। (বুখারী মুসলিম)
ফজর হওয়ার পর :
(১) ফজরের সুন্নত আদায়: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : “ফজরের দুই রাকাআত সুন্নত দুনিয়া ও দুনিয়ার মাঝে যা আছে তার থেকে উত্তম”। (মুসলিম)
(২) ইকামত পর্যন্ত দু’আ ও যিকিরে মশগুল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ‘‘আযান ও ইকামতের মাঝে দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না”। (আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ) (
৩) ফজরের নামায আদায়: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ‘‘তারা যদি ইশা ও ফজরের ফযীলত জানতো, তো হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তাতে উপস্থিত হত”। (বুখারী ও মুসলিম)
(৪) সূর্যোদয় পর্যন্ত সকালে পঠিতব্য দুআ-যিকর ও কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে মসজিদে অবস্থান: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজর নামাযের পর নিজ স্থানেই সূর্যোদয় পর্যন্ত অবস্থান করতেন”। (মুসলিম)
(৫) সূর্যোদয়েরে পর দুই রাকাআত নামায: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ‘‘যে ব্যক্তি জামায়াতের সহিত ফজরের নামায পড়লো, অতঃপর সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে আল্লাহর যিকর করলো, তারপর দুই রাকাআত নামায আদায় করলো, তার জন্য এটা একটি পূর্ণ হজ্জ ও উমরার মত’’। (তিরমিযী)
(৬) নিজ নিজ কর্মে মনোযোগ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “নিজ হাতের কর্ম দ্বারা উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাবার নেই”। (বুখারী)
যোহরের সময় :
(১) জামায়াতের সহিত জহরের নামায আদায়। অতঃপর কিছুক্ষণ কুরআন কিংবা অন্যান্য দীনী বই পাঠ।
(২) আসর পর্যন্ত বিশ্রাম, কারণ তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: (তোমার উপর তোমার শরীরেরও হক আছে)।
আসরের সময় :
(১) আসরের নামায জামাতের সাথে সম্পাদন: অতঃপর ইমাম হলে নামাযীদের উদ্দেশ্যে দারস প্রদান কিংবা দারস শ্রবণ কিংবা ওয়ায নসীহতের ক্যাসেট ও সিডির মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :”যে ব্যক্তি মসজিদে ভাল কিছু শিক্ষা নিতে কিংবা শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে গেল, সে পূর্ণ এক হজ্জের সমান নেকী পেল”। (ত্ববারানী)
(২) পরিবারের সদস্যদের সাথে ইফতারির আয়োজনে সহায়তা করা: এর মাধ্যমে যেমন কাজের চাপ হাল্কা হয় তেমন পরিবারের সাথে ভালবাসাও বৃদ্ধি পায়।
মাগরিবের সময় :
১) ইফতারি করা এবং এই দুআ পাঠ করা: “যাহাবায্ যামাউ ওয়াব্ তাল্লাতিল্ উরূকু ওয়া সাবাতাল্ আজরু ইন্শাআল্লাহু তাআলা”। অর্থ: পিপাষা নিবারিত হল, রগ-রেশা সিক্ত হল এবং আল্লাহ চাইলে সওয়াব নির্ধারিত হল। (আবূ দাউদ)
(২) মাগরিবের নামায জামায়াতের সাথে আদায় করা যদিও ইফতারি পূর্ণরূপে না করা যায়। বাকি ইফতারি নামাযের পর সেরে নেওয়া মন্দ নয়। অতঃপর সন্ধ্যায় পঠিতব্য যিকির-আযকার পাঠ করে নেওয়া।
(৩) স্বভাবানুযায়ী রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে একটু বিশ্রাম করে তারাবীর নামাযের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
ইশার সময় :
১) জামায়াতের সহিত ইশার নামায আদায় করা।
২) ইমামের সাথে সম্পূর্ণ তারাবীর নামায আদায় করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি ঈমান ও নেকীর আশায় রমযানে কিয়াম করবে, (তারাবীহ পড়বে ) তার বিগত সমস্ত (ছোট গুনাহ) ক্ষমা করা হবে”। (বুখারী ও মুসলিম)
৩) সম্ভব হলে বিতরের নামায শেষ রাতে পড়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ‘‘তোমরা বিতরকে রাতের শেষ নামায কর”। (মুত্তাফিকুন আলাইহ) আল্লাহ পাক আমাদেরকে মাহে রমজান মাসের সকল কর্মসূচী সফল করার তাওফিক দান করুন-আমিনপ্রতিমুহূর্ত |
বিষয়: বিবিধ
৩৩৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন